নাম রায়হান। বয়স ত্রিশের কোঠায়। একটা ছোট ফ্ল্যাটে একা থাকে ঢাকায়। চাকরি করে একটা কর্পোরেট অফিসে, সকাল নয়টা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত সময়টা যেন মেশিনের মতোই কেটে যায়। অফিসের ডেস্ক, এক কাপ কফি, আর নিরব কীবোর্ডের শব্দ—এই তার সঙ্গী।
রায়হান একা। বন্ধুবান্ধব আছে, কিন্তু ব্যস্ত। পরিবার গ্রামে থাকে, বাবা-মা বার্ধক্যে নিঃশব্দ। রায়হান শহরে এসেছে স্বপ্ন নিয়ে, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই স্বপ্নগুলো হারিয়ে গেছে বাস্তবের চাপ আর নিরন্তর ছুটে চলার ভিড়ে।
শুধু রাত হলে ওর একাকীত্বটা বোঝা যায়। ফোনটা চুপচাপ থাকে। সোশ্যাল মিডিয়ায় হাসিমুখের ছবি, ভালোবাসার গল্প, অথচ নিজের জীবনে কারও স্পর্শ নেই।
মাঝেমধ্যে প্রশ্ন করে নিজেকে—"সবাই কি খুব সুখী? না আমিই শুধু একটু বেশি একা?"
একদিন অফিস থেকে ফেরার পথে বাসস্ট্যান্ডে এক বৃদ্ধাকে দেখল—চুপ করে বসে, ভাঙা চোখে কিছু একটা খুঁজছেন যেন। রায়হান কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“চাচী, কিছু হয়েছে?”
বৃদ্ধা বললেন, “বাসা হারিয়ে ফেলেছি বাবা, ছেলে ফোন ধরছে না।”
রায়হান বৃদ্ধাকে সঙ্গে করে থানায় নিয়ে গেল, যোগাযোগ করে তার ছেলের সঙ্গে, এবং বাড়ি পৌঁছে দিলো। যাওয়ার সময় বৃদ্ধা শুধু বলেছিলেন,
“ভালো থেকো বাবা। আমার ছেলে সময় পায় না, তুমিই যেন আজ আমার ছেলের মতো লাগছিলে।”
সেদিন রাতে রায়হান আয়নায় তাকিয়ে থাকল অনেকক্ষণ। নিজের চোখে এক অদ্ভুত ক্লান্তি দেখল। হঠাৎ মনে হল, একা সে নয়—এই শহরে অনেকেই একা। অনেকে আছে যাদের গল্প বলা হয় না, শুধু বুকের ভেতর জমে থাকে।
এরপর রায়হান প্রতি সপ্তাহে বৃদ্ধাশ্রমে যেতে শুরু করল।
গল্প করে, চা খাওয়ায়, কারো চশমা ঠিক করে দেয়, কারো চুল আঁচড়ে দেয়। কেউ বলে—“তুই আমার ছোট ছেলের মতো,” কেউ বলে, “তুই এলেই ঘরটা আলো হয়ে যায়।”
রায়হানের জীবন বদলে গেল। চাকরি, ব্যস্ততা সবই আছে, কিন্তু মন আর একা নেই।
একদিন সে নিজের ডায়েরিতে লিখল—
“জীবন মানেই শুধু প্রেম বা সাফল্য নয়। কারো পাশে দাঁড়ানো, কাউকে জড়িয়ে ধরা, এক কাপ চায়ের পাশে কিছু নিঃশব্দ বোঝাপড়াই—এই তো জীবনের সত্যি রঙ। একা ছিলাম, একা আছি, কিন্তু আজ বুঝি, ভালোবাসা মানে শুধু সঙ্গে থাকা নয়, মনে রাখাও একধরনের সঙ্গ।”