Posts

উপন্যাস

এইসব গোলাপের দিন (১৩-২৫)

May 17, 2025

saleh muhammed

143
View

1-12

১৩. মার্লবোরো

  Do not go gentle into that dark night,

   Old age should burn and rave at close of day

                                                 - Dylan Thomas

 আমরা বাসায় আসি। তাই কারেন্ট থাকে না। নার্সটি বলে,

-          আপনার বাসাটা ছোট।

আমি বলি

-          আমরা লোকজন কম।

-          আপনাদের বাচ্চা নেই।

-          না।

-          কোন সমস্যা?

আমার অস্বোয়াস্তি হয়। নার্সটা কেমন মুচড়ে মুচড়ে হাসে। বলে যে,

-          আপনার সিগারেটগুলো থেকে একটা দেবেন? আমি দিনে চার টান সিগারেট খাই। আজকে দিনে এক টানও খাইনি।

আমি বলি

-          চলেন বারান্দায় বসি।

বারান্দায় নার্সটা মার্লবোরো খায়। চারটা টান। লম্বা লম্বা, গভীর। ফিল্টারের কাছে একটু শুধু থাকে। সে আমাকে বলে টানতে। আমার ভয় হতে থাকে। মনে হয় মিষ্টি হয়ে গেছে মার্লবোরোটা। ফিল্টারটা ফেলে দেই অন্যদিকে। যেন সে দেখতে পায় না। নার্সটি নগ্ন হতে শুরু করে। আমি অন্ধকারেও বুঝি ব্যাপারটা। বলি যে,

-          এগুলির দরকার নাই।

সে অবাক হয়। অন্ধকারে তার বিস্ময় আমার কাছে সেভাবে ধরা পড়ে না। 

সে তারপরও নগ্ন হয়। তার চেয়ারটা আমার কাছাকাছি নিয়ে আসে। 

বলে যে,

-          আমি এভাবেই থাকব।

তার কন্ঠে কাঠিন্য। কেমন রাগ রাগ। 

আমার এত ক্লান্তি হয়। যেন আমি ভেঙে যাচ্ছি। 

একটা দুটা করে গুলির শব্দ শুরু হয়। বাড়তে থাকে তারপর। আমি কেঁপে কেঁপে উঠি।

নার্সটা আমার হাত চেপে রাখে। শক্ত করে।

একজন নগ্ন মানুষের হাত ধরে আছি। ভেবে আমার একটু একটু হাসি পায়।

১৪. আলপ্রাযোলাম পয়েন্ট ফাইভ

   গীত গায়/ শান্ত রাত্রি জুড়ে/ বন্দী পোকা

                    - ইসা

হাসপাতালে,  ফার্মেসীর লোকটা ঝামেলা করল। প্রেসক্রিপশন চাইল সে। বললাম আমি,

-          ভাই আগে তো লাগত না আপনার বালের প্রেসক্রিপশন।

সে হাই তুলল। অন্যদিকে ছোট টিভি। সে ছোট টিভি দেখছে। আমার মনে হল একে খুন করে ফেলি। 

-          তুমি বাসায় যাও নাই?

তাকালাম পিছনে। স্ত্রী দাড়িয়ে আছেন। তাকে বিস্মিত দেখাচ্ছে। আমি উত্তর দিলাম না। একারনেই হাসপাতাল আসব না ভাবসিলাম। 

তিনি বললেন যে মনসুর সাহেবের এক ভাই আসতে দেরী করছেন। তাই এখনও গাইবান্ধা রওয়ানা দেয়া হয় নি। 

তিনি আরও জিগেশ করলেন

-          ফার্মেসী থেকে কি কিনবা? জোল্যাক্স?

-          হু। হারামজাদা দিচ্ছে না। প্রেসক্রিপশন চোদায়।

-          মুক খারাপ কোরো না। আমি সকালে এক পাতা কিনেছিলাম। নিয়ে নাও।

-          এক পাতায় হবে না।

-          আজকের রাতটা কাটাও। পরে দেখা যাবে বাকীটুকু।

আমি স্ত্রীকে দেখছি। কেমন ক্লান্ত ক্লান্ত চেহারা। আমার তার গালে হাত দিতে ইচ্ছা হয়। পরে মনে হয় ধুউর। 

আমাকে ওষুধগুলো দিয়ে স্ত্রী বলল

-          তুমি চলে যাবা না?

