সকালে উঠে মেসেঞ্জার চেক করতে গিয়ে দেখি হাসান একটি খবরের লিংক পাঠিয়েছে। কোনো এক অখ্যাত অনলাইন নিউজ পোর্টালের খবর। খবরের সারমর্ম হলো, বসন্তপুর নামক এক গ্রামে প্রতিদিন রাত্রে শিয়াল সদৃশ একটি প্রাণী কাউকে না কাউকে কামড়ে দিচ্ছে। আমি অবাক হলাম না। হাসান এমন খবরের লিংক পাঠাবে এটাই স্বাভাবিক। হাসানের সাথে আমার পরিচয় পাহাড়ে বেড়াতে গিয়ে। হাসান ভীষণ এডভেঞ্চার প্রিয়। তাছাড়া জীবজন্তুর অস্বাভাবিক আচরন নিয়ে সে কোনো এক প্রফেসরকে গবেষণায় সহযোগিতা করে। কাকতালীয় ভাবে বসন্তপুর গ্রামেই হাসানের ছোট খালার বাড়ি। হাসানের পীড়াপীড়িতে শেষ পর্যন্ত সরেজমিনে তদন্ত করার জন্য বসন্তপুর যেতে রাজি হলাম।
ফতেহপুর বাসস্ট্যান্ডে নেমে ভ্যানে করে প্রায় পয়তাল্লিশ মিনিটের জার্নি শেযে আমরা শেষ বিকেলে বসন্তপুর পৌছালাম। গ্রামে ঢোকার মুখে একটি ছোট নদী। শীতের শেষে এসে নদীতে পানির কোনো চিহ্ন খুজে পেলাম না। নদীর উপরে একটা সরু সেতু। দেখেই বোঝা যাচ্ছে সেতুটি নতুন করা হয়েছে। একটু পরেই সন্ধ্যা নামবে। ভ্য্যন ড্রাইভার সেই শেয়াল সদৃশ প্রাণীর ভয়ে আমাদের সেতুর এই পাড়েই নামিয়ে দিয়ে বিদায় হলেন। সেতু পাড় হতেই আমি আর হাসান ভড়কে গেলাম। বিশ পঁচিশ জন লোক হাতে লাঠি কারও হাতে আবার ধারালো দা বঠি নিয়ে আমাদের দিকেই এগিয়ে আসছে। দৌড় দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি ইতিমধ্যে হাসান তার খালাতো ভাই তমালকে দেখে হাফ ছেড়ে বাঁচলো। আসলে যেহেতু প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেছে তাই সবাই মিলে লাঠিসোটা নিয়ে আমাদের এগিয়ে নিতে এসেছে।
খালা বাড়ি পৌঁছতে পৌঁছতে একদম অন্ধকার হয়ে গেলো। গ্রামবাসী আমাদের পৌঁছে দিয়ে চলে গেলেন। লং জার্নি করে এসেছি তাই সকাল সকাল খাওয়াদাওয়া শেষ করে শুয়ে পরেছি। হঠাৎ বিকট চেঁচামেচির শব্দে ঘুম ভেঙে গেলো। বাইরে বেরিয়ে দেখি তমাল আর খালুজান লাঠি নিয়ে বের হতে যাচ্ছেন। তমাল আর খালুজানের সাথে আমরাও বের হলাম। প্রায় মিনিট তিনেক হাঁটার পর আমরা ঘটনাস্থলে পৌছালাম। ঘটনার আকষ্মিকতায় আমার চোখ কপালে উঠে গেলো। প্রাণীটি এক মহিলার ঠিক ঘাড়ের নীচে কামড়ে দিয়েছে। ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। মহিলাটি টয়লেট থেকে ফিরছিলো ঠিক সেই সময় তার পেছন থেকে প্রাণীটি কামড়ে দেয়। মহিলাটির স্বামী লাইট নিয়ে পাহারা দিচ্ছিলেন। তার বর্ণনা মতে প্রাণীটি শেয়ালের মতো এবং গায়ে ডোরাকাটা দাগ আছে। কি প্রাণী হতে পারে সে বিষয়ে আমার অভিজ্ঞতা নেই। তবে ক্ষতের গভীরতা দেখে মনে হলো এটা কামড়ের দাগ নয়। মনে হচ্ছে কোনো প্রাণী নখ বিঁধিয়ে দিয়েছে। আমার পর্যবেক্ষণ মতে প্রাণীটি কোন মতেই শিয়াল হতে পারে না। নখের সাইজ দেখে মনে হচ্ছে সাইজে অন্তত শেয়ালের তিনগুণ সাইজের কোনো জন্তু হবে। গ্রামবাসী একত্রিত হয়ে ডিশ, বাটি, প্লেট বাজিয়ে শব্দ করে পাহারা দিচ্ছে। সেই শব্দে কোনোমতেই ঘুম আসছে না।
কখন ঘুমিয়ে পরেছি খেয়াল নেই। ঘুম ভাঙলো বেশ দেরী করে। গোসল খাওয়া- দাওয়া শেষ করে গ্রাম দেখতে বের হলাম। খালা আমাদের কিছুতেই বের হতে দিবেন না। "দিনের বেলায় তো আক্রমণ হচ্ছে না", আমরা যুক্তি দিলাম। যাই হউক অবশেষে তমালের কয়েকজন বন্ধুর সাথে আমরা লাঠিসোটা নিয়ে বের হলাম। কিন্তু খালা, গ্রামের পূর্ব দিকটায় যেখানে ঘন জঙ্গল সেদিকে যেতে একদম নিষেধ করে দিলেন। একদম গল্পের বর্ণনার মতো একটি গ্রাম। কাঁচা রাস্তা, রাস্তার দুপাশে নাম জানা- অজানা বিভিন্ন লতা -গুল্মের ঝোপঝাড়, মাঝে মাঝে বাড়ি। উত্তর দিক থেকে নদী এসে পশ্চিম দিক দিয়ে গ্রামের গা ঘেঁষে বাঁক নিয়ে পূর্ব দিকে চলে গেছে। আর গ্রামের পেছন দিকে যতদূর চোখ যায় দিগন্ত জোড়া বিল। পূর্ব দিকে নদী ঘেঁষে বিশাল জঙ্গল। আর উত্তর দিকে নদী ঘেঁষে সব চাষাবাদের জমি। পূর্ব দিকটা ভালোভাবে দেখার জন্য হাসান ড্রোন উড়িয়ে দিলো। ঘন জঙ্গল ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তমালের বর্ণনায় জানতে পারলাম জঙ্গলের ভেতরে একটা ছোটখাটো পরিত্যাক্ত জমিদার বাড়ি আছে। বাড়ির সামনে পুকুর আছে। সচরাচর সাপের এবং ভূতের ভয়ে ঐদিকটায় কেউ যায় না। তমাল বন্ধুদের সাথে কয়েকবার ওখানে গেছে। এই পরিস্থিতিতে ওখানে যাওয়ার ইচ্ছা বা সাহস কোনোটাই আমার হলো না। হাসান অবশ্য জেদ ধরেছিলো যাওয়ার। তমালের বন্ধুরা রাজিও হয়ে গিয়েছিলো। আমার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় পোড়া বাড়িতে যাওয়া বন্ধ হলো। জঙ্গলে যাওয়ার পরিবর্তে আমরা আক্রান্ত ব্যাক্তিদের সাথে দেখা করার সিদ্ধান্ত নিলাম। মোট আক্রান্ত লোক পাওয়া গেলো আটাশ জন। এর মধ্যে ছয়জন এখনো হাসপাতালে ভর্তি। আক্রান্তদের কারও অবস্থাই গুরুতর নয়। সবাইকে জলাতঙ্কের ইনজেকশন দেওয়া হচ্ছে। হাসান সবার আক্রান্ত স্থানের ছবি তুলে নিলো। সূর্য অস্ত যাওয়ার কিছুক্ষণ আগে আমরা খালা বাড়ি ফিরে আসলাম।
তমাল বন্ধুদের সাথে গ্রাম পাহারা দিতে বের হয়েছে। হাসান একমনে বারবার ক্ষতস্থানের ছবিগুলো নিখুঁতভাবে পর্যবেক্ষন করছে। আমি সারাদিনে সংগ্রহ করা তথ্যগুলোকে একত্রিত করে একটা স্পষ্ট ছবি দাঁড় করানোর চেষ্টা করছি। মুরুব্বিদের বর্ণনা মতে এই একই ঘটনা এই গ্রামে আগেও ঘটেছে। কারো কারো মতে একাধিকবার ঘটেছে। কিন্তু কোনো চাক্ষুষ স্বাক্ষী নাই। কেউ শুনেছে তার দাদার কাছে। তার দাদা আবার শুনেছে তার দাদার কাছে। তাদের বর্ননা মতে, রঘুরামের স্ত্রী জমিদারের হাত থেকে বাঁচার জন্য গ্রামবাসীর কাছে আশ্রয় চেয়েছিলো। গ্রামবাসী তাকে রক্ষা না করে জমিদারের হাতে তুলে দিয়েছিলো। জমিদার তাকে নির্যাতন করে হত্যা করার পর জমিদার বাড়ির আশেপাশে কোথাও পুঁতে রাখে। প্রতিশোধ নিতে রঘুরামের স্ত্রীর আত্মা মাঝে মাঝে ফিরে আসে। এমনকি সেই আত্মার ভয়ে জমিদার এই এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায়। কিছুদিন আগে মাজেদের স্ত্রী হঠাৎ মারা যায়। সবার ধারণা তার সাথে কোনো অন্যায় হয়েছে। তারপর থেকেই এই অত্যাচার শুরু হয়েছে।
"একটা জিনিস লক্ষ্য করেছিস," নীরবতা ভেঙে জিজ্ঞেস করলো হাসান। "কি?" আমি উত্তর দিলাম।
-সবগুলো ক্ষত কিন্তু একই স্থানে!
