Posts

প্রবন্ধ

এ স্টাডি অফ ড্রিমস

April 28, 2025

এমদাদুল

Original Author ফ্রেডেরিক ভ্যান ইডেন‌

Translated by ডীপসীক এআই

116
View

এ স্টাডি অফ ড্রিমস/ [A Study of Dreams]
ফ্রেডেরিক ভ্যান ইডেন‌/ [Frederik van Eeden]

Frederik van Eeden, 1895
Image from wikipidia

১৮৯৬ সাল থেকে আমি আমার স্বপ্নগুলি অধ্যয়ন করে আসছি আর সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্বপ্নগুলি ডায়েরিতে লিখে রাখছি। ১৮৯৮ সালে আমি একটি ভিন্ন রেকর্ড রাখতে শুরু করি, সেই সকল বিশেষ স্বপ্নগুলো লিপিবদ্ধ করার জন্য যেগুলো আমার কাছে আরো বেশী গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হচ্ছিল, এবং আজ পর্যন্ত সেটা চালিয়ে যাচ্ছি। সর্বমোট প্রায় ৫০০টি স্বপ্ন আমি সংগ্রহ করেছি, যার মধ্যে ৩৫২টি স্বপ্ন হল উল্লিখিত বিশেষ ধরণের স্বপ্ন। আমি আশা করি এই উপাত্তগুলি একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক কাঠামো গড়ে তুলবে যদি সময় আর সামর্থের কারনে আমি ব্যার্থ না হই।

স্বপ্ন ধারণাগুলি সময় মতো প্রকাশ করা যাবে না, এমন একটা উদ্বেগের কারণে আমি সেগুলিকে দ্যা ব্রাইড অফ ড্রিমস[The Bride of Dreams] নামক একটি উপন্যাসে অন্তর্ভুক্ত করেছি। এই ফিকশনাল ফর্মটি আমাকে এর সুক্ষ্ণ বিষয়গুলোকে স্বাধীনভাবে উপস্থাপন করার সুযোগ করে দিয়েছে, আর একই সাথে এই সবিশেষ ধারণাগুলোকে অপেক্ষাকৃত কম আক্রমণাত্মক উপায়ে প্রকাশ করার সুবিধা দিয়েছে। তবুও, এই ধারণাগুলোকে আমি এমন ভাবে প্রকাশ করতে চেয়েছি যেন বৈজ্ঞানিক মনে এটি সরাসরি আবেদন তৈরি করতে পারে; আর এই উদ্দেশ্যে সোসাইটি ফর সাইকিক্যাল রিসার্চের সদস্যদের চাইতে উপযুক্ত শ্রোতা আমি আর পাবো না এটা আমি জানি, যারা ইনভেস্টিগেটিভ চিকিৎসায় অভ্যস্ত আর অপ্রথাগত বিষয়গুলোর জন্য প্রসস্থ মানসিকতার এবং একই সাথে সমালোচনামূলক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার বিশ্লেষনে অভ্যস্ত।

এই লিখাটি কেবল একটি প্রথমিক খসড়া, বৃহত্তর কাজের একটি ক্ষুদ্র বিবৃতি, যা পরবর্তী বছরগুলোর মধ্যেই সম্পূর্ণ করতে পারবো বলে আমি আশা করি।
 
আমি যতটা সম্ভব অনুমান নির্ভর ভাবনা এড়িয়ে যাব এবং তথ্য নির্ভর থাকার চেষ্টা করবো; তবুও আমি যতটুকু এই তথ্যগুলো পর্যাবেক্ষণ করেছি, সেগুলো আমাকে সাধারন ভাবে এই দৃঢ় বিশ্বাস দেয় যে এগুলোই স্বপ্ন-জীবন[dream-life] এর ত্তত্বসমূহ, আমার জানা মতে, আজ পর্যন্ত আমাদের সামনে যেসকল ত্তত্ব আনা হয়েছে, এগুলো ঘটমানবিষয়কে বর্ণনা করতে সর্বক্ষেত্রে সক্ষম নয়।


এখন আপনাদের বিভিন্ন ধরনের স্বপ্নের একটি শ্রেনীবিন্যাস বলার চেষ্টা করছি, যা আমি ষোল বছর ধরে অভিজ্ঞ হয়েছি এবং পর্যবেক্ষণ করেছি। এর ফলে আমি নয়টি ভিন্ন ধরনের স্বপ্নকে পৃথক করতে সক্ষম হয়েছি, যার প্রতিটি স্বপ্ন একটি সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ঠ উপস্থাপন করে। এই স্বপ্নগুলোতে নিশ্চিতভাবে মধ্যবর্তী ফর্মের সংমিশ্রন এবং উপস্থিতি আছে, এরপরও এই মিশ্রিত অবস্থায় ধরনগুলোর পার্থক্য সহজে বোঝা যায়।
 
প্রথম ধরনের স্বপ্ন; ইনিশিয়াল ড্রিমস[initial dreams]। এই ধরনে স্বপ্ন বিরল; আমার বেলায় এমন স্বপ্ন কেবল অধা ডজন ঘটছে, এছাড়া আর কারো কাছ থেকে এ ধরনের স্বপ্নের কোন ইঙ্গিত আমি পাইনি। তবে, এই ধরনটি খুবই বৈশিষ্ঠপূর্ণ এবং সহজেই আলাদা করা যায়। এটা কেবল ঘুমের শুরুতেই হয়, যখন শরীরটা স্বাভাবিক সাস্থ্যকর অবস্থায় থাকে, এবং খুব ক্লান্ত। এই স্বপ্নে জাগ্রত স্তর থেকে ঘুমন্ত স্তরের রূপান্তরটি, যেটাকে সাধারনত সংজ্ঞাহীনতা[unconsciousness] বলা হয়, সেটি খুব কম সময়ের জন্য হয়; আমি যেটাকে স্মৃতির বিচ্ছিন্নতা[discontinuity of memory] বলতে পছন্দ করি। মোরি[Alfred Maury] হিপনোগোজিক হ্যালুসিনেশন[hypnagogic hallucination] বলেছেন এই স্তরকে, যদিও এটি কিন্তু সেটি নয়, এটার প্রপঞ্চ আমার বেশ ভালো করেই জানা আছে এবং আমি তাতে অভিজ্ঞ; এরপরও আমি এই স্তরকে স্বপ্ন জগতের অন্তভুক্ত বলে বিবেচনা করি না। হিপনোগোজিক হ্যালুসিনেশনের সময় আমাদের দৃকশক্তি[visions] থাকে, সেইসাথে আমাদের শারীরিক সম্পূর্ণ উপলব্ধিসমূহ থাকে। অন্যান্য স্বপ্ন ধরনের মতই ইনিশিয়াল স্বপ্নে আমরা দেখতে পাই আর অনুভূতি পাই। দিন-জীবনের স্মৃতি সম্পূর্ণ স্মরণে থাকে আমাদের, আমি জানি আমি ঘুমাচ্ছি এবং আমি কোথায় ঘুমাচ্ছি, কিন্তু শারীরিক শরীরের সকল উপলব্ধি, ভিতর আর বাহির, ভিসারাল[visceral] বা পেরিফেরাল[peripheral] সকল উপলব্ধি পুরোপুরি অনুপস্থিত থাকে। সাধারণত উড়ছি বা ভাসছি এমনটা অনুভূত হয়; এবং আমি স্পষ্ট পর্যবেক্ষণ করি যে আমার অবসাদগ্রস্থতা, মাত্রারিক্ত শারীরিক খাটুনির ক্লান্তি বোধ আর থাকে না। আমি সতেজ ও সবল বোধ করি, আমি যেকোন দিকে নড়াচরা করতে পারি এবং ভেসে থাকতে পারি; এরপরও আমি জানি আমার শরীর ভয়ঙ্কর ক্লান্ত এবং আমি ঘুমন্ত।

সতর্ক পর্যবেক্ষণের ফলসূতিতে আমি দৃঢ় বিশ্বাস করি যে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ঘুমন্ত ব্যাক্তির শারীরিক পরিস্থিতি, স্বপ্নে তার চরিত্রের উপর প্রভাব ফেলে না— গুটিকয়েক বিরল আর অস্বাভাবিক ক্ষেত্র ছাড়া, বা জেগে উঠার মুহুর্তের কাছাকাছি সময় ছাড়া; কিংবা সেই দ্বিতীয় ধরনের স্বপ্ন ছাড়া, যেটাকে আমি প্যাথলজিক্যাল[pathological] স্বপ্ন হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করেছি, সেসব ক্ষেত্রে যেখানে জ্বর, বদহজম আর বিষক্রিয়া, একধরনের ভূমিকা পালন করে, এবং এটা সংখ্যায় কম। একজন পর্যবেক্ষক হিসাবে নিজের ক্ষেত্রে, আমি বলতে পারি যে পর্যবেক্ষণের পুরো সময় জুড়ে আমি সম্পূর্ণ সুস্থ ছিলাম। স্নায়বিক বা শারীরিক কোনো গুরুতর সমস্যা আমার ছিল না। আমার ঘুম আর হজমশক্তি— দুটাই সাধারনত ভালো হয়। সবসময়ের মতই আমার শরীর সতেজ আর স্বাস্থ্যকর থাকা অবস্থায়ও আমি অত্যন্ত ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন দেখেছি; আবার প্রবল ঝড়ের মধ্যে জাহাজে বা রেলওয়ের স্লিপিং-কারে আমি শান্তিদায়ক ও সুখকর স্বপ্ন দেখেছি। 

ফলে, আমি প্রকৃত স্বপ্নগুলোকে সেই দশা হিসাবে সংজ্ঞায়িত করতে চাই যেখানে শারীরিক সংবেদনগুলি— তা হোক আভ্যন্তরীণ[visceral], দৈহিক বা প্রন্তীয়— সরাসরি মনের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে পারে না; বরং কেবল একটি প্রতীক[symbol] বা ছবি[image] -র শারীরিক ও অ-স্থানিক[nonspatial] রূপে প্রবেশ করে।
 
