রাত তখন তিনটা বাজে। শহর ঘুমিয়ে আছে, কিন্তু সায়মার ঘুম আসছে না। বাসার পুরনো দেয়ালঘড়ির টিক-টিক শব্দটা কিছুতেই সহ্য হচ্ছে না আজ। বাবা-মা দু’দিনের জন্য গ্রামে গেছে। পুরো বাসাটা আজ যেন অচেনা লাগছে—চুপচাপ, ভারী একটা নিরবতা যেন জমে আছে দেয়ালের গায়ে।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সায়মা আচমকা থমকে গেল। ঘড়িটার কাঁটা থেমে গেছে। ৩টা বেজে ০১ মিনিটে এসে দাঁড়িয়ে আছে। অথচ ঘড়িটা নতুন ব্যাটারি দিয়েই সেট করা হয়েছিল গত সপ্তাহে।
সায়মা উঠে গিয়ে ঘড়ির ব্যাটারিটা খুলে নিলো। ভাবল হয়তো মেশিনের সমস্যা। কিন্তু ঠিক তখনই সে শুনতে পেল এক ফিসফিসে আওয়াজ—একেবারে ঘড়ির দিক থেকে আসছে।
“সময় শেষ… সময় শেষ… সময় শেষ…”
ভয়ে গা ছমছম করে উঠল। সে পেছনে তাকাল, কেউ নেই। কিন্তু ঘড়িটা? ঘড়ির কাঁটা আবার নড়তে শুরু করেছে—এইবার উল্টো দিকে। মিনিট আর সেকেন্ড একসাথে ঘুরছে।
সায়মা হতবাক। ঘড়ির ব্যাটারি তোলা, তাও কীভাবে চলছে এটা?
তখনই দরজায় টোক টোক শব্দ। সে দম আটকে শুনে রইল। কারা টোকাচ্ছে? এত রাতে তো কেউ আসে না। ভয় আর কৌতূহল মিলে সায়মা ধীরে ধীরে দরজা খুলে দিলো।
কেউ নেই।
কিন্তু বারান্দায় ছোট্ট একটা ছায়া দেখতে পেল—একটা ছোট্ট মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে, সাদা জামা পরে, চুলগুলো সামনে ঝুলে পড়েছে। মুখ দেখা যাচ্ছে না।
“কে?” সায়মা ডাকল। কোনো জবাব নেই।
মেয়েটা ধীরে ধীরে মাথা তুলল। তার চোখ ছিল লাল, একদম লাল—যেন রক্ত ভেসে আছে। সায়মার পা অবশ হয়ে এল।
মেয়েটা ফিসফিস করে বলল, “তোমার সময় ফুরিয়ে এসেছে… ওরা আসছে…”
সায়মা ছুটে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো, ভেতর থেকে ছিটকিনি লাগিয়ে দিল। সে তখন হাঁপাচ্ছে। বুকটা ধড়াস ধড়াস করছে। আবার ঘড়ির দিকে তাকাল—এখন ঘড়ির কাঁচে আঁচড় কাটা দাগে লেখা, “তোমাকে চাই…”
তার নাম, “সায়মা”, ধীরে ধীরে ঘড়ির কাঁচের ওপর রক্তের মতো দাগে ফুটে উঠল।
সেই মুহূর্তে বিদ্যুৎ চলে গেল।
ঘর অন্ধকার। পুরো বাসা নিস্তব্ধ। ঘড়ির টিকটিক বন্ধ, কিন্তু সে শুনতে পাচ্ছে আরও কিছু—ছুটে আসার পায়ের শব্দ… যেন চারপাশ থেকে কেউ ছুটে আসছে, ছুটে আসছে তার দিকে।
একটা ঠাণ্ডা হাত তার কাঁধে স্পর্শ করল।
সে চিৎকার করে উঠতে চাইল, কিন্তু গলা দিয়ে আওয়াজ বের হলো না।
আর কিছু মনে নেই।
পরদিন সকালে, সায়মার খালা বাসায় এসে দেখলেন দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। অনেক ডাকাডাকির পরও সাড়া না পেয়ে তালা ভেঙে ঘরে ঢুকলেন। ঘরে কেউ নেই।
শুধু দেয়ালের ঘড়িটা উল্টো দিকে ঘুরছে… আর কাঁচের ওপর লাল অক্ষরে লেখা,
“একটা চলে গেল… এবার পরেরটা।”