- হুম, লক্ষ্য করেছি।
- কোনো গবাদি পশু গরু, ছাগল এদের কিন্তু আক্রমণ করা হয়নি।
এবার আমি ভড়কে গেলাম। কথা তো ঠিক। তার মানে কি তুই বলতে চাচ্ছিস প্রাণীটি বুদ্ধিমান?
"আমি তা বলতে চাচ্ছি না। আমি শুধু বলতে চাচ্ছি, প্রাণীটির বিষয়ে এটা একটা বিশেষ তথ্য", হাসান উত্তর দিলো।
-আরেকটা বিষয়।
-বল।
- প্রাণীটি আক্রমনের সময় কিন্তু কোথাও কুকুরের চিৎকারের বর্ণনা পাওয়া যায় নাই। অথচ প্রায় প্রতি বাড়িতেই কুকুর আছে।
এবার আমি রীতিমতো ভয় পাওয়া শুরু করেছি। "তার মানে কি বোঝাতে চাচ্ছিস?", আমি জিজ্ঞেস করলাম।" কিছু না। এটাও একটা তথ্য আর কি" বলে হাসান আবার ছবির দিকে মন দিলো।
সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি হাসান নেই। হাসান রোগী নিয়ে গেছে থানা সদরে সেখান থেকে থানায় গিয়ে সহযোগিতা চেয়ে তারপরে সে ফিরবে। এবার আক্রমণ হয়েছে পাহারাদারদের ভেতর থেকে। পাহারা দিতে দিতে কেউ একজন প্রকৃতির ডাকে সারা দিতে গিয়েছিল। সেখান থেকেই তার উপর আক্রমণ হয়েছে।
হাসান ফিরে আসলো দুপুরে। থানা থেকে তেমন কোনো সহযোগিতার আশ্বাস আপাতত পাওয়া যায় নি। সবাইকে নিরাপদে থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তারপরও হাসানকে খুব উৎফুল্ল দেখাচ্ছে। তার উৎফুল্ল ভাবের কারণ জানতে চাইলাম। "প্রফেসর এ কে আজাদ আসছেন", হাসান উত্তর দিলো। প্রফেসরের সম্পর্কে যেটুকু তথ্য পেলাম তাতে তিনি বন্য প্রাণীর অস্বাভাবিক আচরণ নিয়ে গবেষণা করেন আমেরিকার কোনো এক ইনস্টিটিউটে। হাসান রাত্রেই তাকে ক্ষতস্থানের ছবিসহ ঘটনার বর্ননা দিয়ে মেইল করেছে। সৌভাগ্যের বিষয় হচ্ছে তিনি গত সপ্তাহেই দেশে এসেছেন। তিনি অলরেডি ঢাকা থেকে বসন্তপুরের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে দিয়েছেন।
আজাদ সাহেব এসে পৌঁছালেন পড়ন্ত বিকেলে। থানা থেকে তার আসার খবর স্থানীয় চেয়ারম্যানকে জানানো হয়েছে। চেয়ারম্যান আসেননি। তিনি আজাদ সাহেবের নিরাপত্তার জন্য একজন চৌকিদার পাঠিয়েছেন। থানায় পুলিশ সংকট থাকায় দুজন সশস্ত্র আনসার সদস্য পাঠানো হয়েছে। আর আজাদ সাহেবের সাথে এসেছেন একজন বডিগার্ড আর একজন ড্রাইভার। খালুজান আজাদ সাহেবের থাকার ব্যবস্থা করেছেন আমাদের পাশের রুমি। রুমের একটা জানালা ভাঙা ছিলো সেটা কাঠ দিয়ে আপাতত মেরামত করা হয়েছে। কিন্তু আজাদ সাহেব রুমে থাকবেন না। তিনি থাকবেন তার গাড়িতে। তার গাড়ি যেন গাড়ি নয় আস্ত একটা থাকার ঘর। শোবার ব্যাবস্থা টয়লেট এমনকি ছোটখাটো একটা ল্যাব রয়েছে গাড়ির মধ্যে। ল্যাবে অনেক ধরনের যন্ত্র। সত্য বলতে একটা যন্ত্রের সাথেও আমি পরিচিত নই। সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে অনেকক্ষণ আগে। খাওয়া- দাওয়ার পর্ব শেষ করে আমরা গাড়িতে এসে বসলাম। যদিও গাড়ির দরজা জানালা বন্ধ তারপরেও গাড়িতে বসে গার্ড চারজন চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখছেন।
এবার মুখ খুললেন আজাদ সাহেব। হাসান তোমার পাঠানো ছবি এবং বর্ণনা আমি মনযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করেছি। তোমার কি মনে হয় ভিক্টিমরা প্রাণীটির যে বর্ণনা দিচ্ছে তা কি গ্রহনযোগ্য? আমার কাছে গ্রহণ যোগ্য মনে হচ্ছে না বলে আমার দিকে তাকালো হাসান। আমি চুপচাপ থাকলাম। হাসান আবার বলতে শুরু করলো, "যেহেতু সবাইকে পেছন থেকে কামড়ে দিয়েছে তাই কেউ প্রাণীটিকে দেখতে পায়নি।" প্রফেসর একমত হলেন। তাছাড়া যে উচ্চতায় কামড়ানো হয়েছে এই উচ্চতায় শেয়ালের কামড়ানো সম্ভব নয়, প্রফেসর যোগ করলেন। আমি বললাম, "ডোরাকাটা ব্যাপারটা?" "আমরা আসলে কিছুই জানিনা। যুক্তি দিয়ে জাস্ট অনুমান করছি", প্রফেসর উত্তর দিলেন।
প্রাণীটিকে দেখা দরকার। এর জন্য প্রফেসর বিশটি সিসি ক্যামেরা নিয়ে এসেছেন। এখন সমস্যা হচ্ছে এতবড় এলাকায় ক্যামেরা গুলো আমরা লাগাবো কোথায়। হাসান গ্রামের নিজ হাতে আঁকা মোটামুটি গ্রামের একটা ম্যাপ প্রফেসরের দিকে এগিয়ে দিলো। আমি অবাক হলাম। হাসান কখন ম্যাপ এঁকেছে আমি টেরই পাইনি। ম্যাপের কিছু কিছু জায়গায় বিশেষ চিহ্ন দেওয়া। ওদের আলোচনা থেকে বুঝতে পারলাম যেসব জায়গায় আক্রমণ হয়েছে সেইসব জায়গায় চিহ্ন দেওয়া হয়েছে। আমরা তিনজন মিলে একটা প্যাটার্ণ বের করার চেষ্টা করছি যাতে বোঝা যায় পরবর্তী আক্রমণ কোথায় হবে। তার মানে প্রফেসর আপনি কি বলতে চাচ্ছেন প্রাণীটি মানুষের মতো বুদ্ধিমান? আমি জিজ্ঞেস করলাম। "হয় সে বুদ্ধিমান অথবা তাকে বুদ্ধি দেয়া হচ্ছে, এর দুটোই হতে পারে", প্রফেসর উত্তর দিলেন।