-          যাব তো।

-          ওই ভাল। আমার সাথে গাইবান্ধা যাওয়ার কোন ট্রাই কোরো না। বাজে ব্যাপার হবে।

-          তোমার সাথে যামু ক্যা? আমার অত্তো চোদে না।

একটু রেগে গেলাম আমি। ক্যান্টিনের দিকে হাঁটলাম। ভেতরে মনসুর সাহেব কফি খাচ্ছিলেন। দেখে বললেন

-          বসুন বসুন। ওষুধ কি কিনবেন বলছিলেন পাইসেন নাকী?

-          এক পাতা যোগাড় হইসে।

-          রাতটা চলবে না?

-          চলবে।

-          বাসায় চলে যাবেন?

-          হু।

-          সেই ভাল। কোন চিন্তা করবেন না। আমরা সবাই আছি। আপনি একটু রেস্ট নিয়ে আসেন।

আমি দুটো জোলাক্স ট্যাবলেট গিলে ফেললাম।

১৫. বিয়ে বাড়ি

 যদি আর না আসো, হে মুগ্ধ সৌরভ

 বিকেলের বনে কি আর আমি যাব

                    - জিনিয়া আলম

  কেউ একজন আসছে। পিছে পিছে। আমি হাঁটছি। খুব রাত। মাঝে মাঝে কমলা আলো। ভাঙা ভাঙা বাড়িঘর। বাড়িঘরগুলোকে জ্যান্ত লাগছে।

 চারপাশ চুপচাপ। ঘুরে তাকালে মনসুর সাহেবকে দেখলাম। ওদিকে একটা বাড়ি। তিনতলা । কমলা আলোতে ছাদ থেকে বোগানভেলিয়া ফুটেছে। তিনতলার বারান্দায় একটা চেয়ার। চকচক করছে চেয়ারটা। অন্য বাড়ির বারান্দাগুলো ফাঁকা। মনে হয় লোক নেই। 

মনসুর সাহেব কাছে এসে বললেন যে

-          চলেন বিয়ে খাই একটা।

ওনার গলায় মাফলার। তাই আমি বললাম যে,

-          কোথায়?

-          এই সামনেই। রাতের খাওয়াটা সেরেই চলে আসব।

আমরা একটা বিয়েবাড়িতে ঢুকলাম।

১৬. পার্টি

   নীল বা নীলাভবর্ণ গোলাপের মত তোমার অভাব বুঝি

                                - বিনয় মজুমদার

 এখানে উৎসব। প্রচুর লোক। সবাই অনেক হাসছে। আমিও হাসছি এসব কারণে। আর হাসছেন মনসুর সাহেবও। এসব বিষয়গুলি, অনুষ্ঠান, বিয়ে আমার বেশ বিশ্রী লাগে। আমি কনসারভেটিভ মাইন্ডের লোক। স্ত্রীর খুব আগ্রহ এসবে। তার স্বভাবটাই বাজে।

  দেখছি আমার এক বন্ধুর বিয়ে হচ্ছে। বন্ধুটির বন্ধুরা ব্যাস্ত হাঁটাহাঁটি করছেন। তাদের গায়ে কোট। সবার কোট কমবেশী কাল। একজনের কোট নীল। আমাদের বিয়ের দিন কম লোক ছিল। আমরা বিয়ে করেছিলাম বারান্দায়। পনেরটা চেয়ার আনা হয়েছিল। সবকটা নানান রঙের। আমি স্ত্রীকে বিষয়টা বলেছিলাম। যে,

-          একটা চেয়ারও যে একরকম না বিষয়টা কি খেয়াল করেছ?

-          পক পক কোর না। যাদের বিয়ে শাদী হচ্ছে তারা পক পক করলে খারাপ দেখায়।

খাওয়া নান রুটি আর কাবাব ছিল। সালাদও ছিল। কোকের হাফ লিটার বোতল আনা হল পনেরটা। তখন নীল কোট পরা জন বললেন

-          আরে তোর খবর কি দোস্ত?……

আমি বললাম,

-          ভাল। তোকে অনেকদিন পর দেখতাসি? আসোস কেমন?

