নীল শহরের কোলাহল ছেড়ে ফিরেছে ছোটবেলার বাড়িতে। অনেক বছর পরে। কর্মজীবনের ব্যস্ততা, শহরের ধোঁয়া, আর আধুনিক জীবনের ধাতব শব্দের ভিড়ে হারিয়ে ফেলেছিল সে সেই পুরোনো, কাঠের দরজাওয়ালা, শিউলি গাছের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সেই বাড়িটার গন্ধ।
এই বাড়ি তার জন্মস্থান নয়, কিন্তু তার শিকড়। এখানেই তার শৈশব কেটেছে দিদিমার কোলে, হোগলার মাদুরে, আর ভাঙা টিনের চালের নিচে বর্ষার বৃষ্টির শব্দে।
দিদিমা মারা গেছেন পাঁচ বছর আগে। নীল তখন সিঙ্গাপুরে, প্রজেক্ট শেষ করে ফিরতে পারল না। সেই থেকে একটা অপরাধবোধ তার মনে কাঁটার মতো বিঁধে আছে। এই বাড়িটাও সেই সময় থেকেই ফেলে রাখা। আজ হঠাৎ, কোনো এক টানেই যেন সে ফিরে এলো।
দরজায় হাত রাখতেই কড়াটি খুলে গেল কেমন করে। যেন বাড়িটাও তাকে চিনে ফেলেছে।
ভিতরে ঢুকতেই পরিচিত সেই গন্ধ—পুরোনো বই, দিদিমার আতর, শিউলি ফুল। ভাঙা চেয়ারটা এখনো বারান্দায়, যেখানে বসে দিদিমা বিকেলে পুঁথি পড়তেন।
নীল ধীরে ধীরে ঘুরে বেড়ায় প্রতিটি ঘর। দেয়ালের পলেস্তারা খসে পড়েছে, জানালার কাঁচ ভাঙা, মেঝেতে ধুলো জমে আছে। কিন্তু এই ধুলোও যেন তার নিজের। তার শ্বাসে, তার চেতনায়।
হঠাৎ পেছনে হালকা একটা ছায়া কাঁপে।
সে ঘুরে দাঁড়ায়। দাঁড়িয়ে আছে একটা মেয়ে। লাল শাড়ি, খোলা চুল, চোখে গভীর এক দৃষ্টি। মুখটা যেন চিনতে চায়, আবার যেন জানে আগে থেকেই।
নীল কাঁপা গলায় বলে, “তুমি কে?”
মেয়েটা মৃদু হেসে বলে, “আমাকে মনে নেই তোমার?”
“আমার মনে থাকার কথা?”
“তোমার দিদিমা আমাকে ডাকতেন ‘ছায়া’ বলে।”
নীলের মস্তিষ্কে যেন বাজ পড়ে। ছোটবেলায় দিদিমার কাছে একটা গল্প শুনেছিল সে—এই বাড়ির একটা ঘরে নাকি একটা মেয়ে ছিল, যাকে কেউ দেখতে পেত না, শুধু অনুভব করা যেত। দিদিমা বলতেন, “ছায়া আছে। সে একলা নয়, বাড়ির আত্মা।”
সে ভাবত, নিছকই কল্পনা। হয়তো দিদিমার বৃদ্ধ বয়সের অলীক কাহিনি। কিন্তু আজ?
নীল বলল, “তুমি তাহলে... সেই ছায়া?”
মেয়েটি একটু হাসল। “হয়তো আমি সেই স্মৃতি, হয়তো একটা না বলা গল্প, অথবা শুধু এক টুকরো অনুভব।”
“তুমি কি দিদিমার সঙ্গে থাকলে?”
