নিয়ত
নিয়ত শব্দটি আমরা সকলেই শুনে থাকি, বিশেষ করে নামাজের সময়। কিন্তু নিয়ত কি শুধু নামাজের সাথেই সম্পর্কিত? না। নিয়ত আমাদের দৈনন্দিন প্রতিটি কাজের সাথে সম্পর্কিত, সেটা ভালো কাজ হোক বা খারাপ কাজ হোক।
নিয়ত মানে উদ্দেশ্য, আপনি কোনো কাজ যে উদ্দেশ্যে সম্পাদন করেন সেটাই নিয়ত। যেমন ধরুন আপনি কলেজে যাওয়ার জন্য বাসে উঠলেন। এখানে বাসে উঠার উদ্দেশ্য হলো কলেজে যাওয়া। কিন্তু আপনার পাশে বসা ব্যক্তির একই উদ্দেশ্য নাও থাকতে পারে। তার উদ্দেশ্য হয়তো অফিসে কোনো মিটিংয়ে জয়েন করা। কোনো যাত্রী হয়তো ছদ্মবেশী পকেটমার, যার উদ্দেশ্য কারো সর্বস্ব চুরি করা। সবাই বাসের যাত্রী কিন্তু সকলের উদ্দেশ্যই আলাদা, তাই না? ঠিক একই রকমভাবে আমরা সকলে এক অবস্থানে, এক কাজে রত থাকলেও আমাদের উদ্দেশ্য আলাদা।
নামাজের নিয়ত নিয়ে নিয়তের আলাপটা শুরু হয়েছিল, অনেকেই ভাবেন নামাজে নিয়ত না পড়লে নামাজ হবে না, আসলে কিন্তু তা নয়। নিয়ত মানে উদ্দেশ্য। আপনার উদ্দেশ্য যদি নামাজ পড়াই হয় তবে মৌখিক নিয়তের প্রয়োজন নেই। কিন্তু ধরুন আপনি নামাজে দাঁড়ালেন কাউকে দেখানোর জন্য (রিয়া), সাথে আবার নিয়ত পাঠ করলেন। আপনার অন্তরের নিয়তের সঙ্গে মৌখিক নিয়তের কোনো সাদৃশ্য আছে? যাক নিয়ত পড়া না পড়া নিয়ে কিছু বলতে চাই না কারণ এতে অনেকেরই বিশ্বাসে আঘাত লাগতে পারে। আমাদের বাঙালির কিছু থাক আর না থাক, চেতনা আর ধর্মপ্রেম অস্থি মজ্জায়। কিন্তু ধর্মীয় জ্ঞান? সে চুলোয় যাক। এ নিয়ে অন্যদিন বলব ইনশাআল্লাহ। আজকে নিয়ত নিয়েই বলি।
নিয়ত করাটা আমাদের কাছে দুধভাত মনে হয়। কিন্তু আসলেই কি তাই? নিয়ত নিয়ে কি আমরা আসলেই সিরিয়াস? আপনি কি জানেন যেই নিয়তকে নিয়ে আপনি ভাবেন না, সেই নিয়ত একদিন আপনার সব ইবাদত, ভালো কাজকে মিথ্যা প্রমান করে দিতে পারে?
আল্লাহ কাজের সাথে সাথে কাজের নিয়তকেও লক্ষ্য করেন। কোন বান্দা কোন ভালো কাজ খারাপ উদ্দেশ্যে করছে সব তিনি জানেন। ধরুন, আপনি আপনার ভাইকে কিছু উপহার দিলেন যাতে করে ভবিষ্যতে আপনি কিছু চাইলে সে মানা করতে না পারে। এখানে আপনার উদ্দেশ্য কি আসলে আপনার ভাইকে খুশি করা নাকি পরবর্তীতে তার থেকে কিছু আদায় করা? আল্লাহ আপনার ভালো কাজের পাশাপাশি আপনার নিয়তকে লক্ষ্য করেন যার ফলে আল্লাহ আপনার নিয়ত অনুযায়ী কর্মফল প্রদান করেন। কোনো বান্দা যদি প্রকাশ করার জন্য ইবাদত করেন যেনো সকলে তাকে ঈমানদার ভাবে তাহলে সে তার নিয়তই হাসিল করতে পারবে, স্রষ্টার সন্তুষ্টি পাবে কিনা আল্লাহ মালুম। একজন লোক যদি দান খয়রাত করে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আল্লাহ তখন সন্তুষ্ট হন, কিন্তু যখন তিনি এর পেছনে অন্য ইচ্ছা পোষণ করেন তখন আল্লাহ তার উক্ত ইচ্ছাকেই পূরণ করেন।
এটাতো গেলো নিয়তের ভয়াবহ দিক, আসুন আপনাদের নিয়তের একটি ভালো দিক বলি। কিভাবে আপনার নিয়ত আপনাকে বাঁচাবে, আপনাকে স্রষ্টার আরো নিকটে নিয়ে যাবে!
