
📘 অধ্যায় ১: হৃদয়ের অলিখিত দোয়া
ঝড়ের মতো এক রাত ছিল সেদিন। আকাশের কান্না যেন থামতেই চাইছিল না। সেই বর্ষণমুখর রাতে একটি পবিত্র সূচনা হয়েছিল দুইটি হৃদয়ের গল্পের—মুজাহিদ এবং আয়েশার।
চোখে একরাশ ঘুম আর কল্পনার আলোছায়া মিশিয়ে আয়েশা সেদিন প্রথমবার দুআ করেছিল এমন কাউকে, যাকে সে তখনও চিনতো না। অথচ তার দোয়ার শব্দগুলো যেন আগে থেকেই লেখা ছিল তাকদীরের পৃষ্ঠায়।
মাদ্রাসার মাঠে বসে থাকা মুজাহিদ তখনও জানতো না—তার জীবনকে পাল্টে দেওয়ার জন্য কেউ একান্তভাবে রাব্বুল আলামিনের দরবারে হাত তুলেছে। সে জানতো না, এই পৃথিবীর কোথাও এমন একটি মেয়ে আছে, যার দোয়ার উত্তরে সে নিজে একদিন বদলে যাবে।
আয়েশার দুনিয়া ছিল পর্দার আড়ালে, তাহাজ্জুদের কান্নায়, কুরআনের প্রতিটি শব্দে। মায়ের হাতে গড়া একটি কোমল হৃদয়, যা আঘাত পেলেও প্রতিশোধ নয়, বরং দোয়ার মাধ্যমে প্রতিউত্তর দিতে শেখে।
তাদের দেখা হয়নি তখনও। তবুও আসমানের কোনো এক গোপন ডায়েরিতে লেখা হয়ে গিয়েছিল দুইটি নাম—একসাথে।
সেই শুরু। এক অলিখিত দোয়ার শুরু, যে দোয়া ছুঁয়ে যাবে দুইটি জীবনের গভীরতম প্রান্ত।
---
মুজাহিদের জীবন ছিল সরল, একগুঁয়ে এবং কিছুটা রুক্ষ। কোরআনের প্রতি গভীর ভালোবাসা তাকে বানিয়ে তুলেছিল আত্মনিয়ন্ত্রণে দৃঢ় একজন যুবক। পরিবার থেকে ভালোবাসা পেয়েছে, কিন্তু শৈশব থেকেই তার মধ্যে ছিল অন্যরকম এক শূন্যতা—যা পূরণ হতে চেয়েছিল কোনো এক নিষ্পাপ ভালোবাসায়।
একদিন হঠাৎ করেই তার চোখে পড়ে একটি চিঠি, যা হয়তো পাঠানো হয়নি কারও উদ্দেশ্যে, কিংবা ঠিক ঠিক পৌঁছেওনি কখনও। তবুও সেই চিঠির শব্দগুলো, সেই লেখা যেন কারো কষ্টের প্রতিধ্বনি—যা একান্তভাবে লেখা হয়েছিল দোয়ার কাগজে।
চিঠিতে লেখা ছিল—
“হে অজানা কেউ, আমি জানি না তুমি কে। আমি শুধু জানি, তুমি আমার তাকদীরে লেখা থাকবে কি না, তা শুধু আমার দোয়া জানে। আমি এমন একজনকে চাই, যে আমার জান্নাতের পথ হবে। যে তাহাজ্জুদের অশ্রুতে আমার নাম তুলে দেবে। যে কুরআনের আয়াতে আমাকে খুঁজে নেবে। তুমি যদি থেকেও থাকো পৃথিবীর কোথাও, তাহলে জেনে রেখো—আমি অপেক্ষা করছি। আমি তোমার নাম জানি না, কিন্তু আমি তোমার জন্য দোয়া করি। প্রতিদিন। নিঃশব্দে।”
চিঠির লেখাগুলো যেন মুজাহিদের অন্তরে ঝড় তোলে। কার লেখা হতে পারে এমন গভীর কথা? কে এমন অজানা কাউকে এত গভীরভাবে চাইতে পারে? সে নিজেও তো এমন একজনের জন্য অপেক্ষায় আছে, যে তাকেও কুরআনের পথে টেনে আনবে, যিনি তার দুআর সঙ্গী হবেন।
তারপর শুরু হয় তার অনুসন্ধান—not কোন ব্যক্তির খোঁজে, বরং এমন এক ভালোবাসার, যা শুধু হৃদয় নয়, তাকদীরকেও বদলে দিতে পারে।
---
একটি অলিখিত দোয়া... একটি অনাগত দেখা... একটি তাকদীরের পথে লেখা প্রেম...
এভাবেই শুরু হয় তাদের যাত্রা, এক পবিত্র প্রেমের যাত্রা।
এক সপ্তাহ পর
একটা বিয়ের মাহফিলে আয়েশার খালার বাসায় অনেক লোক এসেছে। ছোট পরিসরে ইসলামি পরিবেশে আয়োজিত বিয়েতে মেয়েরা আলাদা ঘরে, ছেলেরা আলাদা ঘরে বসেছে।
মুজাহিদের মা এই বিয়ের একজন অতিথি। তার সঙ্গে এসেছে মুজাহিদ, মায়ের ইচ্ছায়। মুজাহিদ এসেছিল শুধু মা'কে সহযোগিতা করতে, কিন্তু সে জানত না, এই বিয়ের দাওয়াতও হয়তো তাকদীরেরই একটা অংশ।
আয়েশা ছিল মেয়েদের ঘরে। হঠাৎ খালার মেয়ে এসে বলে,
— "তোর জন্য এক গেস্ট খালার বড় পুত্রকে নিয়ে এসেছেন। চুপচাপ, শান্ত। শুনলাম দারুণ আল্লাহভীরু।"
আয়েশা কেমন যেন চমকে যায়।
— "তুই তার নাম জানিস?"
— "হুম… মনে হয় নাম বলছিলেন মুজাহিদ।"
হঠাৎ আয়েশার হৃদয়ে শব্দ হয় না, অথচ গলা শুকিয়ে যায়। "মুজাহিদ…" নামটা যেন কানের ভেতর গড়িয়ে হৃদয় ছুঁয়ে যায়। তারপর আয়েশা খুব স্বাভাবিকভাবে বলে,
— "আল্লাহ যেন সঠিক তাকদীর বানান আমাদের জন্য।"
---
ছেলেদের ঘরে...
মুজাহিদ জানত না যে তার মা ইতিমধ্যে বিয়ের ব্যাপারে কথা বলছেন। মায়ের চোখে আয়েশাকে নিয়েই স্বপ্ন।
— “ছেলেটা আমার ভালো, রোজা রাখে, মসজিদে যায়, কারো দিকে নজর তুলে চায় না। মেয়েটাকেও আমি দেখেছি, পর্দাশীল, নম্র, দৃষ্টি নিচু করে চলে।”
কিন্তু মুজাহিদ জানত না, যার জন্য হৃদয়ে দোয়া করেছে, তাকেই আল্লাহ তার মায়ের মুখে এনে দিয়েছেন।
---
রাতে মায়ের সাথে কথা...
— “মা, তুমি কী বলতে চাও?”
— “আমি চাই, এই মেয়েটিকেই তুমি বিয়ে করো। কিন্তু সিদ্ধান্ত তোমার। মেয়েটিকে তুমি হয়তো একবার দেখেছ বইমেলায়, আমার মনে হয় সেটা শুধু দেখা নয়, আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি ইশারা ছিল।”
মুজাহিদের চোখে পানি চলে আসে।
— “মা, আমি তাকেই দোয়া করেছিলাম। আমি তাকেই হৃদয়ে বসিয়েছি নাম ছাড়াই। আমি চেয়েছি এমন কাউকে, যার হায়া আমায় কাঁদিয়ে দেয়। কিন্তু জানতাম না, তাকদীর এভাবে চলে।”
মা চুপচাপ ছেলের মাথায় হাত রাখেন।
— “আল্লাহ যদি দিতেই চান, তবে বাধা কিছুই না।”
---
আয়েশার দোয়া...
রাত ২টা। আয়েশা তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ে সেজদায় পড়ে গেছে।
— “হে আল্লাহ, যদি এই ছেলেটি আমার জন্য হালাল হয়, তবে আপনি সহজ করে দিন। যদি না হয়, তবে তাকে এমন দূর করে দিন যেন চোখে ধরা না পড়ে কোনোদিন।”
সে কাঁদে। জানে না, সে দোয়া করছে ঠিক যাকে নিয়ে, সে-ই তখন দোয়া করছে তার জন্য।
---
দুই পরিবারের আলোচনার পর...
মুজাহিদ ও আয়েশার মাঝে একটি বৈঠক হয়—কিন্তু ইসলামী আদর্শে। পর্দার বাইরে তারা আলাদা ঘরে বসে, মাঝখানে খালা উপস্থিত। আয়েশাকে বলা হয়, "তুমি চাইলে তার বিষয়ে প্রশ্ন করতে পারো"।আয়েশা চুপ থাকে। তার হাত কাঁপে, কিন্তু সে বলার সাহস করে—
— “আপনি কি আল্লাহর উপর সম্পূর্ণ ভরসা করেন?”
একটা দীর্ঘ নীরবতা। তারপর সেই গলা, যা চোখে চোখে কথা বলত, এবার মুখে শব্দ তুলে বলে—
— “যখন আমি কাঁদি, আমি মানুষকে ডাকি না। আমি সেজদায় পড়ে যাই। আমি শুধু আল্লাহকে ডাকি।”
আয়েশার চোখ ভিজে যায়। সে মাথা নিচু করে বলে—
— “তাহলে আমি নিশ্চিন্ত।”
---
এক মাস পর
বিয়ের আয়োজন খুব সরল। কোনো গান, বাজনা নেই। শুধু কোরআন তেলাওয়াত, দোয়া আর কিছু আত্মীয়। মুজাহিদ আর আয়েশা এখন একজন আরেকজনের হালাল ভালোবাসা।
তাদের বিয়ের পরদিন মুজাহিদ বলে—
— “তুমি জানো, আমি প্রথম কবে তোমাকে দেখি?”
— “না…”
— “মসজিদের পেছনে বসে ছিলাম। তুমি জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলে।”
আয়েশা কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে—
— “তখন আমি দোয়া করেছিলাম—হে আল্লাহ, এই বান্দাকে যদি আমার জন্য রাখেন, তবে আমি তাকে চাই।”
---
শেষ রাতের কথা...
