Posts

চিন্তা

ঈদের টুকিটাকি

June 13, 2025

সাজিদ রহমান

227
View

বাজারে যাওয়ার পথে রিবেলের মুদির দোকান। গ্রামের বাড়িতে গেলেই ওর সাথে দেখা হয়। সহুল কেমন আছে, সেদিন দেখা হতেই জিজ্ঞেস করি। সহুল ভাই নিজের জীবন শেষ করেছে, সাথে আমাদেরকেও। রিবেলের কণ্ঠে হতাশা। অনেক বছর হলো, সহুলের সাথে দেখা নেই। 

সহুল আমার প্রাইমারির বন্ধু। বেশ দূরের এক গ্রাম থেকে স্কুলে আসতো। খুবই চঞ্চল স্বভাবের ছেলে। পড়াশুনায় ছিল ভীষণ দুর্বল। সহুল নিজেও বুঝতো, ওকে দিয়ে পড়াশুনা হবে না। ওর বাড়ির লোকজন ধরে নিয়েছে, ওর পক্ষে প্রাইমারি পাশ করা সম্ভব নয়। কিন্তু ও চমক দেখিয়ে প্রাইমারি পাশ করে ক্লাস সিক্সে উঠে যায়। ওর প্রাইমারি পাশে আমার ভূমিকা আছে, ওর বাড়িতে ঢোল পিটায়। ওর বাবা-মা খুব করে যেতে বলেছে আমাকে। শেষে একদিন সহুলের সাথে ওদের বাড়িতে গিয়ে হাজির হই। ওদের গ্রামে গিয়ে খুব ভালো লাগে,পুকুরে দাপিয়ে গোসল করি। চাষের জমিতে মই দিলে মাছ ভেসে উঠে। দৌড়ায়ে দৌড়ায়ে সেই মাছ ধরি। ওদের বাড়ির লোকজন খুব আদর করে। ভালো ভালো খাওয়ায়। পড়াশোনায় সাহায্য করে এত খাতির আর কখনও পাইনি। ইদানিং অনেক কিছু মনে রাখতে পারি না। সহুলের সেই দাওয়াত, ভালোবাসার কথা ভুলে যাইনি। রিবেলের সাথে আলাপে জানতে পারি, সহুল অনেক দিন ধরে নেশাগ্রস্ত। আগে অনেক ধরণের নেশা করতো। এখন এক রকমের ট্যাবলেট খায়। সহুলের কারণে ওদের পরিবার ধুকে ধুকে ক্ষয়ে যাচ্ছে। 

শুনে আমারও মন খারাপ হয়ে যায়। সুন্দর একটা জীবন হতে পারতো সহুলের। সংসারের হাল ধরতে পারতো, কিন্তু তাঁকে নিয়েই পরিবারের মাথাব্যাথা। শুধু সহুল নয়, সমাজের একটা বড় অংশ বিভিন্ন রকমের নেশায় আসক্ত। খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, নেশার সকল উপকরণ হাত বাড়ালেই পাওয়া যায়। ছেলের হাতের মোয়াও আর অতটা সহজ নেই, যতটা সহজে নেশা পাওয়া যায়। সমাজে যত ধরণের অপকর্ম আছে, এর মূলে রয়েছে মহামারির মত ছড়িয়ে পড়া নেশা। নেশার বিষে পুরা সমাজে নীল হয়ে যাচ্ছে। এ থেকে উত্তরণ ব্যতীত সমাজে ভালো কিছু আশা করা বৃথা নয় কি?

২।  

বন্ধু কাউসারের দোকানে বসে আছি। আছে তাজুল, তারিক, কালাম, বুলু ও জনি। পাশের এক হোটেলের কারিগর এসেছে। তাঁর কথায় বুঝলাম, সে আমলযোগ্য অপরাধ করেছে। কিন্তু  মালিক নিজে না বলে অন্য একজনকে দিয়ে বলিয়েছে। বিনা বেতনে ৫ দিনের ছুটির সিদ্ধান্ত জানিয়েছে। সে ভীষণ সংক্ষুব্ধ। মালিকের বিরুদ্ধে সমিতিতে অভিযোগ দেয়ার বিষয়ে বদ্ধ পরিকর। বন্ধুর দোকানে এসেছে সেই দরখাস্ত লিখতে। সে একজন মিষ্টির কারিগর, তাঁকে যথাযথ সম্মান দেয়া হয়নি। বন্ধু অবশ্য বেশ হালকা করে দরখাস্ত লিখেছে। কড়া চিঠি লিখে কাজ হারালে তাঁরই ক্ষতি হবে। মনিবের ভয়ে নত হয়ে থাকবে কর্মচারী, সেই দিন শেষ হয়ে আসছে। দীর্ঘ দিন ধরে মানুষের ভিতরে বাস করা ভয় পালিয়ে গেছে। দরখাস্ত রেডি হলে সেটা নিয়ে চলে যায়। খুব গরম পড়েছে, একজন ঠাণ্ডা নিয়ে এসেছে। সেটা নিয়ে কাড়াকাড়ি শুরু হয়।  