-          ভাল , ভাল। তুই যে এর মধ্যেও আসবি ভাবি নাই। সো গ্ল্যাড ইউ কেম ম্যান।

বললাম যে,

-          এসব থাকেই লাইফে মাইনষের।

-          শাবাশ ম্যান। অওসাম। সো এনজয় দি পার্টি । আমি একটু আশতাশি ওদিক থিকা।

সে হেঁটে চলে যায়। খুব দ্রুত আর ব্যাস্ত হয়ে। এরপর আরেকজন আসল। তার চোখে চশমা আর কাল কোট। সে করুণকন্ঠে বলল

-          দোস্ত আই ওয়াজ শকড টু হেয়ার দি নিউজ।

এরপর সে হাসতে থাকে। জোরে জোরে। আর আশপাশের কিছু লোকও দেখছি তাকাচ্ছে। মনে হচ্ছে তারাও হাসবে। আমারও একটু একটু পাচ্ছে হাসি। কিন্তু আমি হাসলে খারাপ দেখাতে পারে ভেবে হাসছি না। 

বন্ধুটি বলল,

-          তোর ওয়াইফ আশছে দেখলাম। আমার বউয়ের সাথে আড্ডা ডিটেশে।

বন্ধুটিকে মন হল ড্রাংক। মুখে গন্ধ। আমি জিগেশ করলাম,

-          মাল খাইসস নাকী ?

-          ওদিকে দরজা দেকতেশিশ না একটা ওটা দিয়ে ঢুকে যা। যারা ড্রিংক করটেশে তারা ঐটাতে ঢুকশে। তোর ওয়াইফও আছে।

বন্ধুটি হাঁটছে। চলে যাচ্ছে সে। তাই তার কথাগুলো দূরে সরে সরে যায়। আমার মনে হল এই বন্ধুটি জানেন যে আমি সামান্য কনসারভেটিভ মাইন্ডের লোক।

১৭.

   তখন হয়তো মাঠে হামাগুড়ি দিয়ে পেচা নামে-/ বাবলার গলির অন্ধকারে/

   অশথের জানালার ফাঁকে/ কোথায় লুকায় আপনাকে!

                               - জীবনানন্দ দাশ

  বন্ধুটি ভুল বলেছে। আমার স্ত্রী দেখছি বিয়েতে আসে নি। বন্ধুটির বউয়ের সাথে আমার দেখা হয়েছিল। তাকে জিজ্ঞেস করলাম,

-          তোমার সাথে বলে জিনিয়া ছিল একটু আগে?

বন্ধুটির বউকে আমি তুমি করে বলি এবং নাম ধরে ডাকি। সে আমার ক্লাসমেট ছিল। ভার্সিটিতে। সে হেসে ভেঙে পড়ে বলল যে,

-          কি যে কও না। তোমার ওয়াইফতো গাইবান্ধা গেছে।

-          না সাজ্জাদ কইল যে।

-          আরে ও তো মাল টাল খেয়ে বাদ হয়ে রইছে।

বন্ধুটির বউ আমাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে ঐ রুমটাতে ঢুকল, যেটাতে সবাই ড্রিংক করছে। ঘরটির বাতাসে উগ্রতা। অ্যালকোহল আর তামাকের গন্ধ। বন্ধুটির বউ বলল

-          তুমি কেমন আছো?

-          খুব ভাল।

সে অরেন্জ জুস খাচ্ছে। কমলার ঘ্রাণ ঘুরঘুর করছে আশপাশে। কিন্তু উগ্র গন্ধটা কাটছে না। আমি বললাম,

-          তুমি একটু মোটা মোটা হয়ে গেছ।

-          তা-ই, না?

-          ফিগারের গিটগুলা আগের মত নাই।

-          গ্লাসটা মাথায় ভাংব বুঝছ।

সে কিরকম করে হাসে। ভার্সিটিতে এভাবে হাসত না। হাসির শব্দটি কেমন যান্ত্রিক। আমার দুঃখ হচ্ছিল। মনসুর সাহেবের জন্যেও কেমন মন খারাপ লাগছিল। কিন্তু তারপরো আমি হাসছিলাম। বন্ধুর বউটি আরো দুজনকে জোগাড় করেছে আমাদের পাশে। তাদের একজন নারী একজন পুরুষ। স্বামী স্ত্রী তারা। একজনের হাতে বিয়ারের ক্যান আরেকজনের হাতে সিগারেট। অন্ধকারে আমি চিনতে পারি না এরা কারা। তারপরো বলি যে

-          তারপর ভাল আছেন আপনারা।

তারাও উত্তর দেয়।

   -  জ্বি জ্বি । আপনি ভাল তো।

আরো লোক জমা হয়। আমরা হাসতে থাকি। আমি তাদের চেহারাগুলো চেনার চেষ্টা করি। আমার বিরক্তিবোধ হয়। আমি দূরে গিয়ে একটা বেন্চিতে বসে পড়ি। এক পুরাতন বন্ধু এসে বলে,

-          দোস্ত কি খাবি বল।

-          টাকা পয়সা নাই বেশী।

-          এভরিথিং ইজ অন দি হাউজ।

আমার ক্লান্তি হয়। যেন ভেঙে ভেঙে যাই। বলি যে

-          আমাকে দুটা ভদকা দে। স্মির্ণ অফ।

চারপাশে সবাই চিৎকার করতে থাকে।

১৮.

