একদিন শক্তি চট্টোপাধ্যায় আমার
কাঁধে হাত রেখেছিলেন—
না, আশ্বাস না,
পোড়া রোদে চোখ রেখে বলেছিলেন,
“এই ধোঁয়া, এই অন্ধ দুপুর, সবই প্রেম—
যদি একদিন তুমি জেগে ওঠো
নিজের ছায়াকে ছুঁয়ে, সম্পূর্ণ নিঃশেষ হয়ে।”
তারপর জীবনানন্দ দাস —
তিনি আসেননি,
একটা কাক কেবল ধাক্কা মেরে চলে গিয়েছিল বাতাসে,
আর আমি বুঝে ছিলাম—
দিনগুলো ঘাস হয়ে জন্মায়
প্রতিটি পা-ফেলা সন্ধ্যায়,
যেখানে মৃত্যু নয়,
জীবনই নিঃশব্দে ঝরে পড়ে ফুটপাতের পাশে।
আমি হেঁটে যাই,
জুতোর নিচে কাঁদে এলোমেলো স্বপ্ন,
কোনো দিন পকেট ভরে আনি কিছু অস্পষ্ট নাম,
কিছু পচা কবিতা,
আর শহরের রক্তে ভিজে-থাকা ব্যস্ততা।
এই ফুটপাত, এই নোংরা ক্যানভাস,
যেখানে প্রতিটি থুতু ফেলে রাখা ভাষা—
তাকেই আমি লিখে রাখি খোলা আকাশের নিচে।
আমি তাকিয়ে থাকি—
শুধু তাকিয়ে থাকি।
আর আমি খুঁজে পাই নিজের অস্থিমজ্জায়
একটা ধোঁয়াটে মানচিত্র:
যেখানে কবিতা বলে, “আমি বেঁচে আছি,
কিন্তু আমার শরীর নোংরা ফুটপাত।”
এলেন বুদ্ধদেব বসু—
তার ঠোঁটে ছিল না তর্ক, ছিল ছায়া—
যেন কবিতা নিজেই একটা সংক্ষিপ্ত তাপমাত্রা,
যেখানে তুমি বাঁচো, অথচ বোঝো না কেন।
তারপর এলেন সমর সেন—
একটা নিরুদ্বিগ্ন হাহাকার ছুঁয়ে গেল আমার বুকে,
কোথাও একটা কাঠফাটা দুপুর বলে উঠল—
"মানুষ বড়ো মফস্বলি হয়ে গেছে,
কবিতা নয় তারা খিদের কথা বলে।"
সুভাষ মুখোপাধ্যায় এসে দাঁড়ালেন জনতার মধ্যে—
হাত মুঠো করে বললেন,
"যদি লিখতেই চাও, তো গায়ে মাটি মেখে লেখো,
শব্দ নয়, ঘাম যেন পড়ে পড়ে জমে তোমার কাগজে।"
অমিয় চক্রবর্তী সেই বিকেলে
হেমন্তের আলোয় হেঁটে গেলেন,
তার কবিতা যেন নিঃশব্দ একটি পাতা—
ঝরে পড়ে, অথচ হৃদয়ে অনুরণন তোলে বহুদিন।
আমার শহর তখন হেঁটে যাচ্ছিল ব্যস্ত ট্র্যাফিকের দিকে,
আমি শুধু থেমে রইলাম—
শব্দেরা আমার দিকে চেয়ে বলল—
“তুমি এখন আর কবি নও,
তুমি নিজেই এক কবিতা।”
আমি তাকাই পেছনে—
আমার হাড়ের ভেতর বেজে ওঠে
কোন্ এক অন্ধকার বাঁশি,
যার সুরে কেঁপে ওঠে আদিম কৃষকের ক্লান্তি
আর আমি হেঁটে যাই কংক্রিটের চিৎকারে—
কিন্তু আমি তবু হাঁটি—
না, তাদের মতো হয়ে ওঠার জন্য নয়,
বরং হারিয়ে যাওয়া একটি যুগের শরীর ছুঁয়ে
নিজেকে চিনে নেওয়ার জন্য।
আমার কলমে কোনো চেতনা নেই, শুধু ধ্বনি—
যা ঝরে পড়ে লন্ঠনের গায়ে,
যেখানে জ্বলছে এখনো
অবসরের, প্রতিবাদের, নিভু নিভু এক কবিতা।
এই হাঁটা শেষ হয় না,
এই ছায়ারা ফুরোয় না—
কারণ তারা আমি নই,
তবু আমি তাদের ভিতরেই প্রতিদিন জন্মাই—
এক নতুন কবিতার জন্য।
০২/০৫/২৫ ইং।