একটি হাদিস দিয়ে এর উদাহরণ দিচ্ছি যেটি আমি সংগ্রহ করেছি।
"হযরত আবু সাঈদ সাদ বিন মালেক বিন সিনান আল খুদরী রাযিআল্লাহু তা’আলা আনহু হতে বর্ণিত। নবী করীম সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তোমাদের পূর্বের জাতির একটি লোক (সম্ভবত বনী ইসরাইলি) নিরানববই জনকে হত্যা করে, এরপর সে সবচেয়ে বড় একজন জ্ঞানী লোকের (আলেমের) খোঁজ করে, তখন তাকে একজন আলেমের কথা বলা হয়। সে তাকে গিয়ে বলে, আমি নিরানববই জন মানুষকে খুন করেছি, আমার তাওবা হবে? সে বলল, না। অতঃপর তাকে হত্যা করে সে একশ জন লোক পুরা করে। অতঃপর সে একজন বিজ্ঞ ব্যক্তির খোঁজ করলে আরেকজন আলেমের খোজ দেয়া হয়। সে তাকে গিয়ে বলে, আমি একশটি লোক হত্যা করেছি, আমার কি তাওবা করার সুযোগ আছে? তিনি বললেন, হ্যাঁ আছে। কে তোমার ও তাওবার মাঝে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াবে? তুমি উমুক স্থানে যাও সেখানে কিছু মানুষ রয়েছে যারা আল্লাহর ইবাদত করে, তুমি তাদের সাথে গিয়ে আল্লাহর ইবাদত কর। আর তুমি তোমার এলাকায় ফিরে যেও না। কেননা তোমার এলাকাটা খুব খারাপ এলাকা। সে তখন যাত্রা শুরু করে। অর্ধেক পথ অতিক্রম করার সময় তার মৃত্যু এসে উপস্থিত হয়। অতঃপর তার ব্যাপারে রহমত ও আযাবের ফেরেশতারা বিবাদে লিপ্ত হয়। রহমতের ফেরেশতারা বলে, সে তাওবা করে আল্লাহর পানে ছুটে এসেছে। পক্ষান্তরে আযাবের ফেরেশতারা বলে, সে কখনো কোন ভালো কাজই করেনি। অতঃপর সেখানে মানুষের বেশে একজন ফেরেশতা আসে। তারা তাকে বিচারক মানে। তিনি বলেন, তোমরা দুদিকটা মেপে দেখ। সে যেদিকে নিকটবর্তী হবে, তাকে সেদিকের বলে ধরে নেয়া হবে। অতঃপর মেপে দেখা গেল যে, সে যেদিকে যাচ্ছিল সে দিকটাই নিকটে। এর ফলে তাকে রহমতের ফেরেশতারা নিয়ে যায়। (বুখারী ও মুসলিম)
অপর বর্ণনায় এসেছে- সে ছিল ভাল গ্রামটার দিকে এক বিঘত পরিমাণ আগানো যার ফলে তাকে সেদিকের ধরে নেয়া হয়। অপর বর্ণনায় এসেছে- আল্লাহ অহি করে দেন যেন এদিক দূরে হয়ে যায় এবং ঐদিকটা নিকটে হয়ে যায় এবং বলেন এর মধ্যখান মাপো যার ফলে তারা মাত্র এক বিঘত পরিমাণ এর দিকে আগান পায়, যার ফলে তাকে ক্ষমা করে দেয়া হয়।"
সূত্র: https://www.hadithbd.com/books/link/?id=3823
১০০ খু*ন করার পরও লোকটি ক্ষমা পেলো ভালো গ্রামে না পৌঁছেও। কারণ উক্ত ব্যক্তির নিয়ত ছিল সে ভালো গ্রামে যাবে এবং ভালো লোকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। সে তার উদ্দেশ্য পূরণে সফল হন নি। কিন্তু আল্লাহর কি অসীম দয়া আর মেহেরবানী যে আল্লাহ তার উদ্দেশ্যের জেরেই তাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। আল্লাহ আমাদের কাজের উদ্দেশ্য দেখেন। আমরা যদি কোনো ভালো উদ্দেশ্যে কোনো কাজ করি কিন্তু সফল না হই তাও যেনো নিরাশ না হই। কেনোনা আমাদের রব ক্ষমাশীল আর তিনি আমাদের মনের সকল গোপন উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানেন। আল্লাহ আমাদের নিয়ত সম্পর্কে আরও সতর্ক হওয়ার তওফিক দান করুন। আমিন।