Posts

গল্প

পরিবর্তনের পথ

April 7, 2025

Alam Rashid

78
View


 









 


 

রাতের শহর যেন এক ঘুমন্ত দৈত্য—আকাশে মৃদু কুয়াশা, বাতাসে শীতের হালকা ছোঁয়া। স্ট্রিট লাইটের নিচে ছায়া লম্বা হয়ে ঝুলে আছে, যেন কারও গোপন অভিমান। দূরে কোথাও এক-আধটা কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দ ছাড়া সবকিছু নীরব। এমন এক নীরবতার মাঝে ধীরে ধীরে হেঁটে চলেছেন আনোয়ার হোসেন, চল্লিশোর্ধ্ব একজন মানুষ। তার মুখে চিন্তার রেখা, চোখে ক্লান্তির ছাপ।  

জিন্সের পকেটে লুকানো একটি পিস্তলের ভার যেন তার শরীর নয়, আত্মাকেই টানছে নিচের দিকে। প্রতিটি পদক্ষেপ যেন একটা দ্বন্দ্ব—ভুলের পথে এগিয়ে যাওয়া নাকি শেষবারের মতো ফিরে আসা।


 


 

একসময় আনোয়ার ছিলেন মেধাবী ছাত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নম্বরধারীদের একজন ছিলেন তিনি। তার স্বপ্ন ছিল শিক্ষক হবেন, সমাজকে কিছু দেবেন। কিন্তু স্বপ্ন আর বাস্তবতার মাঝে যখন রুটি-রুজির যুদ্ধ শুরু হয়, তখন অনেক সময় আত্মার ইচ্ছেগুলোকে পিষে ফেলতে হয়।


 

পড়াশোনার পর অনেক চেষ্টা করেও চাকরি মেলেনি। সময়ের পর সময় কেটে যেতে থাকে, হাতে আসে না কাঙ্ক্ষিত কোনো কাজ। সংসারে তখন অভাব যেন নিত্যসঙ্গী। স্ত্রী সাবিনা, যার চোখে একসময় স্বপ্নের রাজপুত্র হয়ে উঠেছিলেন আনোয়ার, সেই চোখে এখন শুধুই দুশ্চিন্তার ছায়া।


 

বাচ্চা ছেলেটা, মুনতাসির, প্রতিদিন বাবার কাছে কিছু চাইলে, আনোয়ারের হৃদয়ে হাহাকার জন্ম নিত।  

অবশেষে একদিন সব আশা ভেঙে গিয়ে তিনি রিকশা চালানো শুরু করেন।


 

প্রথম কয়েক মাস শুধু আত্মসম্মানের সাথে যুদ্ধ করেছেন। "তুমি এত মেধাবী ছিলে, আজ এই কাজ করছো!"—এই কথাগুলো না বললেও, আশেপাশের দৃষ্টিগুলো যেন প্রতিদিন বলে দিতো। তবু তিনি থেমে যাননি। পরিবারই তখন একমাত্র কারণ ছিল তার বেঁচে থাকার।


 


 

একদিন রাস্তায় এক পুরনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়। নাম তার কামাল।  

“এই যে ভাই, কি খবর তোর?”  

“চলছে... তুই?”  

“তোর মতো একজন লোক রিকশা চালাচ্ছে, এটা বিশ্বাস করাই কষ্টকর। চল, মতিন ভাইয়ের সাথে দেখা কর। কাজ পেয়ে যাবি।”


 

মতিন ভাই, নামটা শুনেই প্রথমে কিছুটা দ্বিধা হয়েছিল। জানতেন লোকটা ছোটখাটো অপরাধ জগতের সঙ্গে জড়িত। তবে ‘খাবারের চেয়ে নীতি বড় নয়’—এই সত্যটা তখন বেশ বোঝা যাচ্ছিল।  

এক রাতের ভেতরই যেন জীবনের মোড় ঘুরে যায়। শুরু হয় গ্যাং-এর কাজ—প্রথমে শুধু পণ্য পৌঁছানো, তারপর ধীরে ধীরে বড়ো দায়িত্ব।


 


 


 

শহরের এক কোণে ছোট্ট একটি স্কুল—একটুকরো আলোর ঝলক, যেখানে গরিব বস্তির শিশুরা বিনামূল্যে পড়াশোনা করে।  

এই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা জাহানারা বেগম। বয়স পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই, কিন্তু মনের শক্তি যেন পাহাড় সমান।  

তাঁর বিশ্বাস ছিল, "একটা শিশুর হাতে যদি বই তুলে দিতে পারি, সে একদিন সমাজ বদলাবে।"


 

বস্তির জীবন কঠিন। সেখানে মাদক, চুরি, সহিংসতা নিত্যনৈমিত্তিক। তবু জাহানারা ম্যাডাম হাল ছাড়েননি। কিন্তু কিছুদিন ধরে লক্ষ্য করছিলেন, কিছু শিক্ষার্থী স্কুলে আসছে না, কেউ কেউ এলেও চোখে-মুখে অদ্ভুত শূন্যতা।


 

একদিন এক ছাত্রের খাতা থেকে পাউডারের মতো কিছু একটা পড়ে গেল। তিনি চমকে উঠলেন।  

“এগুলো কি?”  

ছেলেটা মাথা নিচু করে বলল, “ওরা বলে, খেলে মাথা হালকা হয়ে যায়...”


 

এটা ছিল তার কাছে যুদ্ধ ঘোষণার মতো। সমাজের অন্ধকার তার আলোর প্রদীপে থাবা বসাতে চায়। তিনি ঠিক করলেন, কিছু একটা করতেই হবে। কিন্তু প্রশ্ন একটাই—সাহায্য করবে কে?


