আবেগ ঝেড়ে ফেলতে পারলেই মানুষ বেগবান হয়। দুনিয়ায় আবেগের জায়গা নাই। কারন পানির মত স্বচ্ছ, এ পৃথিবী সেকেন্ডে প্রায় ৩০ কিলোমিটার বেগে দৌড়ায়। মামা নামের কলঙ্ক সূর্য তো আরও নির্দয়, সে সেকেন্ডে পিছনে ফেলে দেয় ২২০ কিলোমিটারের শূন্য-পথ।
মানুষের গতিও বদলায়, গতিপথও এক থাকে না। যেমন, আমি এই অধম, কয়দিন আগে পথে ছুটতাম, এখন সে পথ আর আমার নয়। পথ ঠিক থাকে, পথিক বদল হয়। কফি হাউজের বিরাম নেই, নিত্য নতুন কাস্টমারের পদচারণায়।
আমিও নতুন করে পুরান শহরে এসেছি। বোতল পুরান, সূরাও নতুন তৈরি নয়, শুধু সময়রা বদলায় গেছে। আর আমার এই যাওয়া আসার পথে গণিতের আলম স্যারের সাক্ষাৎ হচ্ছে। আর গণিতের আলম স্যার আমাকে ইংরেজির জুয়ান স্যার ও সেই শহরের কথা মনে করিয়ে দেয়।
কয়দিন আগেও জুয়ান স্যারের শহরেই ছিলো আমাদের আনাগোনা। সে শহর ছোট কিন্তু মায়াময়। নামে শহর হয়েও শহর হয়ে উঠেতে পারেনি। নাম 'রাজু বানগায়ে জেন্টলম্যান' হলেও গেয়ো ভূতই রয়ে গেছে। এ শহরের খানেক দূরে গেলেই গ্রামের নাগাল পাওয়া যায়। সেখানে শহর ও গ্রাম কাছাকাছি মাখামাখি করে থাকে। সে শহর যেন মায়ের আচল পেতে একান্নবর্তী পরিবারের স্নেহ ভালোবাসা নিয়ে মুখিয়ে থাকে। দূর থেকে সামান্য গলা খাকরি দিয়ে রাখলেই হয়। গায়ে পড়ে আদর মাখিয়ে ব্যস্ত করে রাখতে চায়।
এর বিপরীতে গণিতের আলম স্যারের শহর অন্য রকম। বড্ড বেশি হিসেবী। এই শহরের সবাই ব্যস্ত এবং সারাক্ষণ হন্তদন্ত হয়ে থাকে। যাকেই দেখবেন সে ছুটছে। মনে হয় ইসরাফিল শিঙায় ফু দিয়ে ফেলেছে। এখন শুধু ছুটে চলার অন্তহীন চেষ্টা। কিন্তু পাখা না থাকলে যেমন ওড়ার আশা বৃথা, এই শহরের রাস্তাগুলো নিজেদের মধ্যে পেরেক মেরে রেখেছে।
আবার অন্য রকমও মনে হয়। মনে হয়, কারও অভাবে শহরটা যেন গভীর দুঃখে ভারাক্রান্ত, সেই শোক আর কাটিয়ে উঠতে পারছেনা। শোককে শক্তিতে রুপান্তরের কোন পথ জানা নেই। এই শহরের রাস্তায়, যে রাস্তাগুলো রাজপথ নামে নিজের পরিচয় দেয়, সেখানে সারি সারি গাড়িগুলোকে ঠিক গাড়ি মনে হয় না। মনে হয়, এরা প্রিন্সেস ডায়ানার অকাল প্রয়ানের পর লন্ডনের ওয়েস্টমিনিস্টার অ্যাবেতে শোক র্যালীতে যোগ দিয়েছে। কিংবা তেহরানের রাজপথ কাসেম সোলাইমানিকে শেষ বিদায় দেয়ার জন্য কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে সাইলেন্সার ফেলে দিয়ে তার স্বরে চেচিয়ে যাচ্ছে।
এবাদেও কথা আছে। জুয়ান স্যারের শহরে সত্যি সত্যি একজন জুয়ান স্যার আছে, আছে অনেক জুয়ান স্যার। ইংরেজির জুয়ান স্যার কবিতার আলাপই করেন বেশি। শেক্সপিয়ারের আলাপ, হেমিংওয়ে, রবার্ট ফ্রস্টের আলাপ। সে আলাপ পেটের ক্ষুধা মেটায় না ঠিক, প্রাণের তৃষ্ণায় গভীর নলকূপ দিয়ে জলসেচের ব্যবস্থা করে। জুয়ান স্যারেরা অকারনে হাসে, বিনা প্রয়োজনে অন্যদেরও হাসায়।
তার বিপরীতে গণিতের আলম স্যার হয়ত বসে আছে খাতা কলম, সায়েন্টিফিক ক্যালকুলেটর নিয়ে। এখন হয়ত চ্যাটজিপিটিরও সহায়তা নেন। খুব করে হিসাব মিলাতে চায়। কি করলে শহরে যানজট থাকবে না, ব্রয়লারে মরণঘাতি লেড থাকবেনা, বিজলি মহল্লায় ইয়াবা থাকবেনা, সাপ্লাইয়ের পানিতে কিলবিলিয়ে পোকা আসবে না।
আলম স্যার হিসেব করে ডানে বামে যেন হাতাহাতি না হয়, ঢাকা বনাম সিটি কলেজের মারামারি থেমে যায়, শাহবাগ শাপলা এক বিন্দুতে মিলে যায়। ব্যাটারি আর প্যাডেল রিকশায় কোপাকুপি না লাগে। কিন্তু বিধিবাম! এত চেষ্টা করেও লাভ হয় না, নাটক পাড়া সড়কের ভবনে আগুন লাগে, ডাচ ডিজিসের রাম-লক্ষণ সব বের হয়ে আসে।
তবুও মানুষ দিনরাত জুয়ান স্যারের শহর ছেড়ে আলম স্যারের শহরের দিকে ছুটতে থাকে। আলম স্যারের শহরের গভীর রাতে নাকি হ্যামিলিনের বাশিওয়ালা নেমে আসে। দু চারটা সুর তুলে সুবেহ সাদিকের আগে মিলিয়ে যায়। কিন্তু মিলিয়ে যায় না সেই সূর। সেই সূরের প্রেমে দিওয়ানা হয়ে, আশেকে বাশিওয়ালা হয়ে পিলপিল করে ছুটতে থাকে। আলম স্যারের শহরটা ছুয়ে দেখতে।
তাই গণিতের আলম স্যারের শহর ঘুমায় না। ঘুমাইতে পারে না। জেগে থাকে, সাত গুনিতক চব্বিশ। সেই সূরের মোহে আমিও এসে পড়েছি। জানি হিসেব মিলবে না, তবুও গণিতের আলম স্যারের কাছে অঙ্ক শিখে যেতে হবে।