সৌক্রেটিস কোইতাছে: অ্যারিস্টনের পোলা গ্লকনের লগে গতকাল পিরিয়াসে গেছিলাম। প্রার্থনা করবো দেবীর কাছে। এরচেয়ে বড় বিষয় ছিল পগ্রাম দেখা। এই পগ্রাম ওরা করতেসে প্রথমবারের মতো। তাই কেমন করে দেখা দরকার। এলাকার স্থানীয়রা তো চমৎকার একটা মিছিল বাইর করছিলোই। কিন্তু এই থ্রেসিয়ানরাও যেইটা করলো সেইটাও দেখার মতো। প্রার্থনা এবং দর্শন শেষে, আমরা শহরের দিকে রওনা হলাম।
বাড়ির দিকে যাওনের টাইমে সিফেলাসের পোলা পলিমার্কাস দূর থেইকা আমগোরে দেইখা ফালাইলো। ওর কেনা চাকর পোলাডারে অর্ডার করলো দৌড়ায়া আমগোরে ধরতে। তারপর যেন আমগোরেও সে অর্ডার করে যে আমরা সিফেলাস পুত্রের তরে থাইমা থাকি। চাকর পোলাডা দৌড়ায়া আইসা আমার চাদর খামছায়া ধরলো পিছন থেকে। কইলো, "পলিমারকাসের হুকুম আপ্নে খাড়াইবেন।"
আর আমি ঘুইরা দাড়ায়া জিগাইলাম তা তোর বাপে কোই রে। "ঐযে আইতাছে", বান্দির বাচ্চায় কয়, "আপ্নে চুপচাপ খাড়ান খালি।"
"আরে দাঁড়াবো না কেন, অবশ্যই দাঁড়াবো। ভাই আসুক আস্তে সুস্থে," গ্লকনে কয়।
ক্ষণিক পরে একগাদা পোলাপান লয়ে পলিমার্কাস আবির্ভূত হইল। ওগো মধ্যে এডিম্যান্টাসরে দেখলাম, গ্লকনের বড় ভাই। আরো ছিল নিকিয়াসের পোলা নিকেরেটাস। আরো কে কে জানি ছিল। পগ্রাম থেইকা ভাই বেরাদার সব একলগে আইতাছে আরকি।
[এই ক্রাউডটা কেমন সেটা একটু বলে রাখা ভালো। সবাই তখনকার গ্রিসের ধনী ও ক্ষমতাবান পরিবারের সন্তান। পলিমার্কাসের পিতা সিফেলাস ছিলেন একজন ধন্যাঢ্য অস্ত্র ব্যবসায়ী। নিকিয়াস ছিলেন রাজনীতিবিদ ও ওয়ারটাইম জেনারেল। পেলোপনেশিয়ান যুদ্ধে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এডিম্যান্টাস আর গ্লকন, প্লেটোরই দুই ভাই। তাদের পিতা অ্যারিস্টনও বিত্তবান মানুষ ছিলেন। দলের লোকগুলোর বয়স তিরিশ চল্লিশের মধ্যে। সক্রেটিসের বয়স পঞ্চাশ থেকে ষাট। তিনি নিতান্তই দরিদ্র মানুষ। ওরকম ক্ষমতা টমতাও নেই। তথাপি এই ধনী যুবকসমাজ সক্রেটিসের জ্ঞান ও প্রজ্ঞার কারণে তার প্রতি প্রবল আকর্ষিত হতেন।]
পলিমার্কস কইলো, "কি সক্রেটিস, আপনারা দুইটা পালাইতেসেন মনে হয়? টাউনে যাইতেছেন না?"
আমি উদাস হয়ে কইলাম, "হইতে পারে।"
"আমরা এখানে পোলাপান কতজন আছি দেখছেন?"
"দেখবো না ক্যান?"
"হয় সবডিরে মাইরা আপনার জিততে হইবো, নাইলে আইজকা কৈছি আপ্নে যাইতে পারবেন না।"
"আচ্ছা, ধরো আরেকটা কাজ করা যায় না," আমি কইলাম, "আমরা তোমাদের সুন্দর যুক্তি দিয়া বুঝাইলাম যে কেন তোমাদের উচিত আমাদের যাইতে দেওয়া।"
"আমরা যদি আগেথেই ঠিক কইরা রাখি আপনার কথা আমরা শুনবো না, তাইলে পারবেন আপ্নে আমাদের বুঝাইতে?"
