Posts

উপন্যাস

ত্রি-রমনী (সূচনা)

June 16, 2025

M. Khanam

84
View

হাসপাতালের করিডরে জোরে জোরে পায়চারী করছে সাদিক। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, চুলগুলো উষ্কখুষ্ক। লাল শিরায় ভরা চোখ দুটো দেখে মনে হয় যেন সারারাত ঘুম হয় নি, শরীরের উপর বড্ড ধকল গেছে। অপারেশন থিয়েটারের দরজা খুলে বাহিরে আসে এক নারী ডাক্তার। মুখের মাস্কটা খুলে সাদিকের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে। সাদিক বিচলিত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। ডাক্তার হাসি মুখে তাকে সুসংবাদ দিতে যাবে, তখনই বাবার পেছনে এসে দাঁড়ায় সাদিকের বড় কন্যা দশ বছরের মারজিয়া। ডাক্তার মারজিয়ার দিকে তাকায়। পেছনে ওয়েটিং চেয়ারে বসে থাকা তাদের আরেক কন্যা চার বছরের আলিশাকে দেখে। ডাক্তারের মুখ থেকে হাসিটা খানিকটা বিলীন হয়। দুঃসংবাদ শোনানোর মত করে বলে, আপনার কন্যা সন্তান হয়েছে। মা ও মেয়ে দুইজনেই সুস্থ আছে।

সাদিক উপরের দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞতার স্বরে বলে, আলহামদুলিল্লাহ। 

আজ থেকে জনাব সাদিক হোসাইন তিন রমনীর বাবা। 

হাসপাতালের টেলিফোনটা কানের সাথে লাগিয়ে মৃদুস্বরে সাদিক বলে, মিলি সুস্থ আছে, আম্মা। কবিতা ভাবী আছে এখানে, চিন্তা করবেন না। 

টেলিফোনের অপাশ থেকে এক বয়স্ক মহিলার আওয়াজ শোনা যায়, আমার আর কি চিন্তা! চিন্তা তো তুমি করবা এখন! তিন তিনটা মাইয়া পাইলা কেমনে বড় করবা, কেমনে এগো বিয়া দিবা! বুড়া বয়সে দেখব কে তোমাগো! কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে, আল্লাহর কাছে এত চাইলাম যে এইবার যেন অন্তত একটা পোলা হয়— 

সাদিক টেলিফোনটা কানের সাথে লাগিয়ে চুপচাপ শোনে। সামনে তাকিয়ে মারজিয়া আর আলিশাকে দেখে। মারজিয়ার চেহারাটা দুঃখী দুঃখী হয়ে আছে। সাদিক তার দিকে হাসি মুখে তাকায়। মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে, চিন্তা করবেন না, আম্মা। আপনি শুধু দোয়া করে যাবেন। আল্লাহ আছেন উপরে। 

সাদিক টেলিফোনটা রেখে মারজিয়ার দিকে তাকায়। হাসিমুখে বলে, মারজু মা, কি হয়েছে? মারজিয়া বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে চুপ করে থাকে, কিছু বলে না। সাদিক মারজিয়াকে কোলে নিয়ে হাসিমুখে বলে, চলো, মাকে দেখে আসি। আর আমাদের ছোট্ট নতুন একটা বোন হয়েছে, ওর সাথে আমাদের মারজু খেলবে না? 

মারজিয়ার বয়স মোটে দশ, দিন-দুনিয়া খুব বেশি বুঝে না। কিন্তু আসেপাশের মানুষদের দেখে এতটুকু সে বুঝে গেছে যে মেয়ে সন্তান হওয়া ভাল না। দাদু মেয়ে পছন্দ করে না। তাই তো তাদের চাচাতো ভাইকে সবসময় তাদের দুই বোনের চেয়ে বেশি ভাল বাসে। কিন্তু কেন, এর জবাব তার কাছে স্পষ্ট না। বাবার গলা জড়িয়ে ধরে তার দুঃখামাখা মুখটা আর ছোট মাথার হাজারটা অস্পষ্ট চিন্তা বাবার কাঁধে লুকায় মারজিয়া। সাদিক মেয়ের পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে এগিয়ে যায়।