এতক্ষণ পর্যন্তও ব্যাপারটা আমার কাছে স্বাভাবিক মনে হচ্ছিল। এখন আর স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। এখন আমার ভয় হচ্ছে। আমরা অনেকক্ষণ ধরে আলোচনা করেও আক্রমণ স্থানের নির্দিষ্ট কোনো প্যাটার্ন বের করতে পারলাম না। প্রফেসর পরবর্তী আক্রমণ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বললেন।
রাত বারোটা পেরিয়ে গেছে। আমি আর হাসান প্রফেসরকে বিদায় দিয়ে রুমে যেতে চাইলাম। প্রফেসর আমাদের যতে দিলেন না। আজ রাত্রে আক্রমণ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বললেন। আপনি কি নিশ্চিত আজ আক্রমন হবে, আমি জিজ্ঞেস করলাম। প্রফেসর হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লেন। আধাঘন্টা অপেক্ষা করার পর আমাদের কাছে খবর আসলো আজকেও টহল টিমের একজনের উপর আক্রমণ হয়েছে। প্রফেসর ম্যাপের তিন জায়গায় তিনটি চিহ্ন দিয়ে আমাদের নিয়ে আক্রান্ত স্থানের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেলেন। আক্রান্ত স্থানে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে প্রফেসর রক্তের কিছু নমুনা নিয়ে ফিরে আসলেন। আমরা রুমে চলে আসলাম। প্রফেসর গার্ডসহ গাড়িতে গিয়ে উঠলেন।
আজ সকাল সকাল ঘুম ভেঙে গেলো। বাইরে বেরিয়ে দেখি প্রফেসর খালুজানের সাথে চা খেতে খেতে গল্প করছেন। গার্ডরা সারারাত ঘুমায় নি। তাই তাদের আমাদের পাশের রুমে ঘুমাতে দেওয়া হয়েছে। নাস্তা সেরে আমরা আবার গাড়িতে গিয়ে বসলাম। প্রফেসর এবার ম্যাপ বের করলেন। তিনি সম্ভাব্য তিনটি জায়গা অনুমান করেছিলেন যেখানে আক্রমণ হতে পারে। তার একটির সাথে মিলে গেছে। তাহলে কি আপনি প্যাটার্ন খুজে পেয়েছেন? হাসান জিজ্ঞেস করলো। সম্ভবত পেয়েছি, প্রফেসর উত্তর দিলেন। "আর রক্তের নমুনা?" আমি জিজ্ঞেস করলাম। প্রাথমিক পরীক্ষা নিরীক্ষা করে রিপোর্ট আমার ইনস্টিটিউটে মেইলে পাঠানো হয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা ডিটেইলস পেয়ে যাবো বলে প্রফেসর গাড়ি থেকে নামনেল।
আমরা পরবর্তী সম্ভাব্য আক্রমণের জায়গা পর্যবেক্ষণের জন্য বের হয়েছি। সকালে ফাহাদ এসে প্রফেসরের সঙ্গে দেখা করে গেছেন। ফাহাদ এ গ্রামেরই সন্তান। পড়াশোনার জন্য ঢাকা থাকে। প্রফেসর আসার খবর শুনে ফাহাদ এসেছে আমাদের সহযোগিতা করার জন্য। ফাহাদের জন্য আমরা অপেক্ষা করছি। সে ১০-১২ জনের একটি টিম নিয়ে পৌঁছলো। প্রফেসর ফাহাদকে ম্যাপের জায়গাটি দেখিয়ে এখানে নিয়ে যেতে বললেন। প্রফেসর আশা করেছিলেন এখানে একটি বাড়ি থাকবে কিন্তু এখানে দুইটি বাড়ি। বাড়ি দুইটির মাঝামাঝি একটি স্থান টার্গেট করে প্রফেসর সিসি ক্যামেরা গুলো লাগালেন। প্রত্যেকটা ক্যামেরায় আলাদা আলাদা মেমোরি দেওয়া আছে। অটোমেটিক সবকিছু রেকর্ড হতে থাকবে। " এখানে প্রাণীটির আসার সম্ভাবনা কত?" হাসান জিজ্ঞেস করলো। "আমার হিসেব ঠিক থাকলে মোটামুটি একশ ভাগ। আর হিসেবে ভুল হলে সম্ভাবনা শূন্য ", প্রফেসর উত্তর দিলেন।
আজ রাতে প্রফেসর গ্রামবাসিকে পাহাড়া দিতে নিষেধ করেছেন। রাত্রি প্রায় বারোটা বেজে গেছে। আমরা গাড়ির মধ্যে প্রানীটির জন্য অপেক্ষা করছি। আমাদের মাঝে শুনশান নীরবতা। হঠাৎ আকষ্মিক শব্দে আমরা নড়েচড়ে উঠলাম। হাসান গাড়ির গ্লাসের সাথে হেলান দিয়ে বসে ছিলো সেখানেই প্রাণীটা আক্রমণ করেছে। কাঁচের উপর জমা শিশিরে প্রাণীটির হাতের আঙুলের ছাপ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তার বডিগার্ড অলরেডি গান লোড করে ফেলেছে। প্রফেসর হাত ইশারায় তাকে থামতে বললেন। আমরা অপেক্ষা করছি পরবর্তী আক্রমণের। এদিকে শিশির পরে কাঁচের উপরের ছাপ মুছে যাচ্ছে। আমরা সতর্ক হয়ে গাড়ি থেকে নামলাম। প্রফেসর কাঁচের উপরের ছাপ থেকে নমুনা সংগ্রহ করলেন। একটা আঠালো মতো তরল লেগে আছে আমরাও দেখতে পেলাম। আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর প্রাণীটি আর ফিরে আসবে না নিশ্চিত হয়ে সিসি ক্যামেরা গুলো সংগ্রহ করে ফুটেজ চেক করতে লাগলাম। সিসি ক্যামেরাতে কিছুই পেলাম। এবার আমি ভয়ে শিউরে উঠলাম। তাহলে কি রঘু রামের বউ!
