
১. দি মার্ডার।
নিষ্প্রাণ অরণ্যের ওপরে/ ক্রোধে গর্জন করে বাতাস/ ঝরানোর মত কোন পাতা আর নেই
-সসেকি
গতরাতে একটা খুন হয়েছে। খুন হয়েছে যে সে অল্পবয়স্ক। মেয়ে। আমার নীচে থাকত বাসার। লোকজন ইতিমধ্যেই আসা শুরু করেছে। ফুল হাতে। ফুল উপহার পাওয়ার জন্যে মৃত্যুর কোন তুলনা হয় না। আমার হাতেও ফুল ছিল। আমার দিকে তাকিয়ে একজন তাই হাসলেন। আমিও হাসলাম। তিনি বললেন এসে যে
- আপনি কেমন আছেন?
আমি বললাম
- ফুল কিনলাম আজকে।
- নিজের জন্যে
- হুঁ
- ও , আমি তো ভাবলাম আপনি...
তিনি কথা শেষ করলেন না। হেঁটে চলে গেলেন। অন্যদিকে। মনে হল তিনি বিরক্ত হয়েছেন।
নিহত ব্যাক্তিকে ফুল না দিয়ে চলে যাচ্ছি দেখে সবাই অবাক হচ্ছিল। এমন করে তাকাল যে আমার খুব লজ্জা হল। আমি দৌড়ে আমার অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকে পড়লাম।
২. দি পোয়েট
কেঁদোনা, পোকারা / এমনকি প্রেমিক আর নক্ষত্রগণও / বিচ্ছিন্ন হবে
- ইসা
বিকেল হয়েছিল। পাশের ফ্ল্যাটের মনসুর সাহেব আমার বাসায় বেড়াতে আসলেন। আগে কবিতা লেখতেন তিনি। এ্খন বলে আর পারেন না। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম
- একদমই কি পারেন না?
- না।
যেন চিন্তা হচ্ছে আমার এভাবে বললাম
- ডাক্তার দেখাইসেন?
- হুমম। ডাক্তার বলেছে এই বয়সে আর কিছু করার নাই।
মনসুর সাহেবকে আমার একটু হিংসা হয়। তিনি খুব ফুল উপহার পান। প্রায়ই লক্ষ্য করেছি আমি এটা। বিষয়টা নিয়ে আমি চিন্তিত।
মনসুর সাহেব বেড়াতে আসার পরপরই বাইরে গুলির শব্দ শুনলাম। আমি বললাম
- গুলির শব্দ শুনলেন নাকী?
- শুনেছি। কাছে না। দূরে কোথাও।
আমরা একটু আশ্বস্ত বোধ করি। আবার খারাপও লাগে। মনে হয় কাছে থাকলেও আমাদের তেমন কিছু যায় আসে না। তিনি ঘাড় ঘুরিয়ে আমার টেবিলের উপর ফুলের তোড়াটা দেখলেন। জিজ্ঞেস করলেন
- আপনাকে ফুল পাঠালো কে?
আমি মিথ্যে করে বললাম
- আছে একজন। আপনে এখন মনে করেন যে চিনবেন না।
বলতে গিয়ে আমার গলা ভেংগে চোখে পানি চলে আসল। মনসুর সাহেব বিষয়টা খেয়াল করলেন মনে হয়। বললেন
- ফুলগুলো সুন্দর
- থ্যাংকিউ।
৩. ওয়াইফ
কি আশ্চর্য বিষয়/ এই বেঁচে থাকা/ চেরি ফুলদের নীচে
- ইসা
রাত একটা। দরজা ধাক্কাচ্ছে কেউ একজন। খুলে দেখলাম আমার স্ত্রী। তাকে মানা করেছি যেন রাত বিরেতে বাইরে না ঘুরে। এই প্রসংগে আমি তাকে ধর্ষিত বা খুন হবার ভয় দেখিয়েছি। তিনি মনে হয় এসব ভয় পান না। প্রায় রাতেই দেরী করে ফেরেন। এখন আর কিছু বলি না আমি। স্ত্রীর সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। আমরা এক সাথে থাকতে চাই না। কিন্তু সমস্যা হল এখন প্রায় রাতেই গুলির শব্দ হয়। মানুষের চিৎকার শোনা যায়। আমাদের খুব ভয় করে তখন। এরকম সময় গুলোতে আমরা একসাথে থাকি। আমরা কোন হাত ধরাধরি , জড়াজড়ি এসব করি না। আমাদের রান্নাঘরে একটা গোল ছোট্ট টেবিল আছে। টেবিলের দুপাশের বিপরীতমুখী চেয়ারে আমরা সারারাত বসে থাকি। যখন শব্দ হয় তখন আমার স্ত্রী কেঁপে উঠেন। দ্রুত একবার আমাকে দেখে নেন। তিনি যখন আমাকে দেখেন না তখন আমি তাকে দেখি। গুলি টুলির শব্দ হলে আমি কেঁপে উঠি না। স্থির হয়ে বসে থাকি। ভয় পেলে আমি নড়াচড়া করি না। আমি আর স্ত্রী একসাথে না থাকার অসংখ্য কারণের মধ্যে এটাও একটা। তিনি বলেছেন আমি নড়াচড়া কম করি। তার কাছে আমাকে শক্ত ফার্ণিচারের মত লাগে। আমার তাকে লাগে পুরাতন সাদা ফুলের মত। লালচে, কড়কড়ে এবং পুরোন।
স্ত্রী ঘরে ঢুকে গোলাপের তোড়াটা দেখলেন। বললেন
- তোমাকে ফুল পাঠাল কে ?