সাবধানতার সাথে কেবিনের দরজাটা খুলে ভেতরে ঢুকে। যাতে খুব শব্দ না হয় সেভাবে মেপে পা বাড়ায়। সাদিক ভেতরে ঢুকতেই তড়িগড়ি করে চোখের পানি মুছে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে থাকা মিলি। পাশে ফিরে ভেজা চোখ লুকানোর বৃথা চেষ্টা করে। সাদিক দেখেও তা না দেখার ভান করে। মিলির পাশেই তার হাত ধরে বসে আছে কবিতা, মিলির বড় ভাইয়ের বউ। 

কবিতা সাদিকের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলে, বাড়িতে জানালে? 

সাদিক হাসিমুখে বলে, হ্যাঁ, জানালাম। সবাই খুব খুশি আলহামদুলিল্লাহ। 

খালাম্মাদের জানিয়েছো তো যে আসার প্রয়োজন নেই? আমি আছি। 

সাদিক মারজিয়াকে কোল থেকে নামাতে নামাতে বলে, ভাবী, আমি তো আছি। আপনি বরং আজ বাড়ি যান। কাল রাত থেকে এখানে আছেন।

কবিতা সাদিকের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তার জোর করে টানা হাসিটা দেখে। ঠোঁটে মৃদু একটা হাসি টানে কবিতা। এই হাসিতে কোনো সুখ নেই, আছে উপলব্ধির বেদনা। বলে, তোমার এই মেয়েটা কিন্তু দেখতে একদম তোমার মত হয়েছে, সাদিক। মিলির চেহারা একটুও পায় নি। কবিতা মিলির হাতটা শক্ত করে ধরে এরপর ছেড়ে দেয়। উঠে কেবিন থেকে বের হয়ে আসে। মিলি তখনও পাশ ফিরে তাকিয়ে আছে। সাদিক খাটের পাশে রাখা ছোট খাটটার দিকে তাকায়। 

আলিশা খাটের পাশে দাঁড়িয়ে ছোট বোনকে দেখছে। বাবার দিকে তাকিয়ে বিশাল একখানা হাসি দিয়ে আদো আদো শব্দে বলে, বাবা, দেখো, আমাদের বাবু! বাবার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা বড় বোনের দিকে তাকিয়ে দৃঢ়কণ্ঠে বলে, এখন আর আমি ছোট নাই। এখন আমিও বড় হি হি হি! বলেই জোরে জোরে হাত তালি দিয়ে হাসতে থাকে। 

সাদিক এগিয়ে এসে আলিশার মাথায় হাত বুলায়। তাকিয়ে সদ্য জন্মানো কন্যাকে দেখে। পৃথিবীর আলো ও শব্দের সাথে যে এখনও মানিয়ে নিতে শিখে নি। চোখ পিটপিট করে বাবাকে দেখছে। সত্যিই চেহারাটা তার মত হয়েছে, ভাবে সাদিক। সাবধানে মেয়েকে কোলে তুলে নেয়। ত্বকগুলো একদম সাদা যেন এতটুকু রক্ত নেই ওর শরীরে। মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে মুখ ঠেকিয়ে রাখে তার ছোট্ট মাথাটায়। অজান্তেই চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে সাদিকের। মিলি হাত বাড়িয়ে সাদিককে ধরে। 

জোরে নিঃশ্বাস টেনে সাদিক বলে, তোমার মনে আছে মিলি, যেদিন আমি তোমাকে দেখতে গিয়েছিলাম— সেদিন তোমায় কি বলেছিলাম? 

