ফেসবুক এর সাবেক গ্লোবাল পাবলিক পলিসি ডিরেক্টর সম্প্রতি তার লেখা এক বইয়ে তুলে ধরেছেন কিভাবে ফেসবুক ব্যবসার স্বার্থে মানুষের নিরাপত্তা ও গোপনীয়তা লঙ্ঘন করে পর এক অপকর্ম করে চলেছে। বইটি প্রকাশের পর মার্কিন সিনেটের একটি কমিটি শুনানির আয়োজন করে। প্রায় দেড় ঘন্টা ব্যাপী এই শুনানিতে তিনি ফেসবুকের বিভিন্ন অপকর্ম তুলে ধরেন আর এই নিয়ে বিশদ জেরা চলে। শুনানিতে তার সূচনা বক্তব্যের বাংলা অনুবাদ দেয়া হলোঃ

"আমার নাম সারা উইন উইলিয়ামস এবং আমি ২০১১ সাল থেকে শুরু করে প্রায় সাত বছর ফেসবুক (বর্তমানে মেটা)-এর গ্লোবাল পাবলিক পলিসি বিভাগের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি।
এই সাত বছরে, আমি দেখেছি, কিভাবে মেটার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা বারবার মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তাকে অবমূল্যায়ন করে চলেছে এবং আমেরিকান মূল্যবোধের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে যাচ্ছে। তারা গোপনে এসব কাজকর্ম চালিয়ে গেছে স্রেফ চীনে ১৮ বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা গড়ে তোলার জন্য। বর্তমানে আমরা চীনের সঙ্গে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) প্রযুক্তি নিয়ে তীব্র প্রতিদ্বন্দীতায় লিপ্ত। কিন্তু আমি যখন মেটাতে কাজ করছিলাম, তখন কোম্পানির কর্মকর্তারা কর্মচারী, শেয়ারহোল্ডার, কংগ্রেস এবং আমেরিকান জনগণের কাছে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে তাদের কাজকর্ম সম্পর্কে মিথ্যা বলেছিল।
মার্ক জাকারবার্গ নিজেকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে একজন চ্যাম্পিয়ন হিসেবে দাবি করেন। অথচ আমি দেখেছি মেটা কিভাবে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে হাত মিলিয়ে তাদের জন্য আলাদা করে সেন্সরশিপ টুল বানিয়ে দিয়েছিল, যা পার্টির সমালোচকদের মুখ বন্ধ করতে এবং সেন্সর করতে ব্যবহার করা হয়েছে। বেইজিং যখন আমেরিকার মাটিতে বসবাসরত ভিন্নমতের একজন চীনা এক্টিভিস্টের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট মুছে দিতে বলেছিল, তারা সেই অনুরোধ রক্ষা করে এবং পরে কংগ্রেসের শুনানিতে এ ঘটনার ব্যাপারে মিথ্যা বলে।
আমি দেখেছি কিভাবে মেটার কর্মকর্তারা চীনা কমিউনিস্ট পার্টিকে মেটার ব্যবহারকারীদের তথ্যে প্রবেশাধিকার দিতে রাজি হয়েছিল, এমনকি আমেরিকান ব্যবহারকারীদের তথ্যও। মেটা কিন্তু এই দাবিগুলো অস্বীকার করছে না। আমার কাছে প্রমাণও আছে। গত সোমবার পর্যন্তও তারা দাবি করেছে যে চীনে তাদের কোন কার্যক্রম নেই। এটা আরও একটি মিথ্যা কথা। তারা ২০১৪ সাল থেকেই চীনে সেবা প্রদান শুরু করেছিল যেটা এখনো বন্ধ হয়নি। তাদের গত বছরের SEC ফাইলিং অনুযায়ী, চীন এখন মেটার দ্বিতীয় বৃহত্তম বাজার।
এদিকে, মেটার AI মডেল Llama চীনের AI প্রযুক্তির উন্নয়নে উল্লেখযোগ্যভাবে অবদান রেখেছে, এমনকি Deepseek-এর ক্ষেত্রেও। ফেসবুকের চীনে প্রবেশের গোপন প্রকল্পের নাম ছিল “Project Uldren”এবং এর কথা খুব সংখ্যক কর্মীই জানতো। মেটা এমন একটি ডেটা পাইপলাইন তৈরি করেছিল যা আমেরিকা এবং চীনকে সংযুক্ত করেছিল।