- নিজেই কিনসি আরকি।
- নিজের জন্যে নিজে ফুল কেনাটা হাস্যকর।
আমি চুপ থাকি। খেয়াল করলাম সারাদিনের ক্লান্তির পরও আমার স্ত্রীর গা থেকে ফুলের মত গন্ধ আসছে। আমার ওনাকে জড়িয়ে ধরার ইচ্ছা হয়। অনেকদিন এরকমটি করা হয় নি। স্ত্রীটি আবার এসব বিষয় চট করে বুঝে ফেলেন। তিনি শরীর ঝাঁকিয়ে রান্নাঘরের দিকে গেলেন। চুলা ধরাচ্ছেন। চা খাবেন মনে হয়। আমি রান্নাঘরের ছোট টেবিলে এসে বসলাম। স্ত্রীটির স্বভাব ভাল না। কেমন বাঁকা বাঁকা করে তাকাচ্ছেন। আর শরীর ঝাকাচ্ছেন। চা বানাল শেষ হলে তিনি আমার উল্টোদিকের চেয়ারে এসে বসেন। তখন বাইরে ছোট ছোট কয়েকটা বিস্ফোরণের শব্দ হয়। কিছু মানুষের চিৎকার শুরু হয়ে শেষ হয়ে যায়। স্ত্রীটি চায়ে চুমুক দেন অল্প অল্প করে। দ্রুত একবার আমাকে দেখে নেন। কি জানি বলতে গিয়ে বলেন না। আমি ধীরে ধীরে বললাম
- আমাকে কেউ কোন দিন ফুল পাঠায় নাই সেভাবে।
স্ত্রীটি একটু চমকে গেলেন। আমরা সাধারনতঃ ছোট টেবিলে বসে কোন কথা বলি না।
আমি চিন্তিত মুখে গোলাপের তোড়াটার দিকে তাকিয়ে থাকি। বাইরে গুলির শব্দ হয়। শব্দটি দিন দিন এগিয়ে আসছে। আমার স্ত্রী কাপ হাতে বসে থাকেন। তার গা থেকে তীব্র ফুলের গন্ধ আসে।
৪. একটা রিক্সা ভ্রমণের গল্প
বাইরে চলো / বরফের উল্লাস নেই /যতক্ষন না পিছলে পড়ি
-বাশোও
আমরা হাসপাতালে যাচ্ছি। মনসুর সাহেবকে গুলি করেছে। গতকাল রাতে। সকাল আটটার সময় শুনলাম। এখন বাজে নটা। খবরটা শুনেই স্ত্রী দৌড়ে কই চলে গেলেন। পরে বারান্দা থেকে দেখলাম তাকে বাইরে গেছেন। বেশ অবাক হলাম। যেকোন জায়গায় যাওয়ার আগে তিনি কিছুটা প্রস্তুতি নেন। পরিস্থিতি যেমনই হোক। আমার কাছে স্ত্রীর এই বিষয়টা ভাল লাগত। মনে হত তার সকল পরিস্থিতির দক্ষতা আছে। আমি পত্রিকা খুললাম। আসলে আমার স্ত্রীর আচরণে আমি বিস্মিত হচ্ছিলাম। আমি ভাবতাম মনসুর সাহেব খালি আমার বন্ধু। স্ত্রীটিও যে ওনার প্রতি এ জাতীয় আবেগ লালন করেন জানতাম না। একটু সময় নিয়ে পাজামা বদলে প্যান্ট পড়লাম। শার্ট ইন করলাম। চুলটা হাত দিয়ে আচড়ে ফেললাম। বাইরে বেরিয়ে দেখি স্ত্রীটি তখনও রিক্সা পাননি। আমি নামলে একটা রিক্সা পাওয়া গেল। স্ত্রীকে ইশারা করলাম। তিনি কাঁদতে কাঁদতে উঠলেন। আমার একটু অসোয়াস্তি হচ্ছিল। সবাই আমাদের দিকে কিভাবে জানি দেখছিলেন। আমি স্ত্রীকে বললাম
- শান্ত হয়ে বসো। সবাই তাকাইতেসে।
তিনি কান্না থামিয়ে রেগে গেলেন। বললেন
- সবাইরে নিজের মত ভাবস। সবাই তোর মত ইমোশানলেস সাইকো?
