পোস্টস

গল্প

একটি পুরুষ বাবুই ও নীল-কপালি লালগির্দি পাখি

২২ মে ২০২৪

সাজিদ রহমান

মূল লেখক সাজিদ রহমান

সপ্তাহ ঘুরে বুধবার এসে হাজির। আমার এই জীবনে বুধবারের আলাদা একটা সুবাস আছে। এখনই সেই সুবাস টের পাচ্ছি। নাকে এসে ধাক্কা খাচ্ছে। মাগরিবের আগে আগে ইফতারের প্লেটে সাজানো সুস্বাদু খাবার যেমন রোজাদারের অন্তরে আনন্দ জাগায়, আমার মাঝেও সেরকম অনুভূতি দেয়। বুধবার মানে মুক্ত বাতাসে শ্বাস নেয়ার দিন। আনন্দের এই উপলক্ষের সাথে একটা চেনা সূর যোগ হয়েছে। বুঝতে পারছি, বাবুই পাখিটা ফিরে এসেছে। সেই চেনা বাবুই। সেই চেনা সূর। বেশ কয়দিন পর ঘুলঘুলিতে বাবুইকে দেখতে পাই। অনেক কষ্টের মাঝেও বেশ মোলায়েম সুখের অনুভূতি হচ্ছে।  
 
ছোট একটা ঘরে আমার বাস। বাইরে বের হওয়ার উপায় নেই। ঘরটায় নেই কোন জানালা। আছে ছোট সাইজের একটা ঘুলঘুলি। ঘুলঘুলিটা ছাদ থেকে বেশ নিচে। সেটা না থাকা জানালার কাজও করে। সেটা দিয়ে বাতাস আসে। সেই ঘুলঘুলি দিয়ে রোদ ঢুকে পড়ে। তাও সব সময় নয়। শীতকালে সুর্য কিছুটা দক্ষিণ দিকে হেলে যাওয়ার সময় কিছু রোদের দেখা পাওয়া যায়। কম্পাউন্ডের মসজিদে যখন জোহরের আজান হয়, তার কিছু পর থেকে সুর্যের আলো এসে আমার ঘরে ঢুকে পড়ে। তেরছা করে আসা শীতের মিষ্টি রোদ। তক্তপোশ থেকে নেমে সেটার কাছে যাই। ঘুরে ফিরে সারা শরীরটায় রোদ মাখি। রোদের উচ্ছলতায় স্নান করি। 
 
বেশ কিছুদিন হল আমাকে এই ঘরটায় নিয়ে আসা হয়েছে। ছোট ঘরটায় কিছুই করার নেই। ওটুক জায়াগায় পায়চারি করি। তক্তপোশের উপর বসি। শুয়ে থাকি। একটা সময় ঘুলঘুলিতে চোখ পড়ে। কয়েকটা বাবুই পাখিকে দেখতে পাই। অন্য পাখিরাও এসে বসে। আস্তে আস্তে অন্য পাখি আসা কমে যায়। একসময় শুধু একটা বাবুই পাখি আসে। সেটা দেখতে অন্যদের চেয়ে বেশ আলাদা। গলার নিচে একটা লালচে দাগ। এর ফলে খুব সহজে তাঁকে আলাদা করা যায়। ভুলে ঘরের ভিতরে ঢুকে পড়ে। প্রথম দিন ভিতরে ঢুকে বেশ আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। এলোমেলো ভাবে উড়তে থাকে। আতঙ্কে বের হওয়ার পথ খুঁজে পায় না। আস্ত ঘুলঘুলিটা ওর নজরে আসে না। অবস্থা বুঝতে পেরে চুপ মেরে পড়ে থাকি। মরা মানুষের মত। পাখিটার ভয় কেটে যায়। বাইরে বের হওয়ার পথ খুঁজে পায়। মানুষ কোন কারণে খুব ভয় পেয়ে গেলে সহজ কাজটাও কঠিন লাগে। ভুল করে বসে। ভয় পেলে পাখিরাও আমাদের মত আচরণ করে।
 
