Posts

গল্প

৪ মার্চ ১৯৮৪

March 26, 2025

Milu Aman

41
View

বড় আপার জন্মদিন আজ। সকাল থেকে চলছে সব প্রস্তুতি। আমরা সাত ভাইবোন মিলে কাগজ কাটছি, হ্যাপি বার্থডে লিখছি, বেলুন ফুলাচ্ছি। বিকেলে অতিথিরা আসতে শুরু করলো। সারা বাড়ি উৎসবমুখর। মেঝভাই তার ইয়াসিকা ক্যামেরাটা নিয়ে ছবি তুলছে। বড় ভাইয়ের হাতে পোলারয়েড ক্যামেরা। বিপুল আয়োজনে কেক কাটা হল। সবাই চলে যাওয়ার পর আমরা বসলাম সব গিফটের প্যাকেট নিয়ে। মা বললেন, “যাই গোছগাছ করে নেই।” 
মা উঠে চলে গেলেন। বাবা অবাক হয়ে বলেন, “লিলি, কোথাও যাচ্ছ?”
মা বিরক্ত হয়ে বলেন, “কেন তোমাকে বলেছিলাম না? আজ আমার কক্সবাজার যাওয়ার কথা। মুন্নির জন্মদিনে মা আসেন নাই, তার দিদিমণি আসে নাই, এটা হতে পারে? আমার বোনরাও আজ কেউ আসে নাই। তুমি কি কিছুই বোঝ না? তাদের সাথে আজ রাতে আমার যাওয়ার কথা, তাই কেউ আসতে পারে নাই। কিছুই মনে রাখো না তুমি…”
আমানুল্লা বেমালুম সব ভুলে গিয়েছিলেন। তিনি বলেন, “ও তাইতো। কিন্তু এত রাতে তুমি যাবে?”
“রাতের ট্রেন, রাতেই তো যেতে হবে। একটুপর গাড়ি আসবে আমাকে নিতে।”
“একাই যাবে?”
“একা কেন? আমরা তিন বোন মাকে নিয়ে যাচ্ছি, বলেছিলাম তোমাকে। আর সাথে কাইজার আর দিপুও যাবে। কাইজার গাড়ি নিয়ে আসছে।”
“না, এভাবে একা যেও না।”
মা রাগ হয়ে গেলেন, “আচ্ছা যাও, যাবো না।” 
বড় ছেলেকে ডেকে বললেন, “টুপুল, কাইজারকে ফোন করে বলে দাও, গাড়ি পাঠানোর দরকার নাই, আমি যাবো না।”
এই বলে মা তার দরজা ঠাশ করে আটকে দিলেন। মুহূর্তেই আমাদের আনন্দময় দিনটিতে নেমে আসলো কালো ছায়া। মা-বাবা ঝগড়া লেগে গেল, “আমাকে যেতে দিবা না, সেটা আগে বললেও পারতে। তাহলে আমি প্ল্যান করতাম না। এইসব আমি প্ল্যান করেছি, সেটা তুমি জান। মা একাএকা থাকেন, মাকে নিয়ে আমরা বোনেরা ঘুরতে যাব…”
আমরা যে যার ঘরে চলে গেলাম। একটু পর বাবা ঘর থেকে বেড়িয়ে হুংকার দিলেন, “এই তোমরা সবাই কোথায়?”
আমরা ভয়েভয়ে বের হয়ে আসি। এবার মনে হয় আমাদেরও বকা খেতে হবে। কিন্তু বাবা সবাইকে অবাক করে বললেন, “সবাই দ্রুত তৈরি হয়ে নাও, আমরা সবাই কক্সবাজার যাচ্ছি।”
আমাদের সবারতো আক্কেলগুড়ুম! বলে কি বাবা। এবার মা এসে বলেন, “যাও সবাই অল্প কিছু কাপড় বড় ব্যাগটায় দাও। আর কিছু নিলে, নিজে একটা ব্যাকপ্যাক নিতে পার।” 
আমরা সবাই তখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না কি হচ্ছে। এবার মা তাড়া দিলেন, “সবাই জলদি করো। ১০টার ট্রেন আমাদের। হারি আপ!”
