Posts

প্রবন্ধ

হিন্দু’ শব্দের ঐতিহাসিক ও ভাষাতাত্ত্বিক বিকাশ

April 12, 2025

মোঃ আব্দুল আউয়াল

Original Author অধ্যক্ষ এমএ আউয়াল

110
View

ভূমিকা

‘হিন্দু’ শব্দটি আধুনিককালে একটি বিস্তৃত ধর্মীয় পরিচয়ের বাহক হলেও এর উৎপত্তি একান্তভাবে ধর্মাশ্রিত নয়। বরং এ শব্দের মূল নিহিত আছে ভৌগোলিক সীমারেখা, ধ্বনিবিকাশ এবং সাংস্কৃতিক বিন্যাসে। কালক্রমে, এক ভৌগোলিক সংকেত ধর্মীয় স্বরূপে রূপান্তরিত হয়েছে ইতিহাস ও রাজনীতির অভিঘাতে। এই প্রবন্ধে আমরা ‘হিন্দু’ শব্দটির উৎস, ধ্বনিগত বিবর্তন, ঐতিহাসিক ব্যবহার এবং আধুনিক তাৎপর্য বিশ্লেষণ করব ভাষাতাত্ত্বিক ও ইতিহাসমনস্ক দৃষ্টিকোণে।


---

প্রাচীন উৎস ও শব্দমূলঃ

সংস্কৃত ভাষায় ‘সিন্ধু’ শব্দটির অর্থ নদী, বিশেষত সিন্ধু নদ, যা বর্তমান পাকিস্তানের ভূভাগে অবস্থিত। রিগ্বেদের বহু স্তোত্রে (যেমন ১০.৭৫) ‘সিন্ধু’কে এক বিশাল ও জীবন্ত নদী হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে। শব্দটি ধাতু অনুসারে সিন্ + ধু, যার অর্থ প্রবাহিত হওয়া, বিস্তার লাভ করা। এই ‘সিন্ধু’-ই কালান্তরে নানা ভাষায় রূপান্তরিত হয়ে ‘হিন্দু’ শব্দটির জন্ম দিয়েছে।


---

ধ্বনিগত বিবর্তন ও পারসিক প্রভাবঃ

ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রাচীন পারসিক তথা অবেস্তান ভাষায় ‘স’ ধ্বনি প্রায়শই ‘হ’ ধ্বনিতে রূপান্তরিত হতো। উদাহরণস্বরূপ, সংস্কৃত ‘সপ্ত’ শব্দটি পারসিকে ‘হপ্ত’, এবং ‘সিন্ধু’ হয়ে ওঠে ‘হিন্দু’। পারসিকরা সিন্ধু নদ ও তার পূর্ববর্তী অঞ্চলকে ‘হিন্দু’ নামে অভিহিত করত। এখানে শব্দটির ব্যবহার ছিল ভৌগোলিক নির্দেশনায়, ধর্মীয় সংজ্ঞায় নয়। (cf. Burrow, The Sanskrit Language, 2001)


---

ইসলামি পর্বে শব্দের তাৎপর্য পরিবর্তনঃ

ইসলামি শাসনের সূচনাপর্বে আরব ও পারসিক মুসলিম ঐতিহাসিক ও পর্যটকরা ভারতীয় উপমহাদেশকে ‘আল-হিন্দ’ নামে আখ্যায়িত করেন। এই ‘হিন্দু’ শব্দটি তখন অর্থবহ হয়ে ওঠে সেই সমস্ত অধিবাসীর প্রতি, যারা ইসলাম ধর্মাবলম্বী নয়। ইবনে বতুতা তাঁর ভ্রমণকাহিনিতে ‘হিন্দুস্তান’ এবং ‘হিন্দু’ শব্দ ব্যবহার করেছেন সাংস্কৃতিক শ্রেণিবিভাগের অর্থে (Gibb, Travels of Ibn Battuta, 1929)। এটি ছিল একপ্রকার ‘অমুসলিম’ শ্রেণির সাংকেতিক নাম।


---

ঔপনিবেশিক অভিঘাত ও ধর্মীয় পুনর্নির্মাণঃ

ঊনবিংশ শতকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক প্রশাসনের অধীনে ‘হিন্দু’ শব্দটি আইনি ও সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসে ব্যবহৃত হতে শুরু করে। এটি একটি নেতিবাচক শ্রেণিতে রূপান্তরিত হয় — মুসলমান, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, শিখ ব্যতীত বাকি সকলকে ‘হিন্দু’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই পর্যায়ে ‘হিন্দু ধর্ম’ পরিভাষাটির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ ঘটে, যা ব্রিটিশ ভাষাতাত্ত্বিক ও নৃতত্ত্ববিদদের রচনায় প্রতিফলিত হয় (Lorenzen, Who Invented Hinduism?, 2006)।

সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে এক আত্মচেতনা জাগ্রত হয় — হিন্দু ধর্মের একটি সুনির্দিষ্ট পরিচয় গঠনের প্রয়াস। রাজা রামমোহন রায়, স্বামী বিবেকানন্দ প্রমুখ এই ধর্মের যুক্তিবাদী, দার্শনিক ও নৈতিক ভিত্তি নির্মাণে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেন।

উপসংহারঃ

‘হিন্দু’ শব্দটি কেবল ধর্মীয় পরিচয়ের বাহক নয়; এটি এক বহুতল ভাষাতাত্ত্বিক ও ইতিহাসবহ পরিক্রমার ফল। এক নদীর নাম থেকে শুরু করে একটি ভৌগোলিক সংকেত, পরে সাংস্কৃতিক শ্রেণি ও শেষে একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের প্রতীক — এই রূপান্তর বিশ্ব ইতিহাসে শব্দ বিবর্তনের এক গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত। ভাষা ও ইতিহাস এখানে পরস্পরকে নির্মাণ করে, প্রভাবিত করে এবং সাংস্কৃতিক চেতনার রূপ নির্ধারণে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।


---

গ্রন্থপঞ্জি

1. Monier-Williams, M. (1899). A Sanskrit-English Dictionary. Oxford University Press.


2. Burrow, T. (2001). The Sanskrit Language. Motilal Banarsidass.


3. Gibb, H.A.R. (Trans.) (1929). The Travels of Ibn Battuta.


4. Lorenzen, David N. (2006). Who Invented Hinduism? Essays on Religion in History. Yoda Press.


5. Doniger, Wendy. (2009). The Hindus: An Alternative History. Penguin.


6. Thapar, Romila. (2002). The Penguin History of Early India. Penguin Books.


-

Comments

    Please login to post comment. Login