আমি ইচ্ছে করেই "সচেতনতা"[consciousness] আর "অসচেতনতা"[unconsciousness] শব্দ দুটি যতটা পারছি এড়িয়ে যাচ্ছি। সাধারণ কথোপকথনে এগুলি ব্যবহার সুবিধাজনক হতে পারে, কিন্তু আমি এগুলোর কোনও স্পষ্ট অর্থ খুঁজে পাই না। "অসচেতনতা" নামক একটি স্বতন্ত্র সত্তা কী নির্দেশ করে, তা আমার ধারণার বাইরে। বরং আমি দেখেছি যে "স্মৃতি"[memory], "স্মরণ"[recollection], এবং "ব্যক্তিত্ব" [personality] বা "ব্যক্তি"[person] শব্দগুলি— যেখানে "ব্যক্তি" বা "পার্সোনা" [persona] এর আদিম অর্থে নেওয়া হয়েছে (অর্থাৎ, নাট্যাভিনয়ে ব্যবহৃত মুখোশ)— দিয়ে আমার কাজ চলে যায়। ঘুমন্ত বা মাদকনিদ্রালু ব্যক্তির দেহকে "অসচেতন" বলা আমার কাছে যথার্থ মনে হয় না। সাইকোথেরাপিস্ট হিসেবে আমার অভিজ্ঞতায়, অসংখ্য মানুষকে সম্মোহনের মাধ্যমে ঘুম পাড়ানোর সময় আমি লক্ষ করেছি যে, মানবদেহ স্মৃতিধারণকারী মনের কোনো অংশগ্রহণ ছাড়াই একটি স্ব-সচেতন ব্যক্তির মতো আচরণ করতে পারে। বর্তমানে আমরা জানি যে, মানুষের ব্যক্তিত্ব বিভাজন কেবল দুটি নয়, বরং তিন বা ততোধিক অংশে সম্ভব। মিসেস থম্পসনের সাথে আমার অধিবেশনগুলোর সময়, আমরা পর্যবেক্ষণ করেছি যে, এক ট্র্যান্স অবস্থার পর— যেখানে মিসেস থম্পসন "নেলি" বা অন্য কোনো "নিয়ন্ত্রক সত্তা"[control] হিসেবে কথা বলেছিলেন— তিনি নিজে সম্পূর্ণ ভিন্ন স্বপ্ন দেখতে পারতেন, যা তার বলা বিষয়বস্তুর সাথে কোনো সম্পর্কই রাখত না। তখন তার সত্তাকে তিনটি ভিন্ন সত্তায় বিভক্ত বলা যেতে পারে: ট্র্যান্সে থাকা দেহ (যা বাইরে থেকে ঘুমন্ত বলে মনে হয়), "নিয়ন্ত্রক সত্তা" (যা তার মুখ দিয়ে কথা বলে), আর মিসেস থম্পসন নিজে (যিনি সম্পূর্ণ অন্য জগতে স্বপ্ন দেখছিলেন)। এই সব "ব্যক্তি" বা "ব্যক্তিত্ব" কোনো না কোনোভাবে "সচেতন" ছিল— যেমন সম্ভবত সবকিছুই কোনো না কোনো স্তরে সচেতন। প্রশ্ন হলো, স্মৃতির এই যোগসূত্রগুলি কোথায় প্রবাহিত হয়, যা আমাদেরকে এই ব্যক্তিত্বগুলিকে চিহ্নিত করতে সক্ষম করে?
 
আমি জানি যে মিস্টার হ্যাভলক এলিস এবং অন্যান্য অনেক লেখক আমার সংজ্ঞা মেনে নেবেন না, কারণ তারা স্বপ্নে সম্পূর্ণ স্মৃতি এবং স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির এই সম্ভাবনাকে অস্বীকার করেন। তাদের মতে, আমি যেটাকে স্বপ্ন বলছি তা আসলে স্বপ্ন নয়, বরং এক ধরনের ট্র্যান্স, হ্যালুসিনেশন বা ধ্যানাবস্থা। মার্কি দ্য হার্ভ’র[Marquis d’Herve] পর্যবেক্ষণও— যা তার বই "লে রেভে এ লে ময়েন্স দি লে দিরিজে"[Les Rêves et les moyens de les diriger] বর্ণিত হয়েছে, যেগুলো আমার মতোই ছিল, তাকেও একইভাবে খারিজ করে দেওয়া হয়েছিল। এগুলো স্বপ্ন হতেই পারে না, এমনটা বলেছিলেন মোরি।
 
এটি আসলে পরিভাষা নির্বাচনের[nomenclature] একটি প্রশ্নমাত্র। আমি কেবল এতটুকু বলতে পারি যে, আমার পর্যবেক্ষণগুলো সম্পূর্ণ স্বাভাবিক, গভীর ও সুস্থ ঘুমের মধ্যে সংঘটিত হয়েছিল। ৩৫২টি ঘটনায় আমি আমার দৈনন্দিন জীবনের পূর্ণ স্মরণশক্তি ধরে রাখতে পেরেছিলাম এবং স্বেচ্ছাপ্রণোদিত ভাবে কাজ করতে সক্ষম হয়েছিলাম— অথচ আমি এত গভীর ঘুমে ছিলাম যে, কোনো শারীরিক সংবেদনই আমার উপলব্ধিতে প্রবেশ করতে পারেনি। যদি কেউ এই মানসিক অবস্থাকে "স্বপ্ন" বলতে অস্বীকার করেন, তবে তিনি অন্য কোনো নাম প্রস্তাব করতে পারেন। আমার ক্ষেত্রে, এটি স্বপ্নের একটি বিশেষ রূপ— যাকে আমি "লুসিড ড্রিমস"[lucid dreams] নামে অভিহিত করি; যেটা আমার গভীর আগ্রহ জাগিয়েছিল এবং আমি এই স্বপ্নগুলোই সর্বচ্চো সতর্কতার সাথে লিপিবদ্ধ করেছি।
 
আমি মি. হ্যাভলক এলিসের[Havelock Ellis] সাথে একমত যে ঘুমের সময় মানসিক কার্যাবলি বিচ্ছিন্নতা’র[dissociation] ক্ষেত্রে প্রবেশ করে। তবে আমার যুক্তি হলো যে, এই বিচ্ছিন্নতা স্বপ্নের মূল বৈশিষ্ট্য নয়; বরং ঘুমজনিত বিচ্ছিন্নতার পর পুনঃএকত্রীকরণ[reintegration]-ই স্বপ্নের মূল চালিকাশক্তি। স্বপ্ন হলো মানসিক সত্তা’র[psyche] একটি আংশিক বা সম্পূর্ণ পুনঃএকত্রীকরণ— একটি ভিন্ন মাত্রায়, একটি অ-স্থানিক[nonspatial] মানসিক অস্তিত্বের রূপে এই পুনঃএকত্রীকরণ ঘটে। এই পুনঃএকত্রীকরণ এতদূর পর্যন্ত যেতে পারে যে, এতে দৈনন্দিন জীবনের পূর্ণ স্মৃতি, চিন্তনশীলতা এবং ইচ্ছাকৃত কর্মকাণ্ড সম্ভবপর হয়।
 
তৃতীয় প্রকার, যা অডিনারি ড্রিমিং[ordinary dreaming] নামে পরিচিত, এটি সেই প্রচলিত ও সুপরিচিত ধরন যা অধিকাংশ স্বপ্নের সাথে মিলে যায়। সম্ভবত, এটিই একমাত্র ধরণ যা অনেক লোকের ক্ষেত্রেই ঘটে। এটি বিশেষভাবে আনন্দদায়ক বা অপ্রীতিকর নয়, যদিও বিষয়বস্তুর উপর নির্ভর করে এর প্রকৃতি পরিবর্তন হতে পারে। এটি ঘুমের যেকোনো মুহূর্তে, দিনে বা রাতে ঘটতে পারে এবং এই স্বপ্নের জন্য কোনো শারীরিক গোলমালের প্রয়োজন হয় না।


এই স্বপ্নগুলোতে বিচ্ছিন্নতা[dissociation] দেখা যায়, অত্যন্ত অসম্পূর্ণ পুনঃএকত্রীকরণ[reintegration]-এর সাথে— এবং যেমনটা বিভিন্ন লেখক উল্লেখ করেছেন— এগুলো অনেক ক্ষেত্রে পাগলামির[insanity] সাথে ঘনিষ্ঠ সাদৃশ্য বহন করে। দৈনন্দিন জীবনের প্রকৃত অবস্থা এখানে স্মরণ থাকে না; মিথ্যা স্মৃতি[paramnesia]— এতে অত্যন্ত সাধারণ; এগুলো অযৌক্তিক ও বিশৃঙ্খল, এবং জাগরণের পর খুব অস্পষ্ট চিহ্ন রেখে যায়।
 
চতুর্থ প্রকার, ভিভিড ড্রিমিং[vivid dreaming]। সাধারণ স্বপ্ন থেকে এর প্রাণবন্ততা[vividness] এবং গভীর প্রভাবের কারণে মূলত এটি আলাদা, যা জাগরণের পরও কখনও কখনও ঘণ্টা বা দিনব্যাপী স্থায়ী হয়— প্রতিটি বিবরণের একটি যন্ত্রণাদায়ক স্পষ্ট স্মৃতি থাকে। এই স্বপ্নগুলো সাধারণত কিছু অস্বাভাবিক শারীরিক অবস্থার প্রভাব হিসেবে বিবেচিত হয়। তবে আমার মতে, এগুলোকে অবশ্যই রোগসংক্রান্ত স্বপ্ন থেকে পৃথক রাখা উচিত। সম্পূর্ণ স্বাভাবিক শারীরিক অবস্থায় এই স্বপ্নগুলো আমি অভিজ্ঞতা করেছি। তবে এটা বলছি না যে কিছু স্নায়বিক ব্যাঘাত, মানসিক অস্থিরতা বা জাগ্রত বিশ্বের কোনো অজানা প্রভাবের উপস্থিত ছিল না। সেগুলো থাকতে পারে, কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমার পর্যবেক্ষণের সেগুলো আসে নি। এই ভিভিড ড্রিমগুলো সাধারণত অত্যন্ত অযৌক্তিক বা অসত্য হয়, যদিও স্পষ্ট এবং ভালভাবে মনে রাখা যায় এই স্বপ্নগুলো। এখানে মন সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন থাকে এবং পুনঃএকত্রীকরণ অত্যন্ত ত্রুটিপূর্ণ হয়।