ড্রাইভার লাল মিয়া গাড়ি নিয়ে রেডি। বাবার শখের আকাশী রঙের ভক্সওয়াগন ফাস্টব্যাক। একসময় বাবা গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পড়তেন যখনতখন। সারা দেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন এই গাড়ি নিয়ে। আমাদের নিয়েও লংড্রাইভে বেরিয়ে যেতেন অনেক সময়। 
আমরা সবাই রেডি হয়ে গাড়ির কাছে হাজির। বাবা নিচে নেমে এসে লাল মিয়াকে বললেন, “চাবি দাও। আমি চালাবো।”
আমরা সবাই খুশি হয়ে গেলাম। অনেকদিন পর বাবা আজ গাড়ি চালাবেন। বাবা বলেন, “লাল, তুমি দ্রুত একটা অটো নিয়ে কমলাপুর আসো। আমার থেকে চাবি নিয়ে, গাড়ি বাসায় নিয়ে আসবা।”
“জি স্যার।” 
লাল মিয়া চাবি বাবার হাতে দিয়ে দৌড়ে বাসা থেকে বেড়িয়ে পড়ে। আমরা নয়জন ঠাসাঠাসি করে গাড়িতে চড়ে বসলাম। ড্রাইভিংসিট থেকে বাবা বলেন, “সবাই ঠিক মতো বসেছো?”
মা আবার চটে যায়, “না কিভাবে? ছেলেমেয়েরা তো আর এখন কেউ ছোট নাই। একসাথে সবাইকে নিয়ে কি বসা যায়…”
সত্যি তাই, শেষবার আমরা সবাই একসাথে গাড়িতে উঠেছি তা আমার মনেও নেই। মা বলেই চলছেন, “আশ্চর্য, শেষ মুহূর্তে এসে কি যে করো তুমি…”
বাবা আর কথা না বাড়িয়ে বলে গাড়ি স্টার্ট দেন, “বিসমিল্লাহ…”
কমলাপুর রেলস্টেশনে পৌঁছতে বেশি সময় লাগলো না। সেখানে পৌঁছে দেখি লাল মিয়া আগেই চলে এসেছে। বাবা দ্রুত চাবি লাল মিয়ার হাতে দেন। আমরা স্টেশনে ঢুকে পড়ি, যদিও আমাদের কাছে কোন টিকেট নেই। ট্রেন ছাড়তে আর মাত্র মিনিট পাঁচেক বাকি! বগি খুঁজে পেতেও কষ্ট হল না। আমরা দৌড়ে ট্রেনের কাছে চলে যাই। হুড়মুড় করে বগিতে উঠতে শুরু করি। ট্রেনের ভিতরে থাকা সবাই ভয় পেয়ে যায়। পরিখালা চেঁচিয়ে উঠেন, “এই তোমরা কারা…” 
পরিখালার ছেলে দিপু যেন ভূত দেখেছে, সে বলে উঠে, “আরি! লিলি আন্টি আসছে!!”
কণাখালা অবাক হয়ে বলে উঠে, “তুমি না আসবে না বলেছিলে? মা মনখারাপ করে বসে আছে।”
মা বিরক্তি নিয়ে বলে, “তোর দুলাভাইকে জিজ্ঞেস কর।”
একেএকে আমরা সবাই উঠে পরি। মেয়ের পুরো পরিবারকে একসাথে দেখে দিদিমণির মুখ খুশিতে ঝলমল করছে, “তোমরা সবাই এসেছো, আমি খুব খুশি হলাম।” 
কাইজার ভাই বলে উঠে, “বাহ! আপনেরাতো ফুল ফ্যামেলি চলে আসছেন। আমার কাছে টিকেট কিন্তু আছে ছয়টা।”
বাবা হেসে বলে, “টিটি টিকেট চেক করতে আসলে ফাইনসহ টিকেটের দাম দিয়ে দিবো।”
