একদম প্রথম যেইটা মনে পড়ে যে আমি কিছু একটার নীচে। জিনিসটা একটা টেবিল। আমি টেবিলের একটা পা দেখলাম। দেখলাম মানুষদের পা। টেবিলক্লথের একটা অংশ ঝুইলা নত হইয়া আসতেছে।
টেবিলের ঐ নীচে কেমন অন্ধকার আছিলো। ভাল্লাগতেছিল আমার ঐ নীচে বইসা থাকতে। তখন আমরা জার্মানিতে মনে হয়। আমার বয়স কত, এক বা দুই বছর হইব।
১৯২২ সাল তখন। আর টেবিলের নীচে ভাল্লাগতেছিল আমার। কেউ মনে হয় বিষয়টা খেয়াল করে নাই। আমি যে রইছি ওখানে অরা জানতেছিলো না। মানুষদের পা গুলার উপ্রে সূর্য আইসা পড়তেছিল। সেই সূর্যালোকরে ভাল্লাগে আমার। তেমন ইন্টারেস্টিং না অগো পা-গুলা। যেমন ইন্টারেস্টিং এই টেবিল ক্লথ, যে ঝুইলা থাকতে চায়। যেমন ইন্টারেস্টিং এই টেবিলের পা, এই রোদ। মানুষগো বিষয়টা সেরকম না। কম ইন্টারেস্টিং।
তারপর আর কিছুই নাই। তারও পরে হইল একটা ক্রিসমাস ট্রি। মোমবাতি। পাখির নকশা করা গয়না। পাখিগুলার ঠোঁটে একটা করে ডাল। জামগাছের ডাল ওগুলা। একটা নক্ষত্র। বড় বড় দুইটা মানুষ গেনজাম করতাছে। চিল্লাইতাছে। মারতাছে। আর খাইতাছে মানুষে। সারাক্ষণই খাইয়াই যাইতেছে মানুষরা। খাইতাম আমিও। আমার চামচটা আছিলো বাঁকা। যানি, আমি খাইতে গেলে ডান হাত দিয়া খাইতে হয়। বাম হাত দিয়া যদি চামচ উঠাই, তাইলে মুখের থেইকা চামিচ সইরা যাইতোগা।

হ্যারা দুইটা পাবলিক। একটা বেশী বড়। অর চুল কোকড়া। নাকটা বিশাল। মুখটাও বিশাল। অনেক ভুরু অর। এই সাইজে বড় লোকটা সারাক্ষণই রাইগা থাকে। বেশীর ভাগ সময়ই চিল্লায়। আরেকটা মানুষ যেটা ছোট কইরা, ওটা চুপ কইরা থাকে। অর মুখ গোল। মুখটা ফ্যাকাশে। বড় বড় মায়ভরা চোখ। দুইটারেই আমি ভয় পাইতাম। মাঝে মাঝে তিন নম্বর মানুষ একটা আসত। ঐটা মোটা কইরা। গলার কাছে ফিতা বান্ধা একটা জামা পড়ত অয়। এই বড় একটা ব্রুচ থাকত অর জামায়। এই মহিলাটার মুখ ভর্তি আঁচিল। আঁচিলগুলা থেইকা চুল গজাইতেছিল। এই বেডিরে অরা ডাকত “এমিলি।”
এই লোকগুলারে দেখতাম আমি। মনে হইত অরা খুশি না একে অন্যের লগে। এমিলি আছিলো দাদী। আমার আব্বার আম্মা। আমার বাপের নামাছিলো হেনরি। আম্মার নামাছিলো ক্যাথেরিন। নাম ধইরা ডাইকা তাগো লগে আলাপ করি নাই কোনদিন আমি। আমি আছিলাম “হেনরি জুনিয়ার”।
বেবাক লোগে হারাক্ষণ জার্মানে কথা কইত। আর কয়দিন পরে অগো লগে আমিও জার্মান কইবার লাগি।
দাদীর প্রথম যে কথাটা আমার মনে আছে যে তিনি বলতেছিলেন , “কুত্তার বাচ্চা তগো সবকটারে আমি কবর দিয়া দিমু !” প্রথম যখন তিনি এই কথাটা কইলেন তখন আমরা এই-খাওয়া-শুরু-করুম এইরকম আরকি। পরেও আরো অনেকবার কথাটা কইছিলেন দাদী। প্রতিবারই খাওয়া শুরুর আগে দিয়া।
যেমন বুঝতাম, খাওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ আর জরুরী বিষয় আছিলো। আলুর ভর্তা খাইতাম আমরা। লগে ঝোল। বিশেষ করে রোববার তো ঝোল থাকতই। আরও খাইতাম আমরা গরুর মাংসের রোস্ট। তারপর শুয়ারের মাংসের সসেজ। আর কাঁচা বাঁধাকপি ঝুরি কইরা বানানো গাজানো সালাদ। আমরা খাইতাম মটরশুঁটি, রাবার্ব, গাজর, পালংশাক, শিম, মুরগি, কোপ্তা আর স্প্যাগেটি। অনেক সময় লগে রাভিওলি থাকত। মাখায় খাইতাম ওইটা দিয়া। থাকত সেদ্ধ পেয়াজ, এসপারাগাস। প্রত্যেকে রবিরার ভ্যানিলা আইসক্রিম দিয়ে স্ট্রবেরী শর্টকেক খাইতাম আমরা। নাশতায় খাইতাম ডিমে ডুবায়া ভাজা পাউরুটি আর সসেজ। আর নাইলে হটকেক বা ওয়াফেল থাকত। লগে বেকন আর গুড়া ডিমের ভূনা। সবসময় যেটা থাকতই সেটা হইল কফি। কিন্তু এই সমস্তর ভিত্রে মনে আছে সবচেয়ে ভালো কইরা খালি আলু ভর্তা আর ঝোলের কথা, লগে আমার দাদী, এমিলি, কইতেছেন, “ তগো সবকটারে আমি কবর দিয়া দিমু!”
