পোস্টস

গল্প

এক দিন শীতের সকালে

৭ মে ২০২৪

হাসান মন্ডল

এক নতুন ভোর। গ্রাম্য পরিবেশ। হীমময় কুয়াশাচ্ছন্ন প্রভাত। চারিদিকে সুমসাম পরিবেশ। 

 সকাল বেলা এক জায়গায়তে যেতেই হবে।  না গিয়ে উপায় নেই। তবে ঘুম থেকে উঠার কোনো ইচ্ছে নেই। যতক্ষণ না আম্মু ডেকে তুলবে,  ততক্ষন আমি উঠবো না। এই ঠান্ডায় উঠে মারা যাওয়ার বুদ্ধি? 

আমি শুধু ভাবতেছি, আম্মু যেন না ডাকে। তাহলেই আমি আর উঠবো না। অবশেষে আম্মুর ডাক, " এ উঠেক ঘুম থেকে, আরো কতই ঘুমাবি?"  আমি চুপ করে আছি। যেন আম্মু মনে করে আমি ঘুম থেকেই উঠিনি। এদিকে আম্মু থামে না,  ডাকতেই আছে, "মরা ঘুম, ঘুমাস নাকি?" এরপর আর থাকতে পারলাম না। আমিও বলে উঠলাম,  "কি হয়েছে? " এমন একটা ভাব ধরছিলাম, যেন আমার কিছুই মনে নাই" তারপর উঠলাম বসলাম। 

এবার আম্মু আরো একটি সকিং বার্তা দিলো, যা শুনে আমি তো মরে যাওয়ার উপযোগী।  আমাকে বলতেছে গোসল করতে। মানে আমার মাথার উপর বাজ পরার মতো অবস্থা। ঘুম থেকেই উঠতে চায় না।  তার উপর আবার নাকি গোসল। 

আম্মুকে বললাম,  আমার জন্য গরম পানি করে দাও। আম্মু চুলায় গরম পানি করা শুরু করে দিলো। আমি রুমের মধ্যেই শারিরিক কসরত করা শুরু করলাম। একটু যদি গা গরম হয়। যত কম সময়ে বেশী গা গরম করা যায়। ২০ বার বুক ডন দিলাম। তারপর আর শরীর চলে না। এমনিতেই রোগা পাতলা শরীর। তারপর আরো কিছু শরীর চর্চা করলাম। একটু গা গরম হয়েছে। কিন্তু মন বসছে না, গোসল করতে।

আম্মু ডাক দিলো, বলল গরম পানি রেডি। এবার আমার যাবার পালা গোসল করতে। এক পা দু পা করে এগিয়ে যাচ্ছি,  আর মনে হচ্ছে ফাঁশির মঞ্চের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। আজ আমার ফাঁশি। অবশেষে পৌছে গেলাম ফাঁশির মঞ্চে। এবার আমার ফাঁশি। 

আমি বাথরুমে ঢুকে ভাবতেছি, এবার কি যে হবে। হায়রে কেমনে বাঁচবো এই ঠান্ডায়। তারপর মকে করে এক মক পানি দিলাম গায়ে,হায় হায়।  এত্তো ঠান্ডা। তারপর খুব ধ্রুত ৪-৫ মক দিলাম গায়ে। এখন আগের থেকে অনেকটা ঠান্ডা কমেছে। তারাতারি ২ মিনিটে গোসল সেরে নিলাম। 


তারাতারি সাজুগুজু করে, এবার আমার নিজস্ব হস্তে তৈরি বাগিচা থেকে সব থেকে বড় লাল টকটকে গোলাপটা ছিরে নিলাম। ভালোবাসার মানুষদেরকে শ্রদ্ধা জানাবো, ভালো ফুলটা ছিড়বো না। এইটা কখনো কি সম্ভব?


খাওয়া দাওয়া সেরে এবার মূল গন্তব্যে যাবার পালা। কোনো গাড়িতে করে নয়। সাইকেলে যাত্রা। এখান থেকে স্কুলে যেতে হবে সাইকেল নিয়ে এবং স্কুলে সাইকেল রেখে, খালি পায়ে শহিদ মিনারে ফুল দিতে যেতে হবে। আমার বাড়ি থেকে স্কুল  সাড়ে তিন কিলোমিটার দূরে। ভালো করে মোটা জামাকাপড় পড়ে নিয়েছি, যেন ঠাণ্ডা না লাগে।