মা আবার চটে যান, “এভাবে ট্রেনে যাওয়া কি অবৈধ কাজ না? এখন এতজন মানুষ এখানে কিভাবে থাকবে? ঘুমাবে কোথায়? ধ্যাত! সবসময় শেষ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নাও তুমি…” 
ঠিক সেসময় ট্রেন ছেড়ে দেয়, আর সবাই সমস্বরে হেসে উঠে।
বড়রা সবাই নিচে আর আমরা সবাই দুইভাগে উপরের বাঙ্কারে উঠে পড়ি। কাইজার ভাইকে কাছে পেলেই আমরা সবাই ঘিরে ধরি। কাইজার ভাই আমাদের প্রয়াত বড়খালার ছেলে, বড়খালু মিনিস্টার। কাইজার ভাই ভীষণ স্টাইলিস্ট, আমাদের আইডল। আর তার কাছে সবসময় থাকতো মজার সব গল্পের ঝুড়ি। কিন্তু সেই কাইজার ভাই হঠাৎ সিরিয়াস হয়ে বলে, “শোন, ভোরে যখন স্টেশনের কাছে এসে ট্রেন স্লো করবে তখন আমি, দিপু আর টুপুল ট্রেন থেকে নেমে পড়বো।”
বড় আপা বলে, “কি যাতা বকতেছো? আব্বা সবার টাকা ফাইনসহ দিবে, তাহলে লাফ দিয়ে ট্রেন থেকে নামার কি দরকার?”
“খালুর একটু টাকা বাঁচাইলাম…” এই বলে কাইজার ভাই হাসতে থাকে, তারপর দিপু ভাই আর বড়ভাইকে বলে, “কিরে? পারবি না? একটা এডভেঞ্চার করলাম। আমি আগেও করেছি…”
মেঝাআপা অবাক হয়ে বলে, “আগেও ট্রেন থেকে লাফায় পরছ?!”
কাইজার ভাই সে কথার উত্তর না দিয়ে বলে, “ফার্স্ট ক্লাস বগিতে টিটি ট্রেন থামার পর আসে। শেষের দিকে ট্রেন একদম স্লো চলে, কোন রিস্ক নাই।”
মেঝভাই বলে উঠে, “আমি পারবো।”
কাইজার ভাই বলে, “হ্যাঁ, তুইও পারবি। কোথায় লাফ দিচ্ছিস সেটা শুধু দেখে নিবি…”
বড়ভাই কঠোর স্বরে মেঝভাইকে তৎক্ষণাৎ বলে, “না। পারলেও তোমার নামার কোন দরকার নাই বাবু।”
বড়আপা মাথা নেড়েই যাচ্ছে, “না, এটা তোমরা কেউই করতে পারবা না। খুবই রিস্কি।”
দিপু ভাই কাইজার ভাইকে চোখ টিপ দিয়ে বলে, “আচ্ছা, আচ্ছা, আমরা কেউ নামবো না। এখন অন্য আলাপ করি…”
ট্রেন চলছে ঝিকঝিক। আমি ঘুম চোখে তাদের গল্প শোনার চেস্টা করছি। কখন ঘুমিয়ে গেলাম। ট্রেন একটা সাইরেন দিলে ঘুম ভেঙ্গে যায়। আধোঘুমে দেখতে পাই কারা যেন সিঁড়ি বেয়ে চুপিচুপি নেমে যাচ্ছে। একটু পর আমরা স্টেশনে পৌঁছে গেলাম। টিটি দরজায় টোকা দিয়ে বলে, “স্যার, টিকেট চেক। ক্যান আই কাম ইন।”  
বাবা বলেন, “প্লিজ, আসুন অফিসার।”
কামড়ায় ঢুকে অফিসারের চোখ চড়কগাছ, “একি? কামড়ায় আপনাদের ছয় জন থাকার কথা, আপনারা ক’জন?”
এই বলে তিনি গুনতে শুরু করলেন, “দশজন এবং একজনও শিশু নন। ছোটজনও মনে হয় দশ বছরের ঊর্ধ্বে।”
বাবা একটু বিচলিত হয়ে পড়েন। দশজন কিভাবে হয়? এদিকওদিক তাকিয়ে তিনি অন্যমনস্ক হয়ে বলেন, “জি, বরাবর দশ বছর, গতমাসেই তার জন্মদিন ছিল।”
