এক দেশে ছিল এক নির্মম নিয়ম।
যারা বয়সের ভারে নুয়ে পড়তেন, কাজ করতে পারতেন না, তাদেরকে গভীর জঙ্গলে ফেলে আসতে হতো। রাজা মনে করতেন, বৃদ্ধদের যত্ন নেওয়ার দায় কমলে সমাজের উন্নতি হবে। এই কঠোর বিধির মধ্যে বাস করত এক পিতা ও তাঁর পুত্র। তাদের মধ্যে ছিল অপার ভালোবাসা।
সময়ের স্রোতে পিতা বৃদ্ধ হলেন। তাঁর হাতে আর শক্তি রইল না, কর্মক্ষমতা হারিয়ে গেল। নিয়ম অনুযায়ী, পুত্রকে তাঁকে গভীর জঙ্গলে ফেলে আসতে হবে। কিন্তু বাবাকে ছেড়ে থাকার কথা সে ভাবতেই পারছিল না। তবু, নিয়মের ভয় ছিল প্রবল। বাধ্য হয়েই সে বাবাকে কাঁধে তুলে নিল এবং জঙ্গলের দিকে রওনা দিল।
জঙ্গলের গভীরে পৌঁছে তার হৃদয় কেঁদে উঠল। বাবা তাঁকে স্নেহে লালন করেছেন, শৈশবে পথ দেখিয়েছেন—সেই বাবাকে কি এমনভাবে ফেলে আসা যায়? সে পারল না। বাবাকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে এল এবং বাড়ির পেছনে লুকিয়ে রাখল। চুপিচুপি খাবার এনে তাঁকে খাওয়াতে লাগল।
একদিন রাজা প্রজাদের বুদ্ধি যাচাই করতে চাইলেন। তিনি ঘোষণা করলেন,
“যে ছাই দিয়ে বোনা দড়ি এনে দিতে পারবে, সে পুরস্কৃত হবে!”
লোকে হতবাক! ছাই দিয়ে কি দড়ি বোনা সম্ভব? পুত্রও ধাঁধার সমাধান খুঁজে পেল না। সে বাবার কাছে গিয়ে বলল, “বাবা, কীভাবে এটা সম্ভব?”
বাবা মৃদু হাসলেন, বললেন, “একটা দড়ি নিয়ে পাত্রে পেঁচিয়ে রাখো, তারপর সেটি জ্বালিয়ে দাও।”
পুত্র বাবার নির্দেশ অনুসারে কাজ করল। দড়ি পুড়ে গেল, কিন্তু ছাইয়ে তার অবয়ব অক্ষুণ্ণ থাকল। সে সেটি রাজাকে দেখাল এবং পুরস্কার জিতে নিল।
কিছুদিন পর রাজা আরও একটি পরীক্ষা দিলেন। একটি কাঠের ডাল সামনে রেখে বললেন,
“এর শিকড় আর আগার পার্থক্য খুঁজে বের করো!”
কিন্তু ডালের দুই প্রান্ত ছিল অভিন্ন। কেহই উত্তর খুঁজে পেল না। পুত্র বাবার কাছে গিয়ে সমস্যার কথা বলল। বাবা বললেন, “ডালটি পানিতে রাখো। যেটি বেশি ডুবে যাবে, সেটি গোড়া; আর যেটি ভেসে থাকবে, সেটি আগা।”
পুত্র আবারো বাবার জ্ঞানের জোরে পুরস্কৃত হল।
এরপর এল সবচেয়ে কঠিন ধাঁধা। রাজা বললেন,
“একটি ঢোল তৈরি করো, যা কোনো আঘাত ছাড়াই শব্দ করবে!”
প্রজারা হতভম্ব! ঢোল তো আঘাত করলেই বাজে। এই রহস্যের সমাধান কে খুঁজে দেবে?
ছেলে দৌড়ে বাবার কাছে গেল। বাবা বললেন, “ঢোলের ভেতরে একটি মৌমাছির চাক রাখো।”
পুত্র বাবার কথা মতো ঢোল বানিয়ে রাজাকে দিল। রাজা ঢোলটি নাড়াতেই ভেতরের মৌমাছিরা ওড়ে উঠল, আর ঢোল শব্দ করে উঠল!
রাজা বিস্ময়ে হতবাক! তিনি ছেলেকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি কীভাবে এত কঠিন প্রশ্নের উত্তর পেলে?”
পুত্র বলল, “রাজামশাই, আমার নিজের কোনো জ্ঞান নেই। আমার বৃদ্ধ বাবাই সব উত্তর দিয়েছেন।”
ছেলের কথা শুনে রাজার মন নরম হয়ে এল। তিনি উপলব্ধি করলেন, অভিজ্ঞতার চেয়ে মূল্যবান আর কিছু নেই। সঙ্গে সঙ্গে তিনি ঘোষণা করলেন,
“আজ থেকে আর কোনো বৃদ্ধকে জঙ্গলে ফেলে আসতে হবে না!”
সেই দিন থেকে সকল বৃদ্ধ-বৃদ্ধা পরিবারের সঙ্গেই স্নেহ-ভালোবাসায় জীবন কাটাতে লাগলেন।
🔹 মূল্যবান শিক্ষা
এই গল্প আমাদের শেখায়—অভিজ্ঞতা অমূল্য। বৃদ্ধরা আমাদের জীবনের আশীর্বাদ। তাদের যত্ন নেওয়া শুধু দায়িত্ব নয়, বরং তা আমাদের সৌভাগ্য।