Posts

প্রবন্ধ

উৎপাদন থেকে পুরাণ: এই জনপদের চিন্তার ধারাবাহিকতা

April 12, 2025

মোঃ আব্দুল আউয়াল

Original Author অধ্যক্ষ এমএ আউয়াল

25
View

যে সমাজে মানুষ তার জীবন ও জীবিকার প্রশ্নে প্রথম কৃষির উপর নির্ভরশীল হলো, সে সমাজেই গড়ে উঠলো প্রাকৃতিক শক্তির প্রতি এক ধরণের নির্ভরতাবোধ। এই নির্ভরতাই কালক্রমে পরিণত হলো পূজাবোধে, দেবতা নির্মাণে এবং একটি সম্পূর্ণ জীবন দর্শনে। আমাদের উপমহাদেশ, বিশেষত সিন্ধু ও গঙ্গার অববাহিকায় যে সভ্যতার সূত্রপাত, তা নিছক কৃষিভিত্তিক উৎপাদন সম্পর্ক নয়, বরং একটি বিশাল দার্শনিক পরিসরের জন্ম দিয়েছিল। এই প্রবন্ধে আমরা খুঁজে দেখব, কীভাবে উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে মানুষের চিন্তার বিকাশ ঘটেছে, কীভাবে সেই চিন্তা মিশেছে পুরাণ, উপকথা, বেদ-উপনিষদের সাথে, এবং কীভাবে এ জনপদের ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি এক অখণ্ড ঐতিহ্যের ধারক হয়েছে।

সিন্ধু সভ্যতা ছিল ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন ও সুসংগঠিত জনপদ। খ্রিস্টপূর্ব ২৬০০ থেকে ১৯০০ অব্দ পর্যন্ত বিস্তৃত এই সভ্যতা শুধু নগর পরিকল্পনা ও স্থাপত্যশৈলীতেই নয়, বরং মানুষের চিন্তা-ভাবনার সূক্ষ্ম বুননে আজও আমাদের অবাক করে। এই সভ্যতার ভিত্তি ছিল কৃষি, বাণিজ্য ও স্থিতিশীল বসবাস। কৃষির সাথে সম্পর্কিত জল, সূর্য, বৃষ্টি ও মাটি—এই চারটি উপাদানই হয়ে ওঠে আদি আরাধনার কেন্দ্রবিন্দু।

মানুষ দেখলো, প্রকৃতি তাকে খাওয়ায়, আশ্রয় দেয়, জীবনের ধারক ও বাহক। এই উপলব্ধি থেকেই জন্ম নেয় ‘জগৎমাতা’ ধারণা—পৃথিবী কেবল বসবাসের স্থান নয়, বরং মা-রূপে পূজিত হবার উপযোগী। এভাবেই প্রকৃতি ও উৎপাদনের সম্পর্ক মিশে যায় আধ্যাত্মিক চেতনায়।

প্রাচীন মানুষের এই চিন্তাগুলি কোনও বিমূর্ত ধারণা নয়। তারা তাদের দৈনন্দিন জীবন, কৃষির চক্র, ঋতুর আবর্তন এবং খাদ্য প্রাপ্তির অভিজ্ঞতা থেকেই দেবতাকে কল্পনা করেছিল। তাই এই সভ্যতায় আমরা পাই ‘ধরিত্রী’, ‘পৃথিবী’, ‘বাসুন্ধরা’—যারা কেবল স্থলভাগের প্রতিনিধিত্ব করে না, বরং এক জীবন্ত সত্তা হিসেবে পূজিত।

কৃষিভিত্তিক সমাজে মানুষের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকেই জন্ম নেয় দেবীভাবনার। যখন বর্ষাকালে মানুষ দেখতে পেলো মাটিতে নিজে থেকেই শাকসবজি গজিয়ে উঠছে, তখন তারা ভাবলো—এ এক অলৌকিক ঘটনা। তারা এই ধারাকেই দেবীত্ব দিয়েছিল, এবং জন্ম নেয় ‘শাকম্ভরী’ দেবীর ধারণা—যিনি শাক দিয়ে মানবজীবন রক্ষা করেন।

এখানেই লক্ষণীয় বিষয় হলো—ধর্ম বা দেবভাবনা এখানে অবাস্তব কোনও কল্পনার ফসল নয়, বরং বাস্তব জীবন থেকে উৎপন্ন এক প্রতীকী রূপ। এই রূপ পরবর্তীকালে পুরাণে বিস্তৃত হয়ে ওঠে, রূপান্তরিত হয় অন্নপূর্ণা, লক্ষ্মী, পার্বতী প্রভৃতি দেবীরূপে। এই দেবীরূপের উৎস নিহিত ছিল উৎপাদনব্যবস্থায়, কৃষিতে, এবং প্রকৃতির নিয়মে।