মিলি নিঃশব্দে মাথা নাড়ে। তার গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পরে। চোখ-মুখ ভর্তি কন্যা সন্তান জন্ম দেওয়ার মত ঘৃণিত অপরাধের অপরাধবোধ দৃশ্যমান 

সাদিক মিলির দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে দৃঢ়কন্ঠে বলে, আমার মেয়ে। মিলি দুই হাত দিয়ে মুখ চেপে হু হু শব্দ করে কেঁদে ওঠে। মারজিয়া কেবিনের এক কোনায় দাঁড়িয়ে মাকে কাঁদতে দেখে। সাদিক ছোট মেয়েকে দোলনায় শুইয়ে দিয়ে বউয়ের পাশে বসে তার কাঁধে হাত দিয়ে সান্ত্বনা দেয়। 

দুইজনের মস্তিষ্কেই এগারো বছর আগের সেই দিনটা খেলে ওঠে। 

বসার ঘর থেকে এক এক করে উঠে চলে যায় বাড়ির বড়রা। বসে থাকে শুধু তারা দুই জন। ইংরেজি বর্নমালা ‘ইউ’ এর মত করে বসার ঘরের সোফাগুলো রাখা। সেই ‘ইউ’–এর দুই রেখার মিলনস্থানে রাখা পাশাপাশি দুই সোফায় বসে আছে সাদিক ও মিলি। 

মিলি মুখ নীচু করে বসে আছে। সাদিক কয়েকবার মিলির দিকে তাকিয়ে কি বলবে বুঝতে না পেরে এদিক ওদিকে দেখতে থাকে। দরজায় লাগানো পর্দার ফাঁক দিয়ে রুমে উঁকিঝুঁকি দিতে দেখতে পায় কয়েকজনকে। সাদিক বিচলিত বোধ করে।

মিলি মৃদু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, আপনি চা বানাতে পারেন? 

সাদিকটা থতমত খেয়ে মিলির দিকে তাকায়। বলে, চা? হ্যাঁ, পারি তো। 

কেমন বানান? 

আমার তো ভালোই লাগে।

মিলি লজ্জা চোখে নীচের দিকে তাকায়। বলে, আপনার কিছু জিজ্ঞেস করার থাকলে করতে পারেন। 

সাদিক মিলির দিকে তাকিয়ে কৌতুহলের সহিত বলে, আপনার আর কিছু জিজ্ঞেস করার নেই? 

আছে— তবে আপনি আগে জিজ্ঞেস করুন।

সাদিক খানিকটা মাথা চুলকে বলে, সত্যি বলতে বুঝতে পারছি না কি জিজ্ঞেস করব। তাই আপনিই করুন।

সাদিক তাকিয়ে থেকে মিলিকে দেখে। নীল রঙয়ের একখানা শাড়ি পরনে তার। পরিপাটি করে চুলগুলো পেছনে খোপা করা। চেহারায় হালকা সাঁজ। সাদিকের মা আগেই জানিয়েছিলো মেয়েকে যেন বেশি সাঁজগোজ করিয়ে না আনা হয়। স্বাভাবিক-সাধারনভাবে, প্রতিদিনের জীবনে যেমন দেখতে সেভাবেই যেন সাজানো হয়। 

মিলি মুখ তুলে সাদিকের দিকে তাকায়। তার গাল দুটোতে হালকা গোলাপি আভা। সাদিকের চেহারায় যেন সে কিছু একটা খুঁজছে এমনভাবে দেখতে থাকে সাদিককে। মিলির তাকিয়ে থাকা দেখে সাদিকের লজ্জা বোধ হয়। 

মিলি বলে, আপনার কন্যা সন্তান নিয়ে কোনো আপত্তি আছে? 

জী? প্রশ্নটা সঠিক শুনল কিনা বুঝে উঠতে সময় লাগে সাদিকের। সে তাকিয়ে পর্দার ফাঁক দিয়ে উঁকিঝুঁকি দেওয়া ব্যক্তিদের দেখে। 

কন্যা সন্তান দিয়ে হবে না, পুত্র সন্তানই লাগবে— এমন কোনো চিন্তাভাবনা আছে আপনার? মিলি উত্তরের আশায় সাদিকের দিকে তাকিয়ে থাকে। 