স্ত্রীটি চিৎকার চেচামেচি করছেন। আমার কাছে তাকে অরুচিকর লাগছে। ইচ্ছা করছে ধাক্কা দিয়ে রিক্সা থেকে ফেলে দেই। কিন্তু তা না করে আমি বললাম
- চিল্লাবি না মাগী , চুপ থাক।
আমি খারাপ শব্দ ব্যাবহার করলে তিনি চুপ করে যান সবসময়। এখনও তাই হচ্ছে। তিনি কাঁদছেনও না আগের মত। যিনি রিক্সা চালাচ্ছিলেন তিনি একবার আমার দিকে ঘুরে তাকিয়ে হাসলেন।
৫. দি হসপিটাল
ধরে নিন,/ আমি এমন কেউ যে ভালবাসে কবিতা /আর খেজুরগাছ
-শিকি
মনসুর সাহেব শুয়ে আছেন। হাসছেন তিনি। স্ত্রী ছুটে গেলেন। তিনি হয়তো মনসুর সাহেবকে চুমু খাবেন মনে হচ্ছিল। তেমনটা করলেন না। মনসুর সাহেবের হাত ধরে কাঁদতে লাগলেন। কেবিনে লোক আছে আরো। তাকাচ্ছে। মনসুর সাহেব হাসতে হাসতে বললেন
- আরে ভাবী কাঁদার কিছু নাই তো। আমি ঠিকই আছি।
ওনার মাথায় আর হাটুতে ব্যান্ডেজ। গুলি লেগেছিল হাটুর নীচটা ঘেষে। তিনি আছাড় খেয়ে পড়ে মাথা ফাটিয়েছেন। গুলির জখমটা ফ্লেশ উন্ড। অতটা ক্ষতিকর না। তথ্য গুলো আশেপাশের লোকেরা বার বার বলে যাচ্ছে। বলার ধরণগুলো নানানরকম। ধরণগুলোতে অবসাদ, আগ্রহ, ঘৃণা, রাগ, রসিকতা সবই আছে। মনসুর সাহেব আমাকে ডাকলেন। আমি হেসে হেসে এগিয়ে গেলাম। বললাম
- অবস্থা তো আপনার দেখা যায়... হে হে ... কেমন লাগতেছে এখন?
- এখন ভালই আছি। রুগী দেখতে আসছেন , কিছু আনেন নাই আমার জন্যে।
মনসুর সাহেব লোকটা রসিক আছে। আমি বললাম
- আরে ভাই আর কয়েন না হইসে যে... আপনের ভাবী মনে করেন যে এম্নে দৌড় দিছে...
- ভাবীকে তাড়া করতে করতে আপনেও চলে আসলেন , নাকী ? হা হা ...
তিনি হাসতে লাগলেন। আমার স্ত্রী এখনও ওনার হাত ধরে বসে আছেন। আমি বললাম
- জিনিয়া ওনার হাত ছাইড়ে দাও। যেমনে ধরছ তাতে এখন তো দেখা যায় ওনার ব্লাড চলাচল বন্ধ হয়ে যাইব।
স্ত্রী আমাকে উত্তর দিল না। মনসুর সাহেবকে বলল,
- মনসুর ভাই , আপনি এভাবে রাত বিরেতে কই গেছিলেন ?