পরে আমরা এম্রিকা চইলা আসি। তখনও দাদী আসতেন প্রায়ই আমগোরে দেখার লাইগা। পাসাদেনা থেইকা লস এঞ্জেলস যাইত একটা লাল ট্রলি। ঐটায় চইড়া দাদী আসতেন। আমরা ওনারে খুব বেশী দেখতে যাইতাম না। গেলে, মডেল টি ফোর্ডটা চালায় যাইতাম।
দাদীর বাসাটা আমার পছন্দ আছিলো। ছোট্ট বাসা। ওপরে শামিয়ানার মত দুইটা পিপার গাছের অবিন্যস্ত ডালাপালা। এমিলি ক্যানারি পাখি পালতেন। এক একটা পাখি এক এক খাচায় রইত। দাদীর বাসায় যাওয়ার একটা বারের কথা আমার বেশী স্মরণ রইছে। ঐদিনের সন্ধ্যা তখন। দাদী সাদা চাদর দিয়ে খাচাগুলা ঢাইকা দিতেছেন। পাখিগুলা যানি ঘুমাতে পারে। লোকজনগুলা চেয়ারে বইসা ছিল আশেপাশে। কথা কইতেছে এই সেই লয়া। একটা পিয়ানো আছিলো। আমি গিয়া পিয়ানোর ধারে বসি। একটা দুটা বোতাম চাপি। বাজনা হইতেছিল। মানুষের কল-কল, মধ্য দিয়া বাজনা। আমি শুনতেছিলাম। সবচেয়ে ভাল্লাগতেছিল পিয়ানোর এক্কেরে শেষ মাথার চাবিটা। ঐদিকটায় তেমন কোন শব্দই হইতেছিল না। এই চাবিটা চাপাইলে মনে হয় তুষার কণা ঝরতেছে। একটা আরেকটার লগে ঠোকাঠুকি কইরা আওয়াজ হইতেছে।
“ থামবি, অই হারামজাদা..” বাপে চিল্লায়া কইল
“ এমন করস কেন? বাজাক না পোলায়,” কইল আমার দাদী।
আম্মায় অল্প কইরা হাসলেন।
“এই পোলা,” দাদী কয়, ”অরে আমি দোলনা থেকে উঠাইসি আদর করব, ওমা পোলায় আমার নাকের ওপর মারসে এক ঘুষি!”
হ্যারা আরও কি কি জানি কয়। আমি পিয়ানো বাজাতে থাকি।
“ এই পিয়ানো টিউনিং করাও না ক্যান?” আব্বা জিগাইলেন।
তারপর আমারে জানানো হইল যে এখন আমার দাদারে দেখতে যাব। আমার দাদা আর দাদী একলগে থাকতেছিলেন না। আমারে কওয়া হইছিল যে আমার দাদা লোক খারাপ। হ্যার মুখ দিয়ে গন্ধ আসে।
“ মুখ দিয়ে গন্ধে আসে কেন?”
অরা উত্তর দেয় নাই।
“ ক্যান মুখ দিয়ে গন্ধ আসে ?”