" কোনোভাবেই না," গ্লকনে কয়।
"তাইলে ধইরাই রাখেন আমরা আপনাদের কথা শুনবো না আর সেই অনুযায়ী সিদ্ধান্ত লন।"
তখন এডিম্যানটাস বলে যে, "আচ্ছা, সন্ধ্যায় ওরা দেবীর পূজায় একটা ঘোড়ার রেস করবে এখানে। সওয়ারীদের হাতে থাকবে মশাল। সৌক্রেটিস জানতেন এইটা?"
"ঘোড়ার পিঠে চইড়া মশাল-দৌড়?", আমি চমকিত হইয়া কইলাম, "মারাত্মক তো? ওরা করবে কি? ঘোড়া নিয়ে রেস করতে করতে একজনের থে আরেকজনের হাতে মশাল পাস করবো নাইলে কি বিষয়টা একটু খুলে কও দেখি।"
"এই আপ্নে ধরছেন ঠিকই," কইলো পলিমার্কাসে, "আরো মনে করেন সারা রাত ধইরাই বহু কাবযাব আছে। মজা পাইবেন। রাতে খায়া উইঠা আমরা দেখতে যামু এইগুলা। ঐখানে মনে করেন আরো ম্যালা ছোট পোলাপান থাকবো। অনেক বোরো আড্ডা হইবো। তাই আপ্নেরে যে কৈছি আপ্নে থাকবেন, আর যা বলবো কথা শুনবেন, ওক্যা?"
আর গ্লকনও লাফায়া উঠলো, "এখন তো থাকতেই হবে।"
"আর কিছু তো বলার নাই," আমি কইলাম, "ওই হইলো তাইলে।"
এরপরে আমরা পলিমার্কাসের বাসায় গেলাম। সেখানে পাইলাম লিসিয়াস আর ইউথেডাইমাসরে। পলিমার্কাসের দুই ভাই। তারপর খ্যালসিডন থেইকা আইছে যে থ্র্যাসিম্যাকাস ওরে দেখলাম। চারম্যানটিডিসরে দেখলাম, ওর বাড়ি পাইয়ানিয়া। আর-আ-ছিলো এরিস্টোনিমাসের পোলা ক্লিটোফোন।
[লিসিয়াস মূলত একজন আইনজীবী। যদিও তখনকার এথেনিয়ান আদালতে আজকের মতো উকিল ছিল না। অভিযুক্তকে নিজেকেই যুক্তি উপস্থাপন করে এবং আইনের আলোকে বুঝিয়ে বলতে হতো কেন তিনি নিরপরাধ। কোর্টে সাধারণ মানুষের জন্য এই বক্তব্যটি যারা লিখে দিতেন তারা ছিলেন লোগোগ্রাফার। এই পেশার লোকরা ছিলেন সুলেখক, যুক্তিবিদ্যায় প্রখর এবং আইন বিষয়ে ওয়াকিবহাল।
পেলোপনেশিয়ান যুদ্ধের পর স্পার্টানরা এথেন্সবাসীর ওপর একটি স্বৈরশাসন চাপিয়ে দিয়ে যায়। এথেন্স থেকেই তিরিশজন নেতা বেছে নিয়ে গঠন করা হয় এই সরকার। ইতিহাসে এরা দি থার্টি টাইর্যান্টস নামে পরিচিত। প্লেটোর রিপাবলিকের ঘটনাগুলি ঘটছে সম্ভবতো যুদ্ধের পরে এই শাসনামলের শুরুর দিকে।
এরা একবছর মতো টিকেছিল। এই সময়ের মধ্যে তারা এথেন্সের গণতন্ত্রকে বিলুপ্ত করে একটি ন্যারো অলিগার্কিকে (সংকীর্ণ অভিজাততন্ত্র?) প্রতিষ্ঠা করতে চেষ্টা করে। এবং সেটি করতে গিয়ে তারা প্রায় পনেরোশো মানুষকে হত্যা করে। তাদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন 'মেটিক'। যেমন, পলিমার্কাস ও তার পরিবার। এরা জন্মসূত্রে এথেন্সের নাগরিক না। কিন্তু বহুদিন ধরেই সেখানে বাস করছেন এবং স্বীয় পরিশ্রমের মাধ্যমে অর্থ ও প্রতিপত্তি অর্জন করেছেন।