অভিমান অভিমান কন্ঠ দেখলাম তার। এখনও ওনার কাছে মনসুর সাহেবের হাত বন্দী। নাকী মনসুর সাহবের কাছে তিনি। দেখলাম বন্দী হওয়াটা উভমুখী। মনসুর সাহেব বললেন
- আমার এক বন্ধুর মেয়ের বিয়েতে গেসিলাম। অনেকদিন পর দেখা। আড্ডা দিতে দিতে দেরী করে ফেলসি। সাইন্সল্যাবের কাছে নামসি রিক্সা থেকে। কোত্থেকে গোলাগুলি শুরু হল.....
আমার স্ত্রী হাঁ করে গল্প শুনছে। মনসুর সাহেবও গল্পটা মনে হয় তাকেই বলছেন। আমি এখন আর শুনছি না। একটু আগে দুজন ভদ্রলোক বলাবলি করছিলেন। তখন শুনে ফেলেছি। আমি পাশে একজনকে বললাম,
- ভাই পানি কই পাওয়া যাইতে পারে আপনে কি বলতে পারেন....?
তিনি বললেন যে তিনি বলতে পারেন না। মনসুর সাহেব গল্প থামিয়ে আমাকে বললেন
- বাইরে ফিল্টার আছে মনে হয়।
গল্পে বাধা পড়ায় স্ত্রী বিরক্ত হচ্ছেন। কেঁদে কেঁদে ওনার চোখ লাল। ফোলা ফোলা। বিরক্ত হয়ে তাকাচ্ছেন বলে আরও বাজে দেখাচ্ছে। আমার অসহ্য লাগল। আমি বেরিয়ে গেলাম।
৭. ধর্ষণ

যদি তুমি রেখে যাও,/ শুধুমাত্র একটা জোনাকীর ঝিকমিক -/ ধন্য হে প্রভু! ধন্য স্বর্গ!
- ইসা
সকাল। লোকজন জড়ো হয়েছে। দুটো ধর্ষনের লাশ পাওয়া গেছে। ফজরের নামায শেষে কয়েকজন মিলে হাটতে বের হয়েছিলেন। একদল বৃদ্ধ। নামাযের পর তারা দৈনিক হাঁটেন। তারা লাশ দুটো প্রথমে দেখলেন । দুটো লাশের মধ্যে একটা পুড়ে গেছে। কয়লার মূর্তির মত। ইলেকট্রিকের খাম্বার সাথে বাঁধা ছিল। পেট্রল ঢেলে পুড়িয়েছে মনে হয়। লাশটা কেমন কুকড়ে আছে। দাঁতগুলো পোড়েনি। দূর থেকে যতটুকু মনে হল যে মেয়েটার সামনের দাঁতগুলো ছোট ছোট , ফাঁক ফাঁক ছিল।
অন্য লাশটা পোড়ায় নি। মেয়ে মানুষ, সুন্দর। লাশটা নগ্ন। দুই পা দুদিকে ছড়ানো। যোনির অংশে একটা লোহার রড ঢোকানো। রক্ত চুঁয়ে পড়ে রাস্তায় জমাট বেঁধে আছে। স্তনগুলো বেগুনী বেগুনী। ফুলে আছে।
আমি ঘটনার কেন্দ্রস্থলে দাড়িয়েছি। লাশ দুটো একদম রাস্তার উপরেই। পাহারা দেয়ার জন্যে একটা পুলিশ রেখে গ্যাছে, অন্য পুলিশরা। সে কাউকে বলছে না তেমন কিছু। পুলিশটার শার্টের বোতাম খোলা। বুকের লোম দেখা যায়। কাঁচাপাকা। তার গোঁফ আছে। বৃদ্ধদের দলটাও এখানে আছে। ওনারা বর্তমানে চারজন। আমি একজনের পাশে দাড়ালাম বলে তিনি আমার সাথে কথা বলতে শুরু করলেন। তিনি দুহাতের তালু একসাথে করে একটা ভি চিহ্নের মত দেখিয়ে বললেন
- দুই পা দুইদিকে এভাবে ছড়ায়ে আছে কেন বুঝতে পারলেন?
- না তো...
- দুজন দুদিক থেকে দুই পা ধরে হ্যাচকায়া টান দিছে।
বৃদ্ধের বলার ভঙ্গি আবেগবর্জিত। এখন তিনি দুই হাতে গোল গোল করে কি জানি বোঝাচ্ছেন। তার কন্ঠ উৎসবমুখর। আমি মাথা নাড়ছি। তবে কোন কথা খেয়াল করছি না। আমি অন্য লোকদের দেখছি। কয়েকটা ছেলে দাড়িয়ে আছে কলেজড্রেস পরা। তারা সংখ্যায় তিন জন। এরা স্থির হয়ে দেখছে লাশগুলো। পুড়ে যাওয়াটাতে লোকেদের অত মনযোগ নেই। সবার আগ্রহ যেটা পুড়ে যায় নি সেটায়। কোন মেয়ে দেখছি না। শুধু মধ্যবয়স্ক গরীব ধরণের কিছু মহিলা আশেপাশে আছে।
-“ আপনে এখানে কি করেন?”
