আমার মনে হয় আগে মুরগী, পরে ডিম।
যদি ডিমই আগে আসে তা দিলো কে? বাচ্চা ফুটলো কিভাবে? এই বিতর্কের শেষ নেই। তবে আজ মুরগী আগে না ডিম, সেখানে প্রবেশ করে বিতর্কে জড়াতে চাই না। তাই এ অধমের সিদ্ধান্ত প্রথম লাইনে দিয়ে রেখেছি। মুরগী ডিমের উপর বসে তা দেয়, এরপর একটা সময় পরে সেই ডিম ফুটে ফুটফুটে সুন্দর মুরগীর বাচ্চা বের হয়ে আসে। এ বিষয়ে কোন বিতর্ক নেই।
বরফ অনেক ঠাণ্ডা হয়, সেই সময় বরফের তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রি (o degree) সেলসিয়াস হয়ে থাকে। সেই বরফে যদি তাপ দিতে থাকেন বেশ কিছু সময় লাগবে সেটা গলতে। বরফ পানিতে পরিনত হওয়ার আগে অনেকটা তাপ শুষে নেয়, কিন্তু তাপমাত্রা সেই ০(শূন্য) ডিগ্রি থাকে। একেই বলে সুপ্ততাপ, Latent Heat.
সুপ্ত তাপকে এক কথায় 'চুপ হুয়া রোস্তম'ও বলা যেতে পারে। নাটক-সিনেমা বা বাস্তব জীবনে, ক্যামেরার সামনে বা রাজনীতির মন্চে, যতজন থাকেন, তারচেয়েও বেশি লোক থাকেন এর বাইরে। ক্যামেরার সামনে যে মারপিট করে, চায়ের আড্ডার বক্তৃতায় যে সুনামি বয়ে দেয়, তাদেরকে আমরা আসল নায়ক ভাবি। কিন্তু এমনও হতে পারে, আসল নায়ক, খেলোয়াড় পর্দার আড়ালে রয়ে গেলো। এই দুজন দুজনার পরিপূরক। একজনকে ছাড়া অন্যজনের কাজ সম্পন্ন হয় না।
আমাদের সমাজ বিজ্ঞান মনস্ক নয়, কিন্তু চাল চলনে পদার্থ বিদ্যাকে কর্মগুরু মেনেছে। পদার্থবিদ্যা মানে ফিজিক্স বলে, কোন কিছুতে বল(শক্তি) প্রয়োগ করে যদি সেটারে সরানো যায়, তাইলে কাজ হবে, নাইলে নয়। একটা ফুটফুটে সুন্দর প্লাজার কলাম ধরে সারা দিন ঠেলে গেলেন, কিন্তু সেই কলাম তার নিজের জায়গায় থাকলো, তাহলে ফিজিক্স সেটাকে কাজ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে নারাজ। তবে ফিজিক্স এক অর্থে ভালো, কাজ হয়নি বলে ঘোষণা দিবে শুধু। কিন্তু একজন স্বাভাবিক মানুষ সারাদিন ধরে বিল্ডিং এর খুঁটি ঠেলতেছে, সমাজ তাঁকে পাগল বৈ অন্য কিছুই ডাকবে না। সমাজের বেশির ভাগ অংশের মত ফিজিক্সও 'নগদ নারায়ণ' এ বিশ্বাসী।
নগদ নারায়ণের উদাহরণ দিয়ে শেষ করা যাবে না। শুধু ছোট একটা ঘটনা বলি। সব কাজ ঠিকঠাক মত চলছে। তবুও একজন এসে বলছেন, ঠিক নাই। তাকে যখন সবকিছু পইপই করে বোঝানো হলো, ঠিক তখনই তিনি নগদ নারায়ণ হয়ে উঠলেন। বললেন, সব ঠিক থাকলে আমার কি লাভ।
আদিম অসভ্য পৃথিবীকে বদলে দিয়েছেন বড় বড় চিন্তাবিদ। যেকোন ধর্মের প্রধান পুরুষের সম্পর্কে খোঁজ নিলে জানতে পারবেন, তাদের প্রায় সকলেই ছিলেন চিন্তাশীল ব্যক্তি। জীবনের একটা বড় সময় তাঁরা নীরবে নির্জনে ধ্যান করেছেন, চিন্তা করেছেন। বিজ্ঞানে, সামাজিক তত্ত্বে, চিকিৎসায়, প্রকৌশলে, দর্শনে, গল্পে কবিতায়...... আজকে যে বিস্ময়কর উন্নতি সাধিত হয়েছে, এর বড় অংশ জুড়ে আছে চিন্তা। শুধু পাগল চিন্তামুক্ত, আর চিন্তামুক্ত থাকে কাঁঠালপাতা খেতে পছন্দ করা ছাগল।
আমরা অবশ্য ব্যতিক্রম। আমরা চিন্তাকে অচিন্তপুরের বনবাসে পাঠিয়ে দিয়েছি। আমরা চিন্তা করতে ঘৃণা করি। আমরা নগদ নারায়ণে বিশ্বাসী। তবে চিন্তা নাই বললেও ভুল হবে। আমাদের চিন্তা আমাদের মত। দুপুরে দুমুঠো ভাত গলা ঠেলে পেটে পাঠাতে পারলে চিন্তা আসে রাতের। গরম ভাতের সাথে অন্তত পোড়া বেগুন ভর্তা, মুগের ডাল আর দেশী ছোট চিংড়ির সাথে লাউশাকের ঝোল। এরও একটা চলতি নাম আছে, ধরো তক্তা মারো পেরেক।
অথচ আমাদের গলাবাজি করা লোক নয়, দরকার ব্যাক স্টেজে কাজ করা নায়কের। দরকার চিন্তাশীল ব্যক্তির, চটুল চুটকি বলে হাসানো জোকার নয়। ব্যক্তি, পারিবারিক বা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সঠিক পরিকল্পনা করে এগুনো দরকার। ভোজবাজি করা বাবাজির দরকার নেই। সমাজে নতুন তত্ত্ব, আবিষ্কার টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে নয়, জার্নালে প্রকাশ করা দরকার।
এই সমাজের বদল হোক ধীর লয়ে, সঠিক উপায়ে। বাংলাদেশ এগিয়ে যাক।