Posts

গল্প

মায়াবী

May 26, 2025

Quazi Md moslamin

78
View

রাত প্রায় সাড়ে দশটা বাজে। ডাঃ শামীমের চেম্বার। অন‍্যমনস্ক হয়ে নিজের চেয়ারে বসে আছে সে, সহকারী শফিক একটু ইতস্তত করে চেম্বারে ঢুকে আস্তে করে বলে — স‍্যার, আর কোনো রোগী নেই, রাত হয়েছে, বাড়ি যাবেন না? চমকে উঠে বললো — হ‍্যাঁ শফিক, এই যাচ্ছি, সব গুছিয়ে রেখে  তুমিও চলে যাও। 

ড্রয়ার খুলে ভিজিটের টাকাগুলো পকেটে ভরে উঠে দাঁড়াতেই  ঘরের কোণে ঝুলানো কঙ্কালটার দিকে তার দৃষ্টি পড়লো… হ্নদয়ে তীব্র ব‍্যথা অনুভব করলো শামীম, র্দীঘশ্বাস ফেলে বেরিয়ে গেলো সে। ডাক্তার হিসাবে তার খুব সুনাম, চেম্বারে সব সময় ভিড় লেগেই থাকে, তার ভিজিট পাঁচশো টাকা, তাও রোগীর কমতি নেই, এছাড়া নামকরা একটা হাসপাতালের প্রফেসর… প্রচুর উর্পাজন তার, এত টাকা দিয়ে কি করবে সে, একা মানুষ…. গরীব আত্মীয়স্বজন, এতিম, অসহায়… এদেরকে দান করে দেয়। 

ফ্ল‍্যাটে ঢুকতেই মিষ্টি মধুর একটা কন্ঠস্বর বলে উঠলো —- বাকি রাতটুকু শেষ করে এলেই তো পারতে? আমি যে একা একা থাকি, এত রাত র্পযন্ত না খেয়ে অপেক্ষা করি — সাহেবের খেয়ালই থাকে না। 

হাসি মুখে শামীম বলে — রাগ কোরো না লক্ষ্মীটি, এত রোগী থাকে, কাউকে ফেরাতে পারি না, আর কতদিন না বলেছি আমার জন্য অপেক্ষা না করে খেয়ে নিয়ো, তা বেগম সাহেবের খেয়াল থাকে না? 

ঝঙ্কার দিয়ে উঠলো স্বরটা — হ‍্যাঁ, স্বামী বাইরে খেয়ে না খেয়ে পরিশ্রম করছেন আর আমি স্বার্থপরের মত আগেই খেয়ে নেবো তাই না? 

— প্রিয় সখী, জেনে শুনেই  এই অধমকে বরণ করেছো তুমি, এখন রাগ করলে চলবে কেন? নাও, টাকাগুলো ধরো….. বলে পকেটে হাত দিয়েই চমকে উঠলো… শামীম শূন্য ঘরে একা দাঁড়িয়ে আছে, আর কেউ নেই  ঘরে। 

অবসন্নের মত টলতে টলতে শোবার ঘরে এসে বিছানায় স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো, বিছানার পাশের ছোট টেবিলে মায়ার হাসি মুখের একটা ছবি রাখা, কি মিষ্টি হাসি…. তার দিকেই তাকিয়ে হাসছে মনে হয় —- আজ তিন বছর হলো তার ঘর শূণ্য…. প্রিয়তমা স্ত্রী মায়া নেই…. তাকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেছে ঐ নিশি গগনে – তারা হয়ে জ্বলছে। 

…………. 

তিন বছর আগের ঘটনা —- একদিন, বেশ রাত হয়ে গেলো শামীমের বাসায় ফিরতে, কলিং বেল টিপলো, দরজা খুললো না, কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আবারও বেল টিপলো, না মায়া, না বুয়া… কেউ আসছে না, দরজার চাবি একটা তার কাছে থাকে, সেটা দিয়ে দরজা খুলে ঘরে ঢুকে অবাক হলো সে, পুরো ফ্ল‍্যাট অন্ধকার, কোনো ঘরেই আলো জ্বলছে না…. বুকটা তার কেঁপে উঠলো, কি হয়েছে? তার মায়ার কিছু হয়নি তো! বসার ঘরের আলোটা জ্বালিয়ে মায়াকে ডাকতে লাগলো, বুয়াই বা কোথায়, কারো কোনো সাড়া শব্দ নেই। 

প্রায় দৌড়ে শোবার ঘরে এলো শামীম, ঘর খালি, মায়া নেই, বিছানাটা এলোমেলো হয়ে আছে, অন‍্যান‍্য জিনিসপত্র সব তছনছ… যেন ঝড় বয়ে গেছে ঘরটাতে। আঁতকে উঠলো, হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেলো ওর। দৌড়ে বাথরুমে ঢুকেই  আর্তনাদ করে উঠলো…. মায়া পড়ে আছে মেঝেতে, শরীরে একটা সুতোও নেই, মুখ বাঁধা, বিষ্ফারিত খোলা চোখে আতঙ্ক এবং কষ্টের ছাপ স্পষ্ট। 