আমার পিছে মনসুর সাহেব বিড়ি টানছেন। সকাল সকাল গোসল করা চেহারা। পান্জাবী থেকে, উড়ে যাচ্ছে, সেন্টের গন্ধ। ওনার প্রশ্নের ভেতরে একধরণের বিরক্তি ছিল। ঠিক সেই অর্থে প্রশ্ন করেন নাই তিনি। নিজের বিরক্তির প্রকাশ ঘটিয়েছেন ভদ্রভাবে। তিনি হাত ধরে টানতে টানতে বললেন
- চলেন যাইগা।
তখন আমার মনে পড়ল যে মনসুর সাহেবতো গতকাল রাতে মারা গেছেন। ওনাকে অবশ্য আমি এই বিষয়ে কিছু বললাম না।
৮. নার্স
হে বৃদ্ধ ব্যাঙ,/ শিশির বিন্দুগুলো কাঁপছে/ দেখো ! ঐ যে!
- ইসা
হাসপাতালের গেটের দুদিক ঘেষে ফুলের দোকান। উল্টো দিকেও ফুলের দোকান। সামনে একটা গলি গিয়ে খুলেছে মুল রাস্তায়। মুল রাস্তা ঘেষে আবারও সারি সারি দোকান। দোকানগুলোর গন্ধে শহরটা গোলাপী হয়ে উঠছে। আমার খুব অস্থিরতা হয়। ভয় ভয় কেমন জানি। আমি দুটো জোলাক্স ট্যাবলেট গিলে ফেললাম। ছোট ছোট নীল রঙের শান্তি। আরও ট্যাবলেট লাগবে। ফার্মেসী কোনদিকে? কাউকে জিগাশা করা দরকার। একটা নার্স যাচ্ছে। আমি বললাম
- আচ্ছা আপা ফার্মেসী কোনদিকে?
তিনি থমকে গেলেন। যেন এই জীবনে প্রথম তাকে কেউ প্রশ্ন করল। নার্স আর আমি পরস্পরকে দেখছি। নার্সটি খুব সুন্দর। আমার একবার মনে হল তিনি অবিকল আমার স্ত্রীর মত দেখতে। তারপর আবার দেখলাম ঐ মাগীটার সাথে এর কোন মিলই নেই। নার্সটি কাজল দিয়েছেন। তার চোখ-নাক-ঠোঁট ধারালো এবং আহ্লাদী। ওনার চোখে জীবনের প্রতি সামান্য বিরক্তি আছে। তিনি সেই বিরক্তি ধরে রেখেই আমাকে আংগুল তুলে একদিকে ইশারা করলেন। সেই দিকটা -ওখানে গোলগোল রঙিন চেয়ার আর চেয়ারে বসা মানুষ ছড়ানো, চারটা জানালা, একটা বৃদ্ধ দেয়াল জড়িয়ে বোগানভেলিয়ার তরুনী ঝোঁপ, লাল রঙে আউটডোর লেখা সাইনবোর্ড, ইতস্তত রোদ- ধন্য হয়ে গেল। তিনি আঙুল নামিয়েই ঠাসঠাস করে হেঁটে চলে গেলেন। চলে গিয়েও তারপরো কিন্তু তিনি যেন থেকে যান। বলেন যে
- ফার্মেসীতে কি ওষুধ কিনবেন?
- আলপ্রাজোলাম জিরো পয়েন্ট ফাইভ মিলিগ্রাম। জোলাক্স।
তিনি ভুরু নাচিয়ে বললেন বা বলার সময় তার ভুরুগুলো নিজেরাই নেচে ওঠে,
- প্রেস্কিপশন আনছেন?
আমি দাঁত দেখিয়ে হাসলাম। নার্সটি আমাকে ছোট্ট করে বকা দিলেন। আমি হে হে করতে করতে বললাম
- এই আজকাল দ্যাশের যে অবস্থা, দুশ্চিন্তায় থাকি আরকি....
- আহারে! দেশের আর লোকজন জোলাক্স না খেয়ে টিকে আছে কেমনে? দেশ নিয়ে আপনি একাই চিন্তা করেন নাকী?