এছাড়াও, পলিমার্কাস ছিলেন গণতন্ত্রের একনিষ্ঠ সমর্থক। এসব কারণে শাসকদের একজন, ইরাটোস্থেনিস, পলিমার্কাসের পরিবারকে টার্গেট করেন। শেষ পর্যন্ত পলিমার্কাস শহীদ হয়েছিলেন। সম্ভবত: তার ভাই ইউথেডিমাসেরও একই পরিণতি হয়, যদিও এই লোকের বিষয়ে খুব বেশি জানা যায় না।
লিসিয়াস পালিয়ে যান এবং স্বৈরাচার পতনের গণতান্ত্রিক লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন। বিজয়ের পরে তিনি এথেন্স ফিরে আসেন। নতুন এথেনিয়ান কোর্টে তিনি তার ভ্রাতৃহত্যার দায়ে অভিযুক্ত ইরাটোস্থেনিস বিরুদ্ধে উপস্থাপন করেন বিখ্যাত মর্মস্পর্শী ভাষণ "এগেইনস্ট ইরাটোস্থেনিস- ইরাটোস্থেনিসের বিরুদ্ধে।" বিগত অত্যাচারী স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে সমগ্র এথেন্সবাসীর যত ক্ষোভ ও ক্রোধ যেন ধ্বনিত হয় আদালতে উপস্থাপিত লিসিয়াসের সেই বক্তব্যে।
অলিগার্কির পতনের এক বছরের মধ্যেই এথেন্সের নতুন গণতান্ত্রিক সরকার সক্রেটিসকে মৃত্যুদণ্ড দেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তিনি গণতন্ত্রের শত্রু এবং বিগত স্বৈরাচারের দোসর।
প্লেটো এই লেখায় লিসিয়াসকে রেখেছেন সম্ভবত: নিজের ন্যারেটিভকে তৎকালীন বাস্তবতার সাথে জুড়ে দেয়ার জন্য। কারণ লিসিয়াসকে আমরা কোনো দার্শনিক আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ বক্তা হিসেবে পাই না। এদিক থেকে থ্র্যাসিম্যাকাস গুরুত্বপূর্ণ। তিনি সরাসরি সক্রেটিসের চিন্তাকে চ্যালেঞ্জ করেন, যেটা একটু পরেই দেখবো আমরা। থ্র্যাসিম্যাকাস ছিলেন একজন সোফিস্ট। বলা যায় একজন কথা বিশেষজ্ঞ। তখনকার এথেন্স যেসব যুবক আইনজীবী বা রাজনীতিবিদ হিসেবে ক্যারিয়ার করতে চাইতেন তাদেরকে পাবলিক স্পিকিংএ দক্ষ হতে হতো। এই যুবকরা সোফিস্টদের শরণাপন্ন রেটোরিক শেখার জন্য। অর্থাৎ কিভাবে কথা দিয়ে সাধারণ মানুষকে ভোলাতে হয় সেই বিদ্যা। প্লেটো, সক্রেটিসরা এই সোফিস্টদের দেখতে পারতেন না। তারা মনে করতেন এরা কথার কৌশলে মানুষকে বিভ্রান্ত করে এবং প্রকৃত সত্য থেকে বিমুখ করে দেয়।
চারম্যানটিডিস, আমাদের দেশের সাকিব, আসিফের মতোই একটা অতি কমন নাম। প্লেটোর রিপাবলিকের বাইরে আর কোথাও এই চারম্যানটিডিস বা প্লেটোর চ্যাডকে পাওয়া যায় না। যেকারণে ধারণা করা যায় এটি একটি কাল্পনিক চরিত্র। আলাপ এগিয়ে নেয়ার জন্য প্লেটো একে ব্যবহার করেছেন।
ক্লিটোফোন ছিলেন এথেন্সের একজন সুপরিচিত রাজনীতিবিদ। তিনি অলিগার্কির সমর্থক হলেও ত্রিশ স্বৈরাচারের মতো অতি উগ্র ছিলেন না। তাদের সাথে তার কোনো সম্পর্কও ছিল না। রিপাবলিকে তিনি নীরব থাকেন এবং প্লেটো তাকে এনেছেন পটভূমি নির্মাণের জন্য। তবে ক্লিটোফোন নাম প্লেটোর আরেকটা স্বল্পপরিচিত বই আছে। সেখানেও সক্রেটিসই বক্তা, তবে আলাপ এগিয়ে নেয়ার জন্য ক্লিটোফোনকে ব্যবহার করা হয়।]