Posts

গল্প

সবুজ পুরের বীর: দীপঙ্কর

April 20, 2025

Rifat

64
View

ঘন সবুজ আর রহস্যে ঘেরা এক জঙ্গল, যার নাম ছিল সবুজপুর। এই জঙ্গলের গভীরে, উঁচু উঁচু গাছের সারি আকাশের দিকে হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়েছিল, আর তাদের ঘন পাতা ভেদ করে সূর্যের আলো মাটিতে এসে পড়ত সোনালী ফোঁটার মতো। নানা ধরনের পাখির কলকাকলি আর ঝিঁঝি পোকার একটানা গুঞ্জন সব সময় লেগে থাকত সবুজপুরের বাতাসে।
এই জঙ্গলে বাস করত একদল হাতি। তাদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট হাতিটির নাম ছিল দীপঙ্কর। দীপঙ্কর ছিল খুব চঞ্চল আর কৌতূহলী। বড় হাতিরা যখন ধীরে সুস্থে হেঁটে খাবার খুঁজত, দীপঙ্কর তখন তার মায়ের পাশ থেকে ছুটে যেত নতুন কিছু দেখার লোভে। তার বড় বড় কান দুটো সব সময় খাড়া থাকত নতুন কোনো শব্দ শোনার জন্য।
একদিন, যখন দলবল জঙ্গলের এক নতুন প্রান্তে যাচ্ছিল, দীপঙ্কর হঠাৎ করে একটা ঝোপের আড়াল থেকে অদ্ভুত এক আওয়াজ শুনতে পেল। আওয়াজটা কেমন যেন ফ্যাঁস ফ্যাঁস করছিল। মায়ের নিষেধ সত্ত্বেও, দীপঙ্কর কৌতূহল সামলাতে না পেরে ঝোপের দিকে এগিয়ে গেল।
ঝোপের আড়ালে সে যা দেখল, তাতে তার ছোট্ট শরীরটা ভয়ে কেঁপে উঠল। সেখানে একটা বিশাল অজগর সাপ, যার গায়ের চামড়া নানা রঙে মেশানো, একটা ছোট হরিণকে পেঁচিয়ে ধরেছে। হরিণটি ভয়ে ছটফট করছে, কিন্তু সাপের শক্তিশালী বাঁধন থেকে তার মুক্তি পাওয়ার কোনো উপায় নেই।
দীপঙ্কর প্রথমে খুব ভয় পেয়েছিল। কিন্তু হরিণটির করুণ চাহনি দেখে তার মনে সাহস জন্মাল। সে ভাবল, কিছু একটা তাকে করতেই হবে। তার মনে পড়েছিল, দলের বয়স্ক হাতিরা বলত, বিপদে বুদ্ধি আর সাহস কাজে লাগানোই আসল বীরত্ব।
দীপঙ্কর দ্রুত তার মায়ের কাছে ফিরে গেল এবং ফিসফিস করে পুরো ঘটনাটা জানাল। প্রথমে মা একটু ভয় পেলেও, দীপঙ্করের চোখে দৃঢ়তা দেখে তিনি বুঝতে পারলেন, তাদের কিছু করা উচিত।
তখন মা অন্য হাতিদের ডাকলেন। সবাই মিলে আলোচনা করে একটা বুদ্ধি বের করল। তারা ঠিক করল, কয়েকটা হাতি মিলে জোরে জোরে শব্দ করবে আর মাটি কাঁপাবে, যাতে সাপটি ভয় পেয়ে হরিণটিকে ছেড়ে দেয়।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, বড় হাতিরা একসঙ্গে গর্জন শুরু করল এবং তাদের বিশাল পা দিয়ে মাটি থকাতে লাগল। জঙ্গলের শান্ত নীরবতা ভেঙে গেল তাদের গর্জনে আর পায়ের আওয়াজে।
অজগর সাপটি প্রথমে হকচকিয়ে গেল। এতগুলো হাতির একসঙ্গে গর্জন আর মাটির কম্পন সে আগে কখনো দেখেনি। ভয় আর অস্থিরতায় তার বাঁধন কিছুটা আলগা হয়ে গেল। সেই সুযোগে হরিণটি এক ঝটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে গেল।
সাপটি বুঝতে পারল, তার শিকার হাতছাড়া হয়ে গেছে। এতগুলো শক্তিশালী হাতির সামনে তার কিছুই করার নেই। তাই সে ধীরে ধীরে ঝোপের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।
দীপঙ্কর আর তার মা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। হরিণটি কিছুক্ষণ পর ঝোপ থেকে বেরিয়ে এসে কৃতজ্ঞতার চোখে হাতিদের দিকে তাকাল এবং তারপর দ্রুত জঙ্গলের ভেতরে চলে গেল।
এই ঘটনার পর দীপঙ্কর দলের অন্য হাতিদের কাছে আরও বেশি সম্মান পেল। সবাই বুঝতে পারল, ছোট হলেও দীপঙ্করের সাহস আর বুদ্ধির কাছে বড় বড় বিপদও হার মানতে পারে।
দীপঙ্করও বুঝতে পারল, শুধু কৌতূহলী আর চঞ্চল হলেই চলবে না, বিপদে অন্যের পাশে দাঁড়ানো এবং সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়াটাও খুব জরুরি।
এরপর থেকে দীপঙ্কর আরও বেশি সতর্ক হল। সে মায়ের কথা মেনে চলত, তবে যখনই কেউ বিপদে পড়ত, সে তার সাধ্যমতো সাহায্য করার চেষ্টা করত। সবুজপুরের জঙ্গলে দীপঙ্কর ধীরে ধীরে এক সাহসী আর বুদ্ধিমান হাতি হিসেবে পরিচিতি লাভ করল। তার গল্প জঙ্গলের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ল, আর অন্য ছোট হাতিরাও তাকে দেখে সাহস আর বুদ্ধির গুরুত্ব বুঝতে শিখল।
সবুজপুরের জঙ্গল আগের মতোই সবুজ আর শান্ত ছিল, তবে দীপঙ্করের সাহসিকতার গল্প সেই জঙ্গলের প্রতিটি গাছের পাতায়, প্রতিটি পাখির গানে যেন মিশে গিয়েছিল। আর সেই ছোট্ট হাতিটি, দীপঙ্কর, চিরকাল সবুজপুরের বীর হিসেবে সকলের হৃদয়ে বেঁচে রইল।

Comments

    Please login to post comment. Login