   সমস্ত মৃত নক্ষত্ররা কাল জেগে উঠেছিলো- আকাশে এক তিল ফাঁক ছিল না

                                           -জীবনানন্দ দাশ

   সবকিছু জলের মত যার গোপন থেকে লোকেদের হাসির শব্দ আসে জিগেশ করছে, সবাই যে আমি ঠিক মত বাসায় যেতে পারব কি না, খুব ঘুরছে সবকিছু ঘুর্ণায়মানের ভেতর আমি ভাসছি, আর লোকজন, খুব হাসছে দুজন ধরে রেখেছে, আর একজন বলছে হালার খাইতে বইলে হিসাব থাহে না, আমি একা একা পারব যেতে, না না অসুবিধা নেই, আপনারা বাসায় যান, আমার বাসা বেশী দুর না, আরে ধুউর মিয়া আপনারা আমারে নিয়া অত চিন্তা কইরেন্না, আ আ, হ্যা হ্যা, ওকে ওকে, দেখা হবে, এই রাতেও একটা কোকিল ডাকছে কই জানি, আহারে, কোকিলটা, কোকিলটা, আমি রাতের রাস্তায় কোকিলটাকে খুঁজতে থাকি।

১৯.

   রাগী লোকেরা কবিতা লিখতে পারে না / তারা বড্ড চেঁচায়

                               - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়   

  শরীর খারাপ। বাজে একটা হ্যাংওভার। গতরাতে বেশী খেয়েছি। মাতাল হয়ে গিয়েছিলাম। বাসায় কিভাবে ফিরলাম কে জানে।

  ফাঁকা  লাগছে বাসাটা । বারান্দায় এসে দাড়ালাম। এই সকালটা খুব সুন্দর। 

 স্ত্রী বলেন যে শরীর খারাপ থাকলে আশপাশের পৃথিবীর সৌন্দর্যে কিছু যায় আসে না। কথাটা ভুল। ফাগুন মাসের সকাল। সোনালী বিরহী রোদ। বাতাসেও বিরহ। আমারও লাগে একটু কেমন কেমন। একটা বিরহের ভাব হয়। যেন আমি খুব একা। মোবাইলটা নিলাম। কেউ, ভাল হত কল দিলে।

   তাই কল আসা শুরু হয়। আমি ধরে বলি যে

-          হ্যালো

-          হ্যালো হ্যা দোস্ত আমি সাজ্জাদ

-          সাজ্জাদ আপনি কেমন আছেন?

-          আপনে আপনে কেন করতেশো? রাতের নেশা কাটে নাই?

-          সরি। সাজ্জাদ তুই আসোস কেমন?

-          আছি তো ভালই। তুই ব্যাটা... কালকে একটা সিন করলি।

-          কি করশিলাম কিছু তো খেয়াল নাই।

-          নেভার মাইন্ড ব্রো। অনুষ্ঠান উৎসব তো এসবের জন্যেই। গেটিং আউট অফ আউয়ার শেল। তো আমি ফোন দিশিলাম এজন্যেই যে তুই কেমন আশিশ।

-          তোকে ধন্যবাদ।

আমি ফোন রেখে দিতেই আবার ফোন আসে। তাই ধরি। উৎফুল্ল গলায় বলি

-          হ্যালো হ্যালো কে বলছেন গো প্লিজ?

-          বাব্বাহ । তোমার গলায় মধু ঝরছে। ঘটনা কি? কার ফোন এক্সপেক্ট করতেসিলা?

স্ত্রী ফোন করেছেন। আমি বললাম

-          তুমি কি করছ?

-          আমার কথা বাদ দাও। সাজ্জাদের বউ আমাকে ফোন দিসিল। তুমি বলে মাতলামি করস গতকাল বিয়েতে গিয়ে?

