সাউন্ড বক্সে জোরে হিন্দি গান বাজছে, স্লো-মোশনে গানের তালে নাচতে নাচতে লাল গালিচার উপর দিয়ে এগিয়ে আসছে লাল টুকটুকে বউ। দূরে মঞ্চে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে কনের দিকে তাকিয়ে আছে সাদা রংয়ের শেরওয়ানি পরা বর।
বিয়েতে দাওয়াতে আসা কয়েকজন একসাথে দাঁড়িয়ে গল্প করছে। তাদের একজন বলে ওঠে, আমাদের সময় তো আমরা লজ্জায় মুখই তুলতে পারতাম না। আর দেখেন আজকালকার মেয়েরা, শ্বশুর-শ্বাশুড়ি, হল ভর্তি মেহমানের সামনে নাচতে নাচতে আসতেছে!
হলের বড় দরজার সামনে ইংরেজিতে লেখা দেখা যায়, ‘Niha Weds Dipto’। পাশে দাঁড়ানো আরেক মহিলা তাচ্ছিল্যের সুরে বলে, কি আর বলব, ভাবী! বাপ মরা মেয়ে তো! বাবার শাসন না থাকলে ছেলেমেয়ে এমনই হয়ে যায়।
মেয়ের বাবা নাই? তো ওই লোকটা কে মেয়ের মায়ের সাথে ঘোরে সারাক্ষণ?
সৎবাবা, ওর মা তো দুইটা বিয়ে করছে!
দীপ্ত ছেলেটা এত ভাল, এত ভদ্র, একটা ভাল পরিবারের মেয়ে খুঁজতে পারে নাই!
পেছনে দাঁড়িয়ে মহিলাদের কথোপকথন শুনছে একটি চব্বিশ-পঁচিশ বছর বয়সী মেয়ে। কিছুটা দূর থেকে মেয়েটিকে ডাকে তার বাবা-মা। সে এগিয়ে বাবা-মায়ের কাছে যায়।
মেয়েটির কাঁধে হাত দিয়ে তাকে এগিয়ে এনে সামনে দাঁড় করায় তার বাবা, সাদিক হোসাইন। আধপাকা চুল আর গাল ভর্তি সাদা-কালো দাঁড়ি নিয়ে হাসিমুখে বলে, এই যে আমার ছোট কন্যা, আনিসা। একটু থেমে পাশে দাঁড়ানো বাকি দুই মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলে, আর এই হল আমার ত্রি-রমনী।
আনিসা বিব্রত চোখে সামনে দাঁড়ানো বয়স্ক দম্পতিকে দেখে। তারা সাদিক সাহেবের বন্ধু আমির সাহেব এবং তার স্ত্রী পারুল।
আমির সাহেব চোখ বুলিয়ে তিন মেয়েকে দেখেন। তিনজনের পরনেই শাড়ি, চেহারায় হালকা সাঁজ। মেয়েদের চেহারা যে প্রাকৃতিকভাবেই সুন্দর তা দেখেই বুঝা যায়। মৃদু হাসি দিয়ে সাদিকের কাঁধে হাত দিয়ে বলেন, তিন মেয়ে হওয়া কিন্তু অনেক ভাগ্যের বিষয়, সাদিক। আমার যে একটা মেয়ের এত শখ ছিল। একটু থেমে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলার ভান করেন। কিন্তু ভাগ্য দেখো, দুই দুইটা ছেলে! আমির সাহেব খানিকটা সান্ত্বনা দেওয়ার মত করে সাদিকের পিঠে মৃদু বারি দিতে থাকে।
আনিসার বিরক্ত বোধ হয়। তাকিয়ে তার বড় দুই বোনকে দেখে। হাসিমাখা মুখে অপরিচিত দম্পতির দিকে তাকিয়ে আছে তারা। সেও জোর করে মুখে হাসি টানে।
আমির সাহেবের স্ত্রী আনিসার মাথায় হাত বুলায়। বেদনার সুরে বলে, আহারে, তিনটা বোন, একটা ভাই নাই।
আমির সাহেব হেসে বলেন, মারজিয়া-আলিশাকে সেই ছোট্ট থাকতে দেখেছি আমি। মামনিরা তো মাশাল্লাহ অনেক বড় হয়ে গেছে। এখন কি করছে তারা?