আমার মাথায় কোন উত্তর আসল না। দেখলাম সময় সাথে সাথে নার্সটি দুবোর্ধ্য আর আকর্ষণীয় হয়ে উঠছেন। ওনার সকল প্রশ্নেই এখন জটিলতা আর রহস্যময়তা।
৯. ক্যানটিন।
হঠাৎ বৃষ্টি নামে/ আমি নগ্ন হয়ে ঘুরি/ নগ্ন ঘোড়ায় চড়ে
- ইসা
হাসপাতালের ক্যানটিন। আমি আর মনসুর সাহেব বিরানী খাচ্ছি। মনসুর সাহেব ফোনে কথা বলছেন। কারও সাথে বসে খেতে আমার একটু সমস্যা হয়। আড়ষ্ট লাগে। আরাম করে খেতে পারি না। স্ত্রীর সাথে বসে খেতেও আমার একই ব্যাপার হয়। ফুল প্লেট বিরানীর এক চতুর্থাংশ কোন প্রকারে খেয়ে বসে আছি। মনসুর সাহেব ফোন নামিয়ে বললেন,
- খেতে পারছেন না?
- ক্ষিদা নাই।
- ভাবী এখন ভাল আছে।
- অ
উনার কথার মানে বুঝলাম না। ভাবী বলতে উনি আমার ওয়াইফকে মিন করলেন নিশ্চই। মনসুর সাহেব বললেন,
- আপনে একদমই খেতে না পারলে আমাকে দিয়ে দেন, খেয়ে ফেলি। নষ্ট করা ঠিক না।
আমার ঘেটে রাখা বিরানী মনসুর সাহেব তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছেন। একটু ঘিন্না ঘিন্না লাগছে। আমি বললাম
- আপনে গতকাল রাতে মারা গেছেন। বিষয়টা বুজতেসি না।
তিনি আমাকে একবার দেখলেন। কেমন সতর্ক হয়ে গেলেন যেন। প্রশ্নের কোন উত্তর দেননি। আবারও জিগেস করা কি ঠিক হবে? আমি কেশে গলা পরিস্কার করলাম। অস্বস্তি কাটল না। বললাম যে,
- এখান থেকে কই যাবেন?
- ভাবীকে দেখবেন না?
- দেখার কি আছে?
তিনি খাওয়া বন্ধ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমার কথায় উনাকে অাহত মনে হল। বললেন,
- আপনে একটু মাথা ঠান্ডা করেন
- আমার মাথা তো ঠান্ডাই আছে মিয়া।
আমি চিৎকার করছি খেয়াল করলাম। খুব রাগ হয় আমার। এখন আবার রাগ চলে যাচ্ছে। গলার কাছে শক্ত শক্ত হচ্ছে। আমি কাঁদতে লাগলাম।
১০. জিনিয়া আলম
পশ্চিম সমুদ্রে / কখন যাব আমি?/ বেগুনী মেঘে চড়ে
- ইশা
হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে দাড়িয়ে আছি। আগে শুধু ঢাকা মেডিকেলে এটি ছিল। এখন সবখানে একটা করে বানিয়েছে। এদিকটায় পুরুষদের যাতায়াতে কিছু নিয়ম কানুন আছে। দুজন মহিলা পুলিশ দেখলাম। একজন কমবয়সী, আরেকজন সেই অনুপাতে বয়স্ক। বয়স্কজনের দৃষ্টিতে ঔদাসীন্য। কমবয়স্ক জন রাগী এবং কিন্নরকন্ঠী। আশেপাশের অসংখ্য শব্দের ভেতরেও তার চিকন গলার ধমক কানে এসে বাজছে বারবার।
- আপনি কাউকে খুঁজছেন?