ঘটনার আকষ্মিকতায় আমরা সবাই নিশ্চুপ হয়ে গেছি। গাড়ির ভেতরে পিনপতন নীরবতা। "হাসান, আমরা একটি ভূল করে ফেলেছি", নীরবতা ভেঙে প্রফেসর বললেন।
কি? গ্রামবাসীর বর্ণনা শুনে আমরা ধরেই নিয়েছিলাম প্রাণীটি শিয়াল হবে তাই আমরা সমস্ত ক্যামেরা মাটির দিকে লাগিয়েছিলাম। তাহলে কি প্রাণীটি গাছ ব্যাবহার করে? সমস্ত প্রমাণ তো তেমনি নির্দেশ করে। আর সে কারণেই কোনো ঘটনাস্থলেই কুকুর প্রাণীটির অস্তিত্ব বুঝতে পারে নি। কুকুর মাটিতে কান রেখে ঘুমায়। মাটিতে কোনো তরঙ্গ হলে কুকুর বুঝতে পারে। প্রাণীটি মাটি ব্যাবহার করে কুকুর তার অস্তিত্ব বুঝতে পারে নাই। প্রফেসরের ব্যাখ্যা আমরা মন দিয়ে শুনলাম।
আমি ক্যামেরা নতুনভাবে সেট করার পরামর্শ দিলাম। প্রফেসর বললেন সেটা করে আর লাভ হবে না। আমি যে প্যাটার্ণ পেয়েছিলাম সে অনুযায়ী আজকের স্থান বুঝতে পেরছিলাম। আগামীকাল কোথায় আক্রমন হবে তা আমার ধারণার বাইরে। আমি মিস অনিতা জামানকে মেইল করে দিয়েছি উনি কাল আসবেন। যতটুকু জানতে পারলাম মিস অনিতা জামান একজন দক্ষ ট্র্যাকার। তিনি প্রাণীটির পায়ের ছাপ ধরে ট্র্যাক করে বের করবেন প্রাণীটির সঠিক অবস্থান।
অনিতা জামান এসে পৌছেছেন বেলা এগারোটার দিকে। এদিকে প্রফেসরের পাঠানো তথ্য বিশ্লেষণ করে রিপোর্ট পাঠিয়েছে তার ইনস্টিটিউট। ভিক্টিমের রক্তে প্রাণীটির দেহ নিঃসৃত তরলের সন্ধান পাওয়া গেছে। কিন্তু তারা বুঝতে পারেনি এটি লালা নাকি দেহ নিঃসৃত কোন তরল। কারণ, আমাদের জানা পৃথিবীর কোনো প্রাণীর সাথে এই নমুনার মিল পরেনি। তবে তারা নিশ্চিত করেছে প্রাণীটি গরম সহ্য করতে পারে না। সুতরাং সে ছায়া যুক্ত তুলনামূলক ঠান্ডা স্থানে থাকবে। সবকিছু পর্যালোচনা করে আমরা সবাই ঐক্যমতে পৌঁছেছি যে প্রাণীটি গ্রামের পূর্ব দিকের পরিত্যক্ত বাড়িটার কোথাও থাকে। কিন্তু আমাদের প্রাণীটির সঠিক অবস্থান নির্ণয় করতে হবে। আনিকা জামান গতরাতে আক্রান্ত স্থানে পর্যবেক্ষণ করে প্রাণীটির পায়ের ছাপ খুঁজে পেয়েছে। প্রফেসরের ধারণাই সঠিক প্রাণীটি চলাচলের জন্য গাছ ব্যাবহার করেছে। বিভিন্ন গাছে তার পায়ের চিহ্ন পরিত্যাক্ত বাড়ির দিকেই নির্দেশ করছে।
আনিতা জামান আরও এগিয়ে যাচ্ছিলেন। প্রফেসর বাধা দিলেন। প্রাণীটি সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারনা নেই। সে যে আক্রমনাত্মক তাতে কোন সন্দেহ নেই। গত কিছুদিনে বিভিন্ন গ্রামবাসিকে আক্রমণের মাধ্যমে তা প্রমাণিত হয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে বিপদের আঁচ পেলে সে কতটা আক্রমনাত্মক হবে। আমাদের একটু অসাবধানতা কারও প্রাণনাশের কারণ হতে পারে, একদমে কথাগুলো বললেন প্রফেসর।
তাছাড়া প্রফেসরের ইচ্ছা প্রাণীটিকে জীবিত ধরার। আমরা একমত হলাম না। আমাদের কাছে না আছে কোনো সরঞ্জাম না আছে কোনো দক্ষ লোক।
আমরা সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি প্রফেসরের সিদ্ধান্ত শোনার। বন্দুক চালাতে পারো? নীরবতা ভেঙে জিজ্ঞেস করলো প্রফেসর। আমি উত্তর দিলাম যে পারি না। তাছাড়া বন্দুক চালাতে পারলেই বা কি! বন্দুক পাবো কোথায়!
প্রফেসর গাড়ি থেকে একটি বাক্স নামিয়ে আনলেন। বাক্স খুলতেই আমার চক্ষু চড়কগাছ! বাক্সের ভেতর দুইটি থ্রি নট থ্রি ব্রিটিশ রাইফেল, দুইটি Springfield Armory নাইন এমএম পিস্তল। এখন আমার সাহস একটু হলেও ফিরেছে। চৌকিদার এবং দুইজন আনসার সদস্যের কাছে আছে তিনটি থ্রি নট থ্রি ব্রিটিশ রাইফেল আর প্রফেসরের কাছে আছে দুইটি। মোট পাঁচটি থ্রি নট থ্রি। চৌকিদার এবং আনসার মিলে কার্তুজ আছে ষোলোটি আর প্রফেসরের কাছে আছে চল্লিশটি। মোট ছাপ্পান্ন রাউন্ড। প্রফেসরের কাছে দুইটি এবং আনিতা জামানের কাছে একটি মোট তিনটি Springfield Armory নাইন এমএম। তিনটি রিভলবার ফুল ম্যাগাজিন লোড অর্থাৎ গুলি আছে ষাট রাউন্ড। আর প্রফেসরের বডি গার্ডের কাছে আছে ০.৭৬২এমএম চাইনিজ রাইফেল, অটো ফায়ার, একবার ঘোড়া টেনে ধরলে পুরো ম্যাগাজিন খালি হয়ে যাবে।
হাসানের হাতে একটি এবং আমার হাতে একটি রাইফেল ধরিয়ে দিতে দিতে প্রফেসর বললেন, "নিরস্ত্র কাউকে আমরা এই মিশনে নেবো না।" প্রফেসর একটি রিভলবার হাতে এবং আরেকটি রিভলবার কোমড়ে রাখলেন। তিনি আমাদের প্ল্যান এবং হাতের আঙুলের সংকেত বোঝাচ্ছেন। অপারেশন স্থানে কথা বলার সুযোগ থাকবে না তাই হাতের ইশারা বোঝা জরুরি। ইতিমধ্যে ফাহাদ বাছাই করা দশজনের একটা দল নিয়ে এসেছে আমাদের সাথে যাবে বলে। তাদের হাতে দেশীয় ধারালো অস্ত্র। প্রফেসর রাজি হচ্ছেন না। অপরদিকে ফাহাদের যুক্তি হচ্ছে তার গ্রামের জন্য বিপদের মধ্যে আমাদের একা যেতে দিবে না।
অনেক জোরাজুরিতে প্রফেসর রাজি হলেন। তবে শর্ত হলো যে, কেউ প্রফেসরের কমান্ডের বাইরে যেতে পারবে না। ফাহাদ রাজি হয়ে গেলো। প্রফেসর কোমরের পিস্তলটা ফাহাদের হাতে ধরিয়ে দিলেন এবং কিভাবে ফায়ার করতে হয় তা শিখিয়ে দিলেন।