সাদিক মেয়েদের দিকে তাকিয়ে গর্বের সুরে বলে, এই তো—মারজিয়া অল-ফ্যামিলি হাসপাতালে নিউরোসার্জন হিসেবে আছে। আলিশা অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কিউ গ্রুপে আছে। আর আনিসা সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে ইন্টার্নশীপ শুরু করল ম্যাস্ট্রো গ্রুপে।
মেয়েদের অর্জন বলতে বলতে সাদিকের চোখ দুটো চকচক করে উঠে। যেন মেয়েদের নিয়ে তার গর্বের শেষ নাই।
আমির সাহেবের স্ত্রী ধীরে ধীরে আনিসার মাথা থেকে তার দয়ার হাতটি সড়িয়ে নেয়। খানিকটা সৌজন্যতার হাসি দিয়ে স্বামী আমিরের দিকে তাকায়।
আমির সাহেব জোরপূর্বক হেসে বলে, মেয়েদের বিয়েশাদি দিবা না নাকি, সাদিক? শুধু চাকরি-বাকরি করালে হবে! কণ্ঠে খানিকটা গম্ভীরতা এনে বলেন, মেয়েদের জীবনের পরিপূর্ণতা স্বামীর ঘরেই আসে, বুঝলা!
দিব তো, ভাল ছেলে থাকলে জানিও। একটু থেমে স্টেজের দিকে তাকায় সাদিক। থাকো তাহলে, আমি যেয়ে দেখি কি অবস্থা, কোনো সাহায্য লাগবে কিনা!
বিদায় জানিয়ে সেখান থেকে চলে আসে সাদিক।
আমির সাহেবের স্ত্রী বেশ কয়েকবার তাকিয়ে মেঝ মেয়ে আলিশাকে দেখল। তিন বোনের ভেতর উচ্চতা ও রূপ দুটোই তার বেশি। হাজার খানেক মেয়ের মাঝে সহজেই তাকে আলাদা করা যাবে।
তাকিয়ে থাকার বিষয়টা চোখ এড়ালো না আনিসার৷
তারা চলে গেলে স্বামী আমিরের কাছে গিয়ে মৃদু কণ্ঠে বললেন, এই শুনো না! আমাদের জায়েদের জন্য সাদিক ভাইয়ের মেঝ মেয়েটা কেমন হবে, আলিশা?
আমির সাহেব ঘুরে আরেকবার আলিশাকে দেখলেন। একটু বেশি লম্বা না?
আরে! মেয়ে তো লম্বা হওয়াই ভাল, তাহলে সন্তানরাও লম্বা হবে। কি মায়াভরা চেহারাটা! আমাদের জায়েদের সাথে সুন্দর মানাবে।
আমির সাহেব একটু ভেবে বললেন, সাদিককে বলার আগে তুমি বরং কথায় কথায় মিলি ভাবীকে একবার বলে পরিস্থিতি বুঝে নেও।
খানিকটা দূরে আনিসা আর মিলি একসাথে বসে আছে।
সৌজন্যতার হাসি হেসে তাদের পাশে বসে পারুল। বলে, যত বয়স হচ্ছে তুমি কিন্তু আরও সুন্দর হচ্ছো, মিলি।
আনিসার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে মিলি বলে, আলহামদুলিল্লাহ, পারুল ভাবী। আল্লাহ ভাল রেখেছেন আমাকে।
তিন তিনটা অবিবাহিত মেয়ে ঘরে নিয়ে কিভাবে শান্তিতে আছো, বলো তো? আমি তো পাগল হয়ে যেতাম দুশ্চিন্তায়।
দুশ্চিন্তার কি আছে! বিয়েশাদি আল্লাহর মর্জি। আল্লাহ চাইলে হবেই। হাসিমুখে আনিশার দিকে তাকায় মিলি। বিয়ের কথা কিভাবে তুলবে বুঝতে পারে না পারুল। খানিকটা এদিক-ওদিক দেখে। বিষয়টা মিলির চোখে এড়ায় না। মিলি বলে, পারুল ভাবী, কিছু বলবেন?
ইয়ে মানে—বলছিলাম আমাদের জায়েদের কথা মনে আছে তোমার? মারজিয়া আর ও তো একই স্কুলে পড়ত। একটু থেমে মিলির দিকে তাকায় পারুল। ওর বিয়ের জন্য মেয়ে খুঁজছি, বুঝচ্ছো।
মিলি খানিকটা অবাক হয়েই পারুলের দিকে তাকায়। মনে মনে ভাবতে থাকে হয়ত পারুলের মারজিয়াকে মনে ধরেছে। শান্তকণ্ঠে বলে, পেলেন কাউকে?