উৎপাদনের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা এই চিন্তা-ভাবনার ক্রমাগত বিকাশ আমরা দেখতে পাই বৈদিক সাহিত্যে, পুরাণে, এবং সর্বোপরি উপনিষদে। বেদের অনেক অংশে প্রকৃতির উপাসনা, ঋতু, অগ্নি, বরুণ, ইন্দ্র প্রভৃতি দেবতাদের প্রাধান্য দেখা যায়। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই বহুদেবতা থেকে চিন্তা সরতে থাকে এক অভিন্ন বাস্তবতার দিকে। এই পরিবর্তনই ‘বেদান্ত’ বা ‘উপনিষদ’ নামক দর্শনে একীভূত হয়।

উপনিষদের মূল বক্তব্য—‘একং সদ্বিপ্রা বহুধা বদন্তি’—সেই বহুত্ববাদী উপাসনা থেকেও একত্ববাদী সত্যের সন্ধান। এ যেন সেই কৃষকসমাজের একটি অভ্যন্তরীণ বিপ্লব; তারা বুঝেছিল, বহুর মধ্যেও এক আছে। দেবতা বহুরূপে প্রকাশিত হলেও তার কেন্দ্রীয় সত্তা একটিই।

এই পরিণত চিন্তা শুধু ধর্মীয় দর্শন নয়, বরং সমাজ, সংস্কৃতি ও ভাষার নির্মাণেও গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করে।

‘হিন্দু’ শব্দটি সিন্ধু নদী থেকেই উৎসারিত। পারস্যবাসীরা ‘স’ উচ্চারণ করতে না পারায় তারা ‘সিন্ধু’কে বলতো ‘হিন্দু’। এ শব্দে কোনও ধর্মীয় সংকীর্ণতা ছিল না। এটি ছিল ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক এক পরিচিতি। পরবর্তীকালে কিছু জনগোষ্ঠী, বিশেষত বিদেশি বর্ণনাকারীরা, এই শব্দকে এক গোষ্ঠীর পরিচয়চিহ্নে পরিণত করে দেয়।

তাহলে প্রশ্ন ওঠে, “এই শব্দ উচ্চারণে ভিন্নতা কেন অচ্ছুৎ হবে?” আদতে এটি ভাষাগত রূপান্তর এবং রাজনৈতিক চেতনার এক খেলা, যেখানে একটি জনপদের অভিন্ন ঐতিহ্যকে বিভক্ত করার চেষ্টা করা হয়। অথচ পুরাণ, উপকথা, বেদ, উপনিষদ—সবই এই জনপদেরই ধন। এইসব গ্রন্থের মধ্যে যে জীবনবোধ, তা কেবল হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জন্য নয়, বরং বিশ্বচিন্তার ঐতিহ্য হিসেবেই গ্রহণযোগ্য।
 

বাংলা ভাষার ইতিহাস কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; এটি ভারতীয় উপমহাদেশের দীর্ঘ সাংস্কৃতিক বিকাশেরই একটি ধারা। এ ভাষা গঠিত হয়েছে মূলত তিনটি স্তর থেকে—তৎসম, তদ্ভব এবং দেশজ শব্দমালা। প্রায় ৯৬ ভাগ বাংলা শব্দ হয় তৎসম নয় তদ্ভব। এর মানে, এ ভাষার মূল উৎস সংস্কৃত এবং প্রাকৃত ভাষা, যা বৈদিক যুগের ভারতবর্ষের চিন্তা ও সংস্কৃতির ভাষা।

তৎসম শব্দগুলো মূলত সংস্কৃত ভাষা থেকে অবিকৃত রূপে গ্রহণ করা হয়েছে, যেমন—‘আকাশ’, ‘মানব’, ‘চিন্তা’। অন্যদিকে, তদ্ভব শব্দ হলো সেইসব শব্দ যা সংস্কৃত থেকে ধীরে ধীরে রূপান্তরিত হয়ে লোকভাষায় মিশেছে, যেমন—‘মোন’ (মন), ‘জমি’ (ক্ষেত্র), ‘চোখ’ (নয়ন) ইত্যাদি।

এইসব শব্দের ভেতরেই নিহিত আছে হিন্দু ও বৌদ্ধ ঐতিহ্যের অভিঘাত। বাংলা ভাষা কেবল একটি যোগাযোগের মাধ্যম নয়, বরং এক সাংস্কৃতিক মহাসাগরের বিস্তার, যেখানে বেদ, উপনিষদ, জৈন, বৌদ্ধ, শৈব, বৈষ্ণব, মুসলিম ও খ্রিষ্টীয় ভাবনার প্রবাহ মিশে গেছে নিঃশব্দে।

