হ্যালো জুনিয়রস,
আমি জানি এখনকার দিনে কেউ আর চিঠির অপেক্ষায় থাকে না। কারণ, চিঠি লেখার যুগ সেই কবে শেষ হয়েছে। অথচ একটা সময় ছিল বটে। ডাক অফিসের পিয়ন ছিল অন্যতম প্রিয়জন। বাড়ির দরজায় পিয়নের দেখা মানে প্রিয়জনের চিঠির সুবাস।
চিঠির ঐ রকম রমরমা যুগে আমি একটা অন্যায় করে ফেলেছিলাম। তখন মাত্রই স্কুলে যাওয়া শুরু করেছি। হুগলী পাড়া থেকে জাম পেড়ে উপজেলা কম্পাউন্ড হয়ে ফেরার সময় একটা পোস্ট বক্সের দিকে নজর যায়। একপাশে পুরা ভাঙ্গা, বক্সে ফেলা সমস্ত চিঠি দেখা যাচ্ছিল। ঐ বয়সে অন্যদের মত আমারও অনন্ত কৌতূহল ছিল। সেই কৌতূহল সামাল দিতে না পেরে সেখান থেকে একটা চিঠি নিয়ে নেই। এই চিঠি নেয়াকে চুরি বা ডাকাতি বলা ঠিক হবে না। চুরির ইচ্ছে থাকলে সব চিঠিই সাবাড় করে দিতে পারতাম। চিঠি পড়ে দেখার নেশায় সেটা খুলি, পড়ি। আজ যদিও কিছুই মনে নেই, তবু সেই চিঠির প্রাপক কোনদিন সেই চিঠি পায়নি। এই বেদনাও কম নয়। অজানা সেই প্রেরক ও প্রাপকের কাছে ক্ষমা চাওয়া ছাড়া আজ আর কোন পথ খোলা নেই।
এরপর পৃথিবী তার কক্ষপথে শত সহস্র বার ঘুরে এসেছে। ফেসবুক, এক্স, ইন্সটাগ্রাম, হোয়াটসএপ এখন সেই চিঠির জায়গা দখল করে নিয়েছে। কবি মহাদেব সাহা সেই কবে টের পেয়েছিলেন। তাই আগাম লিখেছেন,
'করুণা করে হলেও চিঠি দিও, খামে ভরে তুলে দিও
আঙ্গুলের মিহিন সেলাই
ভুল বানানেও লিখো প্রিয়, বেশি হলে কেটে ফেলো তাও, এটুকু সামান্য দাবি, চিঠি দিও, তোমার শাড়ির মত
অক্ষরে পাড়-বোনা একখানা চিঠি।'
'কেউ কথা রাখেনি' কে মিথ্যা প্রমাণ করে ইদানিং চিঠি লেখা শুরু হয়েছে। মহাদেব সাহার আকাংখা মোতাবেক চিঠি লেখার আইস-ব্রেকিং হয়েছে এক আপুর হাত ধরেই-যিনি নিজে দীর্ঘ দিন বিদেশ বিভূঁইয়ে থেকেছেন-বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন এবং সেই দেশে এখনও নিয়মিত চিঠি লেখার চল আছে। এরপর এক ভাইয়া উত্তর দিয়েছেন- সেই সুত্রে দেশে জমিদারি প্রথার আলাপ চলে এসেছে। যদিও সেই ১৯৫০ সালে প্রজাস্বত্ব আইন প্রণয়নের মাধ্যমে জমিদারি প্রথার বিলোপ করা হয়েছে। এরপর উত্তরে প্রতিউত্তরে অনেকেই চিঠি লেখা শুরু করেছেন। কেউ পরামর্শ দিচ্ছেন, কেউবা নতুন বিষয়ের অবতারণা করছেন।
চিঠি লেখার তালিকায় আমিও শামিল হলাম। তবে উনাদের মত বড় বড় বিষয়ে কথা বলার যোগ্যতা আমার নেই। আমি ক্ষুদ্র মানুষ, তার চেয়েও বেশি ক্ষুদ্র বিষয় নিয়ে আমার আলাপ। আমি সেই জুনিয়রদের উদ্দেশ্যে লিখছি, যারা বড় বড় শহরে থাকে, যারা দেশের বাইরে থাকে।
তোমরা যারা ঢাকা চট্টগ্রাম সিলেট খুলনা রাজশাহী কুমিল্লায় থাকো, বছরেও একবার গ্রামে যেতে পারো না, তাদের জন্য আমার মায়া হয়। যে শহরে সারা বছর থাকো, সেই শহরটা দেশের তুলনায় অনেক অনেক ছোট। তোমাদের সেই শহর কয়েকটা বাদ দিলে এই দেশটা এখনও গ্রাম। তোমাদের শহর থেকে বড় বড় রাস্তা এসে ধীরে ধীরে সরু হয়ে গ্রামে ঢুকেছে।
এই দেশের গ্রামগুলো তোমাদের শহরের মত উজ্জ্বল নয়। কিন্তু গ্রামে আছে অবারিত সবুজ মাঠ, মাঠে মাঠে ধানের চারা, সবজির ক্ষেত। গ্রামগুলো থাকে গাছ আর বাঁশ ঝাড়ের আড়ালে। তোমাদের মত ছোট ছোট ছেলেরা সেখানে বাপের জন্য ভাত নিয়ে ক্ষেতে যায়। গরুর জন্য ঘাস কেটে নিয়ে আসে, বিকেল হলে মাঠ থেকে ছাগল ঘরে নিয়ে আসে।
ওদের গ্রামে গেলে তোমাদের ভিন দেশী মনে করে কত আদর আপ্যায়ন করবে। আম গাছের উপর শালিক পাখির বাসাটা দেখিয়ে দিবে। ডাব গাছ থেকে ডাব পেড়ে সতেজ পানি খেতে দিবে।
একটা কথা কি জানো? ওরা খুব অল্পতে খুশি হয়ে যায়। লুকিয়ে রাখা মার্বেল দেখানোর সময় যদি বলো তুমিও খেলবে, তাহলে দেখবে, খুশিতে আত্মহারা হয়ে গায়ের উপর এসে পড়বে।
ওদেরকে গ্রাম্য খ্যাত মনে হবে। তবে শুনে রেখো, ওরা গ্রাম্য খ্যাত থাকলে পুরা দেশটাই গ্রাম্য খ্যাত হয়ে যায়। কারণ ওরা সংখ্যা গরিষ্ঠ।
এই দেশটাকে এগিয়ে নিতে হলে গ্রামগুলোকে আলোকিত করতে হবে। গ্রামের অর্থনীতি চাঙ্গা করতে হবে। শিক্ষায় স্বাস্থ্যে যোগাযোগে পর্যাপ্ত সুযোগ দিত দিতে হবে। তাহলে আমরা সবাই ভালো থাকবো।
আর এসব তখনই মাথায় আসবে, যদি মাঝে মাঝে গ্রাম দেখতে আসো। হয় তোমার বাবা, বা দাদা বা তার বাবা, এই গ্রামের মানুষ ছিল। গ্রামে আসলে তোমার পুর্ব পুরুষের সাথেও দেখা হবে। আজ এই পর্যন্তই। বিদায়।