গ্রামের সবাইকে স্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে ঘরের দরজা জানালা আটকে ঘরে থাকার জন্য। ঘন জঙ্গল। আনিতা জামান এগিয়ে যাচ্ছেন এক গাছ থেকে আরেক গাছে চিহ্ন খুজতে খুজতে। তাকে কাভার করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ফাহাদকে। ফাহাদ গাছ থেকে গাছে আনিকা জামানকে অনুসরণ করে এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা যাচ্ছি নীচ দিয়ে। প্রফেসর লোডেড পিস্তল নিয়ে সবার আগে। তার পেছনে তার বডিগার্ড। তার পেছনে পরপর আনসার দুইজন এবং চৌকিদার। তার পেছনে গ্রামবাসী। এদের মধ্যে দুজনের কাছে প্রফেসরের দুইটি বাক্স। ভেতরে কি আছে আমি নিজেও জানি না। সবার পেছনে হাসান। তার সামনে আমি। আমার প্রচন্ড টেনশন হচ্ছে। বন্দুক যদি না ফায়ার হয়, বললাম হাসানকে। প্রফেসর আমার দিকে ঈশারা করে চুপ করতে বললেন। মিনিট পনের হাঁটার পরে আমরা পুরনো বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালাম। বাড়ির বাড়ির সমস্ত দেয়ালে পরগাছা জন্মেছে। মনে হচ্ছে দেয়ালগুলো গাছের, তৈরী কেউ একজন হয়তোবা গাছের ফাঁকে ফাঁকে কিছু পুরাতন ইট রেখে দিয়েছে। চারদিকে পিনপতন নীরবতা। সবার হাত বন্দুকের ট্রিগারে। যাদের কাছে ধারালো অস্ত্র আছে তারাও প্রস্তুত মূহুর্তে আক্রমণ করার জন্য। বাড়িটি আমাদের ধারণার চাইতে অনেক বড়। আমরা সন্তর্পণে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলাম। আমরা একটা পুকুর পাড়ে এসে পৌছালাম। পুকুরের আয়তন খুব বেশী নয়। তিল লাফ দিলে পুকুর পেরিয়ে যাওয়া যাবে। পুকুরের চারপাশ বাধানো ছিলো তার চিহ্ন এখনও ভালোভাবেই বোঝা যাচ্ছে। আনিতা জামান এখন নীচে আমাদের সাথেই হাঁটছেন। প্রফেসর এবার ইশারা দিয়ে আমাদের একত্রিত হতে বললেন। আমরা পুকুর পাড়ে সবাই সবাইকে পেছনে রেখে গোল হয়ে দাড়ালাম। " পায়ের চিহ্ন এখানেই শেষ হয়ে গেছে", বললেন আনিতা জামান। প্রফেসরের হিসেব মিলছে না। তার মতে চিহ্ন কোনো সুরঙ্গের কাছে শেষ হওয়া উচিৎ। "যেহেতু প্রাণীটি গরম সহ্য করতে পারে না সেহেতু তার এই পুরাতন বাড়ির সুরঙ্গে থাকাটা প্রায় নিশ্চিত", বললেন প্রফেসর। আমরা মাথা নেড়ে সন্মতি জানালাম। প্রফেসর দেয়াল এবং মেঝে মনোযোগ সহকারে পরীক্ষা করতে লাগলেন। "প্রফেসর, আপনি কি মনে করছেন সুরঙ্গের মুখ লুকিয়ে রাখতে পারে?", হাসান জিজ্ঞেস করলো। "যেহেতু প্রাণীটি সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারনাই নেই সেহেতু সম্ভাব্য সবকিছুই মাথায় রাখতে হবে", উত্তর দিলেন প্রফেসর। আমরা একটা বৃত্তের মতো বলয় তৈরি করে প্রফেসর আর আনিতা জামানকে মাঝে রেখেছি। ইতিমধ্যে আনিতা জামান নতুন একটা চিহ্ন খুজে পেয়েছেন। সেই চিহ্ন ধরে ধরে এগুতে গিয়ে তিনি পৌছলেন পুকুরের মাঝে ঝুলে পরা গাছটিতে। তারপর আর কোনো চিহ্ন নেই। আগানোর মতো আর কোনো চিহ্ন আমাদের হাতে আর নেই। প্রফেসর হতাশ হয়ে একটা ইটের উপর বসে পরেছেন। আমরা চুপচাপ সতর্কার সাথে ট্রিগারে হাত দিয়ে দাড়িয়ে আছি। "পুকুরে খুঁজতে হবে", গ্রামবাসীর মধ্যে কেউ একজন বলে উঠলেন। প্রফেসর এ কথা শুনে লাফ দিয়ে দাড়িয়ে পরলেন। তাই তো আমরা তো পানির নীচের কথা চিন্তা করিনি। পানির নীচের চেয়ে শীতল জায়গা আর কোথায় পাওয়া যাবে! আনিতা জামান আরও কয়েকটা চিহ্ন পেয়েছেন। সবগুলো চিহ্ন ঐ ঝুকে পরা গাছে গিয়েই শেষ হয়েছে। তিনি গাছের গোড়ার মাটি পরীক্ষা করে বললেন, " আসলে পানি থেকে উঠানামার সুবিধার্থে গাছটিকে ইচ্ছে করেই বাঁকানো হয়েছে।
"যে যাতায়াতের জন্য ইচ্ছে করে গাছ বাঁকাতে পারে সে, আমাদের ধোঁকা দেওয়ার জন্যও গাছ বাঁকিয়ে রাখতে পারে",বললো হাসান। প্রফেসর সন্মতি জানালেন।" কিন্তু আমাদের হাতে আর কোনো ক্লু নেই সুতরাং পুকুর নিয়েই আমাদের ভাবতে হবে", প্রফেসর যোগ করলেন।
এবার আমরা পরলাম বড় সমস্যায় পুকুরের ভেতর প্রানীটিকে আমরা আক্রমণ করতে পারবো না। আমাদের অপেক্ষা করতে হবে সে নিজেই কখন বেরিয়ে আসবে। তাহলে আমাদের রাত পর্যন্ত এখানে অপেক্ষা করতে হবে। প্রাণীটির গতি সম্মন্ধে আমাদের কোনো ধারনা নেই। রাত্রে সে দশ হাত দূরে গেলেই গাছ আর অন্ধকারের জন্য আমরা তাকে দেখতে পাবো না। তাছাড়া যার গাছ হেলিয়ে যাতায়াত করার বুদ্ধি আছে তার কাছে আমরাই রাতে শিকারে পরিণত হবো না তার কি নিশ্চয়তা আছে। এখনো সূর্য ডোবা প্রায় দুই ঘন্টা দেরি আছে। যা করার এর ভেতরেই করতে হবে।
প্রফেসর একমনে ভাবছেন কি করা যায়। হঠাৎ করে উপর থেকে কয়েকটা ইট এসে আমাদের সামনে পরলো। প্রাণীটি ভেবে আমি প্রায় ট্রিগার চেপে দিয়েছিলাম। কেউ একজন দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিলো। পুরাতন দেয়াল ভেঙে পরেছে। প্রফেসর আবার উপর থেকে ইট ফেলতে বললেন। কথা না বাড়িয়ে একজন দেয়ালের উপরে উঠে আবার ইট ফেললো। প্রফেসরের মুখ দেখে বোঝা গেলো তিনি বিশেষ কোনো ক্লু খুঁজে পেয়েছেন। আবারও ইট ফেলতে বলে আমাদের পানির দিকে তাকাতে বললেন। আমরা অবাক হয়ে দেখছি। ইট পরার সাথে সাথে পুকুরের পানিতে গোলাকার একটা কম্পন সৃষ্টি হচ্ছে। বিষয়টি পরীক্ষা করার জন্য আরও কয়েকবার ইট ফেলানো হলো। প্রত্যেকবার একইভাবে পানিতে আলোড়ন সৃষ্টি হলো। প্রফেসর কিছু একটা নিশ্চিত হওয়ার জন্য পুকুর পাড়ে আলাদা আলাদা জায়গায় ইট ফেললেন। প্রতিবার একই ফলাফল পাওয়া গেলো। প্রফেসর কিছু একটা বলবেন আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি।
আমি যতদূর বুঝেছি প্রাণীটি মাটিতে সৃষ্ট কম্পনে সাড়া দিচ্ছে, প্রফেসর বললেন। তাহলে আমাদের কি করা উচিত? প্রফেসর আমাদের একসাথে সবাইকে মাটিতে আঘাত করতে বললেন। আমরা আঘাত করতে শুরু করলাম। প্রত্যেকবার মাটিতে আঘাতের সাথে সাথে পুকুরের পানি বড় আলোড়ন তৈরি হচ্ছিল। "প্রাণীটিকে পানির নীচ থেকে বের করে আনতে আরও বেশি কম্পনের প্রয়োজন", প্রফেসর বললেন। দূরে চেঁচামেচির শব্দ শুনে আমরা চুপ হয়ে গেলাম। ভাবলাম উত্তেজনায় ভূল শুনছি। কিন্তু সময় যাওয়ার সাথে সাথে শব্দ স্পষ্ট হলো। আমাদের এতো দেরি দেখে গ্রামবাসী একজোট হয়ে যার হাতে যা আছে তাই নিয়ে আমাদের খোঁজ নিতে এসেছেন। ফাহাদ এগিয়ে গিয়ে গ্রামবাসীকে বুঝিয়ে ফেরত পাঠানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু তাদের স্পষ্ট কথা। আমাদের এভাবে বিপদে ফেলে তারা যাবেন না। প্রফেসর হাত ইশারা করে ফাহাদকে ডাক দিলেন। গ্রামবাসীদের নির্দিষ্ট দূরে অবস্থান করতে বললেন। এখন আমার ভীতু ভাব কেটে গেছে। এতসংখ্যক লোক দেখে সাহস পাচ্ছি। প্রফেসর সিদ্ধান্ত নিলেন পুরো গ্রামবাসী মিলে আমরা একসাথে পা দিয়ে মাটিতে আঘাত করবো। তাহলে অনেক বেশি কম্পন তৈরি হবে। আর তার ধারণা সঠিক হলে প্রাণীটি অবশ্যই পানি থেকে উপরে উঠে আসবে।