মেটা ২০১৫ সাল থেকেই চীনা কমিউনিস্ট পার্টিকে বিভিন্ন বিষয়ে অবগত করতে শুরু করে, যার বিষয়বস্তু ছিল বিভিন্ন উদীয়মান এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি—বিশেষ করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্সতা সম্পর্কে। উদ্দেশ্য স্পষ্ট - চীনকে এমনভাবে সহায়তা করা যাতে তারা আমেরিকান কোম্পানিগুলোর থেকে এগিয়ে যেতে পারে। সাম্প্রতিক ঘটনার সাথেও এর যোগসূত্র আছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে চীন সামরিক কাজে ব্যবহারের জন্য AI মডেল তৈরি করছে, যার ভিত্তি মেটার Llama মডেল। মেটার অভ্যন্তরীণ নথিতেও বর্ণনা আছে কিভাবে তারা চীনের বাজারে প্রবেশের জন্য নিজেদের “চীনের বৈশ্বিক প্রভাব বৃদ্ধিতে এবং চায়না ড্রিম বাস্তবায়নে সহায়ক” হিসেবে উপস্থাপন করেছিল। আমি মেটার বোর্ডের কাছে চীনে তাদের কার্যক্রম তদন্তের জন্য একটি শেয়ারহোল্ডার রেজল্যুশন দাখিল করেছি এবং SEC ও DOJ-এর কাছে হুইসেলব্লোয়ার অভিযোগ দায়ের করেছি। মেটা যেভাবে প্রাণপনে চেষ্টা করে যাচ্ছে আমার মুখ বন্ধ করার এবং ভয় দেখানোর জন্য, তা দিয়েই বোঝা যায় এই সত্য এবং তথ্যগুলো কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
আমি ২০১৮ সালে তাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতির ওপর ভরসা করেছিলাম যে তারা জোরপূর্বক সালিশি কার্যক্রমের (forced arbitration) পথে যাবে না। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি উপেক্ষা করে তারা এখন আমার বিরুদ্ধে কয়েকশো মিলিয়ন ডলারের মামলা করেছে। তারা এখন একটি আইনি গ্যাগ অর্ডার জারি করেছে আমাকে চুপ করিয়ে রাখার জন্য, এমনকি কংগ্রেস সদস্যদের সাথেও কথা বলতে দিতে চাইছে না। এই গ্যাগ অর্ডার এতটাই বিশাল যে আমি কোনও ধরনের বিবৃতি দিতে পারি না। আর অপরদিকে মেটা ও তাদের মিত্ররা আমার বিরুদ্ধে ক্রমাগত মিথ্যা ছড়িয়েই চলেছে। এই আদেশ এসেছে এমন একটি কোম্পানির কাছ থেকে যার সিইও নিজেকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার রক্ষক বলে দাবি করেন।
আমেরিকান জনগণের সত্য জানার অধিকার আছে। মেটা তাদের মূল্যবোধ বিসর্জন দিয়েছে, ব্যবহারকারীদের নিরাপত্তা বিপন্ন করেছে, এবং আমেরিকান স্বার্থকে বিপন্ন করে তুলেছে, স্রেফ চীনে ব্যবসা গড়ে তোলার জন্য।"
অনুবাদকের মন্তব্যঃ মেটা যদি সত্যিই কংগ্রেসের সামনে মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়ে থাকে তাহলে সেটি গুরুতর অপরাধ এবং আইনগত থেকে এর শাস্তি বিশাল। সেই সাথে যুক্ত হয়েছে চীনকে গোপনে সহায়তার অভিযোগ যেখানে ট্রাম্প এডমিনিস্ট্রেশনের সাথে চীনের সম্পর্ক বেশ শীতল । প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও ফেসবুকের উপর বেশ ক্ষিপ্ত ছিলেন কারণ তার বিরুদ্ধে চালানো নিরন্তর কুৎসার অন্যতম মাধ্যম ছিল ফেসবুক, এবং এ নিয়ে মেটা কোন ব্যবস্থাই নেয় নি। উল্টো ফ্যাক্টচেকার নিয়োগ দেয়া হয়েছিল যাদের ব্যাপারে মার্ক জাকারবার্গ নিজেই স্বীকার করেছেন যে তারা ছিলেন পলিটিক্যালি বায়াসড। নির্বাচনের ফলাফলের পর খুব দ্রুতই উনি পল্টি নিয়ে ফেলেছেন, ফ্যাক্ট চেকিং সিস্টেমটাই বাদ দিয়ে এক্স এর মত কমিউনিটি নোটস চালু করেছেন।