কাউসারের দোকানে বসার আগে শেভ করাই। নাপিতের দোকানেও কাণ্ড একখান হয়েছে। তখনও আমার শেভ শেষ হয়নি। পাশের এক কাস্টমারের সাথে লেগে গেছে। কারিগরের দাবি দুই শ টাকা। কিন্তু কাস্টমার এক শ’র বেশি দিবে না। কান খাড়া করলাম। চারদিকে এত হাউকাউ কেন, বোঝা দরকার। চুল কাটাইছে, দাঁড়ি সাইজ করেছে, হালকা করে ফেস ওয়াশ করিয়ে মাথাও ধুয়ে নিছে। এখন এক শ’র বেশি দিবে না। কারিগর তাঁকে চেনে। কয়দিন আগে বিয়ে করেছে এই এলাকায়। শ্বশুর বাড়িতে ঢুকার আগে ফ্রেশ হতে এসেছে। এসে এই কাণ্ড। কারিগরকে বেশ ধৈর্যশীল মনে হল। এসময় পাশের আরেক কাস্টমার সরব হয়েছেন। তাঁর মতে কারিগরের কোন দোষ নাই। 

-ভাই আমি গরীব মানুষ, ভ্যান চালাই। বেশি দিতে পারবো না। এবার সে ডিফেন্সিভ মুডে চলে যায়। 

-তাইলে বাড়িতে গিয়ে মাথা ধুইতেন। সেলুনে শ্যাম্পু দিয়ে মাথা ধুয়ে নিলে মিনিমাম পঞ্চাশ টাকা চার্জ করে। সেই কাস্টমার ভাই ক্ষেপে যান।

কোন এক বাংলা সিনেমায় দেখেছিলাম। পেট পুরে খেয়ে দেয়ে বলে টাকা নেই। পরে থালা বাটি পরিষ্কার করে টাকা শোধ। এখানে সে সুযোগও নেই। আনাড়ির হাতে ডালের পাতিল দিলে সর্বনাশ হতে সময় লাগবে না।  

যাক, এরপর একটা দফা রফা হয়। শ্বশুর বাড়িতে যাওয়ার আগে আরেক বার আয়নায় নিজেকে দেখে নেয়। যাই বলি, ছেলের রুচির প্রশংসা করতে হয়। শুধু কয়টা টাকা পয়সার অভাবে ছেঁচড়া হয়েছে। 

৩। 

নওগাঁয় অন্যান্য অনেক কিছুর সাথে জেলখানার স্মৃতিও আছে। জেলখানার সামনে দিয়ে যাই আর ভাবি, একদিন ভিতরে যাবো। শুধু দেখার জন্য। এটা ভাবতে ভাবতে আড়াই বছর পার হয়ে যায়। রংপুরে বদলী হই। রংপুরে চলে যাওয়ার ২/৩ দিন আগে জেল সুপারকে ফোন দিলাম। সব খুলে বললাম। তিনি তখন জেলখানা থেকে বাসায় চলে গেছেন। আমার কথা শুনে উনি বাসা থেকে চলে আসেন। আমাকে ঘুরে ঘুরে দেখান। নওগাঁ জেলের ভিতরটা বেশ পরিচ্ছন্ন। জায়গাটা মন্দ নয়। সেদিন ফেরার সময় জেল সুপারকে আমার লেখা বিজিতের পলায়নবিদ্যা উপহার দিয়েছিলাম। সেই জেলারেরও মেলা গল্প শুনলাম। ওসব এখানে না বলাই শ্রেয়। 