গ্রামবাসী আসায় সুবিধার সাথে সাথে আমরা কিছু অসুবিধায়ও পরলাম। এখন আর ভূমির সমান্তরালে গুলি চালানো যাবে না। তাহলে গুলি যে কারো গায়ে লাগতে পারে। প্রফেসর আমাদের শুধু উপর দিকে গুলি চালানোর নির্দেশ দিলেন। পুকুরকে ঘিরে ধরে আমরা যেমন স্কুলে পিটি করি বাম-ডান- বাম তেমন করে একসাথে পা দিয়ে মাটিতে আঘাত করতে থাকলাম। মিনিট দুয়েক পরে পুকুরের পানি ঘোরা শুরু করলো। মনে হচ্ছিল ঘুরতে ঘুরতে সব পানি কোনো ছিদ্র দিয়ে নীচে নেমে যাচ্ছে। হটাৎ করে এক লাফ দিয়ে প্রাণীটি বেরিয়ে আসলো। মূহুর্তের গিয়ে বসলো সবচেয়ে বড় গাছটার মগডালে। ঘটনার আকষ্মিকতায় আমরা হাঁ হয়ে গেলাম। গুলি চালানোর কথা মাথায়ই আসলো না। তারপর সবার বন্দুক একসাথে গর্জে উঠলো। কিন্তু টার্গেট মিস। প্রাণীটি গিয়ে বসলো আরেকটি গাছের ডালে। সে এদিক- ওদিক ঘুরে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছে। প্রফেসর ঠোঁটে আঙুল রেখে আমাদের চুপ করতে বললেন। প্রাণীটিও চূপ হয়ে গেল। প্রফেসর বুঝে গেছেন প্রাণীটির দৃষ্টি শক্তি ক্ষীণ। হয়তো কম্পনের সাহায্যেই সে বস্তুর অবস্থান নির্ণয় করে। এর মধ্যে হঠাৎ করে হাসানের বন্দুক গর্জে উঠলো। এবার লক্ষ্যভেদ হয়েছে। প্রাণাটি এসে পরলো একদম আমাদের সামনে। কয়েকবার নড়াচড়া করে চুপ হয়ে গেলো। সারা শরীরে সেই অর্ধ তরল। গায়ে লোম নেই এমনকি চামড়াও নেই। থকথকে মাংস দেখা যাচ্ছে। যাকে এতোদিন আমরা শেয়ালের মতো শুনে এসেছি এখন দেখছি সম্পূর্ণ ভিন্ন। প্রাণীটি অনেকটা বাদুরের মতো। শরীরের আয়তন একটা শেয়ালের সমানই হবে। তবে পায়ের পাতাগুলো অস্বাভাবিক বড়। চোখ তুলনামূলক ছোট এবং নীল রঙের। মাথার মাঝ বরাবর গুলি লেগে একদম ওপাশ দিয়ে বেরিয়ে গেছে। চশমা পরা সাধাসিধে হাসানের মতো একজন নিরীহ মানুষ যে এত ভালো বন্দুক চালাতে পারে আমি বিশ্বাস করতেই পারছিনা। একটা বাক্সে প্রাণীটিকে নিয়ে আমরা ফেরত আসলাম। গ্রামবাসী উল্লাস করছে আমাদের ঘিরে আর প্রফেসর মনোযোগ দিয়ে প্রাণীটিকে পরীক্ষা -নিরীক্ষা করছে। আমাদের ইশারা দিতে প্রফেসরের কাছে এগিয়ে গেলাম। আমাদের যেমন মাংসের ভেতরে হাড় থাকে প্রাণীটির তেমন হাড় নেই। হাড়ের বদলে কোনো ধাতু রয়েছে। অবশ্য কি ধাতু প্রফেসর এখনো তা বুঝতে পারেন নি। শিরা -উপশিরার বদলে রয়েছে পাতলা চিকন ধাতব তার। উপরের মাংস আমাদের মতোই!
বাক্সভর্তি মৃত প্রাণীটিকে নিয়ে আমরা প্রফেসরের সাথে রওনা দিলাম। গ্রামবাসী অবশ্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছে আমাদের আর একদিন রেখে দিতে। কিন্তু প্রফেসরের তর সইছে না। হাসানও প্রফেসরের সাথে ল্যাবে যাবে। এতএব, আমার থাকার কোনো প্রশ্নই আসে না। গ্রামবাসী আমাদের বিদায় জানালো। রাত হয়ে গেছে কিন্তু আজ আর কারও চোখে কোনো ভয় নেই।
গাড়ী চলছে হাইওয়ে রোডে। আমরা যে যার মতো চুপচাপ বসে আছি। ইতিমধ্যে হাসানের ফোন বেজে উঠলো। শুধু শুনতে পেলাম হাসান অবাক হয়ে বললো, "কি!" "আবার আক্রমণ হয়েছে"? প্রফেসর জিজ্ঞেস করলো। হাসান হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো। প্রফেসর গাড়ি ঘুরাতে বললেন। তার ভাব দেখে মনে হচ্ছে তিনি আগেই জানতেন আবার আক্রমন হবে। "আপনি কি জানতেন আবার আক্রমণ হবে? "জিজ্ঞেস করলাম। প্রফেসর ল্যাপটপ খুলে দেখালো কিছুক্ষণ আগে মেইল এসেছে তার ইনস্টিটিউট থেকে। তারা রিপোর্ট দিয়েছে। গাড়ির কাঁচের আর রক্তে পাওয়া তরল এক প্রাণীর নয়। হাইওয়ের পাশে ফাঁকা জায়গায় প্রফেসর গাড়ি দাঁড় করালেন। আমাদের বাক্স চেক করতে বললেন। বাক্স খুলে আমরা হতবাক হয়ে গেলাম। আমি, হাসান এবং আনিতা জামান পরস্পরের দিকে বিষ্ময়ে তাকাচ্ছি, বাক্সে প্রাণীটির মৃতদেহ নেই।
প্রফেসর গা এলিয়ে দিয়ে বললেন," প্রস্তুত হও,আসল মিশন শুরু হচ্ছে! "
মৃত প্রাণীটির অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার বিষয়ে প্রফেসর আমাদের সম্ভাব্য ব্যাখ্যা দিয়েছেন। প্রফেসর গাড়ির ভেতরে ল্যাবে প্রাণীটির শরীরের সামান্য অংশ নিয়ে পরীক্ষা করার সময় শরীরের অংশটুকু আস্তে আস্তে অদৃশ্য হয়ে যায়। প্রফেসর জোর দিয়ে বললেন প্রাণীটির শরীর এমন পদার্থ দিয়ে করা হয়েছে যেন মৃত্যুর পর বাস্প হয়ে যায়। এতে কোনো প্রাণী ধরা পরলেও কোনো তথ্য কেউ উদঘাটন করতে পারবে না।