কতক্ষণ পর দেখি, ফের ঘুলঘুলিতে এসে বসেছে। এরপর প্রায় প্রতিদিনই তাঁকে ঘুলঘুলিতে বসতে দেখি। সেখানে বসেই ঠোট দিয়ে শরীরের যত্ন নেয়। অনেকটা বয়ঃসন্ধি পার হওয়া তরুন যুবকের মত। ঐ বয়সে একজন তরুণ ঘুরতে ফিরতে আয়নায় নিজেকে দেখতে থাকে। চুলের ভাজটা কোন দিকে দিলে স্মার্ট লুক আসে। গোঁফ থাকলে ভালো দেখায়, নাকি গোঁফ ছাড়া। গেঞ্জিটা পুরা না ঝুলিয়ে প্যান্টের একপাশে গুঁজে দেয়। ট্রায়াল এরোর মেথডে বিভিন্ন ভাবে কসরত চলে। উদ্দেশ্য একটাই, যেন একটা সুন্দর মেয়ের নজরে পড়তে পারে। দরকার হলে ইউটিউবে শিমুল মোস্তফার আবৃত্তি শুনে নেয়। গোপনে দুই চার লাইন কবিতা লিখে। রবি ঠাকুরের গান শুনে। হৃত্ত্বিকের মত করে হাটা রপ্ত করে। চুলকাটার পর নাপিতের উস্কানিতে হারবাল ফেস ওয়াশ করায়। তবু যদি সুন্দর একটা মেয়ের নজরে পড়া যায়! 
 
 
২। 
বাবুই পাখিটা আমাকে দাদির কথা মনে করিয়ে দেয়। অনেক ছোটবেলায় দাদি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। তবু দাদির কিছু স্মৃতি এখনও জ্বলজ্বল করে। একবার ঝড়ে বাবুই পাখির বাসা পড়ে গেছিলো। আমরা দৌড়ায়ে সেই বাসাটা নিয়ে আসি। ভিতরে বেশ কয়টা বাবুই পাখির ছানা ছিল। এর আগে আমাদের একটা পোষা ময়না ছিল। সেটা সেই কবে উড়ে গেছে। এরপর থেকে খাঁচাটা পড়েই ছিল। বাসা থেকে বের করে ছানাগুলোকে সেই খাঁচার ভিতর ঢুকাই। ঘর থেকে ধান, চাউলের খুদ এনে দেই। খুব চেষ্টা করি, কিন্তু ওরা খায়না। কিছুক্ষণ পর একটা পাখি আশেপাশে উড়তে থাকে। ওটা ছিল ছানাগুলোর মা। এ গাছ থেকে অন্য গাছে, এপাশ থেকে ওপাশ উড়তে থাকে। চিৎকার করতে থাকে। আমাদের খুব মজা লাগে। দাদি কোথায় যেন গেছিলো। এসে যেই দেখে, অমনি আমাদের বকতে থাকে। খাঁচা থেকে ছানা গুলোকে ছেড়ে দেয়। ছানাগুলো একটু একটু করে উড়তে শিখেছিল। ওর মায়ের সাথে উড়ে দূরে চলে যায়। আমরা পরে জেনেছিলাম, একদিন গোপনে দাদি পোষা ময়নাটাকেও ছেড়ে দিয়েছিলো।  
 
সন্ধ্যায় দাদি আমাদের কাছে ডেকে নেয়। মাকে ছাড়া কি থাকতে পারবি? এই যে তিন বেলা খাইয়ে দেয়, গোসল করিয়ে দেয়। মা না থাকলে কি করবি তখন? আমাকে জিজ্ঞেস করে। তখন বুঝতে পারি। মা না থাকলে আমি কিভাবে বাঁচব? এই বলে কাঁদতে শুরু করি। দাদি আমাকে কোলে নিয়ে আদর করে। তখনও পাখির ছানাগুলো আমার ভাবনায় থাকে। খাঁচায় বন্দি করে রাখলে ওদের মাকে ছাড়া কিভাবে বেঁচে থাকত! দাদি সেদিন অনেক কথাই বলে। একটা কথা খুব মনে আছে। দাদি বলে, পাখি তো সুখের বাহক। ঘরের পাশে যদি পাখি আসে, এসে ঘর বাধে, সেটা খুব ভালো লক্ষণ। সংসারে তখন আনন্দের নহর বইতে থাকে। কিন্তু পাখি বন্দি করে রাখা যাবে না। সেই থেকে যেখানে থাকি, ঘরের পাশে পাখি এসে বাসা বাধে কিনা খেয়াল করি।  
৩। 
আমার ঘরের ঘুলঘুলিতে নিয়ম করে আসে বাবুই পাখিটা। একটা দুইটা করে খড় কূটো নিয়ে আসে। ঠোট দিয়ে বাসা তৈরির কসরত চালাতে থাকে। ঘরটা দুইজনে শেয়ার করি। দাদির কথা ভাবি। নিজেকে বেশ সুখী ভাবতে থাকি। বিয়ের আগে একটা মেয়ে কি চায়?ছেলে দেখতে সুন্দর, অন্তত মনটা পরিষ্কার। ভালো কোন কাজের সাথে জড়িত। যে মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেছে, সেও মনে মনে ওরকম একটা ছেলের কথা ভাবে। 
 