এই স্বপ্নের অযৌক্তিকতা, উন্মাদ চরিত্র এবং তাদের দ্বারা সৃষ্ট দীর্ঘস্থায়ী প্রভাবের কারণে সাধারণত আমি এই স্বপ্নগুলিকে অপ্রীতিকর বলে মনে করি। সৌভাগ্যক্রমে এগুলো বিরল, অন্তত আমার ক্ষেত্রে। কখনও কখনও এগুলো এমন একটি প্রবল বিশ্বাস দেয় যে এগুলো "অর্থবোধক", এগুলোর একটি পূর্বাভাসমূলক, একটি ভবিষ্যদ্বাণীপূর্ণ চরিত্র রয়েছে। এবং যখন আমরা ভবিষ্যদ্বাণীপূর্ণ স্বপ্নের উদাহরণ পড়ি, তখন সাধারণত দেখি যে সেগুলো এই শ্রেণির অন্তর্গত। আমার ক্ষেত্রে আমি প্রায়ই দেখেছি যে সেগুলো সত্যিই কোন "অর্থ" তৈরি করে না; যদিও কখনও কখনও আমি এতটা নিশ্চিত ছিলাম না। এটি নির্ভর করে আমরা কোন দিকে কারণ খুঁজছি তার উপর।

এক রাতে, যখন আমি বক্তৃতা সফরে ছিলাম, একটি প্রাদেশিক শহরের আমি একটি পরিবারের অতিথি হিসেবে ছিলাম এবং আমি যে ঘরটিতে ঘুমিয়েছিলাম সেটিকে আমি অতিথি ঘর বলে ধরে নিয়েছিলাম। সবচেয়ে ভয়াবহ স্বপ্নে ভরা একটি রাত কাটালাম আমি, একটি দীর্ঘ বিভ্রান্তিকর দুঃস্বপ্ন, যার মধ্যে একটি শক্তিশালী অনুভূতি ছিল যে এটি "অর্থবহ"। যদিও আমি সম্পূর্ণ সুস্থ, প্রফুল্ল এবং স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করছিলাম। পরের দিন সকালে নাস্তার টেবিলে আমি না বলে থাকতে পারিনি যে কী অপ্রীতিকর রাত আমি কাটিয়েছি। তখন পরিবারটি আমাকে বলল যে আমি ওদের মেয়ের ঘরে ঘুমিয়েছিলাম, যে একটি গুরুতর স্নায়বিক রোগে, এখন হাসপাতালে রয়েছে, এবং যে এই ঘরটিকে তার "নির্যাতন আস্তানা" বলে ডাকত।
 
লক্ষণীয় বিষয় হলো যে, এমন ভিভিড ড্রিমগুলো কখনও কখনও অত্যন্ত আনন্দদায়ক ধরণেরও হয়ে থাকে, যা সমগ্র দিনটিকে এক অবর্ণনীয় আনন্দে পূর্ণ করে দেয়। এটি সত্য হলেও আমার অভিজ্ঞতা অনুযায়ী, আমার প্রাণবন্ত আনন্দদায়ক স্বপ্নগুলো এখন সর্বদা ভিন্ন ও উচ্চতর ধরণের। শৈশবে আমি এই রকম মুখরোচক প্রাণবন্ত স্বপ্ন দেখতাম। এখন এগুলো তাদের ধরণ সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তন করেছে এবং লুসিড ধরণ[lucid type]-এ উন্নীত হয়েছে।
 
পঞ্চম প্রকারের স্বপ্ন, সিম্বলিক[symbolic] বা মকিং ড্রিমস[mocking dreams]। এই স্বপ্নের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ উপাদানটি আমি দানবীয় বলে আখ্যায়িত করি। আমার আশঙ্কা এই শব্দটি খানিকটা অস্বীকৃতি, অথবা অন্তত কিছু হাসি বা উপহাস সৃষ্টি করবে, তবুও আমি বিশ্বাস করি এই পরিভাষাটির ব্যবহার আমি সফলভাবে রক্ষা করতে পারব। আমি অবিলম্বে স্বীকার করছি যে, যাদের আমরা "দানব" বলতে পারি তাদের প্রকৃত অস্তিত্ব প্রশ্নসাপেক্ষ, কিন্তু এরপরও বিজ্ঞানীরা এই ধারণাটিকে খুবই উপযোগী ও সুবিধাজনক বলে মনে করেন।
 
"দানবীয়" অভিব্যক্তিটিকে আমি নিম্নরূপে সংজ্ঞায়িত করে, আমার সবচেয়ে সংশয়বাদী শ্রোতাকেও সন্তুষ্ট করতে পারবো বলে আমি আশা করি:
 
আমি সেই সমস্ত ঘটনাকে "দানবীয়" আখ্যা দিই যেগুলো আমাদের উপর এমন প্রভাব সৃষ্টি করে যে, মনে হয় এগুলো অত্যন্ত নিম্ন নৈতিক মানের কোনো বুদ্ধিমান সত্তা দ্বারা সৃষ্টি বা সাজানো হয়েছে।
 
আমার কাছে মনে হয় যে ফ্রয়েড এবং তার অনুসারীদের দ্বারা বর্ণিত বেশিরভাগ স্বপ্নগুলি এবং তার জটিল তত্ত্ব গঠনে ব্যবহৃত স্বপ্নগুলোর বেশিরভাগই এই প্রকার স্বপ্নের অন্তর্ভূক্ত। স্বপ্নের প্রতীকীবাদকে বৈজ্ঞানিক জগতে পরিচয় করা নিঃসন্দেহে একটি সাহসী কাজ এবং এটি ফ্রয়েডের মহান অর্জন।


কিন্তু এখন বিবেচনা করা যাক "প্রতীক" শব্দটি কী অর্থ প্রকাশ করে। প্রতীক হলো একটি চিত্র বা কাল্পনিক ঘটনা, যা কোনো বাস্তব বস্তু বা ঘটনার প্রতিনিধিত্ব করে এবং যার সাথে এর দূরবর্তী মিল থাকে। এখন, একটি প্রতীকের উদ্ভাবন কেবলই চিন্তা ফলপ্রসূ একটি কাজ হতে পারে অর্থাৎ কোনো বুদ্ধিমান সত্তার কাজ। প্রতীকগুলি নিজেরা নিজেদের উদ্ভাবন করতে পারে না; এগুলো অবশ্যই চিন্তা করে বের করতে হয়। এবং প্রশ্ন হয়, কে এই বুদ্ধিবৃত্তিক কাজটি সম্পাদন করে; কে প্রতীকটি চিন্তা করে বের করে? ফ্রয়েডীয় স্কুলের দেওয়া উত্তর হলো, অবচেতন মন। এটা অবশ্য জার্মান এই প্রবাদের মতই, “wo die Begriffe fehlen”[বুঝতে যখন নারি, কথায় ভরসা করি]। আমার কাছে "অবচেতন" শব্দটি, একটি চিন্তাশীল সত্তাকে নির্দেশ করে, এটি ঠিক ততটাই রহস্যময়, ততটাই অবৈজ্ঞানিক; যতটা "অপ্রাকৃত" শব্দটি, যেমনটা "দানব" শব্দটি। আমার মতে, এটি নির্ভুলভাবে বলা যায় যে, স্বপ্নে আমরা যে চিত্রগুলি দেখি এবং যে ঘটনাগুলি অনুভব করি, তার জন্য আমাদের নিজস্ব মন— আমাদের "ব্যক্তিত্ব" যেমনটা আমরা স্মরণ রাখি— দায়ী নয়, এটা অবশ্যই অজানা কোনো এক উৎস থেকে আসে। তবে, এই উৎসগুলোর সাধারণ চরিত্র সম্পর্কে আমরা কিছু ফয়সালা গঠন করতে পারি এবং আমি এই ধরনের স্বপ্নগুলোকে "দানবীয়" বলে অভিহিত করা ন্যায্য মনে করি— অর্থাৎ নিম্ন নৈতিক স্তরের।
 
এই শ্রেণীতেও যৌনাত্মক উপাদান বরং বলা যায় অশ্লীল উপাদান, একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আর এতে আশ্চর্যের কিছু নেই যে ফ্রয়েডীয় স্কুলের কিছু অনুসারী, কেবল এই ধরনের স্বপ্ন নিয়ে গবেষণা করে, এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে সমস্ত স্বপ্নেরই একটি যৌন উৎপত্তি রয়েছে।
 