সকালের নার্সটা। আঙুল তুলে ফার্মেসীর দিকে নির্দেশ করেছিলেন। উনাকে সকালের মত সুন্দর লাগছে না। সারাদিনের ক্লান্তিতে বিপর্যস্ত দেখাচ্ছে। তিনি প্রশ্নটা আমার উদ্দেশ্যে করেছেন। এদিকেই তাকিয়ে আছেন। চোখে জীবনের প্রতি সুক্ষ বিরক্তি। আমি কিছুই বলছি না। নার্সটি অধৈর্য হয়ে উঠছেন। মনসুর সাহেব নার্সটিকে কি জানি ইশারা করলেন। ওনারা এখন আমার সামনেই একটু দূরত্বে দাড়িয়ে গুজগুজ করে কি জানি আলাপ করছেন। কথা বলতে বলতে মনসুর সাহেবের মুখ করূণ হয়ে ওঠে। নার্সটির চোখে ছলছলে ভাব আসে। আমার এভাবে দাড়িয়ে থাকতে অসোয়াস্তিবোধ হয়। ওনাদের কথাবার্তা তেমন শুনতে পারছি না। তবে “হাজবেন্ড” শুনলাম আর “জিনিয়া” শুনলাম। আমার মনে হল আমার ভাল্লাছে না। আমি পকেট থেকে জোলাক্সের পাতা বের করে তিনটা গিলে ফেললাম।
নার্সটি আমার দিকে আসছেন। মনসুর সাহেবকে দেখছি না। কোথায় গেল লোকটা? নার্সটি আমার একদম সামনে দাড়িয়ে বললেন
- আপনার ওয়াইফের সাথে দেখা করবেন?
- কি বলছেন বুজতেসি না।
- আপনি জিনিয়া আলমের হাজবেন্ড না?
- জ্বি। কিন্তু আমার স্ত্রীতো গাইবান্ধা গ্যাছে। আপনে অন্য কারও সাথে আমাকে মিলায়ে ফেলছেন মনে হয়।
নার্সটিকে বিভ্রান্ত দেখায়। আর ভীত। নার্সরা সাধারণতঃ নিম্ন মধ্যবিত্ত। নিম্ন মধ্যবিত্তরা বিভ্রান্ত হলে ভীতও হয়ে পড়েন। তিনি এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন। মনসুর সাহেবকে খুঁজছেন মনে হয়। নার্সটিকে বলা দরকার যে মৃত মানুষদের কখনও খুঁজে পাওয়া যায় না।

১১. দি বারান্দা
চক্ষে আমার তৃষ্ণা
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আমি বারান্দায় বসছি। স্ত্রী আর আমি বসি বারান্দায়। মাঝে মাঝে।
বারান্দায় অদ্ভুত অন্ধকার। অন্ধকারে কেমন সব শব্দ শোনা যায়। যেন অনেক মানুষের কথা। কিন্তু খুব নীচু গলায়। স্ত্রীর সাথে এবিষয়ে আলাপ করতে চেয়েছিলাম। তার বিরক্তি ঘটেছিল। বলছিলেন যে আমার ফালতু কথা তার ভাল্লাগে না। আমি মার্লবোরো ধরিয়েছিলাম। স্ত্রীও খেতেন মার্লবোরো। ঠোট কাল হয়ে যাচ্ছে বলে আর খান না।
বারান্দায় স্ত্রীর কথা বেশ মনে পড়ছে। সে রাতে বলল হাসপাতালে থাকবে। মনসুর সাহেবকে ছেড়ে যাবে না। আমি চলে যাচ্ছি দেখে সে বলে অবাক হতে গিয়েও হয়নি। কারণ সে বলছিল আমি একজন বিকৃত মানুষ। আমার পক্ষে এটাই স্বাভাবিক। একটু আগেই স্ত্রী মেসেজ পাঠাল। মনসুর সাহেব মারা গেছেন। ডেডবডি যাবে গাইবান্ধা। স্ত্রীও ডেডবডির সাথে গাইবান্ধা যাবেন। আমি ইংলিশে লিখেছি ‘ হেভ এন অওসাম জার্নি ’। হে হে। জোকটা ভাল হয়েছে আমার ধারণা।
এটাই শেষ মার্লবোরো। মার্লবোরোটা মিষ্টি মিষ্টি। আগে স্ত্রী আর আমি শেয়ার করে মার্লবোরো টানতাম, এই বারান্দায়ই। তখন ফিল্টারে তার লিপগ্লস লেগে মার্লবোরো এরকম মিষ্টি হয়ে যেত। আমি বের হব। সিগারেটটা শেষ করে নেই। তারপর। রাতে কেউ এখন আর বের হয় না। বিশেষতঃ এত রাতে। বারটা বেজে গেছে। বেতের চেয়ার থেকে বাইরেটা দেখছি। খাঁ খাঁ রাস্তা। গুলির শব্দ শুনেছি দুবার। একটু পর আরও শুনব। তখন সিগারেট লাগবে। জোলাক্স লাগবে। জোলাক্সও শেষ। বাইরে খুব খুন হয় রাতে। বের হতে বড় ভয় হয়। সাথে ভাবছি একটা অস্ত্র মত কিছু নিয়ে নেব। কিছু বড় বড় দা চাকু আমি কিনেছি। রান্নাঘরে রেখে দিয়েছি যাতে সবাই ভাবে রান্নাঘরের জিনিস ওগুলো। কিন্তু আসলে অস্ত্র।
আমি মোবাইলে গান ছাড়লাম
- “ডোন্টগো ব্রেকিং মায় হার্ট
ও হানি আই কুডেন্ট ইফ আই ট্রায়েড
ও হানি ইফ আই এভার গেট রেসলেস
বেবি ইউর নট দা টাইপ
ডোন্ট গো ব্রেকিং মায় হার্ট....”