একদিন গভীর রাতে, আয়েশা উঠে দেখে মুজাহিদ সেজদায়। তার কান্না শুনতে পায়।
সে খুব আস্তে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়।
— “হে আল্লাহ, যদি আমি তাকে একদিন হারাই, তবে তাকে জান্নাতে আমার সাথেই রেখো।”
আয়েশার চোখে অশ্রু নেমে আসে। সে চুপচাপ ফিরে যায়, বালিশে মুখ লুকায় আর ভাবে—
> “এই ভালোবাসা, এই দ্বীনি প্রেম… আমি কখনো ছেড়ে যাবো না।”
বিয়ের ৩ মাস পর
সময় দ্রুত যায়। মুজাহিদ এখন নিয়মিত দাওয়াহর কাজে জড়িত। আয়েশাও ঘরে বসেই কোরআনের তাফসীর পড়ে, হাদিস চর্চা করে। এই তিন মাসে তারা বুঝতে পারে—হালাল ভালোবাসার মিষ্টতা আসলে সেজদার কান্নার মধ্যে লুকানো থাকে।
তবে এমন কোনো দাম্পত্য জীবনে শুধু আনন্দ নয়, সবরও থাকে।
এক সন্ধ্যায় আয়েশার শরীর খারাপ লাগে। মাথা ঘোরে, বমি বমি ভাব। প্রথমে ভেবেছিল জ্বর, কিন্তু যখন এক সপ্তাহ কেটে যায়—তখন ডাক্তারের কাছে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকে না।
ডাক্তার রিপোর্ট হাতে দেয়:
— “আপনার স্ত্রীর রক্তে একটা জটিলতা দেখা গেছে। খুবই বিরল একটা অবস্থা, যা প্রেগন্যান্সির আগে চিকিৎসা না করলে মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে।”
মুজাহিদের গলা শুকিয়ে যায়। সে কোনো কথা বলে না। আয়েশা কিছু বুঝতে না পেরে বলে,
— “কী হয়েছে, মুজাহিদ?”
সে ধীরে বলে,
— “কিছু না, আল্লাহ আমাদের পরীক্ষা নিতে পারেন।”
ডাক্তার পরে আলাদাভাবে মুজাহিদকে ডেকে জানায়,
— “এই অবস্থায় যদি স্ত্রী সন্তান ধারণ করে, তার জীবন ঝুঁকিতে পড়বে। আপনি ভাবুন, আপনারা সন্তান চাইবেন, নাকি স্ত্রীর জীবন বাঁচাবেন।”
---
[আত্মত্যাগের প্রথম শিক্ষা]
রাতে আয়েশা বলে,
— “আমি তো ভাবছিলাম আমরা হয়তো মা-বাবা হবো শিগগিরই...”
মুজাহিদ হাসে, মুখে আড়ষ্টতা।
— “হবে ইনশাআল্লাহ... আল্লাহ যখন চান, তখনই হয়।”
সে আয়েশার মাথায় হাত রাখে। মনে মনে বলে,
> “হে রব, যদি সন্তানের চেয়ে আমার স্ত্রী আমার জন্য অধিক গুরুত্বপূর্ণ হয়, তবে আমি সন্তান চাই না।”
---
এক রাতে আয়েশা কোরআন পড়তে গিয়ে এই আয়াতে আটকে যায়:
> “তোমরা ধৈর্য ধারণ করো, নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন।”
(সূরা বাকারা: ১৫৩)
তার মনে হয় কিছু একটা হতে চলেছে।
সে স্বপ্নে দেখে—এক সাদা পাঞ্জাবি পরা ছেলে কাঁদছে কবরের পাশে। কেউ নেই, শুধু কাঁদছে। আয়েশা নিজেই যেন সেই কবরের ভেতরে। ঘুম ভেঙে যায়। সে বলে—
— “হে আল্লাহ, এই স্বপ্ন তুমি কেটে দাও। আমার স্বামী যেন একা না হয় কখনো।”
---
[মহান আত্মত্যাগ: গর্ভে নতুন প্রাণ]
পরবর্তী মাসে আয়েশা গর্ভবতী হয়।
ডাক্তার জানায়, এটা জীবনঘাতী হতে পারে।
মুজাহিদ বলে,
— “তুমি যদি আমার কথা শোনো, তাহলে চিকিৎসা নিও, সন্তান পরে আসবে, ইনশাআল্লাহ।”
কিন্তু আয়েশা বলে,
— “এই সন্তান তো আল্লাহ দিয়েছেন। আমি মৃত্যুকেও ভয় পাই না। যদি সে আসে আল্লাহর হুকুমে। শুধু বলো, তুমি আমায় ছাড়া পারবে?”
মুজাহিদের চোখ বেয়ে অশ্রু গড়ায়।
— “আমি শুধু দোয়া করবো, তুমি যেন আমার আগে থাকো, তুমি না থাকলে আমি কাকে নিয়ে জিকির করবো রাতে?”
তারা একসাথে সেজদায় পড়ে যায়।
— “হে আল্লাহ, আপনি যা ভালো, আপনি জানেন। আমরা শুধু দোয়া করতে পারি, আপনি তাকদীর লিখেছেন, আমরা শুধু মেনে নিই।”
---
৮ম মাসে গর্ভকালীন জটিলতা শুরু হয়।
আয়েশার রক্তশূন্যতা মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছায়। ডাক্তার বলে, "প্রসব হলে হয়তো সন্তান বাঁচবে, হয়তো মা না-ও বাঁচতে পারে।"
মুজাহিদের দুই চোখ লাল। সে পাশে বসে শুধু আয়েশার কপালে হাত রাখে, আর সেজদায় পড়ে থাকে।
আয়েশার শেষ কথা প্রসব কক্ষে যাওয়ার আগে:
— “আমার সন্তানকে তুমি নাম দেবে 'সাবিরা' যদি মেয়ে হয়। আর যদি আমি না থাকি, তাহলে তাকদীরের এই আঘাত তুমি সবর দিয়ে বইবে।”
মুজাহিদ বলে,
— “তুমি না থাকলে, আমার সবর হারাবে। কিন্তু জান্নাতে দেখা হবে ইনশাআল্লাহ।”
---
[শেষ অধ্যায়ের ভিত: অধ্যায়ের শেষভাগে মৃত্যু]
প্রসব কক্ষে ভেতর থেকে কান্না আসে। নবজাতকের।
ডাক্তার বেরিয়ে এসে শুধু একটিই কথা বলে—
— “সন্তান বেঁচে গেছে। কিন্তু...”
আর কিছু বলার দরকার পড়ে না। মুজাহিদ মাটিতে বসে পড়ে।
পিছন থেকে মা এসে কাঁদে—
— “বাবা… আয়েশা আর নেই।”
---
তিন দিন পর
মুজাহিদ আয়েশার কবরের পাশে বসে। সামনে বসে ছোট্ট 'সাবিরা'।
সে চুপচাপ তাকিয়ে থাকে তার স্ত্রীর কবরের দিকে, হাত তুলে বলে—
— “হে আল্লাহ, আপনি আমার আয়েশাকে জান্নাতে রাইখেন। সে আমাকে কোনোদিন ভালোবাসা দিয়ে পাপ করতে দেয়নি। সে হালাল ছিল, সে ঈমান ছিল, সে দোয়া ছিল। আজ সে কবরে, আমি এখানে। কিন্তু আমরা একদিন আবার মিলবো—তোমার জান্নাতে।”
তারপর সে ছোট্ট সাবিরার মুখে তাকায়। মেয়েটা হাত নাড়ছে, মায়ের গন্ধ পেতে চাইছে।
মুজাহিদ চোখ মুছে বলে—
— “তাকদীরের ছায়ায় তুমি হারিয়ে গেলে, তবে আল্লাহর রহমতে আবার দেখা হবে।”
📘 দ্বিতীয় অধ্যায়: ভালোবাসার মানে বদলে যায়
[অংশ ১ – ভোরের নিঃশব্দ কান্না]
রাত পেরিয়ে ভোর আসে—কিন্তু মুজাহিদের ঘরে আর কোনও আলোকচ্ছটা ঢুকে না।
আয়েশা নেই।
তার কণ্ঠের সেই কোমল “আসসালামু আলাইকুম” আর শোনা যায় না ফজরের সময়।
পাশের খালি বিছানাটা যেন কাঁদে… প্রতিদিন।
তিন মাস কেটে গেছে।
মুজাহিদ আজকাল আর আয়নার সামনে দাঁড়ায় না। দাঁড়ায় না কারণ, চোখের নিচে যে ঘুমহীন দাগ পড়েছে, সেটি তাকে আয়েশার স্মৃতির চেয়ে বেশি কষ্ট দেয় না।
ঘরের এক কোণে একটা ছোট্ট খাট। সেখানে ঘুমায় সাবিরা।
মায়ের গন্ধ বোঝে না, মুখে দুধ ছাড়া কিছু চায় না। কিন্তু তার কান্নার ধরন দেখে মনে হয়—সে যেন প্রতিনিয়ত একটা শূন্যতা অনুভব করছে।
একদিন ঘুম থেকে উঠে সাবিরা মুখে বলল,
— “আ...আ-মা...”
মুজাহিদ ছুটে গিয়ে সাবিরাকে জড়িয়ে ধরল। আর নিজেই ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলল।
বলল—
— “মাগো!তোর তো মা নেই! তোর মা নেই সাবিরা। মা তো চলে গেছে... তবে মা জান্নাতে আছে। একদিন জান্নাতেই তুই আবার মায়ের কোল পাবি। ইনশাআল্লাহ।”
---
[অংশ ২ – একলা বাবা, অথচ শক্ত হৃদয়]
মুজাহিদের বয়স তখন মাত্র ২৬। বয়সটা এমন, যখন মানুষ ক্যারিয়ার গড়ার কথা ভাবে, যখন মানুষ দ্বিতীয় বিয়ের পরামর্শ পায়, অথবা নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবে।
কিন্তু মুজাহিদ শুধু একটাই জিনিস চায়—
সাবিরা যেন আয়েশার মতোই হোক। একেবারে ঈমানদার, একেবারে অন্তর থেকে আল্লাহকে ভালোবাসে এমন এক মেয়ে।
সে প্রতিদিন সকালে সাবিরাকে কোলে নিয়ে সূরা ফাতিহা পড়ে। মেয়েটির মুখে ছয় মাসেই “আল্লাহ” শব্দ উচ্চারিত হয়।
লোকে বলে—
— “এই মেয়ে তো আয়েশার ছায়া। দেখতে, আচরণে, চোখের দিকে তাকালেই বোঝা যায়—আল্লাহর কুদরত কাকে বলে।”
---
[অংশ ৩ – সমাজের বাস্তবতা ও একার লড়াই]
এত কিছু সত্ত্বেও, সমাজ কি একা বাবা মেনে নেয়?
