ঈদুল আজহা বনাম ভারতের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি
জিলহজ মাসের শুরুতে মুসলিম বিশ্ব এক গভীর আধ্যাত্মিক আনন্দে মেতে ওঠে। এটি কেবল পশু জবাই নয়, বরং মানুষের আত্মশুদ্ধি, তাকওয়া এবং মানবিকতার প্রতীক। ইসলামের পরিভাষায় এই উৎসবকে ঈদুল আজহা বলা হয়। নবী ইব্রাহিম (আ.)-এর ত্যাগ ও আল্লাহর প্রতি তাঁর নিঃশর্ত আনুগত্যের স্মৃতিকে কেন্দ্র করে ইসলামের প্রথম যুগ থেকেই এই ইবাদত গুরুত্বপূর্ণ উৎসব হিসেবে পালন হয়ে আসছে। সমাজে সমতা, সহমর্মিতা ও ভ্রাতৃত্বের বার্তা ছড়িয়ে দিতে মানুষ “বনের পশু দিয়ে মনের পশু কোরবানি” করে। এতে যেমন সমাজের দরিদ্র মানুষের মুখে হাসি ফোটে, তেমনই মানুষের ভেতরের পশুত্বও দমন করার প্রয়াস থাকে।
বাংলাদেশে কোরবানির ঈদ শুধু ধর্মীয় আচারেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং দেশের অর্থনীতিরও বিশাল এক অংশ। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩ সালে কোরবানির জন্য প্রায় ২ কোটি ৪৮ লাখ ৫৬ হাজার পশু প্রস্তুত ছিল, যার বেশিরভাগই ছিল গরু। এর বাজারমূল্য প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। পশু পরিবহন, খামার, পশুখাদ্য, ওষুধ এবং চামড়া শিল্প—সবখানেই এই ঈদ কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে। শুধু চামড়া রপ্তানি থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৫৮ কোটি মার্কিন ডলার আয় করেছে। বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসাগুলোও চামড়া শিল্পে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এ বছর তারা সরকারের কাছে আহ্বান ও স্মারকলিপি দিয়েছে, যা কার্যকর হলে চামড়া শিল্পে আরও উন্নতি ও লাভের সম্ভাবনা তৈরি হবে। ধর্মীয় নিয়ম অনুযায়ী কোরবানির মাংস তিন ভাগে ভাগ করে পরিবার, আত্মীয়স্বজন ও দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করা হয়, যা সমাজে সহমর্মিতা ও সমতা প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
কিন্তু ভারতের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। সেখানে কোরবানির ঈদ এবং রাস্তায় নামাজ প্রায়শই হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির চক্রান্তের শিকার হয়। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (VHP) ও বজরং দলের মতো চরমপন্থী সংগঠনগুলো কোরবানির ঈদকে ধর্মীয় আচার হিসেবে না দেখে রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত করেছে। গরুর ‘পবিত্রতা’র হাস্যকর ধারণাকে কাজে লাগিয়ে মুসলিমদের ধর্মীয় অধিকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে। অথচ তাদের ঋগ্বেদসহ প্রাচীন বৈদিক সাহিত্যে গোমাংস খাওয়ার অসংখ্য প্রমাণ রয়েছে। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে আমার দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত আমার “ঋগ্বেদের গো-সংহার ও গরুর আধুনিক ধর্মবাণিজ্য” শীর্ষক লেখাটি পড়তে পারেন।
গো-রক্ষার নামে ভারতে যে সহিংসতা ও নিষেধাজ্ঞা চলছে, তা কেবল সামাজিক অশান্তিই নয়, মানুষের জীবন ও পরিবেশের জন্যও বিপজ্জনক। ভারতের সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত হরিয়ানায় গরুর কারণে ৩,৩৮৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৯১৯ জন প্রাণ হারিয়েছেন এবং ৩,০১৭ জন আহত হয়েছেন। ছত্তিশগড়েও একই সময়ে ৪০৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া, ৩০-৪০% গরু পলিথিনজাত প্লাস্টিক খেয়ে মারা যাচ্ছে। ২০১৯ সালে উত্তরপ্রদেশের একটি গরুর পাকস্থলীতে ৫০ কেজির বেশি প্লাস্টিক পাওয়া গিয়েছিল। গো-রক্ষার নামে গড়ে তোলা এই অব্যবস্থা ও দায়িত্বহীনতা—একদিকে পরিবেশের জন্য হুমকি, অন্যদিকে গরুর ‘পবিত্রতা’র হাস্যকর দাবিকেও সমালোচনায় পরিনত করছে।