-          আই এম আউট অফ কন্ট্রোল বেইবি।

-          মনসুর ভাইয়ের কাজকর্ম সব শেষ। আমি খুব টায়ার্ড। একদিন রেস্ট নিয়ে ফিরব। এসব তথ্য তোমাকে দেয়ার কোন মানে হয় না যদিও। আমি কখন আসি , কই যাই তোমার তো যায় আসে না।

-          আমার এমনিতেই মাথা ধরেছে। আরো বাড়ায় দিও না। ফোন রাখলাম।

আমি লাইন কেটে দেই। সাথে সাথে আবার রিং হয়।

-          হ্যালো ? হ্যালো ? কে ?

-          আরে শান্ত হউন। আমি মনসুর। আপনার কি অবস্থা?

-          ভাল ভাল খুব ভাল।

-          বেশী করে লেবুর সরবত খান। হ্যাংওভারে উপকার পাবেন।

-          লেবু তো নাই বাসায় ভাই।

-          ছাদে চলে যান। আমার নিজের হাতে লাগানো গাছ আছে। লেবু পেয়ে যাবেন।

লাইন কেটে গেল। আবার বাজছে। এখন আমি বিরক্ত হচ্ছি। বারান্দার মেঝেতে আমি মোবাইলটা আছাড় মারলাম।

২০.

  তবে কেন ঘন্টায় ষাট মাইল স্পিডে ছুটে যাওয়া একটি মেয়ের এক পলক মুখ দেখে এমন প্রেমে পড়ি যে সাতদিন আহারে রুচি থাকে না?

                                     - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

  ছাদে উঠতে উঠতে ভাবছিলাম আজকাল আমি বেশ ইমোশানাল লোক হয়ে গেছি। অল্পতেই আবেগাচ্ছন্ন হই। কান্না আসে। রাগ হয়। এই যে স্ত্রীর সাথে কথা বলছিলাম, এখন কেমন দুঃখ দুঃখ করছে। আবার মনসুর সাহেব আমার জন্যে লেবুগাছ লাগিয়েছেন ছাদে ভেবেও খুব মায়া হচ্ছে। গতমাসে চাকরীটা গেল। তারপর থেকে এসব বেড়েছে। অল্পতেই কাতরবোধ করি।

  আমি লেকচারার ছিলাম। একটা প্রাইভেট মেডিকেল কলেজে। বেতন দিত পঁচিশহাজার টাকা।

   খুব মোটা , লম্বা , গলায় ডার্কব্লু টাই পড়া একটা লোক আমাকে ডেকে নিয়ে বললেন যে,

-          আপনাকে আমরা এখানে আর রাখতে পারব না।

আমি খুব অবাক হলাম। জিগেশ করলাম,

-          কেন স্যার?

স্যারটি বললেন

-          না বলে আপনাকে উপায় নেই, তাই বলছি। আপনার মাথায় সমস্যা আছে। আগে আপনার চিকিৎসা দরকার। তারপর চাকরী বাকরী করবেন।

-          আমার মাথা ঠিক আছে স্যার।

-          তাহলে তো ভালই। আমরা অবশ্য সেরকম মনে করি না। আর সেকেন্ড কথা হল আপনার কিছু ড্রাগ এডিকশনের কথাও আমি শুনসি।

 ছাত্রদের ভেতরও এসব কথা প্রচলিত। এরকম একজন লোককে এই মেডিকেল কলেজের সাথে জড়িত রাখা.... আপনে বোঝেন তো।

ছাদে খুব রোদ। পিঠ পুড়ে যাচ্ছে। আমি লেবু গাছ খুজছি। কিভাবে লেবুগাছ খুঁজতে হয় আমার জানা নেই। আমার কান্না কান্না পায়।

২১.

    দাঁতের ডাক্তার আমার পায়ে ঘা করে দিয়েছিল বলে আমি আর কখনও সে শুয়োরের বাচ্চা জীবাণুসমন্বয়ের সঙ্গে সিনেমা দেখতে যাই নি

                                              - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।

-          ঘুম থেকে কখন উঠলেন?

