Posts

গল্প

শালগাছের নিচে

May 26, 2025

মেঘের ডায়েরি

60
View

শালগাছের নিচে

(অংশ ১: আগমন)

রাত্রি তখন গভীর। চারদিকে শুধু ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ আর মাঝে মাঝে দূর থেকে ভেসে আসা কুকুরের হুক্কাহুয়া। দার্জিলিং-এর শেষ প্রান্তে একটা ছোট্ট গ্রাম—পাহাড়পুর। গায়ে গা লাগা কুয়াশা আর বিশাল শালগাছের অন্ধকার ছায়া যেন রাতটাকে আরও বেশি গা ছমছমে করে তোলে।

এই গ্রামে এসেছেন তরুণ লেখক অর্ক। শহরের কোলাহল থেকে কিছুদিন মুক্তি পেতে, আর তার নতুন উপন্যাসের জন্য ‘সত্য ঘটনা’ খুঁজতে। গ্রামে আসার আগেই শুনেছিলেন—পাহাড়পুরে একটা শালবন আছে, যেখানে সন্ধ্যার পর কেউ যায় না। কেউ কেউ বলে সেখানে নাকি ‘ওরা’ আছে।

অর্ক এসব কুসংস্কারে বিশ্বাস করে না। তবে কৌতূহল ছিল প্রবল। গ্রামে পা দিয়েই সে উঠেছিল এক প্রাচীন বাংলোয়, যেটা এককালে ব্রিটিশ সাহেবদের অফিস ছিল।

"এই বাংলোতে থাকবেন?" বিস্ময়ে চোখ বড় করে জিজ্ঞাসা করেছিল স্থানীয় চৌধুরী মশাই, যিনি বাংলো দেখভাল করেন।
"হ্যাঁ, শুনেছি এখানকার ইতিহাসটা খুব পুরনো। জায়গাটা দেখেই মনে হলো আমার লেখার জন্য একদম পারফেক্ট।"

চৌধুরী মশাই হেসে বলেছিলেন, "ইতিহাস আছে ঠিকই, তবে কিছু কিছু ইতিহাস জানার চেয়ে না জানাই ভালো…"

(অংশ ২: শালবনের ডাক)

রাত বাড়তে থাকে। অর্ক তার ডায়েরিতে লেখা লিখছিল, হঠাৎ জানালার কাচে এক টুকরো ছায়া পড়ল। সে তাকিয়ে দেখে, কেউ যেন শালবনের দিক থেকে তাকিয়ে আছে… অনেক দূরে, তবে চোখদুটো জ্বলজ্বল করছে।

অর্ক সাহস করে বাইরেও গেল, কিন্তু সেখানে কেউ নেই। শুধু শালগাছগুলোর মধ্য দিয়ে হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। বাতাসে এক অদ্ভুত গন্ধ—পচা মাটির গন্ধ, যেন কিছুর মৃতদেহ পচছে।

সেই রাতেই ঘুমের মধ্যে অর্ক দেখল—সে হাঁটছে শালবনের ভিতর দিয়ে। হঠাৎ একটা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা এক মেয়েকে দেখতে পেল, সাদা কাপড়ে ঢাকা, লম্বা চুলে মুখ ঢাকা।

সে বলল, "ফিরে যা… নয়তো তোর লেখা শেষ হবে আমার মৃত্যু দিয়ে…"

ঘুম ভেঙে যায়। ঘড়ি দেখল—রাত ৩টা ৩৩ মিনিট।

(অংশ ৩: ইতিহাস উন্মোচন)

পরের দিন, গ্রামের লাইব্রেরি ঘেঁটে একটা পুরনো সংবাদপত্রে অর্ক পেল এক ভয়ংকর কাহিনি—
১৯৭৫ সালে, ঠিক এই শালবনের মধ্যেই এক ব্রিটিশ সাহেবের মেয়ে, এভলিন, হারিয়ে যায়। পরে তার লাশ পাওয়া যায় শালগাছের নিচে ঝুলন্ত অবস্থায়। গ্রামের মানুষ বলে, সে আত্মহত্যা করেনি—তার ওপর কিছু একটা এসেছিল। এরপর থেকেই শালবনের নাম “শাল মৃত্যু বন” হয়ে যায়।

অর্ক এবার ঠিক করল—রহস্যের শেষ দেখেই ছাড়বে।

(অংশ ৪: চূড়ান্ত রাত)

সেদিন রাতেই সে গেল শালবনে। গলায় ঝোলানো ছিল রেকর্ডার, ক্যামেরা আর একখানা ছোট নোটবুক। গভীর বনের মাঝে হঠাৎ ঠান্ডা বাতাস বয়ে গেল। শালগাছের নিচে আবার দেখতে পেল সেই মেয়েটিকে। এবার সে মুখ তুলল…

মুখটা নেই। শুধু দুটো চোখ আর গহ্বর।

অর্ক চিৎকার করে উঠে পড়ল। কিন্তু শব্দ বের হলো না। গলার স্বর আটকে গেছে। সে দৌড়াতে চাইল, পা নড়ল না।

মেয়েটি তার দিকে এগিয়ে এল, আর বলল,
“তুই আমার গল্প লিখতে এসেছিস? এবার তোর লেখার শেষ অধ্যায় আমি লিখব…”

(শেষাংশ: হারিয়ে যাওয়া ডায়েরি)

পরদিন সকালে গ্রামের লোকজন অর্কের খোঁজে বাংলোয় আসে। সে নেই। শুধু একটা খোলা নোটবুক পড়ে আছে টেবিলের ওপর—শেষ পাতায় লেখা:

“শেষ অধ্যায় শুরু হলো শালগাছের নিচে… আর শেষ হলো আমার লেখকসত্তার মৃত্যুর সঙ্গে।”

তখন থেকেই কেউ আর শালবনের দিকে যায় না।

শেষ।

Comments

    Please login to post comment. Login