আবার সাইকেল নিয়ে মূক সড়ক দিয়ে যাবার পালা। আমি ধীর গতিতে সাইকেল চালাচ্ছি। স্পিডে চালানোর জো নেই। যে ঠান্ডা বাহিরে। সবাই নাক,  কান, গলা ভালোভাবে ঢেকেছে। কেউ কেউ মানকি টুপি পরেছে। একথায় বলা চলে,  নানা জনের নানান সাজ। শুধুমাত্র শীতের কবল থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য। ধির গতিতে সাইকেল নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। গাছের পাতা ঝরা শুরু হয়েছে। অনেক গাছে পাতা নাই। রাস্তাগুলো পাতায় ভরে আছে। পাতাগুলো দেখে মনে হচ্ছে,  রাস্তা যেন আমায় ফুল দিয়ে বরণ করে নিচ্ছে।

কেউ থেমে নেই। আর আমি একাই শুধু যাচ্ছি না। যাচ্ছে নানার রঙের নানান ঢঙের মানুষ। একেক জনের একেক কাজ। যতই শীত হোক, কেউ তার কাজ বন্ধ রাখে নি। রাখবেই বা কিভাবে? কাজ না করলে টাকা আসবে কিভাবে? পরিবার খাবে কি? মাছ ব্যবসায়ীরা মাছ নিয়ে চলছে তার গন্তব্যে। কৃষক চলছে তার জমিতে। কেউ চলছে বাজার করছে। সকাল বেলা সতেজ বাজার পাওয়া যায়। 

কিছুক্ষন পর পর একদল মহিলা,  আবার একদল পুরুষদেরকে দেখতে পাওয়া যায়, তারা চাদর মুরি দিয়ে হাটছে।নিজেকে রোগ থেকে বাঁচাতেই এই প্রাতভ্রমণে। তারাও দেখতে পাচ্ছে শীতের এই মনরম আপ্লিত দৃশ্য। দেখতে পাচ্ছে স্রষ্টার এই অপরূপ সৃষ্টি। একদম যেন মনের মতো করে গড়া।

আমি এগিয়ে যাচ্ছি আপন গতিতে। আর ভাবছি, ঘরে আবদ্ধ হয়ে থেকে কি সুন্দরর্যটাই না আমি দেখি নি। আজ দেখলাম।  স্রষ্টা তার আপন হাতে গড়েছেন এই ভূখন্ড। আরো ভাবছি তাদের কথা, যারা তখনো লেপ, কম্বল চোখে মূখে দিয়ে শুয়ে আছে। তারা দেখতে পারে না এই দৃশ্য। আমি যেন এক আলাদা দুনিয়ায় হাড়িয়ে গিয়েছিলাম।

অবশেষে সেই দুনিয়া অতিক্রম করে পৌছে গেলাম আমার সেই গন্তব্যে। দেখি আমার আগেই অনেকে এসেছে।  অনেকেই সব কিছু রেডি করে নিয়েছে। অনেকেই তৈরি করেছে ফেস্টুন, ব্যানার। অনেকেই ধরেছে নানান ভঙ। এ যেন "যেমন খুশি তেমন সাজো" এর প্রতিযোগিতা চলছে। কেউ কৃষক৷ কেউ বাউল, কেউ জেলে, কেউ কবি।  কত জনার কত সাজ। কাউকে যেন আর শীত লাগছে না। 

এরপর ব্যানার, ফেস্টুন,  আর নানান সাজ নিয়ে দলবেধে খালি পায়ে চললাম শহীদ মিনারের দিকে। যেতে যেতে দেখলাম শুধু আমাদের স্কুল না, আমাদের মতোই  আপন গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে অন্যান্য স্কুল। তাদেরও রয়েছে নানা সাজ। নানান ফেস্টুন। মনে হচ্ছে সবাই চলছে,  তাদের মায়ের ভাষাকে রক্ষা করার যুদ্ধে। 

এরপর পরম শুদ্ধার সাথে আমার ভালো লাগার ফুলটি ভালোবাসার অমর ব্যাক্তিদের দিয়ে দিলাম।  হয়তো তারা ফুলটি নিতে পারবে না কিন্তু আমার মনে জমে থাকা তাদের জন্য গভীর শ্রদ্ধা হয়তো অনুভব করতে পারবে।মনের মধ্যে একটা পরম শ্রদ্ধা জাগ্রত হলো। দু চোখ বন্ধ করলাম।  একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে।  কি যেন ভাবলাম। একটা শান্তি অনুভব করাম।