দেখলাম যে নার্স। তিনি রোদে ঝিকমিক করছেন। চুলে, ওড়নায় বাতাস। আর তার কচি সবুজ রঙের কামিজ। নার্সটিকে আমার একটি লেবু গাছের মত লাগলো। সে হাত বাড়ায়। দেখি তার হাতে লেবু। বলল যে,

-          লেবু গাছ দেখে লেবু পেরে ফেললাম কয়েকটা। কার না কার গাছ এখন ভয় ভয় করছে। আমি তো আর এই ফ্ল্যাটের লোক না। আপনি একটু রাখেন তো এগুলো।

নার্সতির মত আমারো সামান্য ভয় করল। আমি লেবুগুলো নিলাম। বললাম থ্যাংকিউ। নার্সটি উত্তরে হাসল। মুচড়ে মুচড়ে। আমার কাছে জীবনটাকে মনে হল, একটা একা একা বেন্চিতে বসে কারও সাথে আড্ডা দেওয়া। 

নার্স পানে আমি চেয়ে দেখি। আমাদের চারপাশে খুব লেবুর ঘ্রাণ। এসব কারণে আমি বলি যে,

-          আপনাকে বেশ সুন্দর লাগছে।

নার্সটি তাই উদাস হল। হুহু করে বসন্তের বাতাস যায়। বাতাসে লেবু লেবু ভাব।


২২.

     সখী যাতনা কাহারে বলে?

-       রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

 নার্সটি বলল,

-       এবার পহেলা ফাগুনে আপনি ঘুরতে গিয়েছিলেন?

-       নাহ্।

-       জানেন আমিও যাই নাই।

সে ঠোঁট বাঁকাল। ঠোঁটই তো। কিন্তু বাকঁলে সমস্ত ব্রক্ষান্ড সমেত বেঁকে ওঠে। আমাদের ঘরটি রোদহীন। তাই নার্সের কামিজটি এখন গাঢ় সবুজ।

 সে আমার হাত থেকে লেবুগুলো নিল। বলল,

-       শরবত খাবেন?

-       জ্বি।

-       আপনাদের রান্নাঘর কোথায় দেখেছি। চিনি খুঁজে পাই নি। চিনি কোথায় রাখেন আপনারা বলুন ত।

-       আমি ঠিক জানি না। আমার ওয়াইফ জানে।

-       অ

আমি ফোন দিলাম স্ত্রীকে। সে ফোন ধরে বলল

-       কি ?

-       আই লাভ ইউ সো মাচ বেবি।

-       দেন হোয়াই ডু ইউ টর্চার মি? কেন এত কষ্ট দাও।

তিনি মৃদু চিৎকার করলেন। কাঁদছেন এখন। কান্না পাচ্ছে আমারও। বেইবি..বেইবি...অহ্ মায় বেইবি।

নার্সটি অবাক হল। ছুটে এসে বলল,

-       আপনি কাঁদছেন কেন? না , না  দেখি। ছিঃ ছিঃ বাবু কাঁদে না।

তিনি আমাকে জড়িয়ে রেখেছেন। তিনি খুব উষ্ণ। শরীরে গভীর ঘ্রাণ।

২৩.

    the locusts have no king, yet all of them go out in ranks

                                        - (all the lights we cannot see: Anthony Doerr)

  আমার বিরক্তি ঘটছে। বাইরে যাওয়ার কথা ছিল। নার্সটির সাথে।   

  তখন মনসুর সাহেব ডাকলেন। বাসার নীচে এসে চেঁচাচ্ছিলেন আমার নাম ধরে ।

  আমার মনে হচ্ছিল সবাই শুনছে। চারদিকের লোকেরা। কিসব জানি ভাবছে তারা। টেনশন হচ্ছিল। তাই তাড়াতাড়ি নেমে এলাম। নইলে নামতাম না। নার্সটি বলেছিল আজকে আমরা পহেলা ফাগুন করব।

 নীচে নামলে মনসুর সাহেব বললেন

-        চলেন হসপিটালে যাই

-        আমি যাব না। আমার শরীরটা খারাপ।

-       ভাবীর সাথে দেখা করবেন। গতকাল রাতের থেকে অবস্থা খারাপ করেছে। আপনাকে যে বলসিলাম অবস্থা ভাল, ওটা মিথ্যা করে বলসিলাম। আপনে এমনেতেই শকে ছিলেন...

-       আমার ওয়াইফ তো গাইবান্ধা গেছে, আপনে জানেন না?

মনসুর সাহেব আমার হাত ধরে টানলেন। বললেন যে

-       আপনে আসেন তো ভাই।

  তার গলা ভেঙে গেল। কিছুদুর হেঁটে একটা চায়ের দোকানের বেন্চে বসে পড়লেন তিনি। আমি অস্থির হলাম। “এই কি হল! কি হল!” বললাম।

 মনসুর সাহেব বলতে লাগলেন

-       আমি ভাবীকে দেখতে গেসিলাম। চিনতে পারি নাই, হায় খোদা এরা কি মানুষ , আমি চিনতে পারি নাই.....