ষষ্ঠ প্রকার, যাকে আমি বলি জেনারেল ড্রিম-সেন্সেশনস[general dream-sensations]; এটি অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য স্বপ্ন কিন্তু  বর্ণনা করা সহজ নয়। এটি সাধারণ স্বপ্ন নয়; এতে কোনো দৃশ্য, চিত্র, ঘটনা, এমনকি শব্দ বা নামও থাকে না। কিন্তু গভীর ঘুমের দীর্ঘ সময় ধরে মন অবিরাম কোন ব্যক্তি, কোন স্থান, কোন উল্লেখযোগ্য ঘটনা বা এমনকি কোন বিমূর্ত চিন্তায় নিমগ্ন থাকে। অন্তত জেগে ওঠার পর স্মৃতি এমনটাই জানান দেয়। এক রাতে আমি এক আমেরিকান ভদ্রলোকের ব্যক্তিত্ব নিয়ে অবিরাম আবিষ্ট হয়ে ছিলাম, যার প্রতি আমি বিশেষ আগ্রহী ছিলাম না। আমি তাঁকে দেখিনি, তার নামও শুনিনি, কিন্তু জেগে উঠে আমার মনে হলো যেন তিনি সারা রাত সেখানে ছিলেন। বরং ভিন্ন একটি ঘটনায় এটি ছিল মোটামুটি একটি গভীর চিন্তা, যা আমাকে গভীর ঘুমে নিমজ্জিত রেখেছিল, জাগরণের পরও যার স্মৃতি স্পষ্ট ছিল। প্রশ্নটি ছিল: আমাদের জীবনের একটি সময়কাল যা খুব দুঃখজনক বলে অনুভূত হয় কিন্তু স্মৃতিতে কেন সেগুলো মিষ্টি ও সুন্দর লাগে? আর উত্তর ছিল: কারণ একজন মানুষ নিজের সম্পর্কে খুব অল্পই জানে। প্রশ্ন ও উত্তর আমাকে কখনই ছাড়েনি; তবুও আমার ঘুম ছিল খুব গভীর ও নিরবচ্ছিন্ন। এই স্বপ্ন-সংবেদনগুলি অপ্রীতিকর বা অযৌক্তিক নয়, যতক্ষণ শরীর সুস্থ অবস্থায় থাকে।


এই স্বপ্ন-সংবেদনগুলি প্রায়শই মনকে উদ্বেলিত করে বা সান্ত্বনাদায়ক প্রভাব ফেলে। তবে রোগসংক্রান্ত স্বপ্নে এগুলো অত্যন্ত বিস্ময়কর ও উৎপীড়ক হয়ে উঠতে পারে। ঘুমন্ত ব্যক্তির এমন অনুভূতি হতে পারে যেন তিনি নিজেই একটি বর্গক্ষেত্র বা বৃত্ত, অথবা সম্পূর্ণ বর্ণনাতীত ভিন্ন কোন সংবেদন।
 
সপ্তম প্রকারের স্বপ্ন, যাকে আমি লুসিড ড্রিমস[lucid dreams] বলি; আমার মতে সবচেয়ে আকর্ষণীয় এবং সতর্ক পর্যবেক্ষণ ও অধ্যায়ন যোগ্য। ১৮৯৮ সালের ২০ জানুয়ারি থেকে ১৯১২ সালের ২৬ ডিসেম্বরের মধ্যে ৩৫২টি লুসিড ড্রিমের অভিজ্ঞতা হয় আমার এবং আমি সেগুলো লিখে রাখি।
 
লুসিড ড্রিমে মানসিক কার্যাবলীর পুনঃএকত্রীকরণ এতটাই অবিকল হয় যে, ঘুমন্ত ব্যক্তি তার দৈনন্দিন জীবন ও নিজের অবস্থান মনে রাখতে পারে, সম্পূর্ণ সচেতনতা অর্জন করে, এবং তার মনোযোগ নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয় ও স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির বিভিন্ন ক্রিয়া সম্পাদনের চেষ্টা করতে পারে। এরপরও আমি তাত্মবিশ্বাসের সাথে বলতে পারি এই ঘুমটি নিরবিচ্ছিন্ন, গভীর এবং সতেজ। ১৮৯৭ সালের জুন মাসে আমি প্রথমবারের মতো লুসিড ড্রিমের এই সচেতনতার আভাস পাই নিম্নোক্তভাবে, আমি স্বপ্ন দেখলাম যে পাতাহীন গাছের এক প্রাকৃতিক দৃশ্যের মধ্য দিয়ে আমি ভেসে যাচ্ছি, জানতাম এটি এপ্রিল মাস, এবং আমি লক্ষ্য করলাম যে ডালপালার দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ স্বাভাবিকভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে। তারপর আমি ঘুমের মধ্যেই এই চিন্তা করলাম যে, আমার কল্পনা কখনই এত জটিল চিত্র সৃষ্টি করতে পারবে না বা এমন দৃষ্টিভঙ্গির গতিবেগ তৈরি করতে পারবে না যেমনটি আমি এই ভেসে যাওয়ার সময় ছোট ছোট ডালপালায় দেখতে পাচ্ছিলাম।


অনেক বছর পরে, ১৯০৭ সালে, আমি প্রফেসর আর্নস্ট মাখের[prof. Ernst Mach]  রচনার একটি অনুচ্ছেদ খুঁজে পাই যেখানে সামান্য পার্থক্য সহ একই পর্যবেক্ষণ বর্ণিত হয়েছে। আমার মতো মাখও এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন যে তিনি স্বপ্ন দেখছিলেন, কারণ তিনি ডালপালার গতিবিধিতে কিছু ত্রুটি লক্ষ্য করেছিলেন; যেখানে আমি বিস্মিত হয়েছিলাম সেই স্বাভাবিকতায়(দৃষ্টিভঙ্গির গতিবেগ) যা আমার কল্পনা কখনই সৃষ্টি করতে পারত না। প্রফেসর মাখ সম্ভবত এটার গুরুত্ব বিশ্বাস না করায় এই দিকে তার পর্যবেক্ষণ চালিয়ে যাননি। আমি আরেকটি সুযোগের জন্য সতর্কত থাকলাম। এই সচেতন অবস্থাকে দীর্ঘায়িত ও তীব্রতর করার লক্ষ্যে আমি নিজেকে প্রস্তুত করলাম।
 
১৮৯৮ সালের জানুয়ারি মাসে আমি এই পর্যবেক্ষণটি পুনরাবৃত্তি করতে সক্ষম হয়েছিলাম। ১৯-২০ জানুয়ারি রাতে, আমি স্বপ্ন দেখলাম যে আমি আমার পড়ার ঘরের জানালার সামনের বাগানে উপুর হয়ে শুয়ে আছি, এবং কাঁচ প্যানেলের মধ্য দিয়ে আমার কুকুরের চোখ দেখতে পাচ্ছি। আমি খুব মনোযোগ সহকারে কুকুরটিকে পর্যবেক্ষণ করছিলাম। একই সময়ে, আমি সম্পূর্ণ নিশ্চিতভাবে জানতাম যে আমি স্বপ্ন দেখছি এবং আমি আমার বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে আছি। তারপর আমি ধীরে ধীরে এবং সতর্কভাবে জেগে উঠার সিদ্ধান্ত নিলাম এবং পর্যবেক্ষণ করার চেষ্টা করলাম কেমন করে বুকের উপর ভর দিয়ে শোয়ার অনুভূতিটা চিত হয়ে শোয়ার অনুভূতিতে পরিবর্তিত হয়। এবং আমি ঠিক তাই করলাম, ধীরে ও ইচ্ছাকৃতভাবে। এবং এই রূপান্তরটি— যা আমি পরবর্তীতে বহুবার অনুভব করেছি— অত্যন্ত বিস্ময়কর। এটি এক শরীর থেকে অন্য শরীরে পিছলে যাওয়ার অনুভূতির মতো, এবং দুটি শরীরের দ্বৈতস্মৃতি স্পষ্টভাবে থাকে। আমি স্বপ্নে বুকের উপর ভর দিয়ে শোয়ার সময় যা অনুভব করেছিলাম তা স্মরণ করতে পারলাম; কিন্তু জাগ্রত জীবনে ফিরে এসে আমি এও স্মরণ করতে পারলাম যে আমার শারীরিক দেহ সব সময় চিত হয়ে শুয়ে ছিল। এই দ্বৈতস্মৃতির পর্যবেক্ষণ আমি পরবর্তীতে বহুবার করেছি। এটি এতটাই নিশ্চয়তা দেয় যে, প্রায় অনিবার্যভাবে একটি স্বপ্ন-দেহের[dream-body] ধারণার দিকে নিয়ে যায়।
 
খানিক বিদ্রুপের সাথে মিস্টার হ্যাভলক বলেন কিছু লোক “যারা অক্কাল্টে ডুবে থাকে” তারা এমন এস্ট্রাল বডির কথা বলে। অথচ তিনি যদি কেবল এমন একটি অভিজ্ঞতা লাভ করতেন, তবে তিনি বুঝতেন যে আমরা না পারি এই ডুবে থাকা থেকে বের হতে না পারি স্বপ্ন-শরীরের ধারনা এড়িয়ে যেতে। লুসিড ড্রিমে একটি শরীর থাকার যে অনুভূতি— চোখ থাকা, হাত থাকা, কথা বলার জন্য মুখ থাকা ইত্যাদি— সম্পূর্ণরূপে স্পষ্ট; তবুও আমি একই সময় জানি যে শারীরিক দেহটি ঘুমিয়ে আছে এবং সম্পূর্ণ ভিন্ন অবস্থায় রয়েছে। জেগে ওঠার সময় এই দুটি অনুভূতি একত্রে মিশে যায়, এমনটা বলা যায় এবং আমি স্বপ্ন-দেহের ক্রিয়াকলাপ ঠিক ততটাই স্পষ্টভাবে স্মরণ করতে পারি যতটা পারি শারীরিক দেহের নিশ্চলতা।


১৮৯৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আমি একটি লুসিড ড্রিম দেখেছিলাম, যেখানে আমি নিম্নলিখিত পরীক্ষাটি করেছিলাম। আমি আমার আঙুল লালা দিয়ে ভিজিয়ে বাম হাতের তালুতে একটি ভেজা ক্রস চিহ্ন আঁকলাম, উদ্দেশ্য ছিল ঘুম থেকে জেগে ওঠার পরও এটি থাকবে কিনা তা দেখার। তারপর আমি স্বপ্নেই দেখলাম যে আমি জেগে উঠেছি এবং আমার বাম হাতের তালুটি গালে লাগিয়ে ভেজা ক্রস অনুভব করছি। অবশেষে দীর্ঘ সময় পর আমি সত্যিই জেগে উঠলাম এবং সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারলাম যে আমার হাতটি পুরো সময় জুড়ে আমার বুকের উপর শান্ত ও বন্ধ অবস্থায় ছিল।
 