সাদিক কি উত্তর দিবে বুঝতে না পেরে মিলির দিকে তাকিয়ে থাকে। 

এ বাড়ি আসার পূর্বে বন্ধুদের সাথে মেয়ে দেখতে আসা নিয়ে আলোচনা হয় সাদিকের। তার বন্ধুরা তাকে জানায় কিভাবে সব মেয়েদের কিছু নির্দিষ্ট প্রশ্ন থাকে। যেমন, আপনি সিগারেট খান কিনা, পূর্বে কোনো মেয়ের সাথে সম্পর্ক ছিল কিনা, নামায পড়েন কিনা, ঘুরতে পছন্দ করেন কিনা। কিন্তু কন্যা সন্তান পছন্দ কিনা এ ধরনের প্রশ্নও যে কেউ করতে পারে তা সাদিক ভাবতে পারে নি। 

কিছুটা বিব্রত বোধ হলেও নিজেকে সামলে নেয় সাদিক। বলে, কিছু মনে না করলে এই প্রশ্নটা করার কারনটা জানতে পারি? মিলি চুপ করে বসে থাকে। বেশ কিছুক্ষণ কেউ কিছু বলে না। 

কিছুটা সময় পর মিলি মৃদুকণ্ঠে বলে, আমার মনে হয় আমার কোনো পুত্র সন্তান হবে না। 

সাদিকের খানিকটা বিরক্ত বোধ হয়। মেয়ে দেখতে এসে এ ধরনের আলাপের জন্য সে প্রস্তুত নয়। খানিকটা বিরক্তের সুরেই বলে, আপনি তো শিক্ষিত মেয়ে। আপনার জানা উচিৎ যে সন্তান ছেলে বা মেয়ে হওয়ার ক্ষেত্রে মায়ের কোনো ভূমিকা থাকে না। একটু থেমে মিলির দিকে তাকায়। 

মাথা নীচু করে বসে আছে সে। মিলি নিঃসন্দেহে সুন্দরী একজন রমনী। তার এই অপরাধীর মত বসে থাকা সাদিকের ভাল লাগে না। 

সাদিক কণ্ঠ থেকে বিরক্তিভাবটা সড়িয়ে নিয়ে মৃদু আশ্বাসের কন্ঠে বলে, তাই ছেলে হোক, মেয়ে হোক দুটোই আমার কারনে হবে, আপনার না। যা আমার কারনেই হচ্ছে সেখানে আপত্তি কিসের!

জী, বুঝলাম। আপনার কিছু জিজ্ঞেস করার থাকলে আপনি জিজ্ঞেস করতে পারেন।

এই ধরনের একখানা বিষয়ের উপর কথা বলার পর আর কি বলা যায় সাদিক বুঝতে পারে না। নির্বিকারভাবে জানায়, আমার কিছু জিজ্ঞেস করার নেই। 

মিলি অনুরোধের সুরে বলে, তাহলে আমি উঠি? 

সাদিক মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানায়। 

হাসপাতালের বিছানায় ক্লান্ত শরীরে মিলিকে শুয়ে থাকতে দেখে সাদিক। তার চোখে মুখে কি অসম্ভব ক্লান্তি। প্রথম যেদিন তাকে দেখেছিলো এক মুহুর্তের জন্য তার চেহারার সাথে মধুবালার চেহারার খুব মিল পেয়েছিলো সাদিক। কি অসম্ভব সুন্দর দেখাচ্ছিলো মিলিকে সেই নীল শাড়িটায়, ভাবতেই ঠোঁটের কোনে হাসি ফোটে তার। 

কান্না ভেঁজা চোখে মিলি সাদিকের দিকে তাকায়, যেন সে এক পরাজিত সৈনিক। সাদিক হাত বাড়িয়ে মিলির চোখ মুছে দেয়। হাসিমুখে মিলির মুখটা টেনে এনে তার কপালে চুমু খায়। মিলি চোখ বন্ধ করে শক্ত করে সাদিকের হাতটা ধরে রাখে। যেন দুইজনেই বুঝতে পারছে সামনের পথটা বড় সংগ্রামের হবে তাদের। 

Comments

    Please login to post comment. Login

  • Kazi Eshita 3 months ago

    কি সুন্দর এক দম্পতি, কিন্তু মেয়েগুলোর কপালে কি আছে কে জানে?