মানুষের সমাজের সাথে বাবুইয়ের সমাজের অবশ্য ঢের পার্থক্য আছে। বাবুই পাখির সাথী জোগাড়ের নিয়ম বেশ অদ্ভুত। এবং মজার বিষয় হল, এর সাথে মিল আছে জাতিসংঘ ঘোষিত এসডিজি গোলেরও। এসডিজির লক্ষ্য হল, যেকোন উন্নয়ন হতে হবে টেকসই ও মজবুত। একেকটা মেয়ে বাবুই যেন স্বয়ং জাতিসংঘ। পুরুষ বাবুই তাল, নারিকেল গাছে সুন্দর করে ঘর বানায়। এরপর ছুটে যায় মেয়ে বাবুই পাখির কাছে। প্রেমের প্রস্তাব নিয়ে। তার সাথে ঘর বাধার আবেদন নিয়ে। মেয়ে বাবুইয়ের কাছে অন্য পুরুষ বাবুইয়েরও প্রস্তাব জমা হয়। পুরুষ বাবুই কতটা যোগ্য, সেটার প্রমাণ তার তৈরি বাসা। মেয়ে বাবুই সেই ঘর দেখতে যায়। একে একে অন্য বাবুইয়ের ঘরও দেখে। এরপর যে পুরুষ বাবুইয়ের ঘর পছন্দ হয়, মেয়ে বাবুই তার ঘরে গিয়ে উঠে। সেখানে তারা মিলিত হয়। মেয়ে বাবুই যেই না ডিম দিতে শুরু করে, পুরুষ বাবুই উড়ে অন্য কোথাও চলে যায়। মেয়ে বাবুই ডিম তা দেয়, বাচ্চা কাচ্চা লালন পালন করে। পুরুষ বাবুই তখন নতুন করে ঘর বানাতে শুরু করে। অন্য মেয়ে বাবুইয়ের মনের মত করে। 
 
আমার এই জীবনটা একেবারে ভিন্ন। নিয়ম কানুনও আলাদা। ঘর ছেড়ে একদিন বাইরে যাওয়ার অনুমতি আছে। ঐদিন শুধু একজনের সাথে সাক্ষাৎ করার নিয়ম। আমার জন্য নির্ধারিত সেই দিনটা বুধবার। বুধবার আসলে তাই মনটা চনমনে হয়ে পড়ে। প্রায় বুধবারে কেউ না কেউ আসে। আমার সাথে সাক্ষাৎ করতে। গত বুধবার এসেছিলো পিংকি। শুরুতে ভেবেছিলাম, দেখা করবো। কিন্তু শেষ মুহুর্তে সিদ্ধান্ত বদলাই। 
 
 
৪। 
পিংকির সাথে প্রথম দেখা হয় কোন এক ১৪ই এপ্রিলে। পহেলা বৈশাখের দিনে। সেই সময় মেজমামা ভীষণ অসুস্থ। ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসা চলছে। প্রায় প্রতিদিন অফিস শেষ করে মামাকে দেখতে যাই। পহেলা বৈশাখের জ্যাম ঠেলে সেদিন মামার কেবিনে যেতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। সেখানেই পিংকির সাথে পরিচয় হয়। পিংকি মামার চাচা শ্বশুরের মেয়ে। সম্পর্কে আমার আন্টি হয়। যদিও বয়সে অনেক ছোট। সেদিন পহেলা বৈশাখ উদযাপনে একটা পাখির সাজ নিয়েছে। পিংকিরা বসুন্ধরায় থাকে। ওকে ড্রপ করে দিয়ে আমি যেন উত্তরা চলে যাই। মামা আমাকে অনুরোধ করেন।  
 