লুসিড ড্রিমে কণ্ঠস্বরের অনুভূতি অত্যন্ত বিস্ময়কর, এবং বহুবার পুনরাবৃত্তির পরও এটি বিস্ময়ের উৎস হয়ে থাকে। আমি আমার পূর্ণ ক্ষমতায় চিৎকার করতে পারি, এবং যদিও আমি পুরোপুরি জানি যে আমার শারীরিক শরীর গভীর ঘুমে শুয়ে আছে তবু বিশ্বাস করতে পারি না এই উচ্চ কণ্ঠস্বরটি জাগ্রত জগতে শ্রবণযোগ্য নয়। এরপরও, আমি শতাধিক স্বপ্নে গান গেয়েছি, চিৎকার করেছি এবং উচ্চস্বরে কথা বলেছি, কিন্তু আমার স্ত্রী কখনই আমার কণ্ঠস্বর শুনতে পাননি এবং কয়েকটি ক্ষেত্রে তিনি আমাকে নিশ্চিত করতে পেরেছেন যে আমি সম্পূর্ণ শান্তভাবে ঘুমিয়েছিলাম।
 
স্বপ্নগুলোর অগণিত আকর্ষণীয় বিস্তারিত বিবরণ সংক্ষেপ বা অতিস্তরতল বর্ণনা এই প্রবন্ধে আমি লিখতে পারব না। বৃহত্তর কাজের জন্য আমি তা সংরক্ষণ করছি। আর আমার আশঙ্কা, কেবলমাত্র এই ঘটনাগুলোর সাথে বারংবার ব্যক্তিগত পরিচয়-ই এর তাৎপর্য সম্পর্কে যে কাউকে সন্দেহমুক্ত করতে পারে। আমি এগুলোর চরিত্র সম্পর্কে কিছু ধারণা দিতে আরও কয়েকটি ঘটনা বর্ণনা করব।


১৯০৪ সালের ৯ই সেপ্টেম্বর আমি স্বপ্নে দেখলাম, জানালার সামনে একটি টেবিলের পাশে আমি দাঁড়িয়ে আছি। টেবিলের উপর বিভিন্ন বস্তু ছিল। আমি সম্পূর্ণভাবে সচেতন ছিলাম যে আমি স্বপ্ন দেখছি এবং চিন্তা করছিলাম আমি কী ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে পারি। শুরুতে, একটি পাথর দিয়ে আঘাত করে কাঁচ ভাঙ্গার চেষ্টা করলাম। পরে, দুটি পাথরের উপর একটি ছোট কাঁচের টুকরো রেখে আরেকটি পাথর দিয়ে আঘাত করলাম। তবুও এটি ভাঙল না। তারপর আমি টেবিল থেকে একটি সুন্দর ক্ল্যারেট গ্লাস নিলাম এবং আমার সমস্ত শক্তি একত্রিত করে মুষ্টি দিয়ে আঘাত করলাম, একই সাথে চিন্তা করছিলাম জাগ্রত অবস্থায় এটি করা কতটা বিপজ্জনক হতে পারতো; তবুও গ্লাসটি অক্ষত থাকল। কিন্তু! কিছুক্ষণ পর আমি যখন আবার সেটির দিকে তাকালাম, দেখলাম এটি ভেঙ্গে আছে।
 
এটি ভেঙ্গে গেল ঠিকই, তবে একটু দেরিতে, যেমনটা একজন অভিনেতা যখন তার কিউ মিস করেন। খানিকটা ত্রুটিসহকারে, অবিকল নকলকৃকত একটি মিথ্যে দুনিয়ার অত্যন্ত কৌতূহলোদ্দীপক ধারনা দিল এটি আমাকে। আমি ভাঙ্গা কাঁচটি নিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে ছুঁড়ে ফেললাম, যেন কাঁচ পতনের শব্দটি শুনতে পাই। শব্দটি ঠিকই শুনলাম এমনকি দেখলাম দুটি কুকুর সেখানে থেকে স্বাভাবিক ভাবে দৌঁড়ে পালিয়ে যাচ্ছে। আমি ভাবলাম, এই কমেডি-দুনিয়াটা কতটা চমৎকারভাবে অনুকরণ করা হয়েছে এখানে! তারপর আমি ক্ল্যারেট[এক ধরনের ফরাসি লাল মদ] ভর্তি একটি সুরাপাত্র দেখতে পেলাম এবং সেখান থেকে খানিকটা মদ চেখে দেখলাম, এবং সম্পূর্ণ স্পষ্ট ধারনা হল: "আমরা তাহলে, এই স্বপ্ন-বিশ্বেও স্বেচ্ছায় স্বাদের অনুভূতি পেতে পারি; এটিতে পরিপূর্ণ ওয়াইনের স্বাদ পাচ্ছি।"


জার্মান কবি নোভালিসের[Novalis] একটি উক্তি আছে, যখন আমরা স্বপ্নে দেখি যে আমরা স্বপ্ন দেখছি, তখন আমরা জেগে ওঠার কাছাকাছি থাকি। এই দৃষ্টিভঙ্গিটা বেশিরভাগ পর্যবেক্ষক দ্বারা সমর্থিত, যা আমি স্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যান করি। লুসিড ড্রিম সাধারনত গভীর ঘুমে সংগঠিত হয় এবং নিয়ম হিসেবে জেগে উঠলেই এটির সমাপ্তি হয় না, যদি না আমি তা চাই এবং ইচ্ছাশক্তি দ্বারা তা করি। তবে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমি যতটা সম্ভব স্বপ্ন দেখা চালিয়ে যেতে পছন্দ করি, আর তারপর লুসিডিটা নিঃশেষ হতে থাকে আর ভিন্ন ধরনের স্বপ্নে রূপ নেয়, এবং যেটা লক্ষণীয় সেটা হলো পরবর্তী রূপটি প্রায়শই "ডিমন-ড্রিম" হয়, যেটা আমি শীঘ্রই আলোচনা করবো।
 
প্রায়শই এমন হয় যে, আমি স্বপ্নে দেখি যে আমি জেগে উঠেছি এবং আমার স্বপ্নটি অন্য কাউকে বলছি। এই শেষ স্বপ্নটি তখন সাধারণ ধরণের একটি স্বপ্নে পরিণত হয়। এই স্বপ্ন থেকেই আমি জেগে উঠি বাস্তাব জাগ্রত জগতে, মনের অদ্ভুত ভ্রমণের এই বিস্ময় সাথে নিয়ে। অনুভূতিটি এমন যেন, আমি ভিন্ন ভিন্ন গভীরতার স্তর ভেদ করে উপরে উঠে আসছি, যার মধ্যে লুসিড ড্রিমটি হল সবচেয়ে গভীরতম।


আমি উল্লেখ করতে চাই যে, গুটি কয়েক ব্যতিক্রম স্বপ্ন ব্যাতিত আমার সমস্ত লুসিড ড্রিমগুলো সকাল পাঁচটা থেকে আটটার মধ্যে ঘটেছে। স্বপ্ন দেখার জন্য এই বিশেষ সময়টির তাৎপর্য বহুবার আলোচিত হয়েছে— অন্যদের মধ্যে দান্তেও, তার Purg. IX. তে এই বিষয়ে বলেছেন, তিনি সেই সময়ের কথা উল্লেখ করেন যখন আবাবিল পাখি কলনাদ শুরু করে এবং আমাদের মন বস্তুগত দেহ দ্বারা সবচেয়ে কম প্রভাবিত থাকে।

লুসিড ড্রিমও প্রতীকী—তবে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে, আমি এতে কখনই কোনো যৌন বা কামোদ্দীপক উপাদান লক্ষ্য করিনি। এই প্রতীকগুলো সুন্দর ভূদৃশ্যের রূপ নেয়—প্রভাময় ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু, সূর্য আলো, মেঘ এবং বিশেষ করে গভীর নীল আকাশ। একটি লুসিড ড্রিমের উদাহরনে আমি পরিস্কার নীল রৌদ্রোজ্জ্বল আকাশে গভীর আনন্দ আর কৃতজ্ঞতার অনুভূতি সহ বিস্তৃত প্রাকৃতিক দৃশ্যের মধ্য ভেসে বেড়াই যা আমি কৃতজ্ঞতা ও ভক্তিপূর্ণ শব্দ দিয়ে বলতে অনুপ্রাণিত হই। কখনও কখনও এই শব্দগুলো আমার কাছে খানিকটা অলংকারপূর্ণ মনে হলেও কিছুই করার থাকে না আমার, কারণ স্বপ্নে আবেগপ্রবণতা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। যা আবির্ভূত হয় সেগুলো কখনো কখনো প্রতীক, সতর্কতা, সান্তনা বা সমর্থন বলে জ্ঞান করি। জড়ো হওয়া মেঘগুচ্ছ অথবা উদ্ভাসিত আলো। একবারই কেবল সূর্য চাতকি দেখেছিলাম আমি।


উড়ে বেড়ানো বা ভেসে বেড়ানো প্রায় সব ধরনের স্বপ্নেই পরিলক্ষিত হয়, সম্ভবত সাধারণ স্বপ্ন-অনুভূতিগুলোর ধরনগুলো ছাড়া; তবে এটি সাধারণত একটি ইঙ্গিত যে লুসিড ড্রিম আসন্ন। 
 
আমি যখন দুই-তিন রাত ধরে স্বপ্নে উড়ে বেড়াই, তখন আমি বুঝতে পারি একটি লুসিড ড্রিম আসন্ন। আর লুসিড ড্রিম প্রায়শই উড়ার অনুভূতি দিয়ে শুরু হয় এবং তা পুরো সময় জুড়েই অব্যাহত থাকে। কখনও বিশাল শূন্যতার মধ্য দিয়ে দ্রুত ভেসে যাচ্ছি অনুভব করি; একবার আমি পিছনের দিকে উড়েছিলাম, আরেকবার স্বপ্নে দেখলাম আমি একটি ক্যাথেড্রালের ভিতরে আছি আর সমস্ত ভবনসহ উপরের দিকে অতি দ্রুত গতিতে উড়ে যাচ্ছি। আমার বিশ্বাস হয় না আমাদের শ্বাস প্রশ্বাসের ছন্দের সাথে এই অনুভূতির কোন সম্পর্ক আছে, যেমনটি হ্যাভলক এলিস ধারণা করেন, কারণ এটি সাধারণত অবিরাম এবং খুব দ্রুতগতির হয়।