গান শুনতে শুনতে মার্লবোরো শেষ হয়েছে। এখন অস্ত্রের খোঁজে রান্নাঘরে যাব।
১২. ফুল
আমার আশ্চর্য ফুল যেন চকোলেট
-বিনয় মজুমদার
সামনে মার্লবোরোর দোকানটা। দোকানটা ভাঙা আর পুড়ে যাচ্ছে। বিশাল আগুন হয়েছে। গরম লাগছে এদিকটায় দাড়ালে। আশপাশ লোকশুন্য।
সম্ভবতঃ ছাত্রদের কাজ। চা খেতে এরা আসে এদিকটায়। রাতে। সংখ্যায় আটদশজন। নেশাগ্রস্থ। সামান্য বিষয়েই এমন কিছু ঘটে। কোন ডেডবডি নেই। দোকানদার হয়তোবা পালিয়েছে। আগুনটা দেখছি আমি দাড়িয়ে দাড়িয়ে। আমার মুগ্ধতা হচ্ছে।
আমার হাতে ছুড়ি। দশ ইন্চি ব্লেড। খুব ধার। কোরবানির সময় এগুলো দিয়ে চামড়া ছাড়ায়। আমি হাঁটা শুরু করলাম। একজন ফ্লাস্কে চা বেচছে। তার কাছ থেকে মার্লবোরো কিনলাম। আমার হাতে ছুড়ি থাকায় সে প্রশংসা করল। আমিও মাথা নাড়লাম। রাস্তার পাশে দেয়াল। দেয়ালগুলোতে নানান কথা লেখা। কম আলোতে পড়া যায় না। ওগুলোতে হেলান দিয়ে আমি মার্লবোরো টানছি। চারপাশ নীরব। হঠাৎ বড় বড় ট্রাক যায়। মনে হয় ভয়ে কোথাও পালাচ্ছে। উল্টোদিকে ফার্মেসী। ফার্মেসীটা বন্ধ। আরও সামনে যেতে হবে। সামনে ঐ হাসপাতালটা। ওদিকে যেতে ইচ্ছা নেই আমার। রাগে কান্না আসছে।
- এক্সকিউজ মি।
আমি দেখলাম নার্স। গায়ে সাদা জামা। অন্ধকারে তিনি ফুটে আছেন। আমি ছুড়ি লুকালাম। তার হাত ভর্তি গোলাপ ফুল। দুতিনটে ফুল এদিক ওদিক পড়ে যাচ্ছে। সে বলল
- আপনি একটু ধরেনতো কয়েকটা।
তার কন্ঠে রাত পাল্টায়। আমি গোলাপ ধরতে ধরতে বললাম
- আপনি চিনসেন আমাকে? ঐ যে সকালে হাসপাতালে..
- ও রাইট। আপনি তো সেই লোক। ভাল আছেন তো? আপনি কি হসপিটাল যান?
- যাচ্ছিলাম।
- ওয়াইফকে দেখতে যান, না?
- আমার ওয়াইফ গাইবান্ধায়।
- ও। আমি মনে হয় আপনাকে অন্য কারো সাথে কনফিউজ করছি। সরি।
- ইটস ওকে।
- আপনার বাসা কই?
তিনি এমন একটা জায়াগার নাম বলেন যে আমি শুনে বলি
- ওব্বাব্বা এত্ত দূর।
নার্সটি ঠোঁট উল্টাল। অাহ্লাদী ভংগিতে।
- হুঁ, জানেন। এখন যে কি করে যাই। যে রাস্তা। আমি কখনও এত রাত করি না।
- আমার স্ত্রী আজকে নেই। আপনি রাতে আমার বাসায় থাকুন।
নার্সটি বাকী ফুলগুলো আমার হাতে দিল। আমরা হাঁটতে লাগলাম।