তিনি চিৎকার করছেন এবং কাঁদছেন। সুতরাং চারপাশে লোক জমতে লাগল। ধীরে ধীরে বিশাল জনতা হয়। তাদের কৌতুহল খুব। প্রশ্ন শুরু করে তারা।

  “ বাই কী-ইছে?” “ ওনারে মাচ্ছে?” “ ক্যাডায় মাচ্ছে?” “ ওনার পোলারে মারছে?” “ সরকার বাইনীর হাতে মরছে নাকী বিপ্লবীগো হাতে?” “বিপ্লবীগো কুন পার্টি এই এলাকায় আছে এখন?” “ ওনার কি-ইছে?” “ ভাই কাইন্দেন না, আল্লাহ্ রে ডাকেন” “কী-ছে” “ কী-ছে?”

 আমি জনতার পানে তাকাই। সোজা হেঁটে যাই লাল গেনজি পরা একজনের দিকে। জিগাশা করি যে

-       ভাই আপনার নাম?

লোকটি খুশি হয়। একটু ঝুঁকে এসে বিনয় জড়িত কন্ঠে বলে

-       আমার নাম পল্লব। আমি বিবিএ কমপ্লিট করলাম লাস্ট মান্থে। আপনারা সবাই একটু আমার জন্যে দোয়া করবেন।

আমি উল্লসিত গলায় বলি

-       পল্লব ভাই আপনার সাথে পরিচিত হয়ে আমি চমৎকৃত। চলুন আমরা দেখি যে মনসুর সাহেব কানছেন কেন।

আমরা জনতা সমেত হাঁটি। মনসুর সাহেবকে ঘিরে দাড়াই আমরা। তিনি কিছু বলেন না। তার কান্না অবিরত রয়। আমাদের বিরক্তি ঘটে। আমি অন্যদের সাথে পরিচিত হতে থাকি,

 “ আমি সোহেল। এখানে দোকানে কাজ করি”

“ আমি মজনু । রিক্সা চালাই। আমরার দাদায় আছিল জমিদার”

“ আমি এই বছর এইচ এস এসি দিমু। এদিকেই থাকি। নামটা খেয়াল রাখবেন ইশরাক। কুন গ্যানজাম ঝামেলা হইলেই আমার নাম কইবেন।“

“ আমার জন্যে একটু দোয়া করবেন ভাইয়া। আমিও এই বছর মেডিকেল থেকে পাশ করলাম”

সবাই অনেক কথা বলে। হাসে। আমিও হাসি হাসি থাকি। আমার গালে ব্যাথা করে। তখন সবাই বিদায় নেয়। আমি হ্যান্ডশেকের পরে হ্যান্ডশেক করি। আমার হাতের তালু চুলকাতে থাকে। কাঁধে ব্যাথা হয়। পল্লব বিদায় নেয়, মজনু বিদায় নেয়, বিদায় নেয় আশরাফ, সাকিব, মমতাজ, করিম, হাসিব, সিজান, ইশরাক, কবির, খাইরুল। “ ভাল থাকবেন ভাই” “ আবার দেখা হবে” “ সময় দেয়ার জন্যে থ্যাংকিউ”। আপনারা ভাল থাকবেন। শালা শুয়োরের বাচ্চারা।

২৪.

   এখন চৈত্রের দিন নিভে আসে, আরো নিভে আসে

                         - জীবনানন্দ দাশ   

    আমরা রিক্সায়। হাসপাতালে যাচ্ছি। মনসুর সাহেব মোবাইলে আলাপরত। তিনি কাঁদছেন না আগের মত। রিক্সায় উঠেই ভদ্রলোক নর্মাল হয়ে গেলেন। আমাকে বললেন,

-       আপনার শ্বশুরের সাথে দেখা হল সকালে। তিনি আজকে ভোরবেলা বাংলাদেশে পৌছালেন। আমার সাথে কথা হইল।

-       কথা হইসে আপনার সাথে?

-       জ্বি।

-       অ

তারপর তার মোবাইল বাজে। আমি দেখছিলাম মনসুর সাহেবকে সুন্দর লাগছে। কম বয়স ফুর্তি ফুর্তি একটা ভাব। তারপর তিনি ফোন রেখে দিলে আমি জিগেশ করলাম

-       ভাই, বসন্ত কি এসেছে?