সেদিন নওগাঁ গিয়ে সেই কথা মনে পড়লো। বন্ধুদের আড্ডায় সেই ঘটনার বর্ননা দিচ্ছিলাম। এর আগে এক বন্ধু বলেছিল, সকালে সেল থেকে বের করার পর এবং বিকেলে ভিতরে ঢুকানোর আগে গোনার যে সিস্টেম তাতে বেশ লজ্জা পেয়েছে। ফকির কিংবা রাজা,সবারই একই দশা। এমন সময় একজন পাশ থেকে বলে ওঠে, ওরও ১৫ দিন জেলে থাকার অভিজ্ঞতা আছে। আমরা কেউ জানি না। শুনে সবাই রীতিমত অবাক। ওর কাছ থেকে সেই ১৫ দিনের গল্প শুনলাম। একটা আরেকটার চেয়ে বৈচিত্র্যপুর্ন। সবকিছু শুনে শুধু এটুকু বলা যায়, এর চেয়ে আজব জায়গা আর দুনিয়াতে কোথাও নেই। কেউ যদি জীবনকে দেখতে চায় সে যেন কয়দিন জেলখানায় থেকে আসে। 

-ভাই, ঠিকই বলছেন। এর মত আজন্ম জায়গা আর হয় না। 

আমাদের পাশে বসে একলোক গল্প শুনছিল। হঠাৎ তাঁর আওয়াজে তাঁর অস্তিত্ব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হই। 

-আমিও একবার জেলে গেছিলাম। 

লে হালুয়া। দুনিয়াতে যতটুকু দেখা যায়, অদেখা অংশ এর চেয়ে ঢের বেশি।  

৪। 

এই ঈদেও জিনিসপত্রের দাম মানুষকে খুব একটা পোড়ায় নি। শেষের দিকে গরুর দাম কমে যাওয়ায় স্বস্তির ঈদ গেছে। কিন্তু ক্ষতির মুখে পড়েছে খামারিরা। আমার এক বন্ধুর বক্তব্য। সে নিজেও ২ লাখ টাকা লসের মধ্যে আছে। সেই দুঃখ ভুলতেই মনে হয় এবারের আড্ডায় বেশ স্বপ্রতিভ। শোককে সে শক্তিতে পরিণীত করেছে। বিষয়টা আমারও ভালো লেগেছে। সংসার যতদিন আছে, রুহ যতদিন শরীর থেকে বের হয়ে যায় নি, দুঃখ থাকবে, কষ্ট থাকবে। এর মাঝেও ভীষণ আনন্দে দিন কাটাতে শিখতে হবে। ঈদের পরে আমাকে নওগাঁ যেতে হবে। পুনশ্চ লিটিল ম্যাগের ২৫ বছর পুর্তির আনন্দ উৎসবে যোগ দিতে। আলাপ উঠাতেই সে রাজি হয়ে গেলো। শুধু রাজি না, ওর মাইক্রোবাসও বরাদ্দ দিয়ে দিলো। ওর মাইক্রোতে খিঁচে ঘুরে আসলাম সোমপুর মহাবিহার, হাসাইগাড়ি বিল, নওগাঁ শহর। এর আগে ঈদ আড্ডা চলে। বন্ধু সোহেলের বাসায় বিশেষ দাওয়াত। কমপ্লেক্সের ভিতর পার্ক করা ভ্যানে বসে আড্ডা শুরু হয়, শেষ হতে চায় না। 

আড্ডায় সিনেমার গল্প আসে। কে একজন বলল, জাম্বুর বাড়ি পার্বতীপুরে। আমার জানা ছিল না। বললাম, চল একদিন ওঁর বাড়ি দেখে আসি। দুয়েক জন হাসতে থাকে। পরে বুঝতে পারি, সুইপার পল্লিতে জন্ম। সেখানে যেতে যথেষ্ট দ্বিধা আছে অনেকের।  আমি আরও দুয়েক জনকে জিজ্ঞেস করি। কেউ আগে থেকেই জানতো, কেউ কেউ তখনই শুনেছে। অবশেষে এক বন্ধু কিছু তথ্য দিলো। ১৯৭১ এর পরপরই ঢাকায় চলে যান। দেলওয়ার জাহান ঝন্টু তাঁকে আবিষ্কার করেন। সুখলাল বাবু হয়ে যায় জাম্বু। জাম্বুর জন্মস্থানের চিহ্ন নেই বললেই চলে। আমার জানার ইচ্ছে শেষ হয় না। কিন্তু সময় আর হয়ে উঠে না। 

অন্য কোন দিন জাম্বুর জন্মস্থান তালাশে যাবো, আশা করছি। ঈদের এই সময়গুলো দারুণভাবে কেটে যায়। ঈদের আনন্দ সকলকে ছুঁয়ে যাক।  

Comments

    Please login to post comment. Login