প্রতিদিন বিকেল বেলা বারান্দার চেয়ারে বসে থাকেন আশরাফ মিয়া। হাতে একটা পুরনো চা–মাখা চিঠি আর চোখে দূরের রাস্তা। চিঠিটা আজ থেকে দশ বছর আগের—ছেলের পাঠানো শেষ চিঠি। তখন ছেলেটা প্রথমবারের মতো বিদেশ গিয়েছিল চাকরির সন্ধানে। বলেছিল, “বাবা, একটু কষ্ট করে কিছু দিন থাকেন, আমি খুব শিগগিরই ফিরব।”
প্রথম দিকে ফোন আসত, চিঠিও লিখত নিয়মিত। কিছু টাকা পাঠাতো, আর দুঃখ করত, “বাবা, তুমি একা আছো, খুব খারাপ লাগে।” আশরাফ মিয়া তখন প্রতিটি চিঠি গুছিয়ে রাখতেন—ছেলের হাতের লেখা, তার অনুভব, তার ভালোবাসা—সব যেন ওই চিঠিগুলোতে ছিল।
কিন্তু বছর দুয়েক পর হঠাৎ সব বন্ধ হয়ে যায়। ফোন বন্ধ, চিঠি আসা বন্ধ। প্রতিবেশীরা বলত, “ও তো এখন বিদেশে, নতুন জীবন পেয়ে গেছে, ভুলে গেছে বাপকে।”
আশরাফ মিয়া বিশ্বাস করতে পারেননি। তাঁর মন বলত, ছেলেটা এমন না। কোনো না কোনো কারণে যোগাযোগ করতে পারছে না।
সেই বিশ্বাস নিয়েই প্রতিদিন তিনি ডাকবাক্স খুলে দেখেন—হয়তো আজ একটা চিঠি এসেছে
বছর চলে যায়;
একা বার্ধক্যে পা রাখেন তিনি। চোখে ঝাপসা দেখে, হাঁটতে কষ্ট হয়। কিন্তু সন্ধ্যায় চিঠির আশায় বারান্দায় বসা থামে না। আশেপাশের মানুষ হাসাহাসি করে, কেউ কেউ দয়াভরে বলে, “চাচা, ও তো আর ফিরবে না। ভুলে যান।”
কিন্তু বাবা তো কখনো ভুলে যেতে পারে না।
এক শীতের সকালে তার নিথর দেহ পাওয়া যায় বারান্দায়, চেয়ারে বসা অবস্থায়। মুখে একটা হালকা হাসি, হাতে ধরা সেই পুরোনো চিঠি।
বুক পকেট থেকে আরও কিছু চিঠি পাওয়া যায়—সবগুলো খালি খাম।
নিজেই নিজের নামে লিখতেন, ছেলের নামে।
চিঠিগুলোয় কোনো শব্দ ছিল না, শুধু খাম—যেন শুধু নিজের বিশ্বাস ধরে রাখতে চাইতেন।
লোকজন বিস্মিত হয়, কষ্ট পায়।
তার মৃত্যুর পর পোষ্ট অফিসের কর্মচারী জানান, আশরাফ মিয়া প্রতিমাসে একবার নিজের ঠিকানায় এক খালি খাম পাঠাতেন। বলতেন, “চিঠি আসলে মনটা ভালো লাগে।”