 


 

তাঁর মনে পড়লো, আনোয়ার নামের সেই ছাত্রকে। যিনি একসময় এই স্কুলেই পড়েছিলেন।  

তাকে ডেকে পাঠালেন।  

এক সন্ধ্যায় আনোয়ার এলেন, মাথা নিচু, চোখে দ্বিধা।


 

“তুমি কি জানো, তোমার আশেপাশে কী হচ্ছে?”  

“ম্যাডাম, আমি…”  

“তুমি মতিন ভাইয়ের সাথে কাজ করছো, আমি জানি। কিন্তু জানো কি, এই কাজটা কাদের ক্ষতি করছে? যাদের জন্য আমি লড়ছি, তাদেরকেই তুমি বিষ খাইয়ে দিচ্ছো।”


 

এই শব্দগুলো আনোয়ারের অন্তরে বিদ্যুৎ খেলে দিল।  

তিনি কোনো উত্তর দিলেন না। শুধু বললেন, “আপনি ঠিকই বলছেন, কিন্তু আমি এখন কি করবো?”


 


 

সেই রাত আনোয়ার ঘুমাতে পারেননি। নিজের ছেলের মুখ মনে পড়ে যাচ্ছিল বারবার। যদি কখনো তাকেও কেউ মাদক দেয়? যদি মুনতাসিরও এমন হয়ে যায়?


 

পরদিন গ্যাং-এর মিটিংয়ে মতিন ভাই জানালেন,  

“এই কাজটা বড়। ব্যাংক লুট। পুলিশ যাতে কিচ্ছু না টের পায়, সব প্ল্যান করা আছে।”


 

আনোয়ার জানলেন, এখনই সময়।


 


 

পুলিশ স্টেশনে গিয়ে সাহস করে একজন অফিসারের সাথে কথা বলেন। সব বলেন, একটুও না লুকিয়ে।  

“আমার পরিবার আছে। আমি অপরাধ করেছি, স্বীকার করি। কিন্তু এইবার আমি সমাজের জন্য কিছু করতে চাই।”


 

অফিসার আশ্চর্য হয়ে যান। এত স্পষ্টভাবে কেউ আগে কখনো আসে নি।  

তারা কথা দেন, তাকে সুরক্ষা দেবেন। শুধু চায় সঠিক সময়ের তথ্য।


 


 


 

লুটের দিন সকাল। আনোয়ার গ্যাং-এর সঙ্গে ব্যাংকে ঢোকে। বাইরে পুলিশ প্রস্তুত।  

ভেতরে ঢুকেই নির্ধারিত সংকেত দেন তিনি।  

এক মুহূর্তের মধ্যেই পুলিশ প্রবেশ করে, পুরো গ্যাং আটক হয়।


 

আনোয়ার নিজের অস্ত্র রেখে আত্মসমর্পণ করেন।


 

“আমি দোষী। কিন্তু আমি বদলাতে চাই।”


 


 

আদালতে স্বীকারোক্তির পর, তাঁর শাস্তি কম হয়। জেলে থাকা সময় আনোয়ার পড়াশোনায় মন দেন, ধর্মগ্রন্থ পড়ে আত্মচিন্তা করেন।  

একদিন কয়েকজন বন্দিকে বলেন,  

“তোমরা কি জানো, বাইরের পৃথিবী তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছে?”  

তারা অবাক হয়। একজন প্রশ্ন করে, “তুমি তো অপরাধী ছিলে, এখন এসব কী?”


 

“হ্যাঁ, আমি ছিলাম। কিন্তু আমি বদলাতে চেয়েছি। তোমরাও পারো।”


 

১০


 

দু’বছর পর, আনোয়ার মুক্তি পান। প্রথমেই যান জাহানারা ম্যাডামের স্কুলে।


 

“ম্যাডাম, আমি ফিরে এসেছি। এবার সত্যিকার অর্থে বদলাতে চাই।”


 

জাহানারা ম্যাডাম কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,  

“আমি 

জানতাম তুমি পারবে।”



 

স্কুলে এখন তিনি শুধু পড়ান না, শিশুদের মা-বাবার সাথে কথা বলেন। বস্তির তরুণদের নিয়ে করেন সেমিনার, আয়োজন করেন বই পড়ার উৎসব।  

একসময় যারা তাকে ভয় পেত, তারাই এখন শ্রদ্ধা করে।


 

একবার এক কিশোর বলল,  

“ভাই, আমরা আপনাকে দেখে সাহস পাই।”


 

১১




 

শহরে এখন একটা বদল এসেছে। মাদকের প্রভাব কমেছে, তরুণদের মধ্যে নতুন উদ্দীপনা।


 

একদিন, এক ছোট শিশু এসে জিজ্ঞেস করল,  

“স্যার, আপনি কি আসলেই আগে খারাপ ছিলেন?”  

আনোয়ার হাসলেন, “ছিলাম। কিন্তু তুমিই প্রমাণ যে আমি বদলেছি।”  

শিশুটি হেসে জড়িয়ে ধরল তাকে।


 

জাহানারা ম্যাডাম দূর থেকে তাকিয়ে বলেন,  

“তুমি আমার সবচেয়ে বড় গর্ব, আনোয়ার। কারণ তুমি দেখিয়েছ, মানুষ ইচ্ছা করলেই বদলাতে পারে।”


 

১২




 

**পরিবর্তনের পথ কখনো সহজ নয়। তবে সাহস, ইচ্ছা আর সঠিক দিকনির্দেশনা থাকলে, মানুষ শুধু নিজেকে নয়—সমগ্র সমাজকেও বদলে দিতে পারে। একজন অপরাধীও হতে পারে নায়ক—যদি সে সত্যের দিকে ফিরে আসে।**


 


 


 


 

.................................................................সমাপ্ত.........................................................


 

Comments

    Please login to post comment. Login