পর্ব ১: অচেনা রাত
মেয়েটার নাম ছিল নীলা।
সে ছিল অসাধারণ সুন্দরী — চোখদুটো টলটলে জল মতো স্বচ্ছ, চুলগুলো কোমর ছুঁয়ে যেত।
সেই গ্রামে এমন মেয়ে আর একটাও ছিল না।
নীলা প্রায়শই রাতের দিকে নিজে নিজেই হেঁটে বাড়ি ফিরত।
তাঁর সাহস ছিল প্রচণ্ড —
"ভয়? আমি কাউকে ভয় পাই না," — এই কথা প্রায়শই বলত সে।
সেদিনও ঠিক এমনই এক রাত।
চারিদিক নীরব, ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক ছাড়া কিছু শোনা যাচ্ছিল না।
বসতবাড়ির পাশ দিয়ে ছিল একটা পুরোনো আমবাগান।
গ্রামবাসীরা বলত, "সন্ধ্যার পর ওই বাগানটা এড়িয়ে চলিস... ওখানে ভালো কিছু দেখা যায় না।"
কিন্তু নীলা কারও কথা শুনত না।
সে হেঁটে যাচ্ছিল চেনা পথে, হঠাৎ চোখ পড়ল বাগানের মাঝে।
একটা সাদা শাড়ি পরা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চুলে কোনও বাতাস না থাকা সত্ত্বেও চুলগুলো যেন নিজের মত দুলছে...
নীলা থেমে গেল।
"কে ও?" — ডেকে উঠল সে।
সেই মেয়েটি কিছু বলল না।
ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে এল।
আর তখনই...
নীলার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।
সেই মুখটা যেন... মুখ ছিল না।
পর্ব ২: মুখহীন ছায়া
নীলা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।
তার শরীর যেন জমে গেছে।
সেই সাদা শাড়ির মেয়েটা ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে আসছে — মাথা নিচু, পা যেন মাটি ছুঁয়েও ছুঁয়েছে না।
নীলা কাঁপা গলায় বলল,
— “কে তুমি? এত রাতে এখানে কী করছো?”
কোনো উত্তর নেই।
মেয়েটির মুখ এখন স্পষ্ট — না, ওটা মুখ না!
চোখ, নাক, ঠোঁট কিছুই নেই, যেন একটা ফাঁকা, সাদা মুখোশ...
হঠাৎ ভেঙে পড়ল মেয়েটা।
পায়ে পায়ে মাটি ঘষে চলে গেল পাশের বাঁশঝাড়ে।
নীলা যেন ঘোর কাটিয়ে দৌড়াতে শুরু করল।
বাড়ি ফিরে এল সে, শ্বাস হাঁফিয়ে যাচ্ছে।
মা বলল, “কি হইছে রে? মুখ এত সাদা ক্যান?”
নীলা কিছু বলতে পারল না।
শুধু বলল —
— “সেই আমবাগানে কেউ ছিল মা... ও মানুষ না... আমি জানি!”
রাতে ঘুম আসল না।
চোখ বন্ধ করলেই সেই ফাঁকা মুখটা দেখতে পাচ্ছে সে।
আর তখনই... জানালার বাইরে খসখস শব্দ...
নীলা উঠে দাঁড়াল।
জানালা খুলে দেখল —
একটি ছোট্ট কাগজ ভেসে এসে আটকে গেছে জানালায়।
তাতে লেখা —
“তুমি আমায় দেখেছো। এখন তুমিও আমার মতো হবে।”
পর্ব ৩: অভিশপ্ত আয়না
নীলা সেই রাতের পর আর স্বাভাবিক ছিল না।
ঘুম আসত না, খেতে পারত না।
চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে, মুখে কেমন যেন একটা শুকনোভাব।
কিন্তু সবচেয়ে ভয়ানক ব্যাপারটা ঘটল তৃতীয় দিন রাতে।
নীলা ঘুমানোর আগে হঠাৎ আয়নার দিকে তাকাল।
নিজেকে দেখে চমকে উঠল —
তার মুখটা যেন একটু একটু করে মুছে যাচ্ছে।
চোখের রেখাগুলো অস্পষ্ট, ঠোঁট যেন হালকা সাদা, যেন কোনো অদৃশ্য কিছু তার চেহারা মুছে দিচ্ছে।
সে চিৎকার করে উঠে পড়ল।
মা এসে বলল, “কি হইছে আবার?”