আমরা সম্ভাব্য পরিকল্পনা করছি কি করা যায়। আমাদের আসার খবর শুনে আনসার সদস্য দুজন এবং চৌকিদার ফিরে এসেছে। প্রফেসরের মাত্র ঘুম থেকে উঠেছেন। তার গা ছাড়া ভাব যেন কিছুই ঘটেনি। কোনো তাড়াহুড়ো নেই। চা খেতে খেতে তিনি ল্যাপটপ খুলে আমাদের কিছু পুরনো ছবি দেখালেন। ছবি গুলো তার ইনস্টিটিউটের এক সহকর্মী পাঠিয়েছেন। আমরা ছবি দেখে অবাক হলাম। বসন্তপুরে আক্রান্ত ব্যাক্তির গায়ের চিহ্ন আর ঐসব ছবির চিহ্ন হুবহু এক। প্রথম ঘটনা ১৮৯২ সালে বর্তমান ইথিওপিয়ায়। দ্বিতীয় ঘটনা ১৯০৩ সালে বর্তমান বলিভিয়ায় আর তৃতীয় ঘটনা ১৯১২ সালে বর্তমান রাশিয়ায়। এরকম আক্রমণের আরও ঘটনা শোনা গেছে কিন্তু সেগুলোর কোনো প্রমান নেই। কিন্তু তিন জায়গাতেই আক্রমণ পরবর্তী ঘটনা শুনে আমরা আঁতকে উঠলাম। তিনটি স্থানেই আক্রমণ পরবর্তী এক বছরের মধ্যে মহামারী ছড়িয়ে পরেছে। মহামারি পরবর্তী কোনো তথ্য কোথাও লিপিবদ্ধ করা হয় নি। কিন্তু, মহামারীর এতো বছর পরেও সেখানে কোনো বসতি গড়ে ওঠেনি স্থানগুলো এখনো ফাঁকা। মহামারীতে এলাকাবাসী মারা যায় নাকি পালিয়ে যায় সে বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। "তাহলে কি আক্রান্ত ব্যাক্তিদের শরীরে কোনো মহামারীর জীবানু ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে?", আনিতা জামান জিজ্ঞেস করলো। "আমার তা মনে হচ্ছে না", প্রফেসর উত্তর দিলেন। আমি প্রাণীটির থাবার অংশ পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখেছি যে মানুষের রক্তের বিভিন্ন কণিকা আলাদা আলাদা শিরায় জমা রয়েছে। হয়তো তারা রক্তের নমুনা পরীক্ষা করে দেখছে যে কি ধরনের মহামারীর জীবাণু ছড়িয়ে দেওয়া যায়। আমরা সবাই চুপচাপ প্রফেসরের কথা শুনছি।
"এতো বছর পরে এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি এক মহাপরিকল্পনার অংশ বলেই মনে হচ্ছে", প্রফেসর আবার বলতে শুরু করলেন। যদি তাই হয় তাহলে এর পেছনে বুদ্ধিমান কেউ আছে। এমনো হতে পারে তাদের জ্ঞান আমাদের মানুষ প্রজাতির চেয়েও অনেক গুন বেশি। "তাহলে এটি কোনো ভিনগ্রহের প্রাণীর কাজ?" হাসান জিজ্ঞেস করলো। নিশ্চিত নয়, প্রফেসর উত্তর দিলেন। "মানুষের জ্ঞান যে কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে সে বিষয়ে আমরা সাধারণ মানুষ কল্পনাও করতে পারি না", তিনি আরও যোগ করলেন। প্রতিনিয়ত কত জটিল গোপনীয় প্রজেক্ট যে এই পৃথিবীতে চলছে সে সম্মন্ধে আমাদের নুন্যতম ধারনাও নেই।
আমরা প্রফেসরের নেতৃত্বে আবার পুরাতন জমিদার বাড়ি পৌছালাম। এবার প্রফেসর অযাচিত শব্দ চাইছেন না। তাই শুধু গতকালের টিমটাকে তিনি নিয়ে এসেছেন। বাড়িটি বেশ বড়। প্রথম দিন এসে মূল বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করা হয়নি। আজ আমরা মূল বাড়ির ভেতবে প্রবেশ করেছি। যতটুকু চিহ্ন অবশিষ্ট আছে তাতে বোঝা যাচ্ছে তিন তলা তিনটি বিল্ডিং ছিলো। কিন্তু একটি বিল্ডিংয়েরও ছাদ অবশিষ্ট নেই। দুইটি বিল্ডিং পাশাপাশি। একটি বিল্ডিং একটু দূরে। মাঝখানে একটা পুকুর। পাশাপাশি দুইটি বিল্ডিংয়ের সাথে সংযোগ করে একটা চিলেকোঠা। শুধুমাত্র চিলেকোঠার ছাদটা অক্ষত আছে। কিন্তু চিলেকোঠার সিড়ি একদম ভেঙে গেছে। চিলে কোঠার নীচে একটি সুরঙ্গের অস্তিত্ব পেলাম। যদিওবা ময়লা আবর্জনায় সুরঙ্গের মুখ বন্ধ হয়ে গেছে।
হাসান প্রতিটি দেয়ালের নীচের অংশে অনুসন্ধান চালাচ্ছে। তার উদ্দেশ্য সুরঙ্গের অস্তিত্ব খুঁজে বের করা। আনিতা জামান গাছে গাছে প্রাণীটির পায়ের চিহ্ন খুঁজছেন। ড্রোন উড়িয়ে প্রফেসর রিসিভার -ট্রান্সমিটার খুজছেন। প্রফেসর নিশ্চিত হয়েছেন প্রাণীগুলোর সাথে তথ্য আদান প্রদানের জন্য অবশ্যই কোথাও রিসিভার এবং ট্রান্সমিটার লাগানো আছে। আর আমরা বাকিরা বন্দুকের ট্রিগারে রেখে সন্তর্পণে পাহারা দিচ্ছি। আমি বিরক্ত হচ্ছি পুকুরে কেন খোঁজা হচ্ছেনা। প্রফেসরের ধারণা এখানে একাধিক প্রাণী আছে। নিশ্চয় কোনো সুরঙ্গে তাদের আস্তানা আছে। হাসান কি যেন একটা খুঁজে পেয়েছে। আনিতা জামানকে হাতের ইশারায় ডাকলো। আমিও এগিয়ে গেলাম। ছোট্ট একটা সুরঙ্গ। ইদুরের গর্ত মনে হচ্ছে। গর্তে যাই থাকুক সে যে নিয়মিত আসা-যাওয়া করে তার চিহ্ন স্পষ্ট। আনিতা জামান আমার সাথে একমত হলেন। ইতিমধ্যে প্রফেসর এগিয়ে এসেছেন। তিনিও আমাদের সাথে একমত হলেন যে এটি ইঁদুরের গর্তই হবে। এবার মুখ খুললো হাসান। প্রফেসর আপনি কি লক্ষ্য করেছেন যে গতকাল এবং আজকে আমরা জঙ্গলে কিম্বা এই বাড়িতে কোনো একটা প্রাণীও দেখিনি। এমনকি কোনো পাখির শব্দও শুনিনি। প্রফেসর ফাহাদকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন এই জঙ্গলে কোনো পশুপাখি থাকে না? ফাহাদ বললো যে এর আগে যখনই সে এসেছে অসংখ্য শিয়াল এবং সাপ দেখেছে। এমনকি সাপের ভয়ে এই বাড়িতে কেউ আসতে চায় না। তাহলে কোনো প্রাণী নেই কেন? প্রায় সমস্বরে সবাই প্রশ্ন করলাম। প্রাণীগুলোর ভয়ে কিম্বা যে কারণেই হোক সাধারন প্রাণীগুলো জঙ্গল ছেড়ে পালিয়েছে, প্রফেসর বললেন। জঙ্গলের সব প্রাণীকে তো হত্যা করা হতে পারে, আমি বললাম। প্রফেসর বললেন, এ সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। তবে,,,। তবে কি? জিজ্ঞেস করলাম। এমনো হতে পারে প্রাণীগুলো যোগাযোগের জন্য এমন কোনো তরঙ্গ ব্যাবহার করে যার কারনে জঙ্গলের অন্যান্য প্রানী জঙ্গল ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। কথা ঠিক। অনেক কিছুই হতে পারে। এ বিষয়ে চিন্তা পরে করলেও চলবে আপাতত আমাদের অদ্ভুত প্রাণীগুলোর আস্তানা বের করতে হবে।
জঙ্গলে কোনো সাধারণ প্রাণী না থাকলে এই গর্ত দিয়ে কি যাতায়াত করে?, হাসান জিজ্ঞেস করলো। এবার আমরা নড়েচড়ে বসলাম। তাই তো! আনিকা জামান পরীক্ষা করে দেখলেন। ছাপ একদম টাটকা। তবে কি প্রাণীগুলো এই গর্ত ধরে কোনো সুরঙ্গে প্রবেশ করে! কিন্তু গতকাল আমরা প্রানীটির যে আকার দেখেছি তাতে এই গর্ত দিয়ে প্রবেশ করা কিছুতেই সম্ভব না। এমন নয়তো প্রাণীগুলো দেহের আকার পরিবর্তন করতে পারে!, বলে উঠলো হাসান। তাই তো! এই সম্ভাবনা তো ভেবে দেখিনি, প্রফেসর বললেন।
একমাত্র উপায় খুঁড়ে দেখা। কিন্তু প্রফেসর অযাচিত শব্দ তরঙ্গ তৈরীতে নারাজ।
