যে কৃষি কাজ করে তাকে কৃষক বলে, লিখতে পারলে বলা হয় লেখক। খুব ছোটবেলার ভাবনা ছিল এরকম। বর্ণমালা শিখতে শিখতে কালো স্লেটের উপর সাদা চক দিয়ে লেখা শুরু করেই নিজেকে লেখক মনে করতাম। ততদিনে শরীরের নরম হাড্ডি বেশ শক্ত হয়েছে। স্কুলের অনেক পরীক্ষায় মূল শীট শেষ করে এক্সট্রা পেজেও উত্তর লিখেছি। এখনকার দিনের মত গুজব কিং সোশাল মিডিয়া না থাকলেও বাজারে চাউর হয় যে, স্যারেরা বিঘত মেপে মেপে নাম্বার দেন। কিন্তু সে আশার গুড়ে বালি ঢেলে দেয় পরীক্ষার রেজাল্ট।
এরপর জানতে পারি, সাবরেজিস্ট্রি অফিসে যারা সকাল সন্ধা দলিল লিখেন তাদেরকে লেখক বলা হয় (আদতে দলিল লেখক, সেটা পরে জানি)। মনে মনে বললাম, যাক বাবা বেঁচে গেছি, সকাল সন্ধা ওভাবে কলমপেষা সম্ভব নয়। এরপর গঙ্গা, যমুনা, নীল নদ কিংবা আমাজনের তলদেশ দিয়ে কত জল গড়িয়েছে, খোদ আমেরিকার প্রেসিডেন্টও সে খবর রাখতে পারেন নি। গাধার দলের বিল ক্লিনটন না, হাতির পালের কোন প্রেসিডেন্টের পক্ষেও সেটা সম্ভব হয়নি।
২.
নেত্রকোনা শহর থেকে খুব ভোরে রওয়ানা হয়ে মদনের গুদারা ঘাটে গিয়ে শুনলাম, দিনের শেষ ট্রলার আমাকে না নিয়েই চলে গেছে খালিয়াজুড়ির উদ্দেশ্যে। সকাল সকাল ছ্যাকা খেয়ে মন খারাপ। মাত্র কয়েকদিন আগে চাকরিতে ঢুকেছি। সারা দেশজুড়ে দুরন্ত গতিতে মোবাইল টাওয়ার নির্মান চলছে। কোম্পানী বেতন দিচ্ছে, সার্ভিস পাচ্ছে না। জানি মিশরীয় বস মিনা এরকম কিছু বলবে। কিছুটা এগুতেই এক লোকের সাথে দেখা। আগের রাতে তার নৌকা চুরি হয়েছে। নৌকা চুরি করে ঘরে লুকিয়ে রাখা যায় না, খালের বা নদীর কোন বাঁকে রাখতে হয়। তার টার্গেট নদী খাল ধরে খালিয়াজুড়ি পর্যন্ত যাওয়া। চাইলে আমিও যেতে পারি। বয়স তখন বেশ কম, নতুন চাকরি, সিদ্ধান্ত নিতে এক মিনিটও নষ্ট করি না। ওনার সাথে চলা শুরু করি। চড়া রোদ, চারদিক খাঁ খাঁ করছে। হাঁটতে হাঁটতে পানির পিপাসায় গলায় শুকিয়ে আসে। উপায় না দেখে এক পুকুরের পানি খাই।
অন্য একদিনের কথা। টেলিকমের কাজে বরগুনার পাথরঘাটা গেছি। কাজ শেষ করে মঠবাড়িয়া হয়ে ঢাকা ফিরবো বলে বাসে উঠি। ও মোর খোদা! বাস নয়, মনে হয় ছোট ডিঙি নৌকায় আমরা ফিরছিলাম উত্তাল সাগরের ঢেউ ভেঙ্গে ভেঙ্গে। আল্লাহর দুনিয়ায় এমন খারাপ রাস্তাও থাকতে পারে!!
মনে পড়ে, স্পিড বোটে পদ্মা পাড়ি দেয়ার সময় হঠাৎ করে পাগলা ঢেউয়ের কবলে পড়ে মরতে মরতে বেচে যাওয়ার স্মৃতি। কিংবা খুলনা যাওয়ার পথে পাটুরিয়ার আগে বাস উল্টে খাদে পড়ে যাওয়ার ঘটনা। ট্রমা কেটে গিয়ে হুশ কিছুটা ফিরলে প্রথমেই মাথায় আসে, আমি কি দুনিয়ার এ পারে নাকি ওপারে?
৩.
মৃতপ্রায় ইছামতি নদীর দুই তীরে গড়ে ওঠা পাবনা শহরের লাইব্রেরী বাজার লাগোয়া একটা অফিস। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারি হিসেবে প্রথম পোস্টিং হয়েছে সেখানে। সেই অফিসে বসে নিজের জীবনের এরকম অনেক গল্পের ঝাপি খুলে বসেছি এক সিনিয়র সহকর্মীর সামনে। টেলিকমের চাকরির সুবাদে তখন ঝুলিতে বৈচিত্র্যময় ভ্রমণ অভিজ্ঞতা।
আমার গল্প শুনে সিনিয়র কলিগ বললেন, স্মৃতি এখনও সতেজ ও টাটকা আছে, ভুলে যাওয়ার আগে লিখো ফেলো। কিন্তু নাদের আলীর মত আমিও ওনার কথা রাখতে পারিনি।
ছোটবেলা থেকে আউটবই পড়ার অভ্যাস শুরু হয়। বড়বেলায়ও সেটা ছাড়তে পারিনি। ফেসবুক আসার পরেও বহুদিন পর্যন্ত এক দুই লাইনের বেশি লেখা হয়ে ওঠেনি। মনে সুপ্ত বাসনা ছিলো বটে। সেটার অর্গল খুলে দেয় রিদমিক কিবোর্ড। এরপর দিনকে দিন নিজের ওয়ালের পোস্ট দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকে। যদিও ততদিনে বিঘত মেপে নাম্বার দেয়ার বিষয় ছিলোনা, স্রেফ ভালো লাগা থেকেই লিখতে থাকি।
৪.
২০২১ সাল। কর্মসুত্রে তখন নওগাঁয় থাকি। বর্ষা আসি আসি করছে। এমন এক দিনে ‘বর্ষা নামে যখন’ নামে একটা লেখা ফেসবুকের নিজের ওয়ালে দিই। ২/৩ দিন পর একটা প্রথম শ্রেণীর জাতীয় দৈনিক থেকে ফোন আসে। লেখাটা বর্ষা শিরোনাম বিশেষ ক্রোড়পত্রে তাঁরা ছাপতে চান। এরপর সেটা ছাপা হল প্রচ্ছদ লেখা হিসেবে। বাথরুম সিঙ্গারের মত আমি ছিলাম বাথরুম লেখক। ‘বর্ষা নামে যখন’ এর প্রকাশ আমার কাছে বাথরুম ছেড়ে স্টেজে উঠে গান গাওয়ার মতই। লেখক এখনও হয়ে উঠিনি, তবে বলতে পারি চেষ্টা সেখান থেকে শুরু। (সমাপ্ত)