নিলয় ছোট্ট একটা গ্রামে থাকে, নাম কচুয়া। গ্রামটা খুব একটা বড় নয়, কিন্তু প্রকৃতির রূপে ভরপুর। ধানের খেত, পাখির ডাক, আর আকাশ জুড়ে মেঘেরা সারাদিন খেলা করে। নিলয় ছিল একজন কল্পনাপ্রবণ ছেলে। তার চোখে ছিল স্বপ্নের ঝিলিক, আর মনের ভিতর ছিল দুঃসাহসী ইচ্ছার তরঙ্গ। সে বড় হয়ে একজন বিজ্ঞানী হতে চায়। কিন্তু সেই গ্রামে বিজ্ঞান ছিল যেন গল্পের মতোই কিছু – বইয়ে লেখা, কিন্তু বাস্তবে কল্পনাতীত।
নিলয়ের বাবা একজন কৃষক, মা গৃহিণী। সংসার চলে খুব কষ্টে। তবে তার মা-বাবা কখনো নিলয়কে স্বপ্ন দেখা থেকে বিরত রাখেনি। নিলয়ের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা ছিল তার স্কুলের শিক্ষক হুমায়ুন স্যার। তিনি সব সময় বলতেন, “স্বপ্ন দেখো, আর সেই স্বপ্নকে ছুঁতে সাহস রাখো। পরিশ্রম করলে কোনো স্বপ্নই অসম্ভব নয়।”
একদিন স্কুলে বিজ্ঞান মেলা হলো। সবাই কিছু না কিছু তৈরি করছিল – কেউ জ্যামিতিক কাঠামো, কেউ ছোট্ট মোটরচালিত গাড়ি। নিলয়ের মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। সে একটা সৌরচালিত বাতি বানাবে, যাতে গ্রামের ঘরে ঘরে আলো জ্বলে। তার নিজের ঘরেই তো রাতে আলো নেই! কেরোসিনের কুপি আর ধোঁয়ায় মা চোখে জল ফেলেন প্রতিদিন।
নিলয় দিনের বেলা পড়াশোনা করে, বিকেলে কাজ করে—কখনো বাজারে, কখনো কারো খেতে। সেই টাকায় সে টুকটাক যন্ত্রাংশ কিনে নিজের বাতি তৈরি করে। বহু রাত জেগে সে অবশেষে বানাল এক সুন্দর সৌরচালিত বাতি।
বিজ্ঞান মেলায় তার প্রজেক্ট দেখে সবাই বিস্মিত। বিচারকরা তাকে জিজ্ঞেস করেন, “তুমি এইসব কোথায় শিখলে?” নিলয় হেসে বলে, “ইউটিউব আর আমাদের হুমায়ুন স্যারের বই থেকে।”
সে মেলায় প্রথম স্থান অর্জন করে, এবং তাকে জেলা পর্যায়ে প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে বলা হয়। এরপর একে একে বিভাগীয়, জাতীয়, এমনকি আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান প্রতিযোগিতাতেও সে অংশ নেয়। তার প্রতিভা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে।
পাঁচ বছর পর, নিলয় পড়ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, পদার্থবিজ্ঞানে। একটা বৈজ্ঞানিক প্রকল্পের অংশ হিসেবে সে সৌরশক্তি ব্যবহার করে পুরো গ্রামের বিদ্যুৎ সমস্যার একটা টেকসই সমাধান তৈরি করে।
সেই প্রকল্প বাস্তবায়নের পর কচুয়া গ্রাম আর অন্ধকারে ডুবে থাকে না। ঘরে ঘরে আলো, শিশুরা পড়াশোনা করে রাতে, মা-বাবারা হাসে।
গ্রামের মঞ্চে দাঁড়িয়ে নিলয় বলে,
“স্বপ্ন দেখার সাহসটাই সবচেয়ে বড়। আমি শুধু দেখেছিলাম—আমার মা যেন আর অন্ধকারে বসে না থাকেন, আমার বাবা যেন চোখের কোণে ক্লান্তির রেখা না রাখেন।”
তার কথায় সবাই আবেগে ভেসে যায়। কচুয়ার মাটিতে সত্যিই জন্ম নিয়েছিল একজন বিজ্ঞানী—যে শুধু নিজের নয়, সবার জন্য স্বপ্ন দেখে।