নীলা বলল, “আমি... আমি হারিয়ে যাচ্ছি মা! আয়নায় দেখি — আমার মুখটাও যেন আর আমার না...!”
মা প্রথমে কিছু বুঝতে পারছিল না।
তবে তখনই দাদীমা ঘরের কোণ থেকে আস্তে বলল —
— “ওই বাগানটা... ওটা অভিশপ্ত। সেই জায়গায় একসময় একটা মেয়ে আগুনে পুড়ে মরে গেছিল... সবাই বলে, ওর আত্মা এখনো ফিরে ফিরে আসে, যাকে দেখে, তাকে সে আপন করে নিতে চায়... আর যেই একবার ‘ওকে দেখে’, সে আর মানুষ থাকে না...”
নীলা জিজ্ঞেস করল, “তাহলে আমি কী করব?”
দাদীমা বলল,
— “তুই বাঁচতে চাইলে ওর গল্প জানতেও হবে... ও কে ছিল, কেন মরেছিল, কেন সে ফিরে ফিরে আসে... আর সেই উত্তর শুধু এক জায়গায় পাওয়া যাবে — পুরনো ঠাকুরবাড়ির ঘরের ভিতর থাকা বন্ধ একটা কাঠের বাক্সে।”
পর্ব ৪: পুরনো প্রেম, নতুন ছায়া
সেই রাতে ঠিক ঘুম আসে না নীলার।
একদিকে মুখ হারানোর আতঙ্ক, অন্যদিকে ঠাকুরবাড়ির অভিশপ্ত বাক্সের কথা।
হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠল।
স্ক্রিনে ভেসে উঠল — "রাহুল কলিং…"
রাহুল — নীলার কলেজের পুরোনো বন্ধু।
এক সময় খুব কাছের ছিল, কিন্তু কোনো এক ভুল বোঝাবুঝিতে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল তারা।
অনেকদিন পর আজ হঠাৎ রাহুল ফোন করেছে!
নীলা ধীরে ধীরে ফোন ধরল।
— “হ্যালো…”
ওপাশ থেকে গলা এল,
— “তুমি ঠিক আছো তো নীলা? জানি অনেকদিন কথা হয়নি… কিন্তু গতকাল রাতে আমি একটা স্বপ্ন দেখেছি… তুমি একটা বাগানের মধ্যে দাঁড়িয়ে, পাশে একটা সাদা শাড়ি পরা মেয়ে, আর তুমি আমাকে বলছো — ‘আমায় বাঁচাও।’”
নীলা চমকে উঠল।
সে তো কাউকে কিছু বলেনি।
তাহলে রাহুল কীভাবে এই দৃশ্য দেখল?
নীলা সব খুলে বলল রাহুলকে — সেই রাতের কথা, মুখহীন মেয়েটা, আয়নার ভয়, দাদীর কথা, আর সেই অভিশপ্ত বাক্স।
রাহুল কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
— “আমিও সেই ঠাকুরবাড়ির গল্প শুনেছি... অনেক পুরনো দিনের কেস, কেউ ওটা খুলে না বহু বছর। আমি কালই গ্রামে চলে আসছি। তুমিই যদি ডাকো, আমি তোমার পাশে থাকব।”
পরদিন দুপুরে রাহুল এল।
দুজন মিলে রওনা দিল ঠাকুরবাড়ির দিকে।
বাড়িটা একেবারে ভেঙে পড়ার মতো — দরজায় তালা ঝুলছে, জানালার কাঁচ ভাঙা।
তারা পেছনের পথ ধরে ভিতরে ঢুকল।
একটা ঘর, যার দরজা আধখোলা।
ভিতরে ধুলোমাখা ফার্নিচার, আর এক কোণায় কাঠের একটা প্রাচীন বাক্স।
নীলা ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল...