মাদরাসার সামনে এক মা এসে প্রশ্ন করল,
— “আপনি তো বিধবা নন, তাহলে বিয়ে করছেন না কেন? আপনার মেয়েটার ভবিষ্যৎ ভাবেন না?”
মুজাহিদ ধীরে উত্তর দিল—
— “আমার মেয়ের ভবিষ্যৎ আমি দোয়ার মাধ্যমে বানাবো। সে জান্নাতি মায়ের উত্তরসূরি। মানুষের ভাষায় তার নিয়তি নির্ধারিত হবে না।”
[অংশ ৪ – মেয়ের ভিতরে মায়ের ছায়া]
সাবিরা এখন সাত বছর বয়সী।
হিজাব পড়ে, খাওয়া শুরু করার আগে “বিসমিল্লাহ” বলে, আর রাতে ঘুমানোর আগে বাবা’র কাঁধে মাথা রেখে বলে—
— “আল্লাহ আমার মা'কে জান্নাতে রেখেছেন, তাই না?”
মুজাহিদ হেসে ফেলে। চোখের কোণে পানি জমে।
সে বলে—
— “হ্যাঁ মা। তোমার মা জান্নাতের এক বাগানে আছেন। তিনি চাইছেন, তার মেয়ে যেন একদিন তাকে খুঁজে পায়... ভালো কাজ করে।”
সাবিরা চুপচাপ বাবার বুকে মাথা গুঁজে বলে—
— “তাহলে আমি মায়ের মতো হইবো।”
মুজাহিদ থমকে যায়। একটুও শব্দ করে না।
এই কথা শুনে তার হৃদয়ের ভেতর একরকম কেঁপে ওঠে।
এই সাত বছরের শিশু যদি সত্যিই আয়েশার মতো হয়, তাহলে আল্লাহর কুদরত আবারও তাকে স্পর্শ করেছে।
---
[অংশ ৫ – সমাজের চাপ ও প্রলোভনের পরীক্ষা]
একদিন গ্রামের মসজিদের এক হুজুর মুজাহিদকে ডেকে বললেন—
— “মুজাহিদ ভাই, আপনার বয়স তো কম। মানুষ যেমন কথা বলে, তেমনি পরিস্থিতিও বদলায়। আপনি চাইলেই একটা ‘ভালো পরিবার’ থেকে বিয়ে করতে পারেন। মেয়ে সাবিরার জন্যই তো! নতুন মা দরকার না?”
মুজাহিদ মাথা নিচু করল। একটু চুপ করে থেকে বলল
— “হুজুর, আপনি তো জানেন, আয়েশা আমার স্ত্রী ছিল না শুধু—সে আমার দ্বীনের সাথি ছিল। এমন স্ত্রী একবারই আসে। আবার বিয়ে করতে পারি, কিন্তু আয়েশার মতো কেউ হবে না।”
হুজুর দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন।
— “কিন্তু জীবন তো থেমে থাকে না ভাই।”
মুজাহিদ বলল—
— “আমি তো থামিনি হুজুর। আমি প্রতিদিন দোয়া করি, সাবিরাকে এমন বানাতে যেন সে আয়েশার ভালোবাসার প্রতিদান হয়।”
---
[অংশ ৬ – পরীক্ষা শুরু হয়]
সেদিন সন্ধ্যায় গ্রামের এক মহিলা মুজাহিদের ঘরে এলেন।
সঙ্গে তার ২৩ বছরের একমাত্র মেয়ে—নাম সানজিদা।
মহিলা এসে বললেন—
— “আপনাকে সবাই প্রশংসা করে। মেয়েটার বাবা নেই। আমি চাই, সে এমন কাউকে বিয়ে করুক যে দ্বীনদার। আপনি চাইলে—”
মুজাহিদ হাত তুলে থামিয়ে দিলেন।
— “আমি ক্ষমা চাচ্ছি। আমি এখন শুধু একটাই কাজ করি—সাবিরার লালনপালন।”
মহিলা চলে গেলেন।
কিন্তু সেই দিন থেকেই, গ্রামের লোকেরা কানাঘুষা শুরু করল।
— “একটা পুরুষের একা থাকা কি ভালো?”
— “মেয়েটার ভালো চাইলে একটা মা দরকার ছিল।”
— “এই মানুষটা কি আয়েশার ছায়া নিয়ে পাগল হয়ে গেছে?”
---
[অংশ ৭ – রাতের আকাশে কথা বলা]
সেদিন রাতে সাবিরা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল।
হাত উঁচু করে বলল—
— “আল্লাহ, তুমি আমার আম্মুকে সালাম দাও। বলো, আমি বাবার সঙ্গে আছি। আমার বাবা কাঁদে না, এখন হাসে… যদিও কখনো লুকিয়ে কান্না করে।”
মুজাহিদ দূর থেকে শুনছিল।
তার বুক কেঁপে উঠল।
সে এসে সাবিরাকে কোলে নিল।
— “কে বলেছে আমি কাঁদি না?”
সাবিরা মাথা নিচু করে বলল—
— “আমি জানি বাবা। আয়েশা আম্মু যখন রাতে ছিল, তখন তুমি তার মাথায় হাত রেখে ‘আল্লাহুম্মাগফির লি’ বলতা। এখন তুমি আমার মাথায় হাত রাখো, আর বলো— ‘রাব্বির হাম হুমা’…”
মুজাহিদ চমকে উঠল।
এই ছোট্ট মেয়েটি যে তার স্ত্রীর মৃত্যুর পরেও সে দোয়া মনে রেখেছে—এটাই তার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।
[অংশ ৮ – হঠাৎ দেখা, পুরনো আঘাত]
একদিন মাদরাসা থেকে সাবিরাকে নিয়ে ফিরছিল মুজাহিদ। তখন রাস্তায় এক মহিলা পড়েছিল অসুস্থ হয়ে। কেউ সাহায্য করছিল না। মুজাহিদ এগিয়ে গেল। মুখটা দেখা মাত্রই তার বুকটা হিম হয়ে গেল।
এই সেই মানুষ, যাকে সে এক সময় চিনত।
ফারহানা।
একটি সময় ছিল—বিয়ের আগেই এই মেয়েটির সঙ্গে একরকম ভালো বোঝাপড়া হয়েছিল। কিন্তু মেয়েটি হঠাৎ একদিন শহরে চলে যায়, আর কখনো ফিরে আসেনি।
আজ সে ভাঙাচোরা চেহারায় পড়ে আছে।
মুজাহিদ সাহায্য করল। সাবধানে ডেকে বলল—
— “আপনি ফারহানা তো?”
মেয়েটি চোখ মেলে তাকিয়ে বলল—
— “তুমি... মুজাহিদ?”
— “হ্যাঁ।”
ফারহানা জ্ঞান হারিয়ে ফেলল।
মুজাহিদ সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে গেল।
সাবিরা তার হাত ধরে বলল—
— “বাবা, উনি কি আম্মুর মতো হবেন?”
মুজাহিদ চুপ করে থাকল। শুধু বলল—
— “উনি অসুস্থ, সাবিরা। আমরা সাহায্য করি, শুধু আল্লাহর জন্য।”
---
[অংশ ৯ – পুরোনো সম্পর্কের অগ্নিপরীক্ষা]
হাসপাতাল থেকে বের হয়ে রাতের দিকে ফারহানার মা এলেন। তিনি কেঁদে কেঁদে বললেন—
— “মুজাহিদ, তুমি আল্লাহর বান্দা। তুমি আয়েশার স্বামী ছিলে, আমরা জানি। কিন্তু তুমি যদি চাও, ফারহানাকে আবার সুযোগ দাও।”
মুজাহিদ কাঁধ ঝাঁকাল। সে বলল—
— “আপনি জানেন না আমি কী হারিয়েছি। আমি এখন আর নিজের ভালোবাসার খোঁজ করি না, আমি আয়েশার রেখে যাওয়া amanah (অমানত)—সাবিরাকে নিয়ে বাঁচি। আমি সাবিরার হৃদয়ের ভেতর একটা আয়েশা গড়তে চাই। কোনো মানবিক সম্পর্ক এখন আমার লক্ষ্য নয়।”
---
[অংশ ১০ – আয়েশার স্বপ্ন]
সেদিন রাতে মুজাহিদ এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখল।
সে দেখতে পেল—এক বাগানে আয়েশা দাঁড়িয়ে আছে। মাথায় সাদা ওড়না, হাতে এক পবিত্র কুরআন।
আয়েশা বলল—
— “তুমি এখনো কান্না করো কেন?”
— “তুমি নেই, আয়েশা।”
— “আমি আছি, আল্লাহর নিকটে। তুমি আমার মেয়েটাকে জান্নাতের পথ দেখাও, তাহলেই আমাকে দেখবে।”
মুজাহিদ জেগে উঠে কাঁদতে লাগল।
তার কান্না কিন্তু এবার কষ্টের ছিল না—এটা ছিল এক ধরণের আত্মতৃপ্তি।
---
[অংশ ১১ – ভালোবাসা বদলে যায়, আত্মত্যাগে]
সাবিরা এবার ১০ বছরে পা দিল। কুরআনের ১৫ পারা মুখস্থ।
গ্রামের মাদরাসার সবচেয়ে নম্র, বুদ্ধিমতী ও শান্ত মেয়ে।
লোকেরা এখন আর কোনো প্রশ্ন করে না।
সবাই বলে—
— “এই মেয়ের পেছনে একজন শহীদ স্ত্রীর দোয়া আছে। আর একজন সবর করা পিতার কান্না আছে।”
---
[অংশ ১২ – চিঠি, যা কখনো পাঠানো হয়নি]
এক রাতে মুজাহিদ তার পুরোনো বইয়ের ভেতর থেকে একটা চিঠি পেল। এটা আয়েশার হাতের লেখা।
চিঠিতে লেখা ছিল—
> “মুজাহিদ, যদি আমি না থাকি, তাহলে সাবিরাকে তুমি শুধু কোরআন শিখিও না। তাকে শেখাও কীভাবে নিজের ভালোবাসাকে কুরবানি দিতে হয়। তাকে শেখাও কীভাবে একা থেকেও আল্লাহর সঙ্গে থাকা যায়। আর যদি কখনো তোমার হৃদয়ে নতুন কাউকে জায়গা দিতে চাও, আগে নিজেকে জিজ্ঞেস কোরো—এই মেয়েটি কি আমাদের মেয়েকে জান্নাতের পথে নিতে পারবে?”