আমিই গাড়ি ড্রাইভ করি। পিংকির পাখির সাজ বেশ পছন্দ হয় আমার। ওর সাথে সহজে আলাপ করতেও সাহায্য করে। জিজ্ঞেস করে জানতে পারি, ও খুব পাখি পছন্দ করে। আমারও পাখি পছন্দ। সেদিনই পিংকির প্রতি একটা অন্য রকম ফিল আসে। এর অবশ্য অন্য একটা কারণও ছিল। দাদি সেই কবে বলেছিল, একটা মেয়ের সাথে তোর বিয়ে হবে। ঐ মেয়েটাও খুব পাখি পছন্দ করবে। দাদি আরও বলেছিল, তুই ওকেই বিয়ে করিস। জীবনে সুখি হবি। দাদির সেই কথা মনে পড়ায় বেশ হাসি পায়। আচমকা আমাকে হাসতে দেখে পিংকি আমার দিকে উৎসুক চোখে তাকায়। সেই দৃষ্টিতে জানতে চায়, কি কারণ এই অকারণ হাসির। আমিও ইশারায় বুঝাই, তেমন কিছু না। সেদিন ওর সাথে খুব বেশি আলাপ হয়না। বসুন্ধরা ডি ব্লকে নামিয়ে দিয়ে বাসায় ফিরি। 
 
পরের দিনই পিংকির ফোন পাই। জরুরি আলাপ আছে। ও জানায়। একদিনের পরিচয়ে এতটা আন্তরিক ও জড়তাহীন আলাপে মুগ্ধ না হয়ে পারিনা। সেই মুগ্ধতা মনে রেখে ওদের বাড়ির নিচে পৌছাই। ৩ টা সড়ক পরে একটা বাসায় নিয়ে যায় আমাকে। সেখানে ঢুকে একদম চমকে যাই। বিশাল এক বাড়ি। বাড়ির নিচে দুইটা বেজমেন্ট। পুরাটা জুড়ে পাখির জগত, ‘এসি বার্ডস ওয়ার্ল্ড’। ঘুরে ঘুরে পাখি দেখি। অবাক হয়ে তাকাই। আনন্দিত হই আবির চৌধুরীর সাথে পরিচিত হয়ে। উনি এসি বার্ডস ওয়ার্ল্ড এর উদ্যোক্তা। 
 
কলেজের জুওলজির ভুঁইয়া স্যার ছিলেন ন্যাচার স্টাডি ক্লাবের সভাপতি। একজন পাখি পাগল মানুষ। কলেজে থাকতে আমিও সেই ক্লাবের সদস্য হই। স্যার আমাদেরকে পাখি দেখাতে নিয়ে যেতেন। বিভিন্ন এলাকায়। বাইনোকুলার ঝুলিয়ে বের হতাম। গাছের ডালে ডালে নানা জাতের পাখি দেখতাম। স্যার সেই পাখির বিস্তারিত বর্ননা দিতেন। স্যার একটু সরে গেলে বাইনোকুলারের ফোকাস গাছের ডাল থেকে রাস্তায়, ভবনের বারান্দায় গিয়ে পড়ত। দেখতাম দুই পায়ের রঙ্গিন সব পাখি। কখনও কখনও মনে হত, স্যার ঠিকই দুই পায়ের রঙ্গিন পাখি দেখার বিষয়টা টের পেতেন। টের পেয়েও কিছু বলতেন না। আমার ধারণা, নিষেধ না করাতেই আসল পাখির প্রতি ভালোবাসাটা রয়ে গেছে। সোনারগাঁও এ পাখি দেখতে গিয়ে তিনি একটা বিরল পাখির কথা বলেছিলেন। নীল-কপালি লালগির্দি। ছোটবেলা থেকে সেই পাখি খুঁজে বেড়াচ্ছেন তিনি। কখনও দেখতে পাননি। 
 
 ৫। 
আমি ভাগ্যবান। আবির চৌধুরীর এসি বার্ডস ওয়ার্ল্ডে নীল-কপালি লালগির্দি পাখি দেখতে পাই। শুধু তাই না, অসম্ভব ও বিরল প্রজাতির পাখি উনার সংগ্রহে রয়েছে। তাঁর বার্ডস ওয়ার্ল্ডও সকলের জন্য উন্মুক্ত নয়। শুধু বিশেষ আগ্রহী ও উনার পছন্দের মানুষরাই সেখানে প্রবেশের অনুমতি পায়। পিংকির সৌজন্যে আমার নামও সেই তালিকায় উঠে। শুধু নীল-কপালি লালগির্দি নয়, উনার সংগ্রহে আছে স্পাটুলা, ভারতীয় বাস্টার্ড ও হর্নবিল, ফ্রিগেট, হন্ডুরান পান্না, কাকাপো, লাল পায়ের আইবিসসহ অনেক বিরল প্রজাতির পাখি। আমি নিজেও ইনাম আল হক, আ ন ম আমিনুর রহমান, তুহিন ওয়াদুদকে ফলো করি। উনারাও এসবের বেশিরভাগ প্রজাতির খোঁজ পাননি। এরপর থেকে পিংকির সাথে বার্ডস ওয়ার্ল্ডেই দেখা হতে থাকে। দুর সম্পর্কে আন্টি হলেও একসময় আমরা সিদ্ধান্ত নেই, এক সাথে ঘর বাঁধার। মেজমামা শুরুতে একটু গাইগুই করলেও পরে রাজি হন। 
 