ছায়া চুপ করে রইল। তারপর বলল, “তোমার দিদিমাই আমায় দেখতেন, আমায় ডাকতেন, আমায় ছুঁয়ে দিতেন মায়ায়। আমি যখন সত্যি ছিলাম, তখন এক অনাথ মেয়ে ছিলাম এই পাড়ার। কেউ আমায় মানত না, কেউ চাইত না। একদিন হঠাৎ এই বাড়িতে আশ্রয় পেয়েছিলাম তোমার দিদিমার কাছে। তিনি আমাকে মানুষ করেছিলেন, মা হয়ে উঠেছিলেন।”
নীল স্তব্ধ হয়ে শুনছে।
“কিন্তু আমি বেশি দিন ছিলাম না,” ছায়া কণ্ঠ নামিয়ে আনে। “জ্বরে মরেছিলাম, তখন তোমার বয়স খুব ছোট। দিদিমা আমার জন্য খুব কেঁদেছিলেন। তারপর থেকেই আমি রয়ে গেছি এই বাড়ির ‘ছায়া’ হয়ে। কখনো নীলের পাশে বসে, কখনো দিদিমার গল্পের পাতায়।”
নীলের চোখে জল চলে আসে। “তুমি থাকো আজও?”
“তুমি ফিরেছো, তাই ফিরে এসেছি আমিও। মনে রাখা মানে তো হারিয়ে যাওয়া নয়। স্মৃতিরা চলে না, ঠিক এই বাড়ির মতো, পড়ে থাকে কোথাও।”
নীল তার হাত বাড়ায়, ছুঁতে চায় ছায়াকে। কিন্তু বাতাসের মতো, ছায়া একটু পেছিয়ে যায়।
“আমি ধরা পড়ি না,” সে বলে। “আমি অনুভব। তুমি ফিরে এসেছো, মানেই তুমি এখনো আমাকে ভালোবাসো।”
নীল আর কথা বলতে পারে না।
পরদিন সকাল
নীল ঘুম থেকে উঠে দেখে, জানালার পাশে রাখা কাঠের চেয়ারটায় জুঁই ফুল রাখা। দিদিমার প্রিয় ফুল। সে তো বাইরে বেরোয়নি, ফুল আনেনি।
সে চেয়ারটার পাশে গিয়ে বসে। হঠাৎই যেন মনে পড়ে ছোটবেলার স্মৃতি—ছোট নীল মাটিতে বসে ছবি আঁকছে, পাশে দিদিমা, আর একটা মেয়ে, মুখে নরম হাসি, তার আঁকা দেখছে।
“তুই তো বলেছিলি ছায়া বলে কেউ নেই!” দিদিমার গলা এখনো যেন কানে বাজে।
“আছে দিদিমা। আমি দেখেছি। আমায় রোজ দেখে।” তখন সে বলেছিল।
আজ বুঝতে পারছে, ছায়া সত্যিই ছিল। শুধু চোখে দেখা যেত না, অনুভবে ছিল। প্রতিটা বিকেলে, প্রতিটা গল্পে।
এক মাস পর
নীল পুরনো বাড়িটা সংরক্ষণ করতে শুরু করেছে। কাঠের দরজা নতুন করে পালিশ করেছে, দেয়ালে দিদিমার ছবি টাঙিয়েছে, আর একটি ছোট ঘরকে স্মৃতি ঘর বানিয়েছে। সেখানে ছায়ার কথা লিখে রেখেছে সে—“আমার বাড়ির ছায়া, আমার দিদিমার হৃদয়।”
লোকজন আসতে থাকে, ছবি তোলে, গল্প পড়ে, অবাক হয়। নীল কাউকে বলে না ছায়ার আসল পরিচয়। সে শুধু জানে, ছায়া এখন এই বাড়ির আত্মা, ইতিহাসের অংশ।
প্রতিদিন রাতে সে বারান্দায় বসে, এক কাপ চা হাতে। মাঝে মাঝে বাতাসে শিউলি ফুলের গন্ধ আসে, বা চুলে হালকা ছোঁয়া লাগে—সে জানে, ছায়া পাশে বসে।

শেষ
নীল একদিন নিজের ছেলেকে নিয়ে ফিরে আসবে এই বাড়িতে। তাকে দেখাবে সেই চেয়ার, সেই বারান্দা, সেই জুঁই ফুল। আর বলবে—“এই বাড়িতে একটা ছায়া আছে, জানিস? সে আমার খুব আপন ছিল। তুই যদি মন দিয়ে ডাকিস, হয়তো একদিন তোকেও দেখতে পাবে।” বাচ্চাটা চমকে যাবে, হেসে উঠবে। কিন্তু সময়ের সাথে বুঝে যাবে—সব ছায়া অন্ধকার নয়, কিছু ছায়া ভালোবাসা।