মা যেন দিশেহারা হয়ে গেলেন, উদ্বিগ্ন হয়ে বড় আপার কাছে এগিয়ে গিয়ে চাঁপাস্বরে বলেন, “মুন্নি, ওরা কই?”
বড় আপা দুই হাত তুলে ইশারায় বাবা-মা দুজনকেই আশ্বস্ত করার চেষ্টা করে। অফিসার সেটা খেয়াল করেন না, তিনি বাবাকে বলেই চলছেন, “বাকি সবার টিকেট কাটুন, সাথে ফাইন দিতে হবে। কি যে করেন আপনারা।”
সবাই হাফ ছেড়ে বাঁচে। সেসময় বাবা বলে উঠেন, “অফিসার আপনি আসার ঠিক আগে আমাদের চার ছেলে, ট্রেন থেকে লাফিয়ে নেমে যায়।”
আমরা সবাই অবাক হয়ে যাই। অফিসার বেচারা নিজের কানকে যেন বিশ্বাস করতে পারছে না, “কি বলছেন? আরও চারজন ছিল? আপনারা টোটাল চৌদ্দজন আর আপনাদের কাছে মাত্র ছয়টা টিকেট? ওরা ট্রেন থেকে লাফ দিয়ে নামল কেন? এটাতো অবৈধ, আপনাদের নামে তো কেইস হয়ে যায়।” 
“ফ্যামিলি নিয়ে ঘুরতে আসার অপরাধে মামলা ঠুকে দেন আমার নামে একটা। তাদের ছাড়া আমি কোথাও যাই না, থাকতেও পারি না। এটা যদি আমার দোষ হয়ে থাকে তাহলে আমি দোষী।”
অফিসার আর কথা না বাড়িয়ে গোমড়ামুখে রিসিট লিখতে শুরু করে। টিটি অফিসার চলে যাওয়ার পর মা হাউকাউ শুরু করে দিলেন আবার, “ট্রেন থেকে লাফ দেয়ার অর্থটা কি? ওরা ঠিক আছে? মিটুলকে কেন নিল ওরা সাথে?” 
তারপর বড় আপাকে বলেন, “তুমি কেন মানা করলা না?” 
বড় আপা বলে, “আমি মানা করেছিলাম। ওরা কথা শুনে নাই। কখন নেমে গেছে আমরা কেউ টের পাই না।”
ততক্ষণে তারা চারজন বীরদর্পে ফিরে এসেছে। আশ্চর্যজনকভাবে বাবা তাদের কিছুই বলল না! যেন কিছুই হয় নাই। তাদের দেখে বলল, “এই তোমরা ব্যাগগুলি সব নামাও তাড়াতাড়ি।”
মা তাদের দেখে বলেন, “তোমরা তো নিজেদের সেইফটি নিয়ে চিন্তা করো নাই, আবার মিটুলকে নিয়ে রিস্কে ফেললা? টুপুল এটা তোমার থেকে আশা করি নাই।”
বড় ভাই কাঁচুমাচু হয়ে বলে, “আম্মা, আমি আসলে খেয়ালই করি নাই সে কখন আমার পিছনে আসছে। বাবু সবার শেষে ছিল, লাফ দেয়ার পর বুঝতে পারছি।”
এবার মেঝভাইকে বকেন, “তোমার এত সাহস হয় কিভাবে?”
মেঝভাই কিছু না বলে হাসিমুখে ব্যাগ টেনে নামাতে শুরু করে। বাবা মা’র কাছে এসে আলতো করে হাতটা ধরেন, “লিলি, আমার সাথে আসো।” 
মা হেসে দিয়ে বলেন, “হ্যাঁ চল, এরপর এখানে বেশিক্ষণ থাকলে আমাদের নামে অফিসার কেইস দিতে পারে।”
মা-বাবাকে জড়িয়ে ধরে হাসতে থাকেন। অনেকদিন পর তারা গোটা পরিবাব একসাথে। চোখ ভরে তারা দুজন ছেলেমেয়েদের আনন্দ পরম তৃপ্তিতে উপভোগ করছেন।

Comments

    Please login to post comment. Login