হঠাৎ বাইরে ঝড় শুরু হল।
আর ঠিক তখনই —
ঘরের দরজাটা আপনি আপনি বন্ধ হয়ে গেল।
রাহুল ছুটে এল দরজা খুলতে, কিন্তু সেটা যেন কাউকে আটকে রাখার জন্যেই বন্ধ হয়েছে।
নীলা বাক্সটার দিকে তাকিয়ে দেখল —
তাতে রক্ত দিয়ে লেখা:
“তুমি যদি খুলো, তার গল্প শুরু হবে… কিন্তু শেষ আর কখনো হবে না
পর্ব ৫: বাক্সের ভিতরের সত্য
ঘরের বাতাস হঠাৎ ঠান্ডা হয়ে উঠেছে।
কাঠের পুরনো বাক্সটার চারপাশে যেন অদৃশ্য কিছু ঘুরছে, একটা চাপা গন্ধ — পুরনো ধূপ বা পুড়ে যাওয়া কিছুর গন্ধ।
নীলা ধীরে ধীরে বাক্সের ঢাকনায় হাত রাখল।
রাহুল তখন দরজার পাশে দাঁড়িয়ে, তাকে থামাতে চায় —
— “নীলা, তুমি নিশ্চিত?”
নীলা মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,
— “হ্যাঁ, আমাকে জানতেই হবে।”
ক্লিক…
বাক্সের তালাটা খুলল।
ভেতরে পুরনো একখানা চিঠি, একটা পোড়া ছবির অ্যালবাম, আর একটা রক্তরঙা চুড়ি।
চিঠিতে লেখা —
“আমি রূপা।
আমি সেই মেয়ে, যাকে ওরা বিশ্বাসঘাতক বলেছিল…
কিন্তু আমার অপরাধ ছিল শুধু ভালোবাসা।
আমি যাকে ভালোবেসেছিলাম, সে-ই আমাকে জ্যান্ত আগুনে পুড়িয়েছিল…
তার নাম ছিল… রাহুল।
সে বলেছিল, আমাকে বিয়ে করবে। কিন্তু গ্রামের লোকেদের ভয়ে আমাকে দোষী বানাল।
আমার আত্মা এখানেই রয়ে গেছে…
আমি ফিরব… আবার…”
নীলা থমকে গেল।
চিঠিটা পড়ে তার গলা শুকিয়ে গেল।
সে তাকাল রাহুলের দিকে।
— “তুমি…? চিঠিতে লেখা ছিল তোমার নাম…! এটা কী?”
রাহুল চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে।
তার চোখ যেন আর আগের মতো নেই — সেগুলো এখন ধীরে ধীরে কালো হয়ে যাচ্ছে।
রাহুল ধীরে ধীরে বলল,
— “আমি রাহুল নই… আমি সেই আত্মা, যাকে বন্দি করে রাখা হয়েছিল এই বাক্স খোলার অপেক্ষায়…”
— “আর তুমি… তুমি আমার উত্তরাধিকার… রূপার রক্ত তোমার শরীরে বইছে… এখন সময় এসেছে… তুমি হবে আমার পরবর্তী রূপ…”
ঘরজুড়ে বাতাস ঝড়ের মতো ঘুরছে, বাতি নিভে গেল।
নীলার শরীর থেকে যেন আলো বের হতে লাগল।
সে চিৎকার করে উঠল —
— “না! আমি তোমার মতো হব না!”