পারুল খানিকটা হাসে। এরপর বুঝিয়ে দেওয়ার মত করেই বলে, তোমার মেঝ মেয়েটা কিন্তু বেশ সুন্দর। বিয়েশাদি দিবা না ওকে?
মিলি একটু হকচকিয়ে পারুলের দিকে তাকায়৷ এরপর আনিসার দিকে তাকায়। মেয়েকে খানিকটা আদেশের সুরেই বলে, তোর বোনরা মনে হয় বর-বউয়ের সাথে ছবি তুলতে গেছে, তুইও যা। আনিসা সেখান থেকে উঠে চলে যায়।
পারুল আবার জিজ্ঞেস করে, কি বল, মিলি?
মিলি শান্ত গলায় বলে, আমি ভাবছিলাম আপনি মারজিয়ার কথা বলছেন।
কথাটা পারুলের ভাল লাগে না। তার সোনার টুকরো ছেলে, তাকে কোন আক্কেলে বয়স পেরুনো একটা মেয়ের সাথে বিয়ে দেওয়ার কথা ভাববে তারা! মনে মনে ভাবে, মিলির বোধবুদ্ধি সব গেছে। খানিকটা জ্ঞান দেওয়ার মত করে বলেই ফেলে, মারজিয়াকে তো আরও আগে বিয়ে দেওয়া উচিৎ ছিল তোমাদের। চেহারায় বুঝা না গেলেও মেয়ের বয়স তো কম হয় নাই! বাচ্চাকাচ্চারও তো একটা বিষয় আছে নাকি। একটু থেমে কণ্ঠের গম্ভীরতা দূর করে হেসে বলেন, আলিশার ব্যাপারে ভাব এখন। ওকে বিয়ের বয়স থাকতে থাকতে বিয়ে দাও।
মিলি পারুলের দিকে তাকায়। মনের বিরক্তিটা তার চেহারাও প্রকাশ পায়। মিলি জানে পারুল ভুল কিছু বলছে না তবুও কথাগুলো তার ভাল লাগে না। মনের বিরক্তি চেপে বলে, আলিশার বিয়ে নিয়ে আসলে কখনও ভাবা হয় নাই। মাঝখানে ছিল তো, সারাটা দিন ছেলেদের মত টো টো করে বেড়াত। ওকেও যে একদিন বিয়ে দিতে হবে, মানুষ ওকে নিজের ছেলের জন্য পছন্দ করবে এটা আমার খেয়ালেই আসে নাই। পুরানো স্মৃতি মনে পড়তেই খানিকটা হাসিতে ঠোঁট বেঁকে যায় মিলির।
তাহলে কি বিয়ে দিবা না মেয়েকে? খানিকটা জোর দিয়েই বলে, ভাল ছেলে কিন্তু সব সময় পাওয়া যায় না, বুইঝো।
আমি আপনার ভাইয়ের সাথে কথা বলে জানাব এ ব্যাপারে। মিলি উদ্বিগ্ন চোখে দূরে স্টেজে মেয়েদের হাসিমুখের দিকে তাকায়।
স্টেজে রংবেংয়ের আলোর ঝলকানির মাঝে একখানা স্টান্ডে লাগানো মাইক। হঠাৎ একখানা পুরুষ কণ্ঠস্বর শোনা যায়, ওয়েলকাম অন দ্যা স্টেজ, ভেরি বিউটিফুল অ্যান্ড হিলারিয়াস, দ্যা ওয়ান অ্যান্ড ওনলি আনিসা হোসাইন! অনুষ্ঠান সঞ্চালককে দেখা না গেলেও তার কণ্ঠ শোনা যাচ্ছিলো।
অন্ধকার স্টেজে আলোর ছড়াছড়ির মাঝে আনিসা এসে মাইকের সামনে দাঁড়ালো। পরনে একখানা সরষে রঙয়ের কুর্তি, কালো প্যান্ট আর ঘাড়ের উপর শিফনের একখানা কালো ওরনা ঝুলানো।
হাসি মুখে বলে, হ্যালো, গাইজ। তাচ্ছিল্যের সুরে বলে, আমিই ‘দ্যা ভেরি বিউটিফুল’ আনিশা হোসাইন। জীবনে কোনো স্থানেই আমাকে ‘ভেরি বিউটিফুল’ কেউ কখনও বলে নাই। আজ প্রথম কেউ বল। তাও আবার এমন একটা জায়গায় যেখানে ‘ভেরি বিউটিফুল’ মানে হচ্ছে বেটির শুধু চেহারাটার দেখার যোগ্য, জোক্স এর দ্বারা হয় না!