পিংকি সহ পরিকল্পনা করি। পুর্বাচলের আরও পরে হলেও বড় দেখে একটা জায়গা নিয়ে বাড়ি করবো। বাড়ি করবো পাখিদের উপযোগী করে। সেখানে এক কোনায় আমাদের থাকার মত দুইটা ঘর করে নিবো। আমাদের বিয়ের প্রস্তুতি চলতে থাকে। অফিস শেষ করে দুইজনে বের হই। বিয়ের কেনা কাটা করি। এলিফ্যান্ট রোডে একটা নতুন রেস্তোরা হয়েছে। বাবুই খোপ। রেস্তোরার ভিতরে বাবুই পাখির বাসার মত খোপ। প্রতি খোপে দুইজন করে বসার ব্যবস্থা। সেদিনও বুধবার ছিল। কেনা কাটা শেষ করে সেখানে খেতে ঢুকি। খাবারের অর্ডার দেয়া হয়েছে। পিংকি আমার ডান হাতটা টেনে নেয়। সেটা ওর স্তনের উপর রাখে। আমার ভিতর অস্বস্তি কাজ করে। অস্বস্তি নিয়ে পিংকির চোখের দিকে তাকাই। আমার হাতটা তখনও ওর বুকের উপর। কিন্তু সে হুহু করে কাঁদতে থাকে। আশেপাশের খোপ থেকে জুটিরা আমাদের দিকে তাকায়। চোখে মুখে বিরক্তি প্রকাশ করে। আমি পিংকিকে সান্ত্বনা দেয়ার বৃথা চেষ্টা করি। সে আরও জোরে কাঁদতে থাকে।           
 
   
৬। 
মার্চ মাসের ৭ তারিখ। সেদিন ছিল বুধবার। আমি বাসায় ওদের অপেক্ষাতেই ছিলাম। উত্তরা পশ্চিম থানা পুলিশ এসে আমাকে গ্রেফতার করে। সারাদেশে হৈচৈ পড়ে। আমাকে যেন ফাঁসিতে ঝুলানো হয়, সেজন্য বিবৃতি দেন ইনাম আল হক, আ ন ম আমিনুর রহমান, তুহিন ওয়াদুদ, রিজওয়ানা হাসানসহ কয়েক ডজন বিশিষ্ট নাগরিক। আগের দিন আমি বার্ডস ওয়ার্ল্ডে গিয়ে শুরুতে আবির চৌধুরীকে ধারালো চাকু দিয়ে তার মৃত্যু নিশ্চিত করি। এরপর উনার সংগ্রহে থাকা সকল পাখি হত্যা করি। একজন পাখিপ্রেমী ও বিরল পাখি হত্যার দায়ে দেশের বিখ্যাত উকিলরা বিনে পয়সায় আমার বিপক্ষে আইনি সহায়তার ঘোষণা দেন। মিডিয়ার চাপে মামলা দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়। দ্রুতই আমার ফাঁসির আদেশ হয়। ফাঁসির আদেশের পর আমাকে এই ছোট ঘর, যেটাকে ওরা সেল বলে, সেখানে আনা হয়। এই ঘরে এসে আবারও এক বাবুই পাখির সাথে সাক্ষাৎ হয়। দাদির কথা মনে পড়ে। ঘরের পাশে পাখি ঘর বাধলে সেই সংসার সুখের হয়। বাবুই পাখিটা ঘুলঘুলিতে আসার পর থেকে আমার বেশ ভালো লাগা কাজ করে।
 
