জানালায় চোখ রাখি, আকাশ দেখার আশায়। শহরের উঁচু ভবনগুলো সেই আকাশের অনেকটা চুরি করে দখলে নিয়েছে। ভবনে ভবনে কবুতরের খোপের মত ছোট ছোট জানালা। পেশাজীবী মায়ের ঘরে-বন্দি শিশু-কিশোরের আকাশ দেখারও জো নেই। গুমোট গরমে ক্লান্ত চারপাশ। লু হাওয়ার আগুনে বিগড়ে গেছে নগরের মামুলি বাতাস। কিছু দূরে হাতিরঝিল, যেখানে জমা থাকে শহুরে মানুষের বুকের অদৃশ্য নোনা জল। সূর্য স্বয়ং তাপ নামক হাতির শুঁড় দিয়ে ফিরিয়ে নিতে চায় ঝিলের সব নোনা জল। নতুন করে লাখো মানুষের মাঝে বিতরণ করবে বলে। যেভাবে টিসিবির ট্রাকে স্বল্পমূল্যের খাদ্যদ্রব্য বিতরণ হয়।
সড়ক দ্বীপে দাঁড়িয়ে থাকা গাছেরা সেই দুশ্চিন্তায় নুয়ে পড়ে। যেন বৃষ্টির প্রার্থনায় রুকুতে গিয়ে স্থির হয়ে আছে। বৃষ্টি নামলে রুকু ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়াবে। গুমোট গরমের মাঝে এ সমস্ত ভাবনা আমাকেও ছুঁয়ে দেয়। ভাবি, আমিও কি প্রার্থনায় যাবো? বৃষ্টি নামার প্রার্থনায়? সাহস পাই না। দ্বিধা আমাকে ঘোরগ্রস্ত করে রাখে।
স্বার্থপরের মত কি বৃষ্টির জন্য দুহাত তুলে ধরবো? কারণ এতকাল সেই সাহস করিনি। বৃষ্টি হলে তাকে আর থামাতে কে পারে? একবার ঝরতে শুরু করলে ভিজিয়ে দেয় শহর, বন্দর, মাঠ, ঘাট। আশ্রয়হীনের শেষ আশাটুকু। খাল, বিল ভরিয়ে রাস্তায় আসে জল। সেই জলে নদীর তীর, বন্দরের ঘাট। উঠে যায় রাস্তার পিচ। সেই ভয়ে বহু বছর বৃষ্টি ছিল এক আতঙ্কের নাম। তখন কায়মনোবাক্যে চাইতাম, মাঠের ফসল জ্বলে যায় যদি যাক। সেই আমি কি নতুন করে বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করবো? জানি, বৃষ্টি নামলে সারাদেশের সহকর্মীদেরও টেনশন শুরু হবে। কেন ভেঙ্গে যায় সড়ক, সড়কের ধার? প্রশ্নের উপর প্রশ্ন, এক জনের পর আরেক জন। ধৈর্য তখন বালির বাঁধের মত অটুট থাকে!
তবু বৃষ্টি দরকার। প্রার্থনা করি বা না করি। একদিন বিনা নোটিশে, ঝরতে শুরু করবে। মৃতপ্রায় এই শহর চনমনে জেগে উঠবে। ধুলোর এই শহরকে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে দেবে। কিন্তু মনের কালিমার কি হবে? আহা, সেটা যদি ধুয়ে দিতে পারতো বৃষ্টির জল। প্রতিদিন সকালে দুপুরে বিকেলে গভীর রাতে ইউটিউব খুলে যদি দেখতে না হতো মানুষ-হায়েনার ফটো, ভিডিও। শান্তিনগরে অশান্তির ঝড়, কালাচানপুরে কালো জগতের সন্ধান, শনির আখড়ায় বৃহস্পতির আকাল, মান্দায় ক্ষুধামন্দা, ভূতের গলিতে জিনের আছর, বেগুনবাড়িতে সবজির চড়া দাম, ওয়ারিতে যুদ্ধের দামামা, বেচারাম দেউড়িতে লাঠালাঠি, পলাশীতে চুল কাটার সিরিয়াল নিয়ে শেরে বাংলা আর সলিমুল্লাহর মাঝে সংঘাত, সদরঘাটের বদ্ধঘরে নারীর অর্ধগলিত লাশ। যদি ফেসবুকের ওয়ালে ভেসে না আসতো এরকম হাজারও দুঃসংবাদ।
জানি, এই শহরে আছে বৃষ্টিপ্রেমিক, কবি, ত্রাণ অফিসের কর্মচারি। ওরা থাকুক বা না থাকুক।ওরা চাউক বা না চাউক। জানি একদিন বৃষ্টি নামবে। নামুক। এখন প্রার্থনায় বসি।