সংকটপূর্ণ অবস্থা বা আকস্মিত ভাসন্ত অবস্থা নিম্ন-স্তরের স্বপ্ন বৈশিষ্ট্য, এবং এটি শারীরিক অসুস্থতার উপর নির্ভর করতে পারে; অবশ্য নৈতিক সংকট বা মানসিক বিষন্নতার প্রতীকও হতে পারে।


১৯১১ সালের ক্রিসমাস দিন আমি এই নিম্নলিখিত স্বপ্নটি দেখেছিলাম। এটি শুরু হয়েছিল উড়ে বেড়ানো ও ভেসে বেড়ানোর মাধ্যমে। আমি অবিশ্বাস্যরকম হালকা ও শক্তিশালী অনুভব করছিলাম। আমি বিশাল ও সুন্দর দৃশ্যাবলী দেখছিলাম— প্রথমে একটি শহর, তারপর অবাস্তব ও উজ্জ্বল বর্ণের একটি গ্রামীণ ল্যান্ডস্কেপ। এরপর আমি আমার ভাইকে দেখলাম, সে বসে আছে— যো ১৯০৬ সালে মারা গিয়েছিল— এবং আমি তার কাছে গিয়ে বললাম: "আমরা দুজনই এখন স্বপ্ন দেখছি।" সে উত্তর দিল: "না, আমি না!" তখনই আমার মনে পড়লো যে ও মারা গেছে। মৃত্যু পরবর্তী অস্তিত্বের অবস্থা সম্পর্কে আমরা একটি দীর্ঘ কথোপকথন করেছিলাম এবং আমি বিশেষভাবে সচেতনতা ও স্পস্টতর উজ্জ্বল অন্তর্দৃষ্টি সম্পর্কে জানতে চাইলাম। কিন্তু সে তা উত্তর দিতে পারেনি; মনে হচ্ছিল ওর সেটা জানা নেই।
 
তারপর লুসিড ড্রিমটি একটি সাধারণ স্বপ্ন দিয়ে বিঘ্নিত হয়েছে; দেখলাম একজন মহিলা একটি সেতুর উপর দাঁড়িয়ে আছে, তিনি আমাকে বলল, ঘুমের মধ্যে তিনি আমাকে কথা বলতে শুনেছেন। এবং আমি ধারণা করলাম আমার কণ্ঠস্বর লুসিড ড্রিমের সময় শ্রবণযোগ্য ছিল।
 
তারপর লুসিড ড্রিমের দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হলো, যেখানে আমি বিখ্যাত ডাচ রসায়রবিদ প্রফেসার ভ্যানট হফকে দেখেছিলাম, যাকে আমি ছাত্রজীবনে চিনতাম। দেখলাম একটি কলেজ রুমে বেশ কিছু পণ্ডিত ব্যাক্তিরা তাতে ঘিরে আছেন। আমি তার কাছে গেলাম, খুব ভালো করে জানতাম যে তিনি মারা গেছেন এবং মৃত্যু পরবর্তী অবস্থা সম্পর্কে আমার জিজ্ঞাসা চালিয়ে গেলাম। এটি একটি দীর্ঘ ও শান্ত আলোচনা ছিল, যেখানে আমি পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন ছিলাম।


আমি প্রথমে জিজ্ঞাসা করলাম, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বোধশক্তির অভাবে আমরা কীভাবে নিশ্চিত হতে পারি যে আমি যার সাথে কথা বলছি তিরি সত্যিই সেই ব্যক্তি এবং একটি কেবল-ই একটি ব্যক্তিগত বিভ্রম নয়? তখন ভ্যানট হফ বললেন: "ঠিক সাধারণ জীবনের মতো-ই; একটি সামগ্রিক ধারণার মাধ্যমে।"


"এরপরও," আমি বললাম, "সাধারণ জীবনে পর্যবেক্ষণের একটি স্থায়িত্ব আছে এবং পুনরাবৃত্ত পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে সেখানে একত্রীকরণ ঘটে।"


"এখানেও তাই," ভ্যানট হফ বললেন। "এবং নিশ্চয়তার অনুভূতিও একই রকম।" তখন আমার সত্যিই অত্যন্ত প্রবলভাবে অনুভব হল যে আমি যার সাথে কথা বলছিলাম সে সত্যিই ভ্যানট হফ ছিলেন, এটি কোনো ব্যক্তিগত বিভ্রম নয়। তারপর, আমি আবার জিজ্ঞাসা করলাম এই ছায়াময় জীবনের স্বচ্ছতা, সচেতনতা ও স্থায়িত্ব সম্পর্কে এবং তখন আমি একই ধরনের দ্বিধাগ্রস্ত, সংশয়পূর্ণ ও অতৃপ্তিকর উত্তর পেলাম যেমনটা আমার ভাইয়ের কাছ থেকেও পেয়েছিলাম। স্বপ্নের সমগ্র পরিবেশ ছিল সুখী, উজ্জ্বল, উন্নত; আর ভ্যানট হফের চারপাশের লোকেদের দেখে সহানুভূতিশীল বলে মনে হচ্ছিল আমার, যদিও আমি তাদের চিনতাম না।


"আপনাদের সাথে যুক্ত হতে আমার আরো কিছুটা সময় লাগবে সম্ভবত," এমনটা বললাম আমি। অবশ্য নিজেকে তখন আমার প্রকৃত বয়সের চেয়েও যুবক মনে হচ্ছিল।
 
তারপর আমি বেশ কিছু সাধারণ স্বপ্ন দেখেছিলাম এবং সম্পূর্ণ সতেজ অবস্থায় জেগে উঠলাম এবং বুঝতে পেরেছি আমার কন্ঠস্বর জাগ্রত জগতে শ্রবণযোগ্য ছিল না।
 
১৯০৩ সালের মে মাসে আমি স্বপ্ন দেখলাম যে, আমি একটি ছোট প্রাদেশিক ডাচ শহরে আছি এবং হঠাৎ আমার ভগ্নিপতির সাথে দেখা হল, যিনি কিছুকাল আগে মারা গিয়েছিলেন। আমি সম্পূর্ণ নিশ্চিত ছিলাম যে এটি তিনিই ছিলেন এবং আমি জানতাম যে তিনি মারা গেছেন। তিনি আমাকে বলেছিলেন যে আমার "নিয়ন্ত্রক"(আমার পথপ্রদর্শক আত্মা) এর সাথে ওনার ঘনিষ্ট যোগাযোগ আছে। আমি খুশি হয়েছিলাম এবং আমাদের কথোপকথন অত্যন্ত আন্তরিক ছিল, সাধারণ জীবনের চেয়েও বেশি ঘনিষ্ঠ। তিনি আমাকে বলেছিলেন যে আমার একটি আর্থিক বিপর্যয় আসন্ন। কেউ একজন আমার ১০,০০০ গিল্ডার ছিনতাই করতে যাচ্ছে। আমি বললাম যে, আমি আপনার কথা বুঝতে পেরেছি; যদিও জেগে ওঠার পর আমি সম্পূর্ণ বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিলাম এবং এর কোনো অর্থ-ই করতে পারিনি। আমার ভগ্নিপতি বলেছিলেন যে আমার পথপ্রদর্শক আত্মা তাকে এটি বলেছিলেন। আমি স্বপ্নের মধ্যে এই গল্পটি অন্য কাউকে বললাম। তারপর আমি আমার ভগ্নিপতিকে মৃত্যু-পরবর্তী জীবন সম্পর্কে আরও কিছু বলতে বললাম, এবং ঠিক যখন তিনি আমাকে উত্তর দিতে যাচ্ছিলেন, আমি জেগে উঠলাম— যেন কেউ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। সেইসময়ে আমি এই সময়ের মতো স্বপ্ন দীর্ঘায়িত করায় অভ্যস্ত ছিলাম না।
 
আমি এই বিষয়টি উল্লেখ করতে চাই যে, এটিই ছিল একমাত্র ভবিষ্যদ্বাণী যা আমি এতটা প্রভাববহুলভাবে কোনো লুসিড ড্রিমে পেয়েছিলাম। এবং এটি সত্য হয়েছিল, যদিও একটু ভিন্নতা ছিল; যে পরিমানে টাকা আমি খুইয়েছি সেটি উল্লেখিত সংখ্যার বিশ গুন বেশী ছিল। স্বপ্ন দেখার সময়কালে এমন বিপর্যয়ের সামন্যতম সম্ভাবনা আছে বলে আমার মনে হয়নি। কারণ, আমার কাছে সেই পরিমানের টাকাও ছিল না যেটা আমি পরে খুইয়েছি। তবুও এটা ঠিক সেই সময় যখন প্রথম ঘটনাটি ঘটেছিল— ১৯০৩ সালের রেলওয়ে ধর্মঘট— যেটা আমার আর্থিক এ ধ্বংসের সূচনা করেছিল।
 
মিথ্যা থাকতে পারে লুসিড ড্রিমে। ১৯১২ সালের মার্চ মাসে আমি একটি অত্যন্ত জটিল স্বপ্ন দেখেছিলাম, স্বপ্নে দেখেছিলাম যে থিওডোর রুজভেল্ট[Theodore Roosevelt] মারা গেছেন, তারপর আমি জেগে উঠে স্বপ্নটি বললাম, বলছিলাম: "স্বপ্নে আমি নিশ্চিত ছিলাম না যে তিনি সত্যিই মারা গেছেন নাকি এখনও বেঁচে আছেন; এখন আমি জানি যে তিনি সত্যিই মারা গেছেন; কিন্তু এই খবরটি আমাকে এতটাই মর্মাহত করেছিল যে আমি আমার স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলাম।" এবং তারপর একটি মিথ্যা লুসিড ড্রিম দেখলাম যেখানে আমি বললাম: "এখন আমি জানি যে আমি স্বপ্ন দেখছি এবং আমি কোথায় আছি।" কিন্তু এটা সম্পূর্ণ ভুল ছিল; আমি আমার প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে কিছুই জানতাম না এবং ধীরে ধীরে জেগে ওঠার পর আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে এগুলো সব অর্থহীন ছিল।