মুজাহিদের চোখে পানি এল। সে চিঠিটা বুকের কাছে চেপে ধরল।
[অংশ ১৩ – যখন মানুষ আর ঈমান মুখোমুখি দাঁড়ায়]
গ্রামের নতুন চেয়ারম্যান নির্বাচনে এক প্রভাবশালী ব্যক্তি মুজাহিদকে ডেকে বলল—
— “আপনি চাইলে এলাকায় বড় কিছু হতে পারেন। আপনার ভালো ভাবমূর্তি আছে। আপনি চেয়ারম্যান হলে মাদরাসা, মসজিদ—সব উন্নত হবে।”
মুজাহিদ বলল,
— “আমি যদি নেতা হই, তাহলে মেয়েকে সময় দিতে পারব না।”
লোকটা বলল,
— “তোমার মেয়ে তো কোরআনের হাফেজা হতে যাচ্ছে, তা তো তুমি গড়েই ফেলেছো। এবার নিজের ক্যারিয়ার ভাবো।”
মুজাহিদ তখন শান্ত কণ্ঠে বলল—
— “আমি ক্যারিয়ার নয়, তাকদীর নিয়ে ভাবি। আমি যে মেয়েটাকে প্রতিদিন ‘রাব্বির হাম হুমা’ বলে মাথায় হাত রেখে দোয়া করি, তার জীবন সুন্দর হলে সেটাই আমার সাফল্য।”
---
[অংশ ১৪ – আত্মত্যাগের ডাক]
সাবিরার বয়স যখন বারো, তখন হঠাৎ তার এক চোখে সমস্যা দেখা দিল।
ডাক্তারের ভাষায়,
— “মেয়েটার চোখে রেটিনা সমস্যা। উন্নত চিকিৎসা দরকার।”
মুজাহিদের কাছে তখন টাকা নেই।
সে তার স্ত্রীর শেষ সোনার গয়নাগুলো বিক্রি করল।
মাদরাসায় দেওয়া পুরস্কার থেকে বাঁচানো টাকা যোগ করল।
তবুও যথেষ্ট নয়।
এক ধনী আত্মীয় বলল—
— “আমার ছেলেকে তোমার মেয়ে যদি কিছুদিন পড়ায়, আমি পুরো খরচ দিয়ে দেই।”
মুজাহিদ দ্বিধায় পড়ল।
একদিকে মেয়ের চিকিৎসা দরকার, অন্যদিকে সে চায় না সাবিরা ঘর ছাড়া হোক বা কাউকে পড়াতে যাক।
শেষ পর্যন্ত, সে এক রাত গভীরভাবে সালাতুল ইস্তিখারা পড়ল।
সকালে উঠে মনে হলো—
“আল্লাহর পথেই ভরসা রাখতে হবে।”
সে অন্য একজন গরিব ছাত্রকে সাবিরার গৃহশিক্ষক বানিয়ে দিল, আর তার নিজের কষ্টের টাকা নিয়েই চিকিৎসা চালিয়ে গেল।
ডাক্তার বললেন—
— “এইটা এক অলৌকিক বিষয়, চোখের সমস্যা ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে।”
---
[অংশ ১৫ – ভালোবাসা বদলে যায়, যদি ঈমান শক্ত হয়]
১৬ বছর বয়সে সাবিরা পুরো কুরআন হিফজ করল।
মাদরাসা এবং শহরের ইসলামি শিক্ষা প্রতিযোগিতায় সে পুরস্কার পেল।
একদিন সে তার বাবাকে জিজ্ঞেস করল—
— “বাবা, আমি বড় হলে কি আম্মুর মতো কাউকে পাবো, যার সঙ্গে আমি জান্নাতে যেতে পারব?”
মুজাহিদের চোখ ভিজে উঠল। সে বলল—
— “তুই কাউকে পাবি না, বরং তুই হবি সেই জান্নাতের পথে কাউকে নেয়ার আলোকবর্তিকা। আয়েশার মতো। তুই হবি এমন এক মা, যার জন্য সন্তান দোয়া করবে: 'রাব্বির হাম হুমা কামা-রাব্বাইয়ানি সাগীরা'।”
---
[অংশ ১৬ – বিদায়ের আগের হাসি]
এক রাতে হঠাৎ মুজাহিদের শ্বাসকষ্ট শুরু হলো।
হাসপাতালে ভর্তি করতে হলো।
সাবিরা তার হাত চেপে ধরল। বলল—
— “বাবা, তুমি কিছু বলো না, আল্লাহর জিকির করো।”
মুজাহিদ আস্তে বলল—
— “তুই আমার জান্নাত। আয়েশার ছায়া তুই। যদি আমি না থাকি… কোরআনকে আঁকড়ে ধরিস।”
তারপর সে খুব শান্তভাবে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল।
---
[অংশ ১৭ – সমাপ্তি, কিন্তু নতুন শুরু]
মুজাহিদের জানাজা হলো স্থানীয় মসজিদের পাশে।
সমস্ত গ্রাম একত্রিত হয়ে কাঁদল। কেউ বলল—
— “এই মানুষটা কেবল বাবা ছিল না, সে ছিল এক জীবন্ত শিক্ষা।”
সাবিরা কাঁদল না। সে মাথা নিচু করে বলল—
— “আল্লাহ আমার বাবার জান্নাত নসিব করুন। তিনি ছিলেন আমার উস্তাদ, আমার পথপ্রদর্শক, আমার মা ও বাবা—দুই-ই।”
---
✅ দ্বিতীয় অধ্যায়ের উপসংহার:
মুজাহিদ চলে গেলেন, কিন্তু রেখে গেলেন এক হৃদয়জয়ী কাহিনি—যেখানে ভালোবাসা এক নারীর মৃত্যুতে শেষ হয়নি, বরং তার কন্যার হৃদয়ে রূপ নিয়েছে নতুন জীবনে।
এই অধ্যায় শিখিয়েছে:
> “ভালোবাসা শুধু একটি অনুভূতি নয়, বরং এটা এক আত্মত্যাগ—যেখানে মানুষ নিজের হৃদয়ের কষ্টকে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নীরবে উৎসর্গ করে দেয়।”
📘 তৃতীয় অধ্যায়: “যার হৃদয়ে কুরআন বাস করে”
[অধ্যায়: ১ – সময় পেরোয়, তাকদীর এগোয়]
সাবিরা এখন আঠারো বয়সী মেয়ে ।
মুজাহিদের মৃত্যুর পর চার বছর কেটে গেছে।
তার মনে আর ভয় নেই—যদিও মাঝে মাঝে রাতের নিস্তব্ধতায় বাবার কণ্ঠস্বর এখনো ভেসে আসে:
> “সাবিরা, আয়েশার মেয়ে কখনো মাথা নিচু করে না। কোরআনের মেয়ে কেবল আল্লাহর সামনে সেজদায় নত হয়।”
এই শব্দগুলোই তার আত্মবিশ্বাস।
---
[অংশ ২ – পুরুষতন্ত্রের সমাজে এক হাফেজা কন্যা]
গ্রামের নতুন প্রভাবশালী মানুষ রেজাউল চেয়ারম্যান।
সে একদিন সাবিরার খালা বাড়িতে এসে প্রস্তাব দিল:
— “সাবিরার বিয়ে আমার ছেলের সঙ্গে দিন। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ে, বিদেশে চাকরির অফার আছে।”
সাবিরার খালা খুশি। তারা সাবিরাকে বোঝায়।
কিন্তু সাবিরা জবাব দেয় খুব বিনয়ের সঙ্গে—
— “আমি বিয়ে করতে রাজি, তবে একমাত্র শর্ত—আমার স্বামী কুরআনের প্রতি আমার ভালোবাসা বুঝবে। সে চাইবে না আমি শুধু রান্না ঘরে থাকি, বরং চাইবে আমি যেন কুরআনের আলো অন্য মেয়েদের মাঝে ছড়িয়ে দেই।”
খালা বলল—
— “তুমি শুধু কুরআনের কথা বলো, ঘরের কথা কখনো ভাবো না?”
সাবিরা বলল—
— “কুরআনই তো আমাকে ঘরের, সমাজের, জান্নাতের পথ দেখায়। যে কুরআন বুঝবে না, সে ঘরকেও জাহান্নামের দিকে নিয়ে যাবে।”
---
[অংশ ৩ – নতুন যাত্রার শুরু]
একটি ইসলামি মাদরাসা থেকে প্রস্তাব আসে—
মেয়েদের হিফজ শাখা খুলতে চায়, কিন্তু নারী শিক্ষক নেই।
সাবিরার কাছে প্রস্তাব যায়।
সে ভাবে—
“এই গ্রামে যদি কোনো মেয়ে কুরআনের হিফজ করে, তবে সে হয়তো ভবিষ্যতের কোনো আয়েশা হবে। কেউ একজন আবার হয়তো মুজাহিদ হয়ে উঠবে।”
সে রাজি হয়ে যায়।
গ্রামের অনেকেই বাঁকা চোখে দেখে।
“একজন মেয়ে, সে আবার শিক্ষক? ছোটবেলা থেকে কুরআন শেখে তো কী হয়েছে?”
কিন্তু তার সামনে তখন তার বাবার চিঠি, তার মা’র দোয়া।
---
[অংশ ৪ – এক ছাত্রীর চোখে প্রশ্ন]
তার ছাত্রীর সংখ্যা দিনে দিনে বাড়ে।
একজন মেয়ের নাম সাদিয়া। চুপচাপ। চোখে গভীর অস্থিরতা।
একদিন সে বলে—
— “আপু, আপনার বাবা মারা গেছেন, অথচ আপনি এত শান্ত কেন?”
সাবিরা একটু থেমে বলল—
— “কারো চলে যাওয়া যদি আমাদের আল্লাহর কাছে নিয়ে যায়, তবে সেটা শান্তির কারণ। আমি কাঁদি না, কারণ জানি, বাবা একদিন জান্নাতের ছায়ায় বসে বলবেন—‘সাবিরা, তুই কুরআন ধরে রেখেছিলি, তাই আজ আমরা একসাথে।’”
সেদিন ক্লাসে অনেকেই কাঁদল।
---
[অংশ ৫ – হারানো চিঠির খোঁজে এক অপরিচিত আগমন]
একদিন সন্ধ্যায় মাদরাসায় একজন যুবক আসে।
পরিচয় দেয়—
— “আমি নাফিস। আপনার বাবা মুজাহিদের পুরনো ছাত্র।”
সে একটি পুরোনো খাম এগিয়ে দেয়।
বলে—
— “আপনার বাবা একবার আমাকে বলেছিলেন, মৃত্যুর পর এটা আপনাকে দিতে। আমি তখন বিদেশে ছিলাম, ফিরে এসেছি। এটা আপনার জন্য।”
সাবিরা হাত কাঁপিয়ে খামটা খুলল।
চিঠিতে বাবার লেখা:
> “সাবিরা, যদি কখনো কোনো এমন মানুষ আসে যার চোখে তুমি আয়েশার ছায়া দেখতে পাও, আর যার ঈমান তোমার হৃদয়ে আলো জ্বালায়—তবে বুঝে নিও, তাকদীর আল্লাহর পক্ষ থেকে আবার ভালোবাসার দরজা খুলেছে। কিন্তু শর্ত একটাই—তুমি যেন কুরআনের পথ না ছাড়ো। কারণ কুরআনের মেয়ে কেবল কুরআনের মানুষেরই সহচরী হতে পারে।”
সাবিরা চোখ বন্ধ করে কাঁদতে লাগল।
তার কান্না ছিল না ভাঙার—ছিল আল্লাহর প্রতি, রিজিকের প্রতি এক নিরব আত্মসমর্পণ।
[অংশ ৬ – এক অজানা হৃদয়ের স্পর্শ]
নাফিস চলে যাওয়ার সময় এক বাক্য বলে—
— “আপনার বাবার কথাগুলো আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল। আমি এক সময় ভয়ঙ্কর গুনাহে ছিলাম। কিন্তু উনি বলেছিলেন, ‘যদি সত্যিকারের প্রেম পেতে চাস, আগে আল্লাহকে ভালোবাসা শেখ।’ আমি শেখার চেষ্টা করছি।”
সাবিরা নিরবে তাকিয়ে ছিল।
এই ছেলেটি কি বাবার দোয়ার ফসল?
---
[অংশ ৭ – ঈমানের পথে যখন মন চুপ করে]
রাত গভীর।
সাবিরা তার মা’র নামাজের জায়নামাজে মাথা রেখে কান্না করল।
— “আম্মু, আমি কাউকে পছন্দ করতে পারি? এটা কি গুনাহ?”
তার ভেতরের দ্বন্দ্ব একেবারে আয়েশার মতো—প্রেম কি শুধু চোখে পড়ে, না হৃদয়ে ঈমান হয়ে ঢোকে?
সে দোয়া করল:
> “হে আল্লাহ! তুমি যদি তার মাঝে এমন কিছু রেখেছো যা আমাকে কুরআনের পথে এগিয়ে নেবে, তবে তাকদীরে রেখো। নইলে মুছে দাও স্মৃতি থেকেও।”
---
[অংশ ৮ – প্রস্তাব, কিন্তু ব্যতিক্রমী]
কয়েক সপ্তাহ পর নাফিসের পরিবার প্রস্তাব দেয়।
তারা জানায়—নাফিস একজন ইসলামি গবেষক, কয়েকটি দেশে কাজ করেছে।
কিন্তু তারা এই কথাও বলে—
— “আমাদের ছেলে চায়, তার স্ত্রী কেবল একজন হাফেজা না, একজন কুরআনের দাঈ হোক। সে জানে, আপনি পুরুষদের মাঝে দাঁড়িয়ে কথা বলবেন না, তবে মেয়েদের মাঝে আলো ছড়াতে পারবেন।”
সাবিরা চুপ। সে ভাবে—
“এই মানুষটা কি সেই, যাকে কুরআন আমানত করে দিতে পারি? যে আমার বাবার শেষ চিঠির উত্তর হতে পারে?”
---
[অংশ ৯ – দুই হৃদয়ের কুরআনি মেলবন্ধন]
একটি ছোট মজলিসে সাবিরা ও নাফিস একে অপরের মুখোমুখি নয়, বরং পর্দার দুই পাশে বসে কথা বলে।
নাফিস বলে—
— “আপনার বাবার প্রথম কথাটা আমি এখনো ভুলিনি: ‘মেয়ের ঈমান যদি দৃঢ় হয়, তাহলে জান্নাতের পথ সহজ হয়।’ আমি জান্নাতের পথ খুঁজছি, আপনাকে নয়। কিন্তু আপনি যদি আমার পাশে থাকেন, হয়তো পথটা সহজ হয়।”
সাবিরার চোখে জল।
সে বলে—
— “আমি কখনো প্রেম খুঁজিনি। আমি এমন কাউকে খুঁজেছি, যে প্রেমকে ইবাদতে রূপ দিতে জানে।”
---
[অংশ ১০ – বিয়ে, কিন্তু ব্যতিক্রমধর্মী]
তাদের বিয়েতে কোনো জমকালো আয়োজন হয়নি। হাদিয়া হিসাবে লাল গোলাপ ও অন্যান্য রুসম রেওয়াজের পরিবর্তে ছিল শুধু দু’টি সাদা কুরআন, এক জোড়া জায়নামাজ, আর এক কপি হাদীসের বই—"রিয়াদুস সালিহিন"।
মেহেদি রাতে সাবিরা কাঁদে, কারণ তার বাবা নেই।
তখন নাফিস তার পাশে চুপচাপ বসে শুধু বলে—
— “আজ থেকে আপনার দুনিয়াতে আমি আছি। কিন্তু জান্নাতে যেন আপনার বাবা পাশে থাকেন—এই জন্য আমি কাজ করবো ইনশাআল্লাহ।”
---
[অংশ ১১ – একসাথে পথচলার গল্প]
তারা দম্পতি হিসেবে জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু করে।
কিন্তু সাবিরার শর্ত ছিল—
“আমি কুরআনের শিক্ষকতা ছাড়বো না।”
নাফিস খুশি হয়ে বলে—
— “তাহলে আমরা একসাথে কুরআনের খেদমত করবো। আপনি মেয়েদের পড়াবেন, আমি ছেলেদের। আমাদের সংসার হোক এক ‘মিনি মাদরাসা’। ইনশাআল্লাহ।”
তারা প্রতি সপ্তাহে দাওয়াহ ক্লাস চালু করে।
বাচ্চা, কিশোর, তরুণী—সবাই সাবিরাকে “আপু” বলে ডাকে, আর নাফিসকে “ভাইয়া”।
---
[অংশ ১২ – ফিরে দেখা, কিন্তু কাঁদা নয়]
বিয়ের এক বছর পূর্ণ হলে, তারা মুজাহিদের কবর জিয়ারতে যায়।
সাবিরা ফুল না নিয়ে যায় কুরআনের একটি খণ্ড হাতে।
কবরের পাশে বসে সাবিরা পড়ে—
"ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।"
তারপর বলে—
— “বাবা, তুমি বলেছিলে, কুরআনের মেয়েরা কেবল চাঁদ দেখে না, আলো ছড়ায়। আমি হয়তো চাঁদ হতে পারিনি, তবে আলো হবার চেষ্টা করছি। তুমি দেখো, আমি এখনো তোমার আয়েশা হয়ে থাকতে চাই।”
📘 চতুর্থ অধ্যায়: “দোয়ার ছায়ায় যে প্রেম ফোটে”
📍 বিষয়: সংসার জীবনের পরীক্ষা, ঈমানের দৃঢ়তা, ভালোবাসার নতুন রূপ
---
[অংশ ১ – নতুন জীবন, নতুন পরীক্ষার শুরু]
বিয়ের দুই বছর পর।
সাবিরা এখন অন্তঃসত্ত্বা।
মাদরাসা বড় হয়েছে, মেয়েরা এখন ঢাকা, চট্টগ্রাম থেকেও আসে।নাফিস নিজের চাকরি ছেড়ে পুরোপুরি দাওয়াহ ও ইসলামী লেখালেখিতে মন দিয়েছে।তারা একে অপরকে দেখে, যেন মনে হয়—এটাই সেই ভালোবাসা, যা শুধু চোখ দিয়ে নয়, সেজদায় বসে আল্লাহকে সাক্ষী রেখে গড়ে ওঠে।
কিন্তু শান্তি চিরস্থায়ী নয়।
---
[অংশ ২ – সন্তান না থাকলে কি সংসার পূর্ণ হয়?]
নবম মাসে সাবিরার গর্ভপাত হয়।
হাসপাতালের সাদা দেওয়াল আর নীচু আলোতে যখন সে শুয়ে ছিল, তখন নাফিস তার হাত ধরে বলেছিল—
— “আল্লাহ কিছু নেয়, কিছু দেয়। আমাদের কুরআনের মেয়ে যদি দুনিয়াতে আসতে না পারে, জান্নাতে অপেক্ষা করবে।”
কিন্তু ভেতরে সাবিরা কাঁদছিল।
সে ভাবছিল—
“একজন মা হতে না পারা কি আমাকে অপূর্ণ করে?”
সে ঘরে ফিরে রাতে দোয়া করল:
> “হে আমার রব! তুমি যদি সন্তান না দাও, তবে আমাকে এমন কিছু দাও যাতে আমি তোমার সন্তুষ্টি পাই। যেন আমি কারো মা না হতে পারি, কিন্তু তুমি আমাকে মানুষের হৃদয়ের মা বানিয়ে দাও।”
---
[অংশ ৩ – হঠাৎ এক মেয়ে দরজায়]
কয়েক সপ্তাহ পর, মাদরাসার দরজায় এক ১৩ বছরের মেয়ে আসে।চোখে ভয়ের ছায়া, গায়ে পুরাতন জামা।সে বলে—
— “আমি তামান্না। আমাকে থাকতে দাও। আমার মা নেই, বাবা আমাকে বিয়ে দিতে চায় এক বৃদ্ধের সাথে।”
সাবিরা স্তব্ধ।
সে মেয়েটিকে দেখে নিজের হারিয়ে যাওয়া সন্তান কল্পনা করে।
সে মাদরাসার একটি কক্ষে মেয়েটিকে থাকতে দেয়। তামান্না দিনের বেলায় কুরআন শেখে, রাতে সাবিরার সঙ্গে খায়, গল্প করে।
নাফিস বলে—
— “আল্লাহ হয়তো তোমার দোয়ার উত্তর দিয়েছেন। তিনি তোমাকে অনেকের মা বানাতে চাইছেন, একজনের নয়।”
---
[অংশ ৪ – দুশমন যখন ঘরের কাছেই]
চেয়ারম্যান রেজাউল, যে একসময় সাবিরাকে নিজের ছেলের বউ করতে চেয়েছিল, সে এই কাজে রেগে যায়।
সে চক্রান্ত করে—
“এই মহিলা তো আমাদের মেয়েদের বিদ্রোহী বানাচ্ছে। এখন এক এতিম মেয়েকে নিয়ে ঘরে রেখেছে? সমাজ নষ্ট হবে।”
সে পুলিশের কাছে মিথ্যা অভিযোগ দেয়—“এক নারী শিশু পাচারের কাজ করছে ধর্মের আড়ালে।”
এক রাতে পুলিশ সাবিরার মাদরাসায় আসে।
সবার সামনে তাকে অপমান করে, বলে—
— “আপনি ধর্মের নামে এই কি করছেন, বুঝি না। অথচ আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ, আপনি নাবালিকা লুকিয়ে রাখেন।”
---
[অংশ ৫ – সমাজ যখন সোজা দেখে না]
সেই রাতেই গ্রামে গুজব ছড়িয়ে পড়ে এই বলে যে,—“সাবিরা একটা চক্র চালায়।”
মাদরাসার অনেক ছাত্রীর পরিবার তাদের ফিরিয়ে নেয়।নাফিস থানায় যায়, আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলে।
তামান্না কাঁদে—
— “আপু, আমি আপনার জন্য বিপদ ডেকে এনেছি। আমাকে বের করে দিন।”
সাবিরা তাকে জড়িয়ে ধরে বলে—
— “তুমি শুধু নয়, কুরআনের সব মেয়ে আমার। আল্লাহ আমার সাক্ষী, আমি কাউকে ফেলে দিতে পারি না। আমাকে যদি জেলে নিতে চায়, নিক। তবুও আমি হার মানব না।”
---
[অংশ ৬ – যখন আল্লাহ পরীক্ষা নেন, তখন সহ্যই ইবাদত]
সাবিরা কয়েক দিন পর গ্রাম ছেড়ে দেয়।নাফিস তাকে শহরে নিয়ে যায়, সেখানে তাদের কিছু বন্ধু মিলে নতুন একটি ইসলামি শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে তোলে।পুরাতন ছাত্রীরা ধীরে ধীরে ফিরে আসে। কিন্তু হৃদয়ের ভিতরে এক ঘূর্ণিঝড় বয়ে চলে—এক সমাজ, যার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছিল, সেই সমাজ তাকে সন্দেহ করলো?
সে রাতে নাফিস তার হাতে হাত রেখে বলেছিল—
— “তুমি আমার জন্য প্রেম না, জিহাদ। তুমি আল্লাহর জন্য কাঁদো, মানুষ তোমাকে ভুল বোঝে। জান্নাতে একদিন তুমি হেসে বলবে—‘ওরা বুঝেনি, কিন্তু রব বুঝেছিলেন।’”
---
[অংশ ৭ – কুরআনের ছায়ায় ফিরে পাওয়া মা]
তামান্না একদিন সাবিরার কোলে মাথা রেখে বলে—
— “আপু, আপনি কি আমার মা হতে পারেন?”
সাবিরা প্রথমে কথা বলে না। কেবল কাঁদে। তারপর বলে—
— “আমি জন্ম দিতে পারিনি তোমাকে, কিন্তু আমার হৃদয় তোমাকে জন্ম দিয়েছে।”
---
[অংশ ৮ – নতুন পথ, নতুন আলো]
শহরের সেই নতুন ইসলামি কেন্দ্রটির নাম হয় —
“নূরের বাতি”। নাফিস তার লেখালেখির মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সাহায্যের আবেদন করে।
সাবিরা তামান্নাসহ ৫ জন এতিম মেয়েকে নিজের হাতে তালিম দিতে থাকে।
মেয়েরা তাকে “সাবিরা আপু” বলে না, বলে “আম্মু।”
সাবিরা একদিন কাঁদে না, বরং হাসে।
সে ভাবে—
“আল্লাহ সন্তান দিলেন না, কারণ তিনি আমাকে এতিমদের হৃদয়ের মা বানাতে চেয়েছিলেন।”
---
[অংশ ৯ – জান্নাতের দাওয়াত]
রমযানের শেষ দশকে এক রাতে, তারা একসাথে কিয়ামুল লাইল পড়ে। তিনটার সময়, যখন চারপাশ নীরব, নাফিস সেজদায় কাঁদতে থাকে।
— “হে আল্লাহ! যদি আমার জীবনে কোনো নেক আমল থাকে, তবে সাবিরাকে জান্নাতে আমার স্ত্রী বানিয়ে দিও। এই নারীর পায়ের নিচে আমি জান্নাত দেখতে পাই, হে রব!”
সাবিরা পর্দার আড়াল থেকে সে কান্না শুনে।
সে ভাবে—
“এই পুরুষটি প্রেম চায়নি, সে আল্লাহর পথে সঙ্গী চেয়েছিল। তাই আল্লাহ আমাকে তার তাকদীরে রেখেছেন।”
---
[অংশ ১০ – ফিরে দেখা: একদিন সেই গ্রামে]
বছরখানেক পর, সাবিরা আবার সেই গ্রামে যায়।
এইবার কেউ তাকে থামায় না। বরং চেয়ারম্যান নিজেই এসে ক্ষমা চায়। গ্রামের অনেক মেয়েই এখন তার পাঠশালায় পড়ে।
কেউ কেউ সাবিরাকে বলে—
— “আপু, আপনি চলে যাওয়ার পর আমরা বুঝেছি, আপনার শিক্ষার পেছনে ছিলো ঈমান। সমাজের চোখ তো অন্ধ, কিন্তু কুরআন আলোর পথ দেখায়।”
---
[অংশ ১১ – যখন মৃত্যু ডাকে, তখন সত্যিকারের প্রেম ফুটে]
এক রাতে নাফিসের প্রচণ্ড বুকে ব্যথা হয়।
হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
ডাক্তার বলে—“হার্ট অ্যাটাক। খুব বেশি সময় নেই।”
সাবিরা পাশে বসে।
নাফিস হাসে, বলে—
— “তুমি আমার জন্য যা ছিলে, জান্নাতেও থেকো। এই পৃথিবী শুধু কুরআনের ছায়ায় কাটলো, জান্নাতে যেন কুরআনের আলোয় জেগে উঠি।”
সাবিরা বলে—
— “তুমি আল্লাহর পথে আমাকে ডেকেছিলে, আমি এসেছিলাম। তুমি যদি আগে যাও, আমাকে রবের দরবারে অপেক্ষা করে নিও।”
---
[অংশ ১২ – বিদায় নয়, অপেক্ষা]
নাফিস মারা যায়।
কুরআনের একটি ছোট আয়াত তার হাতে রাখা ছিল—"ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।"
সাবিরা কেঁদে ওঠে, কিন্তু গলায় অভিযোগ নেই।
সে বলে—
— “হে আল্লাহ, তুমি যদি পৃথিবীতে আমাকে তাঁর সহধর্মিণী করো, তবে আখিরাতে আমিও চাই তার পাশে কিয়ামতেの日 দাঁড়াতে।”
তারপর সে আবার ফিরে যায় “নূরের বাতি” মাদরাসায়। তামান্না তাকে জড়িয়ে ধরে।
সাবিরা বলে—
“তোমরা সবাই আমার তাকদীরের ছায়া। আর আমি সেই ছায়ায় আল্লাহর প্রেম খুঁজি।”
---
[অধ্যায়ের শেষ কথা – এক চিঠি, এক জান্নাতী প্রার্থনা]
কয়েক বছর পর, এক ছোট চিঠি পাওয়া যায় “নূরের বাতি”-এর দরজায়।
এক মেয়ে লিখেছে:
> “আমি আপনাকে দেখিনি। শুধু শুনেছি, আপনি ছিলেন একজন, যে ভালোবাসা দিয়ে ইসলাম শেখাতেন। আমি এতিম। আমাকে মা ডাকতে দিন। আপনি না থাকলে, দয়া করে আপনার পথ আমাকে শিখিয়ে দিন।
— জান্নাত চাওয়া এক এতিম।”
সাবিরা জান্নাতের পথে হাঁটছিল, তখনো সে কেবল একজনের স্ত্রী ছিল না, হাজারো মেয়ের ‘আম্মু’ ছিল।
📖 পঞ্চম অধ্যায়: “তাকদীরের চিঠি”
📍 অংশ ১: “স্মৃতির আযানে একটি হৃদয় কাঁদে”
---
[১] সময় চলে গেছে, কিন্তু কেউ কোথাও দাঁড়িয়ে আছে…
রমযান শেষ হয়েছে কেবল ৫ দিন।
আকাশে ঈদের রঙ মিলিয়ে গেছে।
শহরের শেষ প্রান্তে ছোট্ট একটি মাদরাসা— “নূরের বাতি”। সেইখানে দাঁড়িয়ে আছে একটি নারী।
নাম— তামান্না ফারহা।
সে এখন ২০ বছরের তরুণী।
চোখে হিজাব, মুখে প্রশান্তি, কণ্ঠে দোয়ার সূরা।
কিন্তু হৃদয়ের গহীনে গুমরে কাঁদছে কিছু কথা—
“আম্মু... আপনি নেই।
কিন্তু আমি এখনও আপনার ছায়ায়ই দাঁড়িয়ে আছি।”
---
[২] আট বছর আগে যেই হাত তাকে ধরেছিল…
তামান্না ১২ বছরের ছিল তখন।
সেই দিনটার কথা মনে পড়ে—
একটা ফেলে দেওয়া বৃষ্টির দিন।
কাঁদতে কাঁদতে এসে সাবিরা আপুর দরজায় দাঁড়িয়েছিল।
“আপু, আমাকে কেউ চায় না। আমি কোথায় যাবো?”
সাবিরা তার মাথায় হাত রেখেছিলেন।
বলেছিলেন—
> “তুমি শুধু এতিম না, তুমি জান্নাতের সন্তান। আমি তোমার জন্য কুরআনের ছায়া খুলে দিব।”
তামান্না এখন ভাবছে—
“সে দিনটা না হলে আজ আমি থাকতাম কোথায়?
কী হাল হতো আমার ঈমানের, আমার অস্তিত্বের?”
---
[৩] মা হওয়ার গল্পটা কেবল রক্তের না…
তামান্না আজ এক কাগজ হাতে বসে।
সেই চিঠি— সাবিরা আপু মারা যাওয়ার আগে লিখে গিয়েছিলেন।
হস্তাক্ষরে লেখা, দোয়ার মাঝে মোড়া। চিঠিতে লেখা ছিল—
> “তামান্না!
যদি আমি একদিন না থাকি, তুমি মনে রেখো, তুমি আমার কন্যা। আমি তোমার জন্মদাত্রী না হতে পারি, কিন্তু জান্নাতে যেন আল্লাহ আমাকে তোমার হাতে তুলেন।
তুমি আমার কুরআনের বাগানে সবচেয়ে সুন্দর ফুল।
আমি হয়তো থাকবো না তোমার পাশে, কিন্তু যদি কখনো কষ্ট পাও, এই চিঠি খুলে কেঁদো। কারণ, কাঁদলে আকাশের দরজা খোলে।
—তোমার আম্মু, সাবিরা।”
চিঠিটা ভিজে ওঠে তামান্নার চোখের পানিতে।
সে বললো—
“আম্মু, আমি তোমার চিঠির মতো করে বেঁচে থাকবো ইনশাআল্লাহ।”
---
[৪] সাবিরার শেষ সময়…
সাবিরা মৃত্যুর আগে কয়েক মাস ধরে খুব অসুস্থ ছিলেন। দেহে দুর্বলতা, ক্যানসার ধরা পড়েছিল।
কিন্তু সে কাউকে বোঝতে দেয়নি। রমযানের শেষ দশক ছিল, লাইলাতুল কদরের রাত। সেই রাতে সাবিরা সবাইকে জড়ো করে বলেছিলেন—
— “একদিন আমরা চলে যাব।
কিন্তু কে জান্নাতের জানালার পাশে বসে কুরআনের সূরা পড়বে, এই দুনিয়ার আলো নিভে গেলে?
আমি চাই, তোমরা সবাই যেন দুনিয়া থেকে জান্নাতের পথে হাঁটো।”
তামান্না তখনো বুঝেনি, এটিই শেষ উপদেশ।
---
[৫] জানাজার দিন: এক সূর্য অস্ত যায়, কিন্তু আকাশে ছায়া রেখে…।যেদিন সাবিরা মারা যান, চারদিকের মানুষ যেন থমকে গিয়েছিল। তার জানাজায় শত শত মেয়ে, বোরকা ও নিকাবে দাঁড়ানো। সবার চোখে কাঁদা...
এক বৃদ্ধা এসে তামান্নাকে বলেছিল—
— “এই মহিলা একা একা হাজার জনের হৃদয় জাগিয়ে দিয়ে গেছে। আমার মেয়ে আজ হাফেজা, সাবিরার দোয়ায়।”
তামান্না সে দিন আর কাঁদতে পারেনি। তার বুক পাথরের মতো শক্ত ছিল। তবে সেজদায় গিয়ে বলেছিল—
> “হে আল্লাহ! তুমি আম্মুকে জান্নাত দিও।
আমি জানি, তিনি কেবল মা ছিলেন না,
তিনি ছিলেন তোমার বান্দিদের বাতিঘর।”
---
[৬] মাদরাসার দায়িত্ব এখন তামান্নার কাঁধে। সাবিরার ইচ্ছা ছিল— “নূরের বাতি যেন কখনো নিভে না যায়।”
তামান্না এখন পরিচালক। সে ছাত্রীদের শেখায়, আগের মতই।
কিন্তু সে রাতের অন্ধকারে চুপিচুপি সাবিরার ঘরে যায়। সেখানে একটি ছোট কুরআন শরীফ রাখা। তার পাতা থেকে এখনও ভেসে আসে সাবিরার কণ্ঠ—
> “ও তোমরা যারা বিশ্বাস করো,
ধৈর্য ধরো, নামাজ কায়েম করো,
নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের সঙ্গে আছেন।”
তামান্না প্রতিদিন ভোরে সেই কুরআন ছুঁয়ে বলে—
— “আম্মু, আমি আছি। আপনার দাওয়াহ এখনও বেঁচে আছে।”
---
[৭] এক এতিমের মা যখন হাজারো মা হয়ে যান…।
সাবিরার মৃত্যুর ১ বছর পর এক আন্তর্জাতিক সংস্থার গবেষণা আসে—
"নূরের বাতি” বাংলাদেশে মেয়েদের ইসলামি শিক্ষা ও নিরাপত্তায় সবচেয়ে সৎ, নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে চিহ্নিত হয়। তামান্না যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করাতে পারে না। সে চুপচাপ সাবিরার কবরের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়।
বলে—
— “আম্মু, আপনি বেঁচে আছেন।
এই মাটির নিচে আপনার দেহ শুয়ে, কিন্তু আপনার তাকওয়া আকাশে উড়ছে এখনো।”
---
[৮] শেষ বিকেলের চিঠি:-
একদিন বিকেলে, হঠাৎ একজন ডাকপিয়ন আসে।
একটি খাম।
ভেতরে সাবিরার নিজের হাতে লেখা আরেকটি চিঠি—
> “তামান্না,
যদি কিয়ামতের আগেই দুনিয়া ঘোলা হয়ে যায়,
তুমি জানবে—আমার দোয়া তোমার পাশে ছিল সবসময়। আমি যেন তোমাকে জান্নাতের বাগানে খুঁজে পাই। কুরআনের একটা আয়াত আমার হাতে তুলে দিও সেখানে।
যদি কখনো মনে হয় তুমি একা,
তাকদীরের ছায়া দেখো…
সেখানে তুমি আমার চিহ্ন পাবে।
—তোমার মা, শুধু দুনিয়ায় না, আখিরাতেও।”
[১] ভালোবাসা মানে শুধু পাওয়া না, বরং হারানোর পরেও ভালোবেসে যাওয়া…
রাত ২:১৪ মিনিট।
তামান্না নিজের বিছানায় বসে আছে।
তার সামনে খোলা কুরআন শরীফ।
একটি আয়াতে এসে তার চোখ আটকে যায়—
> “وَمَا تَدْرِي نَفْسٌ مَاذَا تَكْسِبُ غَدًا”
“কোনো প্রাণ জানে না আগামীকাল সে কী উপার্জন করবে।”
(সূরা লুকমান ৩৪)
তামান্না দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
“কাল তো আম্মু ছিলেন… আজ তিনি নেই।
আমিও একদিন থাকবো না।
আমার পর কেউ থাকবে কি?”
তার চোখে পানি।
কিন্তু সেই পানির মাঝে এক শপথ।
— “আমি আমার জীবনের প্রতিটি নিঃশ্বাস এমনভাবে ব্যবহার করবো, যেন আপনি আমাকে জান্নাতে নিয়ে গেছেন আম্মু।”
---
[২] একজন যুবক আসে, তাকদীরের পাতায় লেখা হয়ে…।
তারপরের ঘটনা ছিল একেবারে হঠাৎ। একদিন সকালে মাদরাসার দোতলায় বসে তামান্না ছাত্রীদের কুরআন শেখাচ্ছিল। নিচে থেকে একজন মেয়ে ডেকে বলে—
“আপু, একজন হুজুর এসেছেন আপনাকে দেখা করতে। নাম বলেছেন... 'হাফেজ আদনান'।”
তামান্না একটু থমকে যায়।
সে কখনো পুরুষদের সামনে যাওয়া পছন্দ করে না, বিশেষ করে সাবিরার মৃত্যুর পর তো একেবারেই নয়।
কিন্তু হাফেজ আদনান ছিল সাবিরার পরিচিত এক ছাত্র, যার কাছে সাবিরা একবার বলেছিলেন—
> “তামান্নাকে আল্লাহর পথে যদি কেউ একদিন নিয়ে যেতে চায়, তবে যেন সে তাকওয়ার চেয়ে বেশি কিছু না চায়।”
---
[৩] আল্লাহর পথে যখন দুটি হৃদয় দেখা করে…।
হাফেজ আদনান বসে ছিলেন মাদরাসার ছায়ায়।
তিনি মাথা নিচু করে তামান্নার আসার অপেক্ষা করছিলেন।
তামান্না মাথায় কালো খিমার, মুখে নিকাব পরে এসে পাশে চেয়ারে বসেন, পর্দার ঠিক এক হাত দূরে। কোনো সোজাসুজি কথা নয়। শুধু এক দোয়া দিয়ে শুরু—
> হাফেজ আদনান বলেন: “আল্লাহ যেন আপনার জন্য জান্নাতে একটি ঘর বানিয়ে দেন, যেটি সাবিরা আপুর দোয়ার ছায়ায় থাকবে।”
তামান্নার চোখে পানি আসে।
সে বলে—
“আপনি আম্মুকে চিনতেন?”
হাফেজ আদনান বলেন:
“তিনি আমার উস্তাদের চেয়েও বেশি ছিলেন। তিনি আমাকে শিখিয়েছেন কীভাবে না চেয়ে ভালোবাসা যায়।”
---
[৪] প্রস্তাব আসে—কিন্তু ভিন্নভাবে…।এক সপ্তাহ পর, হাফেজ আদনানের মা একটি চিঠি পাঠান। সেই চিঠিতে লেখা ছিল—
> “আমাদের পরিবার চায়, তামান্না যেন আদনানের জীবনসঙ্গী হয়। তবে আপনার সিদ্ধান্তই আমাদের তাকদীর।
কারণ জান্নাত শুধু ভালোবাসা দিয়ে তৈরি হয় না—তাকওয়া দিয়ে গড়া হয়।” তামান্না সেই চিঠি পড়ে চুপ হয়ে যায়।
সে মনে মনে ভাবে—
“আমি কি জীবনসঙ্গী হতে পারি একজন আল্লাহর বান্দার, নাকি আমি শুধু দুঃখের গল্পের পাতায় পড়ে থাকবো?”
সে দু’রাকাত ইস্তিখারা নামাজ পড়ে। তার চোখে কেবল একটি মুখ ভেসে ওঠে— সাবিরা।
আর যেন কানে আসে—
> “যদি কেউ কুরআনের আলোয় তোমার দিকে আসে, জানো, তাকে আমি পাঠিয়েছি…”
---
[৫] বিয়ে হয়—তবে সাধারণ নয়, বরং তাকওয়ার আলোয়…।মাদরাসার হলরুমে ছোট্ট একটি আয়োজনে বিয়ে হয়। কোনো অলংকার নয়, কোনো গান নয়, কোনো ছবি নয়। শুধু কুরআন তিলাওয়াত, দোয়া, কিছু খেজুর আর একটিমাত্র গিফট—
একটি কুরআন, যার প্রথম পাতায় লেখা—
> “তাকদীরের ছায়ায় তুমি — এখন আমার জান্নাতের দোয়া।”
তামান্না নতুন জীবনে পা রাখে।
কিন্তু তার প্রথম রাতেও সে সাবিরার খালি খাটের পাশে বসে ছিল।বলেছিল—
“আম্মু, আমি নতুন জীবন শুরু করছি।
আপনি না থাকলেও, আপনার দোয়া যেন আমার মাথার ওপর ছায়া হয়ে থাকে।”
---
[৬] দাম্পত্য জীবন—প্রেম যেখানে সিজদার মাঝেও হাঁটে…
হাফেজ আদনান এমন একজন স্বামী যিনি কখনো “আমি” বলেন না, সবসময় বলেন— “আমরা”।
তিনি বলেন—
> “তামান্না, তুমি কেবল স্ত্রী না, তুমি আমার আমানত।
আমি তোমাকে জান্নাতে দেখতে চাই সেই ছায়ায়, যেখান থেকে সাবিরা আপু আমাদের দেখবেন।”
তারা প্রতিদিন ফজরের পর একসাথে দোয়া করেন।
রোজা রাখেন প্রতি সোম ও বৃহস্পতিবার। তাদের সংসার কেবল একটি ঘরে নয়—
বরং কুরআনের প্রতিটি আয়াতে গাঁথা ছিল তাদের ভালোবাসা।
---
[৭] আরেকটি তাকদীর এসে দরজায় কড়া নাড়ে...। বিয়ের তিন বছর পর।এক রাত। তামান্নার চোখে পানি। ডাক্তার বলেছে—
“আপনার সন্তান হবে না।” হাফেজ আদনান পাশে বসে ছিলেন। তিনি কেবল বলেছিলেন—
“তুমি সন্তান দিতে না পারো, তাতে কিছু আসে যায় না। তুমি আমার জান্নাতের পথে সাথী— এর বেশি কিছু চাই না।”
তামান্না বলেছিল—
“আপনি জানেন, আম্মু আমাকে বলেছিলেন— যদি কষ্ট পাও, কাঁদো। কারণ কাঁদলে আকাশের দরজা খোলে।” সে রাত ছিল… জান্নাতের দরজা খুলে যাওয়ার মতো নিঃসঙ্গ।
---
[৮] এক এতিম শিশু, একটি জীবনের সঞ্চয়…। কয়েক মাস পর তারা একটি এতিম শিশু দত্তক নেয়।নাম রাখে— সাবিহা সাবিরা। তামান্না শিশুটিকে কুরআনের আয়াত দিয়ে বড় করে।
সে বলে—
“তুমি জানো, তোমার নাম কেন সাবিহা সাবিরা?
কারণ তুমি আমার আম্মুর দোয়ার ফল। তুমি তার নামের আলো।” সেই শিশুটি বড় হয়ে উঠে,
যার কণ্ঠে কুরআন— এবং চোখে জ্যোতির্ময় তাকওয়া।
---
[৯] একটি সকাল—যে সকালে চিঠি আসে না, আসে নীরবতা।
এক সকালে হাফেজ আদনান ঘুম থেকে উঠলো না।
তামান্না ভেবেছিল, হয়তো তাহাজ্জুদের পর ঘুমিয়ে গেছেন।
কিন্তু না।
তিনি আর উঠলেন না।
তার পাশে পড়ে ছিল এক কুরআন শরীফ,
তার বুকের কাছে ছিল একটি ছোট্ট কাগজ—
তাতে লেখা—
> “যদি একদিন আমি না থাকি, তুমি জানবে, আমি এখন সেই ছায়ায় আছি,
যেখান থেকে সাবিরা আপু আর আমি—দু’জন মিলে তোমার জন্য জান্নাতের দরজা খুলতে চাইছি।”
তামান্না বোবা হয়ে যায়।
এই কষ্ট আগে সে পেয়েছিল— সাবিরার মৃত্যুতে।
এবার পেয়েছে এমন একজনের বিয়োগে,
যিনি তাকে জান্নাতের দিকে প্রতিটি পা’য়ে এগিয়ে নিয়েছিলেন।
---
[১০] কবরের পাশে দাঁড়িয়ে এক বিধবা বলে…।
তামান্না দাঁড়িয়ে আছেন তার স্বামীর কবরের পাশে।
তার কণ্ঠে কাঁপুনি—
> “আল্লাহ্, আপনি তো আমাকে ধৈর্য শিখিয়েছেন।
আপনি তো বলেছিলেন— صبر جميل – সবচেয়ে সুন্দর ধৈর্য। আমি তা করবো। কিন্তু এই শূন্যতা… আপনি বুঝেন?”
সে বসে পড়ে। তার নিকাব ভিজে যায় অশ্রুতে।
সে বলে—
> “আল্লাহ্, আপনি তো কুরআনে বলেছেন—
‘যারা ধৈর্য ধারণ করে, তাদেরকে সীমাহীন পুরস্কার দেয়া হবে।’ আমি সেই পুরস্কার চাই না…। আমি শুধু আমার তাকদীর চাই, আমার ছায়া চাই, আমার হাফেজ আদনানকে চাই।”
---
[১১] সন্তান, দোয়া ও জীবন চালিয়ে নেওয়া…।
সাবিহা সাবিরা তখন সাত বছরের। সে তার মায়ের চোখে দেখে এক বিষণ্ণ সূর্য।
সে মায়ের কোলে এসে বলে—
> “আম্মু, আমি আপনাকে জান্নাতে নিয়ে যাবো।
আমি কুরআনের হাফেজা হবো। আমি আপনাকে আর কাঁদতে দেবো না।”
তামান্না এক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ।
তারপর সেই কোল, যেখানে কান্না ছিল, সেখানে আলতো এক হাসি ফুটে ওঠে।
> “আল্লাহ্ তোমার মুখের কথা কবুল করুন মা…। তুমি হয়তো আমার দোয়া নও, আমার দোয়ার উত্তর।”
---
[১২] একদিনের চিঠি — তাকদীরের ছায়ার ছোঁয়া ফিরে আসে…।
সাবিহা হিফজ শেষ করার দিন। পুরো মাদরাসা কান্নায় ভেসে গেছে। তামান্না একটি খালি চিঠি হাতে পায়। চিঠিতে কিছুই লেখা নেই, শুধু একটি আয়াত—
> “إِنَّ مَعَ الْعُسْرِ يُسْرًا"
“নিশ্চয়ই কষ্টের সাথে সহজতাও রয়েছে।”
(সূরা ইনশিরাহ ৬)
তামান্না সেই চিঠির পেছনে লিখে রাখে—
> “আমার দুঃখের মধ্যে যে হাসি ছিল, তা তুমি ছিলে, সাবিহা। আর আমার জান্নাতের পথের ছায়া ছিল হাফেজ আদনান। আর যিনি সব কিছুর ঊর্ধ্বে— তিনি আমার রব। আমার আল্লাহ্।”
---
[১৩] উপসংহার: একটি নামাজ, একটি জান্নাতের দরজা, একটি মৃত্যু…
তামান্না বৃদ্ধা হয়েছে।
তার মুখে এখনো সেই খিমার, তার ঠোঁটে এখনো সেই দোয়া— “আল্লাহ্, তুমি আমায় ক্ষমা করো…”
একদিন ফজরের পর সে আর উঠলো না। তার মাদরাসার এক ছাত্রী এসে বলে—
> “উনি না উঠার আগে বলে গেছেন— ‘আজ আমার স্বামী আমাকে নিতে আসবে। আমি এখন জান্নাতে যাবো… সাবিরা আম্মু ডাকছেন।’”
তার জানাজার দিনে এক হাজারের বেশি মানুষ উপস্থিত ছিল।
সবাই বলছিল—
> “উনি কেবল শিক্ষক ছিলেন না, উনি ছিলেন আল্লাহর একজন প্রেমিকা…
যিনি তাকদীরের ছায়ায় ভালোবেসেছিলেন, হারিয়েছিলেন, কিন্তু কখনো থেমে যাননি।”
---
[শেষ চিঠি: “তাকদীরের ছায়ায় তুমি…”]
মাদরাসার এক কোণে তামান্নার লেখা একটি নোট পাওয়া যায়।
> “তাকদীরের ছায়ায় তুমি ছিলে আম্মু, তুমি ছিলে আদনান। কিন্তু তার চেয়েও বড়, তুমি ছিলে আমার রবের সবচেয়ে প্রিয় পরীক্ষাগুলোর ছায়া।
আমি পাস করেছি কি না জানি না…
তবে আমি এসে যাচ্ছি, সেই ছায়ায়,
যেখানে জান্নাতের বাতাসে শুধু একটিই নাম ঘুরে বেড়ায় —
‘আল্লাহ্… আল্লাহ্… আল্লাহ্।’”
এ গল্পটা শুধু কল্পনা না…
এটা সেইসব নারীদের গল্প,
যারা ভালোবাসেন তাকদীরকেও, যিনি তাকদীর লিখেছেন তাকেও।
লেখকের আরও একটি সংক্ষিপ্ত উপন্যাস:
“হারানো গোধূলির সন্ধানে”
👉://fictionfactory.org/posts/11686
এবং চলমান সিরিজ:
"তাকদীর ও হালাল ভালোবাসার সংঘর্ষ”
চ্যাপ্টার (১) পার্ট (১-২)
👉://fictionfactory.org/posts/11955
চ্যাপ্টার (১) পার্ট (৩-৪)
👉://fictionfactory.org/posts/11989