তিনি বললেন

-       হ্যা , আপনার মনে নাই সেদিন পহেলা ফালগুনে আমি আর ভাবি ঘুরতে গেলাম।

-       ভাবী, ইউ মিন আমার ওয়াইফ?

-       জ্বি।

আমি চিন্তিত হই। আমার মনে পড়ে না ঘটনাটি। বললাম যে,

-       আপনে আর জিনিয়া ঘুরতে গেসিলেন পহেলা ফাগুনে?

-       হুমম। আপনি বললেন আপনার ভীড় হইচই ভাল্লাগে না। যাবেন না। তখন আমি আর ভাবী গেলাম।

আমি চুপ থাকি। মনে করতে পারি না। জোলাক্সের স্মৃতিনাশক গুনাবলী আছে। আজকাল অনেক ঘটনাই মনে পড়ে না। আমার রাগ হতে থাকে। স্ত্রীটির স্বভাবে মাগীভাব বিদ্যমান। যার তার সাথে যেখানে সেখানে চলে যান। রাস্তায় কোকিল ডাকছিল। মনসুর সাহেব বললেন,

-       কোকিল ডেকে ডেকে কি বলে জানেন?

আমার কথা বলার আগ্রহ হচ্ছিল না। সংক্ষিপ্ত করে বললাম

-       না।

-       বলে যে ‘বসন্ত চলে যায়’ ‘বসন্ত চলে যায়’। সে ডাকাডাকি করে একজন কম্পানিয়ানের জন্য।

-       ভাল।

-       এ বিষয়ে আমার একটা কবিতা আছে।

-       আমার কবিতা ভাল্লাগে না। আপনে চুপ থাকেন।

-       তাই নাকী? আগে তো কোনদিন বলেননি।

-       ভদ্রতা করে বলি নাই। এখন পরিস্থিতি খারাপ, ভদ্রতা করা বাদ দিসি।

-       আই এম স্যরি। বাট লাস্ট এটা শুনে নিতে পারেন। প্লিজ।

আমার বিরক্তি হয়। ভদ্রলোক ছ্যাড়রামি করছেন। এমন তো, ছিলেন না উনি। 

আমার মনে হল মনসুর সাহেব পাল্টাচ্ছেন। সময়ের সাথে সাথে আরও পাল্টে যাবেন।

ভদ্রলোক আবৃত্তি করছেন।

 “  বসন্ত যায়গা

   ও সখী বসন্ত যায়গা

   ফুরায়ে যেতে লেগেছে

   রোদের বাসন্তী

   ঈষৎ দক্ষিণ হয়ে আসছে হাওয়া

   আমাদের পালকের রং

   ক্রমান্বয়ে ধুসর

   দৃশ্যহারা হইয়া গেলেগো সখী

   আমাদের আর বসন্ত হবে না।“

রাস্তায় ফাগুনের ঝিকঝিকে রোদ।

২৫.

    সব ভালবাসা যার বোঝা হল, দেখুক সে মৃত্য ভালবেসে

                                  - জীবনানন্দ দাশ

 শ্বশুরকে দেখতে পাচ্ছি। তিনি খানিকটা দূরে। সাথে দুজন ডাক্তার। তিনজনই কথা বলছেন মনে হলো। প্রত্যেকের ভাব বিমর্ষ। 

 ডাক্তারদের আচরণটি অস্বাভাবিক। তারা দাড়িয়ে দাড়িয়ে কারো সাথে আলাপ করছে এমনটা দেখি না। ‌এরা সর্বদা গতিশীল ও ব্যাস্ত। তবে শ্বশুর লোকটি ধনী ও ক্ষমতাবান। এ ধরণের লোকেরা সবকিছুর গতি নিয়ন্ত্রণকারী।

 শ্বশুর ভাল লোক। আমাকে স্নেহ করেন। আমি আগাচ্ছি ওদিকে। ডাক্তারদ্বয় বিদায় নিয়েছে। দৃশ্যে এখন শুধুই শ্বশুর সাহেব। দূর থেকে বুঝতে পারছি তার চোখে পানি। আমি ওনার কাছে গিয়ে দাড়ালাম। তিনি হতভম্ব হয়ে আমাকে দেখলেন কিছুক্ষণ। তারপর জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন।

  আমার শার্ট ভিজে যাচ্ছে। আশেপাশের লোকেরা ঘুরে তাকাচ্ছে। খুব অস্বস্তি লাগছে আমার। আমি শক্ত হয়ে দাড়িয়ে আছি।

  

Comments

    Please login to post comment. Login