কিন্তু তখনই চুড়িটা নিজে নিজেই নীলার হাতে পরে গেল।
আর তারপর… নীলার চোখগুলো ধীরে ধীরে ফ্যাকাসে হতে লাগল…
পর্ব ৬: আত্মা বনাম আত্মা
চুড়ি পরার পর মুহূর্তেই নীলার শরীরটা থরথর করে কেঁপে উঠল।
তার চোখের পাতা ভারি হয়ে এলো, মুখে ধীরে ধীরে ছায়া নেমে এল।
হঠাৎ, চারপাশের ঘরটাই যেন বদলে গেল —
আলো নিভে গিয়ে চারদিকে অন্ধকার আর ছায়া ঘিরে ধরল নীলাকে।
সে এখন আর বাস্তবে নেই, সে আটকে গেছে রূপার অভিশপ্ত জগতে।
এই জগতটা কুয়াশায় ভরা —
গাছে ঝুলছে পোড়া ওড়না, মাটিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পুরনো পায়ের চিহ্ন,
আর দূরে দাঁড়িয়ে আছে সেই মেয়ে — রূপা।
সাদা শাড়ি, পোড়া মুখ, আগুনের গন্ধ ভাসছে তার চারপাশে।
রূপা বলল,
— “তুই আমার রক্তের।
তুই আমাকে ফিরিয়ে আনবি, নইলে তোও আমার মতো — অর্ধেক মানুষ, অর্ধেক ছায়া হয়ে থাকবি…!”
নীলা চিৎকার করে বলল,
— “আমি তোর মতো হব না!
তুই যে কষ্ট পেয়েছিস, আমি বুঝি — কিন্তু প্রতিশোধ নিয়ে আরেকটা জীবন ধ্বংস করেও কিছুই ফেরানো যায় না!”
রূপা এক মুহূর্ত থেমে যায়।
তার চোখে একফোঁটা অশ্রু ঝরে পড়ে, পুড়ে যাওয়া মুখটা একটু কোমল হয়ে আসে।
তখনই পেছন থেকে ভেসে আসে আরেকটি গলা —
রাহুল! কিন্তু এবার আসল রাহুল।
সে বলল,
— “রূপা, আমি জানি আমি ভুল করেছিলাম।
তখন ভয়ে, সমাজের চাপে আমি তোমার পাশে দাঁড়াতে পারিনি।
কিন্তু আজ আমি এসেছি তোমাকে মুক্তি দিতে — আমার সমস্ত জীবনের অনুতাপ দিয়ে।”
রূপা কাঁদতে কাঁদতে নীলার দিকে এগিয়ে এসে বলল,
— “তুই যদি চাস… আমাকে মুক্ত করতে পারিস।
আমার যন্ত্রণা শেষ হোক… আমাকে আলোতে ফিরিয়ে দে…”
নীলা চুড়িটা খুলে ফেলল,
চিঠিটা দু’হাত জোড় করে পুড়িয়ে ফেলল আগুনে,
আর বলল —
— “যে ভালোবাসা বিশ্বাসঘাতকতায় মরে যায়, তাকে মুক্তি দেওয়াটাই আসল প্রতিশোধ।”
এক ঝলক আলো চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল।
রূপার ছায়া ধীরে ধীরে আকাশের দিকে ভেসে উঠল…
আর একটা শান্ত হাসি রেখে চলে গেল।
চারদিক স্বাভাবিক হয়ে গেল।
নীলা আবার নিজের মুখে ফিরে পেল আলো, আর আয়নায় নিজেকে দেখে এবার সত্যিই হাসল।
শেষ? নাকি নতুন শুরু...?
সবকিছু যেন ঠিক হয়ে গেছে।
রাহুল আর নীলা এখন শান্ত, কিন্তু…
গল্পের শেষে, দূরে একটা জানালায় আবার দেখা গেল এক সাদা শাড়ি…
কোনো একটা নতুন আত্মা…
নতুন অপেক্ষা…