“ মদ খায় এই জন্যে।”
আমরা মডেল টি-তে উঠলাম। গাড়ি চলতেছিল। আমার দাদার নাম লীওনার্ড। এই লীওনার্ডরে দেখতে যাইতেছিলাম আমরা। গাড়ি যখন আইসা থামল, দেখলাম যে বাড়ির পোর্চে খাড়ায় রইছেন আমার দাদা। তিনি অত্যন্ত বুইড়া। তারপরও কেমন ঋজু হইয়া দাড়াইছিলেন। এককালে আর্মির অফিসার ছিলেন উনি। জার্মানিতে। আম্রিকায় আইছিলেন, কারণ লোকজন তারে কইছিল যে আম্রিকার রাস্তাঘাট সোনা দিয়া বান্ধানো। বাতাসে পয়সা ওড়াওড়ি করে। খাবলা মাইরা ধরলেই হইল। কিন্তু ঘটনা সেরকম হয় নাই। যেকারণে দাদা পরে, বাড়ি বানায় যে ঐ ব্যবসাগুলার একটা করছিলেন।
আমার লগের আরও লোকজন যারা ছিল তারা কেউ গাড়ি থেইকা নামল না। দাদা আমার দিকে একটা আঙুল নাড়াইলেন। একজন কেউ গাড়ির দরজা খুইলা দেয়। আমি নামি। হাঁইটা ওনার দিকে যাইতে থাকি। দাদার চুল ধবধবা সাদা। অনেক লম্বাও। তার দাড়িও বিশুদ্ধ ধবধবা সাদা। আর লম্বাও। আরও কাছে যাওনের পরে তার চোখ জোড়া খেয়াল করলাম আমি। তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমান দু’টা চোখ। নীল রঙের আলোর মত ধিকধিক করে জ্বলতেছে। আমারে দেখতেছে। আমি ওনার থেইকা একটু দূরে থাইমা দাড়াই।
“হেনরি,” তিনি বললেন, “তোমার আর আমার তো আগেও দেখা হয়েছে। আসো, বাড়ির ভেতরে আসো।”
তিনি হাত বাড়ায়া দেন। আরেকটু কাছে গিয়া আমি তার নিঃশ্বাসের বদঘ্রান পাই। অত্যান্ত কড়া ঘ্রাণ। কিন্তু উনি ছিলেন আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে সুন্দর পুরুষ মানুষ। আমি ভয় পাইলাম না।
আমি দাদার লগে তার বাড়ির ভিত্রে ঢুকলাম। তিনি আমারে একটা চেয়ারে বসাইলেন।
“ বস, বস, প্লিজ। খুবই খুশি হচ্ছি তোমাকে দেখে।”
তিনি আরেকটা ঘরে গেলেন গা। ফেরত আসলেন একটা ছোট্ট টিনের বাক্স হাতে।
“ এটা তোমার জন্য। খুলে দেখ কি।”
আমি ঢাকনা খুলার চেষ্টা করি। পারি না। কেমন গেনজাম লাগে।
“ দেখি,” তিনি বললেন, “ আমাকে দাও দেখি, আমি খুলে দেই।”
তিনি ঢাকনাটা আলগা কইরা দিলেন। টিনের বাক্সটা ফিরায়া দিলেন আমরা হাতে। আমি ঢাকনা তুললাম, আর ভিত্রে পাইলাম একটা ক্রুশ। একটা জার্মান ক্রুশ। সাথে রঙিন ফিতা বান্ধা।
“ আরে না না,” আমি বললাম, “ আপনে রেখে দেন এইটা।”
“ এটা তোমার,” তিনি বললেন, “ এমন কিছু তো না। সামান্য একটা গামি-ব্যাজ।”
“ থ্যাঙ্কিউ।”
“ আচ্ছা, তুমি যাও এখন। ওরা দুশ্চিন্তা করবে।”
“ আচ্ছা। গুডবাই।”
“ গুডবাই হেনরি, আচ্ছা, না একটু দাড়াও…”
আমি খাড়াইলাম। তার প্যান্টের সামনে একটা ছোট পকেট। তিনি ওটাতে কয়েকটা আঙুল ঢুকাইলেন। অন্য হাত দিয়া একটা লম্বা সোনার চেইন ধইরা টানতে লাগলেন। তারপর তিনি আমাকে তার সোনার পকেট ঘড়ি আর চেইনটা দিয়া দিলেন।
“ থ্যাঙ্কিউ দাদা…”
বাকী লোগ হ্যারা বাইরে ওয়েইট করতেছিল। আমি গিয়া মডেল টিতে উঠলাম। গাড়ি গেলগা।
রাস্তায় কত কিছু নিয়া আলাপ করতেছিল গাড়ির মানুষগুলা। সারাক্ষণই এরা কথা কইতে থাকে। শেষই হয় না তাগো আলাপ। এমনে কইতে কইতেই আমার দাদীর বাসা পর্যন্ত চইলা গেলাম। বেবাক বিষয়ে নিয়ে আলাপ করল হ্যারা। কিন্তু একবার, এক লহমার লাইগাও, আমার দাদার বিষয়ে কিচ্ছু বলল না।
(to be continued…)