দর্শকেরা হো হো করে হেসে ওঠে।
আনিসা উপরে কর্নারের দিকে তাকিয়ে অভিমানের সুরে বলে, এগুলা কি, অপু ভাই? বাড়ি ডেকে অপমান! আগে বলতা, আসতাম না!
আবারও সঞ্চালকের কন্ঠস্বর শোনা যায়, আই আম ভেরি স্যরি, আনিসা। গাইজ, ওয়েলকাম অন দ্যা স্টেজ—একটু থেমে চিৎকার করে বলে, দ্যা হিলারিয়াস, আনিসা হোসাইন!
দর্শকেরা হর্ষধ্বনির মাধ্যমে আবারও আনিসাকে শুভেচ্ছা জানায়।
ধন্যবাদ সবাইকে। একটু থেমে একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলে, পেশায় আমি একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার আর এই জন্য একজন কমেডিয়ানও। আমার মনে হয় ইঞ্জিনিয়ারিং এবং কমেডি—একটা প্যাকেজ। ইউ স্টার্ট ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড সাডেনলি ইউর লাইফ বিকামজ অ্যা জোক।
হল ভর্তি দর্শক হো হো করে হেসে ওঠে। দর্শক সারী থেকে একজন বলে, ঠিক ঠিক।
একখানা বিব্রতকর হাসি মেখে আনিসা লোকটির দিকে ইশারা করে বলে, হি ক্যান ফিল মি। ইঞ্জিনিয়ার, ব্রো? দর্শক সারীর ছেলেটি হেসে মাথা নাড়ে। আনিসা হেসে বলে, বুঝেছিলামই। পুরো সপ্তাহ স্ক্রিনের সামনে মাথা ঘষে ঘষে সপ্তাহ শেষে কমেডির নামে আমি ফ্রাস্ট্রেশন ঝাড়তে আসি। আর আমার এই কষ্টের উপর টাকা দিয়ে হাসতে আসেন আপনারা। জীবনটা আসলে এমনই, আপনার দুঃখ-কষ্ট নিয়ে হাসিতামাশা করার মানুষের অভাব হয় না!
আনিসা স্ট্যান্ড থেকে মাইকটা হাতে নিয়ে খানিকটা স্টেজে হাঁটে। গল্পের মত করে বলতে থাকে, আমরা তিন বোন। আমি সবার ছোট। দুই বোনের পর যখন আপনার জন্ম হয়, তখন বুঝ হওয়ার আগেই আপনি বুঝে যান যে কাঙ্খিত আপনি একদমই না, বরং পরিবারের অনেকটা হতাশারই কারন। এক ছেলে সন্তানের আশায় আপনি এই দুনিয়াতে আসছেন– আমার বড় বোনদের চেয়ে আমি শুধু বয়সেই না, সৌন্দর্য, ট্যালেন্ট সকল দিকেই ছোট। জন্মের পরে আমার চেহারা দেখার পর আমার বাবা-মাও বুঝে গিয়েছিল যে এবার বন্ধ করতে হবে— কোয়ালিটি ডাউন খাচ্ছে।
হল ভর্তি মানুষ হো হো করে হেসে ওঠে তার কথায়।
আনিসা বলতে থাকে, আমার দুই বোনই পড়াশোনায় বেশ ভাল। আমার বড় আপু মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষায় পুরো দেশে দ্বিতীয় হয়েছিল।
দর্শকেরা হাত তালি দিয়ে সাধুবাদ জানায়।
আনিসা মুখে গম্ভীরতা এনে বলে, না, না এটা খুশির বিষয় না। আজও সেই সময়টা আমাদের পরিবারের জন্য দুঃস্বপ্নের মত, আমরা এই প্রসঙ্গ কখনও তুলি না। এই দুর্ঘটনার পর মাসব্যপি আমাদের বাড়িতে শোক পালন করা হয়। এই শোকের মাত্রা এতটাই তীব্র ছিল যে আমার চাচা-চাচীরা বাড়ি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়।
মৃদুস্বরে হাসতে থাকা দর্শকের তালির তীব্রতা বেড়ে যেয়ে হর্ষধ্বনিও যুক্ত হয়।