এই ধরনের উপহাসকে আমি দানবীয়[demonical] বলি। এবং এখানে একটি সংযোগ আছে, যা আমি এত বার পর্যবেক্ষণ করেছি যে মনে হয়েছে এটির নিশ্চয়ই একটা তাৎপর্য আছে, যেটি  লুসিড ড্রিমের পরপরই আসে, অষ্টম প্রকারের স্বপ্ন যাকে আমি "ডেমন-ড্রিমস"[demon-dreams] বলি।

আমি আশা করি আপনারা আমাকে সম্মতি দেবেন কেবল মাত্র আলোচনার সুবিধার্থে এটা বলতে যে, এই নিম্ন নৈতিক স্তরের বুদ্ধিমান সত্তাগুলির অস্তিত্ব রয়েছে। একে আপনারা একটি ওয়ার্কিং হাইপোথিসিস বলতে পারেন। তারপর আমি আপনাদের পূর্বে বর্ণিত প্রতীকী[symbolic] বা বিদ্রূপাত্মক[mocking] স্বপ্ন এবং দানব-স্বপ্নের[demon-dreams] মধ্যেকার পার্থক্য তুলে ধরতে চাই।
 
প্রতীকী[symbolic] স্বপ্নগুলিতে, ঘুমন্ত ব্যক্তিকে বিভিন্ন ধরনের অদ্ভুত, ভুতুরে, অশ্লীল, শোকগ্রস্থ বা শয়তানী উদ্ভাবনের মাধ্যমে হয়রান করা, বিভ্রান্ত করা বা উৎপীড়িত করা হয়। নিষ্ঠুর হত্যালীলা বা মৃতদেহের মধ্য দিয়ে তাকে হাঁটতে হয়; সে দেখতে পায় সবকিছু রক্তাক্ত ​​বা মলমূত্রে মাখানো; তাকে অশ্লীল, কামোদ্দীপক বা ভয়াবহ দৃশ্যের মধ্যে টেনে আনা হয়, যেখানে সে সক্রিয়ভাবে অংশও নেয়। তার নৈতিক অবস্থা সম্পূর্ণভাবে অধঃপতিত হয়; সে হয় খুনি, ব্যভিচারী এবং ইত্যাদি; এক কথায়, এই জাতীয় স্বপ্ন থেকে আরকিছু এতোটা হীন আর ভয়ঙ্কর হতে পারে না।
 
জেগে ওঠার পর এই স্বপ্নের অপ্রীতিকর প্রভাব থাকে; কমবেশী সে লজ্জিত ও হতবাক বোধ করে; যত দ্রুত সম্ভব এই স্মৃতি ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করে সে।


ডেমন-ড্রিমে[demon-dreams] (যা সর্বদা লুসিড ড্রিমের আগে বা পরে আসে) আমি এমন আক্রমণের মধ্য দিয়ে যাই; আমি সেই অ-মানবিক, অদ্ভুত সত্তাদের রূপ, আকৃতি ও ব্যক্তিত্ব স্পষ্টভাবে দেখতে পাই, যারা এসব করছে। উদাহরণস্বরূপ, এক রাতে আমি এমন এক সত্তাকে দেখলাম যে আমার আগে আগে চলছিল এবং যেটাই স্পর্শ করছে, দরজার হাতল বা চেয়ার, সেটাই মাটি হয়ে যাচ্ছিল। এই সত্তারা সর্বদা অশ্লীল ও কামোত্তেজক এবং এরা আমাকে তাদের কাজকর্মে জড়িত করার চেষ্টা করে। তাদের কোনো লিঙ্গ নেই এবং তারা পর্যায়ক্রমে পুরুষ বা নারীর রূপ ধারণ করে। তাদের চেহারা অত্যন্ত বৈচিত্র্যময় এবং পরিবর্তনশীল, প্রতি মুহূর্তে রূপ বদলায়; মধ্যযুগের চিত্রশিল্পীরা যেসব অলৌকিক রূপ আঁকার চেষ্টা করেছিলেন সেইসকল চেহারা ধারণ করে এরা, তবে এক অদ্ভুত প্রাণবন্ততা ও পরিবর্তনশীলতা থাকে তাতে, যা কোনো চিত্রই প্রকাশ করতে পারে না।
 
এই স্বপ্নগুলোর একটি এখন আমি বর্ণনা করব ( ১৯০৭ সালের ৩০ মার্চ, বার্লিনে), যেটা একটি লুসিড ড্রিমের পরপরই ঘটেছিল। সেই স্বপ্নের স্পষ্টতা খুব তীব্র ছিল না এবং আমি আমার প্রকৃত অবস্থা নিয়ে কিছু সন্দেহে ছিলাম। তখন হঠাৎই আমি দানবদের মাঝখানে নিজেকে আবিষ্কার করলাম। এর আগে আমি কখনও ওদের এত স্পষ্ট, এত ঔদ্ধত্যপূর্ণ আর এত আক্রমণাত্মক দেখিনি। একজন ছিল পিচ্ছিল, উজ্জ্বল, নরম এবং ঠাণ্ডা, একটি জীবন্ত লাশের মতো। আরেকজন বারবার তার মুখায়ব পরিবর্তন করছিল এবং অবিশ্বাস্য ভঙ্গিতে ভেঙচি কাটছিল। একটি আমার নিচ দিয়ে উড়ে গিয়ে, একটি আঞ্চলিক অশ্লীল কথা চিৎকার করে বলল। আমি সক্রিয়ভাবে আত্মরক্ষা করলাম, প্রধানত গালিগালাজ দিয়ে, এটি একটি দুর্বলতা বলে মনে হল আমার। আমি শব্দগুলো লিখিত রূপ দেখতে পেয়েছিলাম।
 
দানবদের চক্রটি আমাকে চারিদিক থেকে ঘিরে ধরেছিল এবং রাস্তার বখাটেদের মতো দাঁত বের করে মুখবিকৃত হাসি হাসছিল। তবে আমি ভয় পাই নি এবং বললাম: "যদি তোমরা আমাকে পরাজিতও করো; ইশ্বর যদি এটাই চায়, আমি ভয় পাই না।" তখন তারা সবাই মিলে ভিড় জমিয়ে বিলাপ করে উঠল, এবং একজন বলল: "তাহলে ইশ্বর-ই আগে কথা বলুক!" আর তখন আমি আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে গর্জে উঠলাম: "তিনি তো বহু আগেই বলেছেন!" তারপর আমি তাদের একজনের দিকে আঙুল উচিয়ে ইঙ্গিত করে বললাম: "তুমি, তোমাকে তো আমি দীর্ঘদিন ধরে চিনি!" এবং আরেকজনের দিকে আঙ্গুল তাক করে বললাম: "আর তোমাকেও!"


তারপর আমি সঙ্গে সঙ্গে জেগে উঠলাম, এবং আমার বিশ্বাস, আমি জেগে ওঠার মুহূর্তে আমার সেই ধর্মোপদেশমূলক বক্তব্যের কিছু অংশ উচ্চস্বরে বলে ফেলেছিলাম।


এবং তারপর— এটি আপনাকে সবচেয়ে বেশী বিস্মিত করবে— এই বিবাদের পর আমি সম্পূর্ণ সতেজ, প্রফুল্ল এবং সম্পূর্ণ শান্ত আর নির্মল অনুভব করলাম।


এটাই সিম্বলিক ড্রিম থেকে ডেমন-ড্রিমের মুখ্য পার্থক্য এটা, যখন ডেমন ড্রিমে আমি দানবদের দেখি ও তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করি, তখন তার প্রভাব সম্পূর্ণভাবে সুখদায়ক, সতেজকারী ও উন্নমনা হয়।


এই ডেমন-ড্রিমগুলোর মূল বিষয় হলো— এই সত্তাগুলি বাস্তব অস্তিত্বপূর্ণ হোক বা এগুলি কেবল আমাদের কল্পনাপ্রসূত হোক; তাদের দেখতে পাওয়া এবং তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা, তাতে করে তাদের সমস্ত ভয়াবহতা, তাদের সমস্ত অশুভতা, তাদের চালাকি ও দুষ্টুমির অদ্ভুততা দূর হয়ে যায়।


আমি এখনও নবম ধরনের স্বপ্ন সম্পর্কে বলিনি, যাকে আমিরং ওয়েকিং আপ[wrong waking up] বলি, যা সর্বদা জেগে ওঠার ঠিক আগমুহূর্তে ঘটে। এই ধরনের স্বপ্নের একটি চমৎকার উদাহরণ মাখের লেখায় পেয়েছি, তিনি এটিকে "ফ্যান্টাসমা"[phantasma] নামে অভিহিত করেন। স্বাভাবিক ঘুমের ঘরে জেগে উঠার অনুভূতি হয় আমাদের, এবং তারপর বুঝতে পারি যে আমাদের চারপাশে ভূতুরে কিছু একটা ঘটছে; অস্বাভাবিক নড়াচড়া বা অদ্ভুত শব্দ শুনি, এবং তখনই উপলব্ধি করি যে আমরা এখনও ঘুমিয়ে আছি। আমার প্রথম এমন এক অভিজ্ঞতায় আমি কিছুটা ভীত হয়েছিলাম এবং সত্যিই জেগে উঠার জন্য নার্ভাস হয়ে পড়েছিলাম। আমার ধারণা, যাদের এই স্বপ্ন হয় তাদের বেশিরভাগেরই এমনটি ঘটে। তারা ভীত এবং নার্ভাস হয়ে পড়ে এবং শেষ পর্যন্ত ধড়ফড় করে, কপালে ঘাম নিয়ে জেগে উঠে।