প্রফেসর জ্যামিতি বক্স সদৃশ একটা যন্ত্র বের করলেন। ব্ক্সটির ভেতরে একটি মিনি কম্পিউটার। লিনাক্সের হ্যাকিং পাই। তিনি তরঙ্গের কম্পাংক কম বেশি করে পরীক্ষা চালাচ্ছেন। কম্পাংকের মিল পরলে যন্ত্রটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে এই প্রাণীগুলোর ব্যাবহৃত সার্ভারে যুক্ত হয়ে যাবে। অনেকক্ষণ চেষ্টা করার পরেও কোন রিসিভার বা ট্রান্সমিটারের সাথে যুক্ত হতে পারলেন না।
শেষ পর্যন্ত প্রফেসর গর্তটি খুঁড়ে দেখতে রাজি হলেন। মিনিট পাঁচেক হাতের ধারালো অস্ত্র দিয়ে খোঁড়ার পরে আমরা একটি সুরঙ্গ মুখ আবিষ্কার করলাম। উপর, নীচে, ডানে, বামে ইট দিয়ে বাঁধানো। বিশেষ বিপদে পালিয়ে যাওয়ার জন্য জমিদার হয়তোবা এই সুরঙ্গটি তৈরি করেছিলেন। আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। সুরঙ্গ আস্তে আস্তে প্রশস্ত হচ্ছে। এখন পাশাপাশি পাঁচ ছয়জন সুরঙ্গ দিয়ে অনায়াসে আরামে এগিয়ে যাওয়া যাচ্ছে। সবার মাথায় টর্চ লাগানো। এমন জায়গায় অক্সিজেনের অভাব হবে স্বাভাবিক। প্রফেসর আমাদের সতর্ক করে দিয়েছেন। অক্সিজেনের অভাব বোধ করলে সাথে সাথে আমরা ফিরে আসবো। ঘোরানো পেচানো রাস্তা ধরে প্রায় মিনিট পাঁচেক ধরে আমরা হাঁটছি। অক্সিজেনের অভাব হচ্ছেই না তো বরং আমরা আরও প্রাণ ভরে শ্বাস নিচ্ছি। মনে হচ্ছে কেউ যেন এখানে অক্সিজেন দিয়ে রেখেছে। আমরা এতো নীরবতার সাথে হাঁটছি যে আমাদের হার্টবিট যেন স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। হঠাৎ পু করে একটা শব্দ হলো। আমরা দাঁড়িয়ে গেলাম। প্রফেসর যন্ত্রটিতে অটো সার্চ দিয়ে রেখেছিলেন। যন্ত্রটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে একটি সার্ভারের সাথে সংযুক্ত হয়েছে।
মিনি কম্পিউটারে বিভিন্ন সিগন্যাল দেখাচ্ছে। মনিটরে ট্রান্সমিটারের সাথে প্রায় চল্লিশটি আলাদা আলাদা সিগন্যাল দেখাচ্ছে, প্রফেসর বললেন। তার মানে?, জিজ্ঞেস করলাম। মানে, এখানে অন্তত চল্লিশটি প্রাণী আছে। এবার আমরা চরমভাবে সবাই ভড়কে গেলাম। আমাদের যে জনবল আর গোলাবারুদ আছে প্রকৃত পক্ষে একটা প্রানীর সাথে পেরে উঠাই মুশকিল। চোখমুখের ভাব স্পষ্ট বলে দিচ্ছে কেউ আর এগোতে চাইছে না।
ইতিমধ্যে যন্ত্রটির মিনি স্ক্রিনে একটি ইংরেজি বাক্য ভেসে উঠলো। যার বাংলা অর্থ করলে দাঁড়ায়, "অনেক হয়েছে। আর না। জাহান্নামে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হও।"
এবার প্রফেসর চেচিয়ে বললেন, ''সবাই প্রস্তুত হও।'' মুহূর্তের মধ্যে প্রাণীগুলো এসে আমাদের সামনে হাজির হলো। হামলিয়ে পরলো আমাদের উপর। আমরা গুলি গুলি করতে করতে করতে পেছনে দৌড়াতে লাগলাম। কোনোমতে হামাগুড়ি দিয়ে সুরঙ্গের মুখে এসে বসলাম। প্রফেসর গুনে দেখলেন সবাই বের হতে পেরেছি। সবার শরীর রক্তে ভেজা। এখনো ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছে। মনে হচ্ছে সার্জারী ব্লেড দিয়ে শরীর কেউ চিরে দিয়েছে। শরীরে আর একটুও শক্তি অবশিষ্ট নেই। দেয়ালে হেলান দিয়ে বসলাম। তখনি প্রাণীগুলো লাফিয়ে লাফিয়ে আমাদের সামনে হাজির হতে লাগলো। সংখ্যা কত হবে গোনার অবস্থা নেই। মনে হচ্ছে যেন হাজার হাজার। বডিগার্ড ফায়ার করলেন। শুধু টুং করে শব্দ হলো। গুলি শেষ। পরপর আরও কয়েকটা ফায়ারের শব্দ শুনতে পেলাম। সেই একই শব্দ 'টুং'। বুঝলাম সব গোলাবারুদ শেষ। আমি ধীরে ধীরে চৈতন্য হারিয়ে ফেলছি। চোখের সামনে ভেসে উঠছে বউ, ছেলে,খেলার মাঠ, বন্ধু, আত্মীয় স্বজনের ছবি ভেসে উঠছে।
সম্বিত ফিরে পেয়ে দেখলাম একটা প্রাণী আমার মাথার উপরে। সমস্ত শক্তি একত্রিত করে ঘুরে ট্রিগারে চাপ দিলাম। ফায়ারের আওয়াজ হলো। কিন্ত টার্গেট মিস। বিপদ বুঝে প্রাণীটি সরে গেছে। আবার ফায়ার করলাম। এবার সেই 'টুং' আওয়াজ হলো। গুলি শেষ। আমি শেষবারের মতো পৃথিবীটা দেখে নেওয়ার চেষ্টা করলাম। স্পষ্ট দেখতে পেলাম মিস হয়ে গুলিটা তিন তলার উপরে ভাঙা দেয়ালের উপরে যে অংশে লেগেছে সেখান থেকে ধোঁয়া বেরুচ্ছে। মূহুর্তে বিকট গর্জনে সেখানে বিস্ফোরণ হলো। সাথে সাথে প্রাণীগুলো আমাদের চারপাশে এমনকি শরীরের উপরে এসে কয়েকটা পরলো। আমি চুপ করে শুয়ে রইলাম। কোথাও কোনো নড়াচড়ার শব্দ নেই। আমার শরীরের উপর থেকে কে যেন একটা প্রাণীকে সরালো। সেও ভীষণভাবে আহত। আমি আবার দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বসলাম। প্রফেসর পরীক্ষা করে বললেন যে প্রাণীগুলো মার গেছে। প্রাণীগুলো যে যন্ত্রের মাধ্যমে সিগন্যাল পেতো ভুলক্রমে আমার গুলিতে সেই যন্ত্রটি বিস্ফোরিত হয়েছে। আর সিগন্যাল নেই মানে প্রাণীগুলো মৃত, প্রফেসর ব্যাখ্যা করলেন। প্রফেসরের সারা শরীর দিয়ে রক্ত ঝরছে। তিনি দেয়ালে হেলান দিয়ে একটি সিগারেট ধরালেন। আমার দিকে একটি এগিয়ে দিলেন। আমি সিগারেটের ধোঁয়ার সাথে প্রাণীগুলোর শরীর ধোয়া হয়ে উড়ে যেতে দেখছি। স্বপ্ন নাকি বাস্তব বুঝতে পারছি না। তারপর আর কিছু মনে নেই।
চোখ মেলে দেখি আমি হাসানের খালা বাড়িতে। বিস্ফোরণের শব্দ শুনে গ্রামবাসী ছুটে গিয়ে আমাদের উদ্ধার করে নিয়ে আসে। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম সবাই সুস্থ আছে। ঘটনার গুরুত্ব বুঝে উপজেলা থেকে ডাক্তার পাঠানো হয়েছে। কেমন ঘুম হলো?, "প্রফেসর জিজ্ঞেস করলেন। জানতে পারলাম আমার জ্ঞান সবার পরে ফিরেছে। পুরো টিম আমার হাতে হাত রাখলো। প্রফেসর প্রতিজ্ঞা করলেন এর প্রতিশোধ তিনি অবশ্যই নিবেন। প্রিয় পাঠক, প্রতিশোধ অবশ্যই নেওয়া হবে। কিন্তু সেটা---- আরেক গল্প!