আনিসা বলে, বড় আপু ছোট থেকেই বেশ চুপচাপ, গম্ভীর স্বভাবের। কারো সাথে খুব বেশি কথা বলে না, সবসময় নিজের দুনিয়ায় কোনো ভাবনাচিন্তায় মগ্ন থাকে। সমাজ বলে, মেয়েরা নাকি খুব সহজে কাঁদে। আমি আজ পর্যন্ত কখনও আমার আপুকে কাঁদতে দেখি নাই। কণ্ঠে খানিকটা গম্ভীরতা এনে বলে, আমার সন্দেহ হত বড় আপু হয়ত সাইকোপ্যাথ। এই সন্দেহকে বিশ্বাসে রূপ দিতে আমি প্রতিদিন খুব আশা নিয়ে ওর খাটের নীচে, আলমারিতে লাশ খুঁজতাম, যে কোনোদিন তো মাথা-হাত-পা, কিছু একটা পেয়েই যাব! কিন্তু কিছুই পেতাম না—একটু থেমে দুষ্টু একটা হাসি দিয়ে বলে, কারন ওসব ও হাসপাতালেই রেখে আসত।
হাসি ও তালির আওয়াজে হল মুখোরিত হতে থাকে।
আমার মেঝবোন বড় বোনের ঠিক উলটো। ওর নাম আলিশা কিন্তু এ ভ্রমান্ডের সবাই ওকে ‘আলু’ বলে ডাকে, তাই আমরাও ওকে আলুই ডাকব। আমাদের তিন বোনের ভেতর আলু সবচেয়ে সুন্দর দেখতে। কিছু মেয়ে আছে না যাদের দেখলেই আপনার প্রেমে পড়তে ইচ্ছা করে? আলু ঠিক তেমনই দেখতে।
দর্শক সারী থেকে এক ছেলে চিৎকার করে ওঠে, আইডি! আইডি!
আনিসা রাগান্বিত কন্ঠে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বলে, শোয়ের মাঝে এসব চাইবেন না। হেসে বলে, এসব শোয়ের পরে চাইবেন!
দর্শকরা হেসে ওঠে।
আনিসা হেসে বলতে থাকে, দুর্ভাগ্যবসত ছোটবেলা থেকেই আলুর শখ সে ছেলেদের পৃথিবীর অংশ হবে। ছোট চুল, গায়ে ছেলেদের মত শার্ট-প্যান্ট, তার এসব পছন্দ। স্কুল-কলেজে ডিস্ট্রিক্ট লেভেল বাস্কেটবল খেলোয়াড়ও ছিল সে, তাই শরীরের গঠনও সাধারণ মেয়েদের তুলনায় বৃহৎ। বড় আপু যতটা শান্ত, আলু ঠিক ততটাই উড়নচণ্ডী। আমার বাবা-মায়ের মনে হয়েছিল তিন মেয়ে নিয়ে শান্তিতে থাকবে। কিন্তু সেই শান্তি আলুর হজম হয় নি।
খানিকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলার মত করে বলে, এমন কোনো দিন থাকত না যেদিন স্কুল বা এলাকার কেউ আলুর নামে বিচার দিতে আসত না। হাঁটতে হাঁটতে বলে, একদিন আমি কোচিং থেকে এসে দেখি বাসায় থমথমে পরিবেশ, আলুর চিৎকার করে কান্না করার আওয়াজ আসতেছে। আমি কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে আমার দাদুর ঘরে গেলাম, যেয়ে দেখি দাদু দিব্যি পায়ের উপর পা তুলে পান চিবাচ্ছে। পরবর্তীতে জানতে পারলাম আলুর ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়েছে, সে বুয়েটে তৃতীয় হয়েছে। আলিশা একটু থামে। আমার জন্ম এবং বড় আপুর মেডিকেলে দ্বিতীয় হওয়ার পরে, এটা ছিল আমাদের সংসারের তৃতীয় ট্রাজেডি।
দর্শকেরা হেসে ওঠে।
আলিশা কণ্ঠে জোর এনে বলে, আলুর কষ্ট শুধু এটা ছিল না যে সে প্রথম হতে পারে নি, তার কষ্ট এটাও ছিল যে সে বড় আপুর মত দ্বিতীয়ও হইতে পারে নাই। সেই ব্যাচে বুয়েটের ম্যাকানিক্যাল ডিপার্টমেন্টের একমাত্র মেয়ে ছিল আলু। আর আগেও বলেছি, আলু হচ্ছে আমাদের তথাকথিত সমাজস্বীকৃত সুন্দরী। আমি নিজেও বুয়েট থেকে সিএসি পাশ করেছি তাই আমার ভালোই জানা আছে যে ওরকম একখানা চেহারা ইঞ্জিনিয়ারিং ভার্সিটিতে কতটা দুর্লভ।
একটু থেমে কণ্ঠের অস্থিরতা বাড়িয়ে বলে, আসেপাশের বিভাগ থেকে ছেলেরা আলুকে দেখতে আসত। র্যাগ কর্নারে আলুকে ডেডিকেট করে সিনিয়ররা 'সে প্রথম প্রেম আমার নীলাঞ্জনা' গান চালাত। এই ক্রেজ যদিও খুব বেশিদিন টিকে নাই। নতুন নতুন ছিল তো, তখনও আলুর স্বভাবের সাথে ওরা পরিচিত ছিল না। ক্লাসেও একমাত্র নারী শিক্ষার্থী হওয়ার কারনে আলুকে নানা বৈষম্য ও বিব্রতকর পরিস্থিতির স্বীকার হতে হত। এই সব বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে বের হওয়ার জন্য, আলু চুলে বয়কাট দিয়ে ছেলেদের মত জামাকাপড় পরা শুরু করে। আনিশা দুষ্টু হাসি দিয়ে বলে, এবং হঠাৎ করেই ভার্সিটির অধিকাংশ ছেলের মধ্যে হোমোসেক্সুয়ালিটির প্রবনতা বাড়তে শুরু করে।
তীব্র হাসি, তালি ও চিৎকারের আওয়াজে হলটা কেঁপে ওঠে।
আনিসা হাসতে হাসতে বলে, এই রকম দুইজন মানুষের সাথে বড় হওয়া সহজ ছিল না। একটু থেমে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, আমার দুই বোনই কট্টর নারীবাদী। যখন আপনার বড় দুই বোন নারীবাদী হয়, তখন আপনার কাছে আর খুব বেশি চয়েজ থাকে না। এছাড়াও বোনদের তুলনায় আমি খুবই সাধারন। তাদের রূপ-গুন কোনো কিছুর সাথেই আমি পেরে উঠি না। মেডিকেলের দিকে তাকানোর মতও জ্ঞান আমার ছিল না। জায়নামায চোখের পানিতে ভিজিয়ে কোনোভাবে বুয়েটে চান্স পেলাম। মেঝ বোনের নাম বেঁচে, ফ্যাকাল্টিদের হাতে-পায়ে ধরে গ্রাজুয়েশন শেষ করলাম। এখন বুয়েটের নাম বেঁচে একখানা চাকরি জুটিয়েছি। ওতে হয় না তাই পেটের দায়ে মাঝে মাঝে এদিকেও আসতে হয়। তবে নিঃসন্দেহে আমার বোনদের কারনেই আমি এতটা দূর আসতে পেরেছি।
কণ্ঠে কিছুটা বেদনা এনে বলে, কিন্তু কষ্ট কখন হয় জানেন? এই বয়সে এসেও যখন আমি টিভিতে নিজের পছন্দের একটা রোমান্টিক মুভি দেখতে পারি না। ঘরের ভেতর দুই দুইটা ফেমিনিস্ট নিয়ে নায়ক নায়িকাকে থাপ্পড় মারার পরও নায়িকার কেঁদে কেঁদে তাকেই জড়ায়ে ধরার সীন আমি কিভাবে দেখব বলেন!
দর্শকেরা জোরে তালি দিয়ে দিয়ে হাসতে থাকে।
হালকা কোকড়া চুলগুলো উপরে তুলে খোপা করা। পরনে গাড় নীল ফুল হাতার শার্ট আর মাটি রঙয়ের গ্যাভাইডিংয়ের প্যান্ট। কোনো প্রকার কৃত্রিমতা ছাড়া চেহারাটা সূর্যের আলোতে চকচক করে ওঠে। চেহারায় উদাসীনতা আর কানে এয়ারফোন লাগিয়ে বসে আছে আলিশা। বাসের জানালায় হাত রেখে চোখ বন্ধ করে বাতাস উপভোগ করছে সে।
বাসের হেল্পার চিৎকার করে বলে, কিউটার্ন নামেন কিউটার্ন!
আলিশা কান থেকে এয়ারফোন নামিয়ে উঠে দাড়ায়। সীটের পাশে দাঁড়ানো লোকটা ঘাড় বাঁকিয়ে আলিশাকে দেখে৷ বাস থেকে নামার সময় তার সীটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এক ১৮/১৯ বছরের ছেলের দিকে তাকায়। ছেলেটা আলিশার তাকানো দেখে বিব্রত বোধ করতে থাকে। চটজলদি বাস থেকে নামার চেষ্টা করে কিন্তু তা আর সম্ভব হয় না। ওর কলারটা ধরে হেঁচকা টান দেয় আলিশা৷ টেনে বাস থেকে নামায় ছেলেটাকে।
ছেলেটা চিৎকার করে বলে, আপা, ছাড়েন! ছাড়েন! আমি কিছু করি নাই!
স্বজোরে গাল বরাবর দুই-তিনটা চড় মারে আলিশা। রাস্তার পাশে মানুষ জড়ো হতে থাকে। কয়েকজন মোবাইল বের করে ভিডিও-লাইভ করতে থাকে।
এক লোক আলিশার মুখে সামনে মোবাইলের ক্যামেরাটা ধরে জিজ্ঞেস করে, কি হয়েছে, আপু? ওকে মারছেন কেন?
আলিশা কিছু না বলে বিরক্তির সাথে তাকায় তার দিকে। বাস থেকে টেনে নামানো ছেলেটাকে মাথা বরাবর বারি দিয়ে জোরে ধমক দেয়, বল, তোকে মারছি কেন? তাড়াতাড়ি বল!
ভিড় থেকে একজন বলে ওঠে, পকেট মারছে? এদিকে দেন, ওরে আমরা সাইজ করতেছি!
আলিশা ছেলেটার দিকে তাকিয়ে হুমকি দেওয়ার সুরে বলে, ছেড়ে দিব তোকে এই ভিড়ে? ভালমত সাইজ করার জন্য?
ছেলেটা কাঁদতে কাঁদতে বলে, না, না, আমি পকেট মারি নাই! বিশ্বাস করেন আমি পকেটমার না! বাসে সামনে দাড়ায়া থাকা এক মেয়ের বুকে হাত দিসিলাম শুধু। আর জীবনে করব না—আমারে মাফ করে দ্যান।
ভীড় থেকে এতক্ষণ তড়িগড়ি করে মারতে আসতে চাওয়া জনতার উদ্বেগ এখন একটু কমে গেছে মনে হল। আলিশা ছেলেটার কলারটা ধরে আরও কয়েকটা চড়-থাপ্পড় দেয়।
ছেলেটার কান্না দেখে আসেপাশের কয়েকজন আলিশাকে অনুরোধ করতে থাকে, থাক, আপু, মাফ করে দিন। ও আর করবে না।
আলিশা রাগী চোখে তাদের দিকে তাকিয়ে বলে, কেন? এখন আর সাইজ করার ইচ্ছা নাই ওকে? আজকে যদি ছেলেটা আপনাদের কারো পকেট মারত, তাহলে কি তাকে এত সহজে ছেড়ে দিতেন? একটু থেমে ভিড়ের সবার মুখের দিকে তাকায় আলিশা। তখন অনেক মারতেন, মেরে হাত-মুখ ভেঙে দিতেন। ‘আর করব না’—বলেই ছাড়া পেত না। আলিশা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে, কিন্তু এক মেয়ের ইজ্জতে হাত দিয়েছে তাতে আপনাদের কিচ্ছু যাচ্ছে-আসছে না। কারন আপনারা মনে মনে ধরে নিয়েছেন, মেয়ে মানুষ ঘর থেকে বের হলে তো এমন হবেই, টাইট জামাকাপড় পরলে ছেলেরা গায়ে হাত দিবেই! ছেলেটার পিঠে শেষ একটা জোরে থাপ্পড় মেরে ওকে ছেড়ে দেয় আলিশা। ঘৃণা চোখে ভিড়ের দিকে তাকিয়ে বলে,আপনাদের কাছে আমাদের সম্মানের চাইতেও দুইটা টাকার মূল্য বেশি! মানুষজন দ্রুত সড়ে পরে সেখান থেকে।