অভিজ্ঞ ডাক্তার, দেখেই বুঝলো মায়া আর নেই। উন্মাদের মত ছুটে যেয়ে সযত্নে কোলে তুলে নিয়ে এসে বিছানায় শুইয়ে চাদর দিয়ে শরীরটা ঢেকে দিলো তারপর পুলিশকে জানালো। পুলিশ এসে তন্ন তন্ন করে খুনীর আলামত খুঁজতে লাগলো কিন্তু কিছুই পাওয়া গেলো না। 

বুয়া অজ্ঞান হয়ে রান্নাঘরেই পড়েছিলো, তারও হাত মুখ বাঁধা, মাথায় আঘাত করা হয়েছিলো। জ্ঞান ফিরলে ও কিছুই বলতে পারলো না, সে রান্না করছিলো হঠাৎ পিছন থেকে মাথায় বাড়ি দেয় কেউ। না কাউকে সে দেখতে পায়নি তবে কলিংবেলের আওয়াজ পেয়ে দরজা খুলতে বেরিয়ে এসেছিলো, বসার ঘরে ভাবী টিভি দেখছিলো, ভাবীই বললো… তুমি যাও, আমি দেখছি কে এলো,  তারপর কি হয়েছে, সে বলতে পারবে না, কেবল একজন পুরুষের অস্পষ্ট স্বর শুনতে পেয়েছিলো এবং কতক্ষণ পরে আততায়ী আচমকা পিছন থেকে আক্রমণ করে। 

পোষ্টর্মটেমে জানা গেলো, মায়াকে একাধিকবার...  করে গলা টিপে মেরে ফেলা হয়, খুব পরিকল্পিত এবং ঠান্ডা মাথায় কাজটা করেছে খুনী, অতিমাত্রায় সাবধানী ছিলো, হাতে দস্তানা পরেছিলো তাই কোথাও হাতের ছাপ পাওয়া যায়নি… পাশবিক অত‍্যাচারের ধরন থেকে আন্দাজ করা যায় যে সে আক্রোশ মিটিয়েছে মেয়েটার সাথে। ফ্ল‍্যাটের র্গাড সে সময় বাথরুমে গিয়েছিলো সুতরাং সেও কিছু বলতে পারলো না, গেট অরক্ষিত রেখে যাওয়াটা তার ঘোর অন‍্যায় হয়েছে, চাকরি থেকে তাকে বরখাস্তও করা হয়েছে কিন্তু আর কি হবে, যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে
কোন পাষন্ড মায়াকে এমন নিষ্ঠুর ভাবে মারলো? কেন? কাউকে সন্দেহ করে কিনা শামীম জানতে চাইলো পুলিশ কিন্তু সে বলতে পারলো না, ওদের দুজনেরই আত্মীয়স্বজন বা বন্ধু বান্ধব তেমন ছিলো না সুতরাং কার নাম বলবে? 

অনেক চেষ্টা করলো পুলিশ কিন্তু খুনী ধরা পড়লো না। 

শামীম একটা কাজ করলো, কারো কথা শুনলো না, মায়াকে তখনই কবর দিতে দিলো না, সে নিজে ডাক্তার… অন্য দুজন ডাক্তারের  সহযোগিতায় মায়ার কঙ্কালটা আস্ত বের করে নিজের চেম্বারে ঝুলিয়ে রাখলো… হোক কঙ্কাল — তবু তো সেটা মায়ার, ওর চোখের সামনেই থাকবে মায়া তার ভালোবাসা। এরপর শরীরের সব কিছু দাফন করে দিলো।  

ওর এই কাজটাকে অন্য সবাই পাগলামী ছাড়া আর কিছুই ভাবলো না…. হ‍্যাঁ, সে পাগল, মায়া তার অস্তিত্বে মিশে ছিলো, অসময়ে তাকে হারিয়ে শোকে, নাওয়া খাওয়া ভুলে উন্মাদের মত হয়ে গেলো, কাজ র্কম কিচ্ছু করতো না, শামীমের দুর সম্পর্কের এক খালা সে সময় ওর কাছে থেকে আদর যত্ন করে সুস্থ করেন আর সহকর্মীদের সহানুভূতি তো ছিলোই। নিজেকে সুস্থির শান্ত করে অবশেষে কাজে ব‍্যস্ত থেকে মায়াকে ভুলতে চেষ্টা করেছে। 

সে যেন এক যন্ত্র, বেঁচে থাকতে হবে তাই আছে, আত্মহত্যা মহাপাপ, আল্লাহ্ কখনো এই পাপ মাফ করবেন না তাই নিজেকে শেষ করতে পারেনি। 

মায়াহীন শামীম যেন আত্মা ছাড়া শরীর। 

এরপর শামীম আর কাউকেই সহ‍্য করতে পারে না, একা থাকতেই পছন্দ করে… খালা বুঝলেন ওর মানসিক অবস্থা, আবার বিয়ে করতে বললেন কিন্তু শামীম রাজী হলো না। বুয়াকে বিদায় করে একজন কম বয়সী ছেলেকে রাখলো… রাজু, যে তার সব কাজ করে, রান্নাও। 

চেম্বার থেকে ফিরে শ্রান্ত দেহে কোনো মতে সামান্য কিছু খেয়ে শুয়ে পড়ে…. বিছানায় শুতেই সিনেমার  মত তার চোখে ভেসে উঠতে থাকে অতীতের মধুর স্মৃতিগুলো। 

গল্পটা লিখেছি বিদেশী সিনেমার ছায়া অবলম্বনে। 

চলবে…

Comments

    Please login to post comment. Login