২০২৫ সালে উত্তরপ্রদেশের গেরুয়া সরকার রাস্তায় নামাজ নিষিদ্ধ করাটা ধর্মীয় বৈষম্যের নগ্ন উদাহরণ। অথচ হিন্দুদের কাঁওয়াড় যাত্রা, গণেশ চতুর্থী, দুর্গাপূজা ও জগন্নাথ রথযাত্রার সময় রাস্তাঘাট বন্ধ হলেও সেগুলোকে ‘সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’ হিসেবে উদযাপন করা হয়। যেমন ২০১৯ সালে উত্তরাখণ্ডে ৩০ লাখ কাঁওয়াড়িয়া জাতীয় সড়কে যানজট তৈরি করে অ্যাম্বুলেন্স ও ফায়ার সার্ভিস ব্যাহত করেছিল। ২০২২ সালে গণেশ চতুর্থীর সময় মুম্বাইয়ে রাস্তা বন্ধ হয়ে জরুরি পরিষেবা পৌঁছাতে দেরি হয়েছিল। দুর্গাপূজায় কলকাতায় ট্রাফিক ৩০-৪০% ধীরগতির হয়। এমনকি অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিও হয়—গণেশ চতুর্থীতে মুম্বাইয়ে ৫০০ কোটি টাকা এবং দুর্গাপূজায় কলকাতায় ছোট ব্যবসায়ীদের ২০-৩০% আয় হারাতে হয়। পরিবেশ দূষণও অনেক বাড়ে, যেমন ২০২১ সালে গণেশ চতুর্থীতে মুম্বাইয়ে ১০,০০০-এর বেশি প্লাস্টার অফ প্যারিস মূর্তি বিসর্জনের ফলে জলাশয় দূষিত হয়, আর দুর্গাপূজায় ৮০-১০০ ডেসিবেল শব্দদূষণ ঘটে। অথচ মুসলিমদের ঈদের নামাজ সাধারণত মসজিদ-কেন্দ্রিক ও সংক্ষিপ্ত হয়—রাস্তায় নামাজ পড়া প্রায় বিরল ঘটনা। তবুও ২০২৫ সালে উত্তরপ্রদেশে নামাজ নিষিদ্ধ! মুসলিমরা হিন্দু উৎসবের প্রতি সহনশীল হলেও হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি মুসলিমদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানের প্রতি বিন্দুমাত্র সহনশীলতা দেখায় না।
ভারতের ইতিহাসে কিন্তু ভিন্ন চিত্র রয়েছে। রোমিলা থাপার তাঁর A History of India বইয়ে লিখেছেন, মুঘল আমলে বৃন্দাবনের গোবিন্দদেব মন্দির নির্মাণে মুসলিম শাসকরা সহযোগিতা করেছিলেন। সতীশ চন্দ্র লিখেছেন, তুলসীদাসের রামচরিতমানস মুঘল আমলে মুসলিম তত্ত্বাবধানে রচিত হয়েছিল। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহে হিন্দু-মুসলিম একসঙ্গে লড়াই করে বাহাদুর শাহ জাফরকে ভারতের সম্রাট হিসেবে মেনে নিয়েছিলেন। এই ইতিহাস ভারতের বহুত্ববাদী ঐতিহ্যের মুকুট। অথচ হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি সেই ঐতিহ্যকে পেছনে ফেলে উগ্রতা ও বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে।
কোরবানির ঈদ ও রাস্তায় নামাজ মুসলিম সম্প্রদায়ের কাছে আত্মত্যাগ, তাকওয়া ও মানবিকতার শান্তিপূর্ণ প্রকাশ। এগুলো কোনো রাজনৈতিক শক্তি প্রদর্শনের জন্য নয়, বরং ধর্মীয় ও সামাজিক ঐক্যের প্রতীক। হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীর অপপ্রচার, গো-রক্ষার নামে সহিংসতা এবং মুসলিমদের ধর্মীয় অধিকারে হস্তক্ষেপ ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতা ও বহুত্ববাদের জন্য বড় হুমকি। এই সংকীর্ণতা থেকে বেরিয়ে এসে সব ধর্মের প্রতি সমান শ্রদ্ধা ও সহনশীলতা দেখানো জরুরি। ভারতের শক্তি তার বৈচিত্র্যের ঐক্যে নিহিত—যেখানে ধর্ম, সংস্কৃতি ও ইতিহাসের রঙে গাঁথা এক অনন্য পরিচয়। গো-রক্ষার নামে সহিংসতার বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ করা এখন সময়ের দাবি। ইসলাম শান্তির ধর্ম, আর কোরবানির ঈদ তার সর্বোচ্চ প্রতিফলন। এই শান্তির বার্তা প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে পৌঁছে যাক—এই হোক সবার প্রার্থনা।
লেখক:
মাহফুজ বিন মোবারকপুরী
প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট।