অঙ্গনা
মোঃ রিফাত হোসেন
আমি তখন চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ি, আমাদের স্কুলে একদিন একটি নতুন মেয়ে ভর্তি হয়। মেয়েটার নাম ছিল ‘অঙ্গনা’—যে নামটা আমি-ই দিয়েছিলাম। নামটার বিশেষ একটা তাৎপর্য আছে—এর অর্থ ‘সুগঠিতা, সুন্দরী রমণী’।
প্রথম দেখাতেই ওকে ভালো লেগে গিয়েছিল। ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব হলো। সেই বন্ধুত্বের আড়ালেই জন্ম নিতে লাগল এক অচেনা অনুভূতি—ভালোবাসার।
তবে আমি ছিলাম ভীষণ আত্মকেন্দ্রিক, নিজের মনের কথা প্রকাশ করার মতো সাহস কখনোই হয়নি। তাই কিছুই বলা হয়নি ওকে।
এইভাবে কেটে গেল স্কুলজীবনের কিছুটা সময়। আমি ষষ্ঠ শ্রেণিতে উঠতেই ভর্তি হই গোমস্তাপুর পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে, আর অঙ্গনা চলে যায় অন্য এক স্কুলে।
কোনো যোগাযোগ নেই, কোনো খোঁজ নেই। শুধু থেকে যায় কিছু অপূর্ণ অনুভূতি আর ছোটবেলার কিছু মিষ্টি স্মৃতি।
সাত বছর কেটে গেছে। আমি এখন উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেছি। হয়তো অঙ্গনাও করেছে।
তবু ছোটবেলার সেই অনুভূতিগুলো কি এত সহজে মুছে যায়?
একদিন হঠাৎ ফেসবুকে ওর নামে একটা অ্যাকাউন্ট চোখে পড়ে। বুকের ভেতর কেমন যেন ধুকপুক করতে থাকে। সাহস করে একটি ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে দিলাম। কিছুক্ষণ পর দেখি—রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করে ফেলেছে!
বুকের ধুকপুকানি আরও বেড়ে গেল। "মেসেজ পাঠাব?"—এই দ্বিধার মাঝেই দেখি ও আগে থেকেই লিখে রেখেছে— "তুই সেই রিফাত না, যে আমার নাম রেখেছিল 'অঙ্গনা'?"
আমি কয়েক মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে গেলাম।
মনে হলো, স্কুলের সেই মাঠ, ক্লাসরুম আর ওর খিলখিল হাসির শব্দ যেন আবার কানে বাজছে।
আমি লিখলাম— "হ্যাঁ, আমি সেই রিফাত। ছোটবেলার সেই বেস্ট ফ্রেন্ড।"
ওর উত্তর এলো— "ভেবেছিলাম, তুই ভুলে গেছিস। কিন্তু জানিস, তোকে আমি আজও আমার সবচেয়ে আপন বন্ধু ভেবে রেখেছি... বেস্ট ফ্রেন্ড, রিফাত।"
সেই দিনই বুঝলাম, অনেক সময় ভালোবাসা প্রকাশ না করলেও, বন্ধুত্বের রূপে থেকে যায়।
আর অঙ্গনা? ও এখনো আমার ‘মেয়ে বেস্ট ফ্রেন্ড’।
হয়তো এখানেই এই গল্পের সৌন্দর্য।
সেইদিন থেকে আবারও কথা বলা শুরু হলো। প্রথমে দু-একটি মেসেজ, পরে নিয়মিত আলাপ।
হঠাৎ করেই যেন হারিয়ে যাওয়া এক সম্পর্ক আবার নতুন করে গড়ে উঠতে লাগল।
সময় কেটে যাচ্ছিল। আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম এবং সেখানে পড়াশোনার জন্য চলে যাই।
নতুন শহর, নতুন জীবন—তবু পুরোনো অনুভূতিগুলো কিছুতেই পিছু ছাড়ে না।
অঙ্গনা তখনও আগের মতোই বন্ধুসুলভ আচরণ করত। ওর চোখে আমি ছিলাম শুধুই এক "পুরোনো, আপন বন্ধু"।
কিন্তু আমি ধীরে ধীরে সেই বন্ধুত্বে ভালোবাসার ছোঁয়া খুঁজে পাচ্ছিলাম।
হয়তো এটি ছিল অবচেতন মনে জমে থাকা অনুভূতি, যা সময়ের সঙ্গে রূপ নিচ্ছিল একতরফা ভালোবাসায়।
একদিন নিজের ডায়েরিতে লিখে রাখলাম হুমায়ুন আহমেদ স্যারের সেই বিখ্যাত উক্তি—
> "একটা মেয়ে এবং একটা ছেলে কখনও বন্ধু হতে পারে না। প্রেমে পড়বেই—তবে আগে না হয় পরে।"
এই লাইনটাই যেন আমার জীবনের বাস্তবতা হয়ে দাঁড়ালো।
প্রতিদিন অঙ্গনার মেসেজের অপেক্ষায় থাকতাম।
ক্লাসে, লাইব্রেরির নিস্তব্ধতায়, এমনকি মাঝরাতেও ভাবতাম—অঙ্গনা কী করছে? কথা বলবে তো?
কিন্তু বাস্তবতা কখনোই কল্পনার মতো সহজ হয় না।
একদিন অঙ্গনা হালকা করে বলল— "রিফাত, জানিস? আমাকে দেখতে কিছু পাত্রপক্ষ আসবে আগামী সপ্তাহে। বাসায় সবাই বেশ সিরিয়াস।"
হৃদয়ে যেন বাজ পড়ল।
যাকে নিয়ে ভবিষ্যতের একেকটা রঙিন ছবি আঁকছিলাম, সেই মানুষটা হয়তো আর আমার জীবনে থাকবে না।
তবুও লিখে পাঠালাম— "ভালো থেকো অঙ্গনা। সবসময় তোর পাশে ছিলাম, থাকব... বন্ধুর মতো, কিংবা কিছু বেশি।"
সেদিন অঙ্গনার সেই শেষ মেসেজের পর আর কোনো উত্তর আসেনি।
আমিও আর কিছু লিখিনি। শুধু অপেক্ষা করেছি... এক অজানা আশায়।
এরপর কেটে গেছে কয়েক মাস। জীবনের নানা ব্যস্ততায় নিজেকে ডুবিয়ে রাখলেও মাঝে মাঝে পুরোনো কিছু কথা, কিছু মেসেজ—মনকে নড়ে দিয়ে যেত।
আমি ভেবেছিলাম, বিয়েটা হয়ে গেছে। একরকম ধরে নিয়েই শান্ত হওয়ার চেষ্টা করছিলাম।
তবে সত্যি কি মানুষ নিজের অনুভূতিকে মেরে ফেলতে পারে?
একদিন ক্লাস শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি থেকে বের হচ্ছি। হঠাৎ শুনি পরিচিত এক কণ্ঠ— "রিফাত!"
পেছনে তাকিয়ে দেখি... অঙ্গনা।
চোখে সেই পুরোনো মায়া, মুখে সেই চেনা হাসি, আর ঠোঁটের কোণে একরাশ বিস্ময়।
আমি একমুহূর্ত থমকে গেলাম।
— "তুই? এখানে?"
— "হ্যাঁ," অঙ্গনা হেসে বলল, "সেকেন্ড টাইম দিয়ে আমি চবিতে চান্স পেয়েছি। সোশিওলজিতে ভর্তি হয়েছি।"
আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।
— "তোর... বিয়েটা?"
— "হয়নি।" একরাশ প্রশান্তি নিয়ে বলল, "মনের মতো কিছু হচ্ছিল না। আমিও সময় চেয়েছিলাম আরও একটু পড়াশোনা করার। শেষমেশ সবাই রাজি হয়ে গেল।"
আমার ভেতরটা হঠাৎ করে আলোয় ভরে উঠল।
হারানোটা যে একেবারেই চিরতরে হারানো ছিল না, সেটা যেন হঠাৎই জানা গেল।
সেইদিনের পর, সবকিছু নতুন করে শুরু হলো।
ক্লাস শেষে হাঁটা, ক্যাম্পাসের টিলাগুলোতে বসে গল্প, টিফিন শেয়ার করা, লাইব্রেরির নীরবতায় চোখে চোখ রাখা—সবকিছু যেন এক নতুন রঙে আঁকা।
কিন্তু এবার আমি চুপ থাকিনি।
এক বিকেলে বোটানিক্যাল গার্ডেনের পাশে বসে অঙ্গনার দিকে তাকিয়ে বললাম—
> "তুই জানিস অঙ্গনা, তোর নামটার মানে শুধু বইয়ের পাতায় না, আমার জীবনেও মানে রাখে—তুই আমার জীবনের সৌন্দর্য, আমার ভিতরের অঙ্গন।"
অঙ্গনার চোখে কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে থাকল। তারপর হেসে বলল—
> "তুই তো কখনো বলিসনি। এখন বলছিস?"
"ভয় পেতাম। হারানোর।"
"এখন?"
"এখনও ভয় পাই। কিন্তু তোকে না বলেও আর পারছি না।"
ও বলল না কিছু, শুধু হাতটা বাড়িয়ে দিল আমার দিকে।
আমি হাত ধরলাম—নীরব, কিন্তু গভীর এক প্রতিশ্রুতিতে।
সেই মুহূর্তে বুঝলাম, ভালোবাসা যদি সত্যি হয়, তবে তা হারিয়ে যেতে পারে না।
চুপ করে থেকে গেলেও, সময় একদিন তাকে জাগিয়ে তোলে।
ক,
জীবনের সব জটিলতা পেরিয়ে, আমরা অবশেষে একসাথে।
একটা সময় ছিল, যখন অঙ্গনা ছিল শুধুই এক স্মৃতি—এক অপূর্ণ ভালোবাসা।
আর এখন? এখন সে আমার প্রতিদিনের গল্প, আমার ভবিষ্যতের অংশ, আমার জানের চেয়েও আপন।
বিশ্ববিদ্যালয়জীবন শেষে আমরা দুজনেই ঠিক করেছিলাম—বিসিএস দিব। একসাথে।
স্বপ্ন ছিল—একই ক্যাডারে চাকরি করব, হয়তো একই শহরে থাকব, আর জীবনটাকে গড়ে তুলব নিজেদের মতো করে।
রোজ পড়তাম একসাথে। অঙ্গনা ঠিক যেমন আগেও ছিল—তেমনি পরিশ্রমী, আন্তরিক।
আর আমি? আমি কেবল তাকিয়ে তাকিয়ে ওর মধ্যে ভবিষ্যতের আশ্বাস খুঁজে নিতাম।
তবে জীবন কখনো আমাদের পরিকল্পনার ছকে চলে না।
দুজনেই তখন বিসিএস-এর প্রস্তুতিতে ব্যস্ত।
স্বপ্ন ছিল—একসাথে অফিসে যাব, সরকারি চাকরিতে ঢুকে বাবা-মায়ের মুখে হাসি ফুটাব।
অঙ্গনা মাঝে মাঝে বলে উঠত—
"রিফাত, যদি একসাথে টিকি, তাহলে আমি তোর হাতটা সারাজীবনের জন্য ধরে রাখব।"
রিফাত হেসে বলত—
"তুই হাত না রাখলেও আমি তোর পাশেই থাকব,My dear ভন্ড।
কিন্তু সময় তার নির্মমতা দেখায়।
কোভিড-১৯-এর ঢেউ যখন আছড়ে পড়ে, তখন আমি একদিন হালকা জ্বরে ভোগি।
প্রথমে ভাবে সাধারণ ঠান্ডা লাগা। কিন্তু তিনদিন পরই শ্বাসকষ্ট শুরু হয়।
চট্টগ্রাম মেডিকেলে ভর্তি করানো হলো।
অঙ্গনা খবর পেয়ে ছুটে যায়, কিন্তু আইসোলেশন বিধির কারণে দেখতে পায় না।
হাসপাতালের বেড থেকে আমি ভিডিও কলে বললাম—
"অঙ্গনা, আমি তোর থেকে কখনও কিছু চাইনি, আজ একটা জিনিস চাই... যদি আমি না ফিরি, তাহলে আমার নামে একটা গাছ লাগাবি। যেন আমি আবার জন্ম নিতে পারি..."
অঙ্গনা কাঁদছিল। কিছু বলতে পারছিল না। শুধু মাথা নেড়ে বলল,
"তুই ফিরবি রিফাত, আমি তোর জন্য দোয়া করছি।"
কিন্তু সব দোয়া, সব প্রার্থনা যেন নিরব ছিল সেদিন।
রাত ৩:৪০ মিনিটে, হাসপাতালের নীল আলোয় শেষ নিঃশ্বাস নেয় রিফাত।
তার মোবাইলের শেষ মেসেজ ছিল অঙ্গনার জন্য:
"তোর জীবনে অনেক আলো আসুক। আমার অংশটুকু অন্ধকারেই থাকুক। ভালোবাসি, কিন্তু বন্ধুর মতো..."
সেই দিন থেকে অঙ্গনার পৃথিবীটা যেন নিঃশব্দ হয়ে যায়।
---
💔 রিফাত নেই, তবু আছে...
অঙ্গনা আর কখনো বিয়ে করেনি।
বছর ঘুরে বছর যায়, বিসিএস পরীক্ষাও দেয় সে, চাকরিও পায়—কিন্তু জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান অনুভূতি আর ফিরে আসে না।
তার ওয়ার্কডেস্কে ছোট্ট একটা গাছ থাকে সবসময়—রিফাতের নামে লাগানো সেই গাছ।
প্রতিদিন কাজ শুরু করার আগে সে গাছটাকে দেখে মুচকি হেসে বলে—
"তুই তো বলেছিলি, জন্ম নিবি আবার... আমি অপেক্ষা করছি রিফাত..."