রাহুল শহরের কোলাহলে ব্যস্ত জীবন কাটাচ্ছিল। সকাল আটটায় অফিস, রাত দশটায় বাসায় ফেরা। একঘেয়ে রুটিন, তবুও সে নিজের স্বপ্নের পেছনে ছুটে চলেছে। সে একটি নামকরা বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের প্রজেক্ট ম্যানেজার। গাড়ি, অ্যাপার্টমেন্ট, বড় ব্যাংক ব্যালান্স—সবই তার আছে। তবুও ভিতরে এক গভীর শূন্যতা কাজ করত।
তার মা-বাবা গ্রামে থাকেন। দারিদ্র্যের মধ্যেও রাহুল কখনো কিছুতে অভাব অনুভব করেনি। তার বাবা-মা নিশ্চিত করেছিলেন, সে যেন ভালো শিক্ষা, পরিপাটি পোশাক আর পুষ্টিকর খাবার পায়। বাবা ছিলেন একজন স্কুল শিক্ষক, মা ছিলেন গৃহিণী। নিজের চাহিদাকে গুরুত্ব না দিয়ে তারা সবকিছু ত্যাগ করেছিলেন ছেলের ভবিষ্যতের জন্য।
ক্যারিয়ারের শুরুতে রাহুল প্রায়ই ফোন করত, বছরে কয়েকবার বাড়ি যেত। কিন্তু ধীরে ধীরে মিটিং, ক্লায়েন্ট ভিজিট আর ডেডলাইনের চাপে তার মা-বাবা যেন অগ্রাধিকারের তালিকা থেকে পিছিয়ে যেতে লাগলেন। ফোনকলগুলো সংক্ষিপ্ত হয়ে গেল। “আমি ভালো আছি, তোমরা কেমন?”—এই পর্যন্তই সীমাবদ্ধ রইল কথোপকথন।
একদিন হঠাৎ খবর এলো—বাবা স্ট্রোক করেছেন, হাসপাতালে ভর্তি। মা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললেন, “তোর নামই বারবার নিচ্ছে। একবার চলে আয় রাহুল।”
রাহুলের ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। নিজেকে আর ক্ষমা করতে পারল না। ভারী মন নিয়ে পাঁচ বছর পর গ্রামে ফিরে গেল।
বাড়ি পৌঁছে চারপাশটা অচেনা মনে হলেও, উঠোনটা যেন আগের মতোই রয়ে গেছে—সময় থমকে গেছে সেখানে।
সে দ্রুত হাসপাতালে ছুটে গেল। বাবাকে বিছানায় নিস্তেজ চোখে শুয়ে থাকতে দেখে তার হৃদয় ভেঙে গেল। কিন্তু রাহুলকে দেখেই বাবার চোখ জ্বলে উঠল। দুর্বল হাতে হাত বাড়িয়ে বললেন, “আমার ছেলে এসেছে। এটুকুই তো চেয়েছিলাম।”
রাহুল মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “আমি অনেক বড় ভুল করেছি মা। সব কিছু থাকলেও, তোমাদের ছাড়া আমি কিছুই না।”
সেই মুহূর্তেই রাহুল সিদ্ধান্ত নিল—মা-বাবাকে শহরে নিয়ে আসবে। এখন সে বুঝেছে, তার জীবনের কেন্দ্রবিন্দু তার মা-বাবা। অফিস, প্রজেক্ট, স্বপ্ন—সবই থাকবে, কিন্তু মা-বাবা একজনই, এবং তারা সারা জীবন অপেক্ষা করেন না।
নৈতিক শিক্ষা:
মা-বাবা আমাদের শিকড়। যতদূরই যাই, যত ওপরে উঠি না কেন—শিকড় ভুলে গেলে, সবচেয়ে বড় গাছও একদিন মরে যায়।
সময় ও উপস্থিতিই হচ্ছে সবচেয়ে বড় উপহার, যা আমরা আমাদের নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসা দেওয়া মানুষদের দিতে পারি।