অধ্যায় ১: ধুলোর নিচে লুকানো চিঠি
সায়েরা আফরোজের দাদু রাশেদ সাহেব মারা গেছেন বছর খানেক হলো। পুরোনো বাড়ির সেই কাঠের আলমারিটা যেন এখনও তার উপস্থিতির সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সেদিন দুপুরবেলা, বইয়ের তাক গুছাতে গিয়ে সায়েরা হঠাৎ চোখে পড়ে কাঠের আলমারির নিচের খোপে একটা পাতলা হলুদ খাম। ধুলোমাখা, কোনায় সামান্য ছেঁড়া। চিঠির খামটায় লেখা—“রাশেদ, যদি এই চিঠি কখনো সায়েরার হাতে পড়ে, তাহলে জেনে নিও, আমার অপেক্ষা শেষ হয়নি।” নিচে শুধু লেখা—“মায়া।”
সায়েরা থমকে গেল। মায়া? কে এই মায়া? দাদুর কোনো আত্মীয়? নাকি কোনো পুরোনো বান্ধবী?
চিঠির কাগজটা অনেক পুরোনো, অথচ লেখাগুলো ঝকঝকে। যেন কেউ তার জন্যই আগলে রেখেছে।
অধ্যায় ২: চিঠির ভাষা, চেনা নয়
চিঠিটা খুলতেই সায়েরা বুঝতে পারল, এটা একটা প্রেমপত্র। কিন্তু ভাষা যেন কেবল প্রেমের জন্য নয়—অপেক্ষা, অভিমান, ভালোবাসা, আর বিসর্জনের মিশ্রণ।
"রাশেদ,
যেদিন আমি চলে গেলাম, সেদিন তুমিও চলে গেলে এক রকম। আমি জানি, আমরা একসাথে থাকতে পারিনি—কিন্তু ভালোবাসা কি শুধু একসাথে থাকার নাম? আমি সায়েরার হাসি কল্পনায় দেখি প্রায়ই। জানি, তুমি তাকে আমার গল্প বলনি কখনো। কিন্তু যদি কখনো সে জানতে চায়—তাকে বলো, আমি তাকে চেয়েছিলাম। ঠিক যেমন একটা অসমাপ্ত গল্প শেষের অপেক্ষায় থাকে।"
সায়েরা বাকরুদ্ধ হয়ে চিঠি পড়ছিল। তার দাদু কি কোনো গোপন প্রেমে জড়িয়েছিলেন? তাহলে সেই মায়া কে?
অধ্যায় ৩: দাদুর দিনলিপি
পরদিন, কৌতূহলে চুইয়ে পড়া মনে সায়েরা দাদুর স্টাডিরুমে খুঁজতে থাকে। সেখানে একটা পুরোনো ট্রাংকের ভেতরে সে খুঁজে পায় বেশ কয়েকটা পুরোনো ডায়েরি। তারিখগুলো ১৯৯৮ থেকে ২০০৪ সালের মধ্যে।
একটা পাতায় লেখা— "আজ মায়া চলে গেল। কেউ জানল না, আমি তার জন্য কতটা ভেঙে পড়েছি। আমার বাবা-মা মেনে নেয়নি ওকে। সমাজ, ধর্ম, শ্রেণি—সব কিছু বাধা হয়ে দাঁড়াল আমাদের মাঝে। কিন্তু সায়েরার জন্য ও যে কী রেখে গেছে, কেউ জানে না।"
সায়েরা এক মুহূর্তে স্থবির হয়ে যায়। মায়া… তার জন্য কিছু রেখে গেছেন? কী রেখে গেছেন?
অধ্যায় ৪: অজানা মায়া ও অচেনা সম্পর্ক
সায়েরা এখন দিশেহারা। সে মায়ের কাছে যায়। চিঠিটা আর ডায়েরির পাতাগুলো সামনে ধরে। মা কিছুক্ষণ স্তব্ধ থেকে বলেন—
"তুই যখন দেড় বছর বয়সী, তখন এক মেয়ে এসেছিল বাড়িতে। দাদু বলেছিল, এটা আমাদের আত্মীয়া। কিন্তু আসলে… সে ছিল মায়া। তোর দাদুর জীবনসঙ্গী হবার কথা ছিল সে। কিন্তু আমাদের পরিবার তাকে মেনে নেয়নি। তোর জন্মের আগে একদিন, চুপি চুপি এসে তোর একটা ছবি নিয়েছিল, আর রেখে গিয়েছিল একটা পুতুল… তোর প্রিয় পুতুলটা কি মনে পড়ে?"
সায়েরা যেন পেছনে ফিরে যায়, সেই ছোটবেলার খেলনার দিকে। গোলাপি জামা পরা ছোট্ট পুতুলটা—যেটা তার সবচাইতে প্রিয় ছিল।
অধ্যায় ৫: মায়ের মুখে সেই ‘নিঃশব্দ অতীত’
মা বললেন, “তোর দাদু ওকে অনেক চিঠি লিখতো, কিন্তু কখনো পোস্ট করতো না। সেই চিঠিগুলো আমি একদিন পুড়িয়ে ফেলি… কারণ আমি ভয় পেতাম, তুই যদি একদিন জানতে, তোকে যে ভালোবাসতো সে একদিন নিজের অস্তিত্ব লুকিয়ে রেখে গেছে। আমি জানি, আমার ভুল হয়েছিল।”
চোখের পানি আটকে রাখতে পারে না মা। সায়েরা প্রথমবারের মতো উপলব্ধি করে—প্রেম, ভালোবাসা, এবং পরিবার—এই তিনটার মাঝে কতটা জটিল সীমানা তৈরি হয় কখনো কখনো।
অধ্যায় ৬: ফিরে দেখা, ফিরে চাওয়া
সায়েরা সিদ্ধান্ত নেয়—সে চিঠিটা ফিরিয়ে দেবে। মায়া যদি এখনও কোথাও বেঁচে থাকেন, তবে তাকে জানানো দরকার, তার লেখা চিঠি পৌঁছেছে। দীর্ঘ অনুসন্ধানের পর সায়েরা খুঁজে পায় এক বৃদ্ধাশ্রম—সেখানে এক নারী, নাম ‘মায়া রহমান’। বয়স প্রায় ৭০ ছুঁই ছুঁই।
সায়েরা যখন সেখানে পৌঁছায়, মায়া তাকে দেখে প্রথমে চিনতে পারেন না। কিন্তু সায়েরা তার হাতে চিঠিটা দেয়। চোখের কোণে জমা জলরাশি যেন সময়ের বাঁধ ভেঙে দেয়।
“তুই... সায়েরা?”
সায়েরা মাথা নাড়ে। আর কিছু বলার প্রয়োজন পড়ে না। দু’জন মানুষ, এক জীবনের অসমাপ্ত অধ্যায়—শেষটুকু যেন লেখা হলো এক হারিয়ে যাওয়া ঠিকানার কলমে।
শেষ পৃষ্ঠা
চিঠিটা সায়েরা এখন নিজের ডেস্কে রাখে, একটা কাঁচের ফ্রেমে। পেছনে ছোট্ট করে লিখে রেখেছে—
“সব ভালোবাসা গল্প হয়ে ওঠে না, কিছু ভালোবাসা চিঠির মতো—পাঠকহীন, কিন্তু গভীর।”