এই রং-ওয়েকিং-আপ ড্রিমগুলোকে আমার আর আতঙ্কিত লাগে না। এগুলো দানবদের দুষ্টুমি বলে বিবেচনা করি এবং এগুলি আমাকে বিনোদন দেয়; এগুলি আর আমার নার্ভকে প্রভাবিত করে না।


১৯০৬ সালের জুলাই মাসে ল্যাঙ্গেন শ্বালবাখে একটি পরিশ্রমী দিনের পর গভীর ঘুমে, আমি এই ধরনের দুই-তিনটি স্বপ্ন দেখেছিলাম। আমার মনে হলো আমি ঘুম থেকে জেগে উঠে, শুনছি একটি বড় ল্যাগেজ ল্যান্ডিং বরাবর প্রচণ্ড ধাক্কায় ঠেলে দেয়া হয়েছে, ল্যাগেজ বাম্পিংয়ের আওয়াজও হচ্ছিল। তখন আমি বুঝতে পারলাম যে আমি আসলে দানব-জগতে জেগে উঠেছি। দ্বিতীয়বার আমি দেখলাম, আমার শোবার ঘরে তিনটি জানালা রয়েছে, যদিও আমি জানতাম যে সেখানে কেবল দুটি জানালা আছে। নিশ্চিত হব বলে, আমি ইচ্ছাকৃতভাবে এক মুহূর্তের জন্য জেগে উঠলাম এবং উপলব্ধি করলাম যে আমার ঘরে দুটি জানালা-ই আছে আর সারারাত সেই বাড়িটা সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ ছিল।

তারপর একটি ধারাবাহিক লুসিড ড্রিমের অভিজ্ঞতা হল আমার, যা অত্যন্ত সুন্দর। এই ধারাবাহিক স্বপ্নের শেষের দিকে, আমি তখনো চিৎকার করে গান গাইছিলাম, হঠাৎ আমাকে অনেকগুলো দানব চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলল, আধা-বন্য প্রনীর মত দেখতে দুষ্টু দানবের একটি দল, ওরা আমার গানে যোগ দিল। তারপর আমি অনুভব করলাম, আমি আমার আত্ম-নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছি। আমি আরও বেশি বেশি উদ্ভট আচরণ করতে শুরু করলাম, আমার বিছানার চাদর ও বালিশ ছুড়ে ফেলতে শুরু করলাম এবং, ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি নিজেকে সামলে নিলাম এবং একটি দানবকে দেখলাম যার চেহারা অন্যদের চেয়ে কম দুষ্ট ছিল বলে মনে হচ্ছিল এবং মনে হলো সে যেন বলছে, "তুমি ভুল করছো।" "হ্যাঁ," আমি বললাম, "কিন্তু কি করা উচিৎ আমার?" তখন সে বলল, "ওদের নগ্ন পিঠে চাবুক মারো।" তখন আমার মনে পড়লো দান্তের ছায়াপ্রাণীদের কথা, ওরা চাবুক ভয় পেত। তৎক্ষণাত আমি চামড়ার দড়ি দিয়ে একটি চাবুক বানালাম (সৃষ্টি করলাম) যার শেষ মাথায় একটি সীসার বল ছিল। এটি দেখিয়ে আমি তাদের হুমকি দিলাম এবং কয়েকবার প্রহার করলাম। তারপর হঠাৎ করেই আমার চারপাশ একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে গেল, এবং আমি দেখলাম সেই প্রাণীগুলো কপট মুখে পালিয়ে যাচ্ছে, যেন তারা এ সম্পর্কে কিছুই জানে না।
 
সেই রাতে লুসিড ড্রিম[lucid dreams] আর অর্ডিনারি[ordinary] ড্রিম মিলিয়ে আরো অনেক গুলো দুঃসাহসিক অভিযান হয়েছিল এবং দীর্ঘ দিন পর এমন সতেজতা, প্রফুল্লতা আর আত্মসুখ নিয়ে আমি ঘুম থেকে জেগে উঠলাম।
 
যে স্বপ্নে আমি স্বপ্ন দেখছিলাম, যে লুসিড[lucid] ড্রিমের পর জেগে উঠেছি এবং সেই স্বপ্ন সম্পর্কে একজনকে বলছিলাম; সেই স্বপ্নের সাথে এই রং-ওয়েকিং-আপ[wrong-waking-up] স্বপ্ন ধরনকে গুলিয়ে ফেলা উচিত হবে না। সেই স্বপ্নগুলো ছিল সাধারন ধরনের। সেগুলোর মধ্যে ভুতুড়ে কোন বিষয় ছিল না। রং-ওয়েকিং-আপ শ্রেণীর স্বপ্নগুলো নিঃসন্দেহে ভয়ঙ্কর, অস্বাভাবিক এবং খুব জীবন্ত আর উজ্জল (একধরনের অশুভ তীক্ষ্ণতা ও স্পষ্টতার সাথে, শক্তিশালী শয়তানী আলোতে ভরপুর)। তাছাড়া, ঘুমন্ত ব্যক্তির মন সচেতন থাকে যে এটি একটি স্বপ্ন এবং খারাপ স্বপ্ন; এবং সে জেগে উঠতে সংগ্রাম করে। এইমাত্র আমি যেমনটা বলেছি, ভয় তখনই শেষ হয়ে যায় যখন দানবদের দেখা পাওয়া যায়— যখন ঘুমন্ত ব্যক্তি উপলব্ধি করে যে সে নিশ্চয়ই নিম্ন নৈতিক স্তরের বুদ্ধিমান সত্তাদের মাধ্যেম প্রতারিত হচ্ছে। আমি কুসংস্কারাচ্ছন্ন, মধ্যযুগী অন্ধকারময় বিভ্রমগুলো পুনরুজ্জীবিত করছি; এমনটা শুনতেও আমি প্রস্তুত আছি কিন্তু আমি কেবল ঘটনাগুলি যতটা সম্ভব স্পষ্টভাবে বলার চেষ্টা করছি এবং এই শব্দ ও ধারণাগুলি ছাড়া আমি তা করতে পারি না। যদি কেউ এগুলিকে অন্য কোনও শব্দ দ্বারা প্রতিস্থাপন করতে চান, যেকোনো পরামর্শের জন্য আমি উন্মুক্ত আছি। আমি কেবল এটুকু বজায় রাখব যে স্বপ্ন-জীবনের সমস্ত ভয়াবহতা ও ভুলের জন্য আমাদের মন দায়ী নয়। তবে, এগুলোর জন্য কেউ-ই দায়ী নয় তা বলা চলবে না, কারণ এগুলিতে কিছু চিন্তা ও অভিপ্রায়ের পরম প্রমাণ রয়েছে, আর তা যতই বিকৃত ও নিচু হোক না কেন। একটি কৌশল, একটি প্রতারণা, একটি প্রতীক, কিছু না কিছু চিন্তা ও অভিপ্রায় ছাড়া এটি হতে পারে না। এগুলোকে সব 'আনকনসাসনেস'-এর ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া খুব সুবিধাজনক হয়; কিন্তু আমি বলব যে বেলজেবুব বা বেলিয়াল নাম ব্যবহার করাও ঠিক ততটাই বৈজ্ঞানিক। আমি অন্ততপক্ষে, 'আনকনসাসনেস'-এ বিশ্বাস করি না, ঠিক যেমন সান্তা ক্লজে বিশ্বাস করি না।


এমন মন্তব্য করা যেতে পারে যে, এই ঘটনাগুলো ব্যাখ্যা করতে নিম্নস্তরের বুদ্ধিমান সত্তাদের উপস্থাপন করার মাধ্যমে একটি খেয়ালী উপাদান সংযোজন করা হয়েছে, যা একটি বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থা খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনাকে বাদ দেয়। উদাহরণস্বরূপ, পাগলামি এবং রোগসংক্রান্ত স্বপ্নের সমস্ত ঘটনার দায় দানবদের উপর আরোপ করা সুবিধাজনক, যারা দেহের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তাদের কূটকৌশল খেলে। বাস্তবে, এটি আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেসের[alfred russel wallace] মত একজন ব্যক্তিরও মত ছিল, যেমনটি তিনি আমার সাথে একটি ব্যক্তিগত আলোচনায় স্বাধীনভাবে স্বীকার করেছিলেন।


এই দানবীয় কূটকৌশলগুলোর মধ্যে একটি বিজ্ঞান সম্মত রীতি খূঁজে বের করার চেষ্টা ব্যহত হবে, আমি এমনটা মনে করি না; এই ভাবনাটাকে যদি একটা ওয়ার্কিং হাইপোথিসিস হিসেবে নেই, তবুও। প্রকৃত অর্থে, উদাহরনস্বপরুপ বলা যায়, কিছু ড্রাগস একটি সুনির্দিষ্ট ধরণের হ্যালুসিনেশন সৃষ্টি করে; কোকেন সুখকর প্রত্যাশা এবং আনন্দদায়ক স্বপ্নের জন্ম দেয় এবং অ্যালকোহল ছোট সাদা প্রাণীদের দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি করে। এটি ইঙ্গিত করে যে এর পিছনে অবশ্যই কোন এক রীতি আছে, যা সম্পূর্ণরূপে স্বাধীন নয়।

তবে, আমরা এখানে এক রহস্যময় জগতসীমায় অবস্থান করছি, যেখানে আমাদের অত্যন্ত সতর্কতার সাথে এগোতে হবে। এটা অস্বীকার করা ঠিক ততটাই বিপজ্জনক এবং ভ্রান্তিকর হতে পারে যতটা এটাকে গ্রহণ করা।




# From Proceedings of the Society for Psychical Research, Vol. 26, 1913 

Comments

    Please login to post comment. Login