বাংলা সাহিত্যের আদিযুগে বৌদ্ধ ধর্মের অবদান ছিল অসামান্য। চর্যাপদ, বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন, ছিল মূলত বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের রচিত দেহতত্ত্বমূলক পদাবলি। এই সাহিত্য একাধারে আধ্যাত্মিক, দার্শনিক এবং গূঢ়ার্থবাহী। বৌদ্ধধর্মের সহজিয়া ভাবনা, 'বোধি' লাভের পথ, দেহের মধ্যেই ‘অচিন পাখি’র বাস—এসব কল্পনা ছিল গভীরভাবে প্রতীকী।

এরপর হিন্দু ভাবনার সময় এলো বৈষ্ণব সাহিত্যের মাধ্যমে। মৈথিলি ভাষার কবিতা, মঙ্গলকাব্য, পদাবলি সাহিত্যে হিন্দু পুরাণ ও ভক্তি আন্দোলনের ব্যাপক প্রভাব পড়ে। বাংলার কবিরা যেমন চণ্ডীমঙ্গল, মনসামঙ্গল রচনা করেছেন, তেমনি রাধা-কৃষ্ণের লীলা নিয়েও গভীর কবিতা রচনা করেছেন। এর মধ্যে ছিল জীবনের প্রেম, দুঃখ, বিরহ, মুক্তি, সমাজ ও ঈশ্বরকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা চিন্তা।

এই দুই ধারার মিলনেই গড়ে উঠেছে বাংলা সাহিত্য। মুসলিম শাসনামলে বাংলা ভাষার ওপর আরবি-ফারসি শব্দের প্রভাব পড়লেও তার মূল কাঠামো রয়ে গেছে ওই প্রাচীন উৎপত্তির ধারায়। তাই যাঁরা বলেন বাংলা ভাষা কোন একটি নির্দিষ্ট ধর্মের, তাঁরা ভাষার শিকড় বুঝতে অক্ষম।

আজকের দিনে দাঁড়িয়ে যদি আমরা এই ভাষা ও সংস্কৃতিকে শুধুমাত্র ধর্মীয় চশমা দিয়ে দেখি, তাহলে আমরা প্রকৃত ঐতিহ্যের অপমান করি। বাংলা ভাষা, তার সাহিত্য, তার ইতিহাস, সবই আমাদের সম্মিলিত উত্তরাধিকার। ধর্ম, বর্ণ, জাতি নির্বিশেষে এই সংস্কৃতি আমাদের সকলের।

যদি কেউ আজ বলে—‘এই শব্দ হিন্দুদের’, ‘এই কাব্য মুসলিমদের’—তবে তা হবে দৃষ্টিভঙ্গির সংকীর্ণতার প্রমাণ। যে ভাষায় আমরা কথা বলি, ভাবি, সৃষ্টি করি, তা কোনো একক জনগোষ্ঠীর সম্পদ নয়, বরং তা সময়ের, মানুষের, চেতনারই ধারক।


এই জনপদের চিন্তা শুরু হয়েছিল প্রকৃতির উপাসনা দিয়ে, তারপর ধীরে ধীরে তা পৌঁছেছে ঈশ্বরতত্ত্ব, দার্শনিক একত্ববাদের দিকে। সেই চিন্তা মিশেছে ভাষা, সাহিত্য, উপকথা, লোকজ সংস্কৃতিতে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য এই চিন্তার স্নায়ুপ্রবাহ বহন করে চলেছে সহস্র বছর ধরে।

তাই যে কেউ এই ভাষা ও সংস্কৃতিকে সংকীর্ণ দৃষ্টিতে দেখবেন, তিনি শুধু অতীতকে অস্বীকার করছেন না, বরং ভবিষ্যতের পথও সংকীর্ণ করছেন।

ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস—এসব কোনো ধর্মীয় প্রপঞ্চ নয়, বরং একটি জাতির আত্মপরিচয়ের মানচিত্র। সেই মানচিত্রে ‘শাকম্ভরী’ যেমন আছে, তেমনি আছে ‘মহাশ্মশান’; যেমন আছে চর্যাপদ, তেমনি আছে নজরুল; যেমন আছে উপনিষদ, তেমনি আছে বাউল তত্ত্ব।

এই সম্পদ আমাদের, এই ভাষা আমাদের, এই চিন্তা আমাদের সকলের।

Comments

    Please login to post comment. Login