সেদিন পিংকির কান্না কোনভাবে শেষ হচ্ছিলো না। অনেক পীড়াপিড়ির পর সে মুখ খুলে। বিয়ের আগে একটা বিষয় ক্লিয়ার করতে চায়। ছোটবেলা থেকে পিংকি পাখি ভালবাসে। সেই ভালোবাসাই তাকে আবির চৌধুরীর বার্ডস ওয়ার্ল্ডে নিয়ে যায়। ওখানকার পাখির সংগ্রহ দেখে সেও চমকায়। শ্রদ্ধার জায়গা থেকে আবির চৌধুরীর সাথে আলাপ করে। তিনিও পিংকিকে বিশেষ স্নেহ করতে থাকেন। নিজে ঘুরে ঘুরে পাখি দেখান। পাখির গল্প বলেন। একদিন আবির চৌধুরী নীল-কপালি লালগির্দি পাখিকে খাওয়ানোর জন্য এক ধরণের দানাদার জিনিস পিংকির হাতে দেন। পিংকিও খুশি হয়ে খাওয়ায়। খাওয়ানোর এক সময় হাঁচি পেলে হাতটা নাকের কাছে নেয়। এরপর পিংকির বোধ বিবেচনা কাজ করেনা। সে সবকিছু দেখতে পায়। অহেতুক হাসি পায়। আবির চৌধুরী তাকে পাশের একটা গোপন রুমে নিয়ে যায়। বিভিন্ন কায়দার তার সাথে রতিকর্মে লিপ্ত হয়। পিংকি তখনও হাসতে থাকে। ঘণ্টা তিনেক পর পিংকির সেন্স কাজ করে। আবির চৌধুরী তার সাথে ঘটা রতিকর্মের ভিডিও দেখায়। অন্য কেউ জানতে পারলে সে এটা ভাইরাল করে দিবে। বাসায় ফিরে অনেক ভাবে। মান সম্মানের ভয়ে কাউকে কিছু বলে না। কিন্তু ৩ দিন পর পিংকির মধ্যে বার্ডস ওয়ার্ল্ডে যাওয়ার নেশা পেয়ে বসে। কোনভাবে নিজেকে সামলাতে পারে না। আবারও যায়, আবারও একই ঘটনা ঘটে। শুধু পিংকি নয়, ওর মত আরও অনেক মেয়ে ওখানে যায়। আবির চৌধুরী ওদের সাথে বিভিন্ন কায়দায় সেক্স করে। ওসবের ভিডিও চড়া দামে বিভিন্ন দেশে বিক্রি করে। আবির চৌধুরীর জাল অনেক দুর পর্যন্ত বিস্তৃত। প্রচলিত আইনি পদক্ষেপে তাকে সাজা দেয়া সম্ভব ছিলোনা। আমি অনেক ভেবেছি। শেষে ঠাণ্ডা মাথায় আবির চৌধুরীকে শেষ করার প্লান করি। বিরল সব পাখি হত্যার কোন পরিকল্পনা ছিলোনা। আবির চৌধুরীকে শেষ করার পরেও ক্রোধ কমতেছিলনা। উন্মাদ হয়ে যাই, পরে খেয়াল করি আমার হাতে সব পাখি মারা পড়েছে। 
 
৭। 
আগামীকাল বুধবার। পিংকির আসার কথা। গত সপ্তাহে দেখা করিনি বলে খুব কষ্ট পেয়েছে। সাক্ষাতের জন্য ১০ মিনিট সময় বরাদ্দ থাকে। অল্প সময়ে জমে থাকা শেষ হবে না। ওর জন্য একটা চিঠি লিখেছি। সাথে একটা উইল। আমার সকল স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তির। ও যেন পাখি ভালবাসে এমন একজনকে খুঁজে নেয়। অতীতের সব কিছু ভুলে জীবনটা নতুন করে শুরু করে। পুর্বাচলের আরও পুর্বে একটা বড় জায়গা জুড়ে পাখিদের আবাস গড়ে তূলে। সেইখানে আমার জন্য যেন সামান্য জায়গা বরাদ্দ রাখে। ফাঁসি হয়ে গেলে যেন আমার লাশটা সেখানে দাফন করে। দাদি বলেছিল, ঘরের পাশে পাখিদের বাস থাকলে সংসার সুখের হয়। কবরের জীবনটা যেন সুখে যায় আমার। গুছিয়ে সুন্দর করে পিংকির জন্য একটা চিঠি লিখেছি। কাল বুধবার চিঠিটা ওর হাতে তূলে দিবো।