আলিশা হেঁটে সামনের বড় বিল্ডিংটাতে ঢোকে। রিসেপশনের উপর বড় করে লেখা ‘কুরেইশি গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ’। হেঁটে লিফটের কাছে এরপর আন্ডারগ্রাউন্ডে যায়।
আলিশাকে আসতে দেখে আধপাঁকা খোঁচা খোঁচা চুলের মধ্যবয়স্ক এক লোক বলে, ইউ আর লেইট! এক্সাক্টলি সেভেন মিনিটস! লোকটির চেহারায় উষ্কখুষ্ক ভাব, চোখে ঘুমের অভাব। যেন কত রাতের ঘুম বাকি পড়ে আছে। একখানা ইঞ্জিনের সামনে চেয়ার পেতে বসে আছেন তিনি। পরনে গাড় নীল রংয়ের ফ্যাক্টরি পোষাক যাতে সাদা উজ্জ্বল সুতার বুননে তার নাম লেখা, ‘ইব্রাহিম খলিল’। এখানকার চিফ ইঞ্জিনিয়ার।
অপেক্ষা করার জন্য ধন্যবাদ, চিফ। দরজার পাশে ঝুলানো কাজের পোষাকটা পরে নেয় আলিশা৷ চোখে সেফটি গ্লাসটা পরে একটা চেয়ার টেনে খলিলের পাশে বসে৷
আলিশার দিকে তাকিয়ে খলিল বলে, এত এত ইঞ্জিনিয়ারিং ফিল্ড থাকতে অটোমোবাইল কেন, আলিশা হোসাইন?
আলিশা এক প্রকার অবহেলা করে তার প্রশ্নটাকে। সামনের ইঞ্জিনটার দিকে তাকিয়ে কিছু ভাবতে থাকে। কিছু মুহুর্ত পরেও যখন খলিল তার দিক থেকে মুখ ঘোরায় না, তখন খানিকটা বিরক্ত হয়েই খলিলের দিকে তাকায়। বলে, আমি কখনও আপনাকে জিজ্ঞেস করেছি আপনি কেন বিয়ে করেন নি? যখন আমি আপনার জীবনের সিদ্ধান্তে নাক গলাচ্ছি না, আপনি কেন রোজ রোজ আমাকে এই প্রশ্নটা করেন?
খলিল খানিকটা হেসে সামনে তাকায়। বলে, নারীরা খুব সহজে বিভ্রান্তির স্বীকার হয়। তাই তাদের ক্রমাগত মনে করাতে হয় কেন তারা একটা কাজ শুরু করেছে। কেন তুমি এই পথে আসলে, কেন এই পথে হাঁটছ, এসব মনে রাখতে হয়। নাহলে পথে হারানোর সম্ভবনা থাকে। সেফটি গ্লাসটা ঠিক করতে করতে বলে, তুমি যদি জিজ্ঞেসও কর আমি কেন বিয়ে করি নি, আমি কিছু মনে করব না। আমার জীবন ওতটা গোপন কিছু না। আলিশার দিকে তাকিয়ে বলে, জানতে চাও?
আলিশা যথেস্ট বিরক্তির সুরে বলে, নাহ!
খলিল হাতের প্লাসটা নাড়তে নাড়তে বলে, তবে এবার বল।
আলিশাটা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। শুনেছিলাম ম্যাকানিক্যালে নাকি মেয়েরা পড়ে না, এটা ছেলেদের সাবজেক্ট। ছোট থেকেই ছেলেদের জীবন আমার ভাল লাগত। সেই আগ্রহ থেকেই ম্যাকানিক্যাল, আর এখন অটোমোবাইল। সেই ব্যাচে বিভাগে আমি একমাত্র মেয়ে ছিলাম, আমার কর্মক্ষেত্রেও আমি একমাত্র নারী এই বিভাগে—কোথাও কোনো মেয়ে নেই। ছেলেদের পৃথিবীর অংশ আমি। চলবে? আলিশার কণ্ঠে বিরক্তি স্পষ্ট।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে খলিল বলে, কারনের চেয়ে কাহিনী বেশি। তবে আজকের জন্য চলবে। আদেশের সুরে বলে, গ্রাভ দ্যা ক্যালিপার! আলিশা পাশ থেকে ক্যালিপারটা নিয়ে খলিলের হাতে দেয়।
মারজিয়া হাত এগিয়ে দেয়, হাতের সাদা গ্লাভসটাতে ছিটেছিটে রক্ত লেগে আছে। তার হাতে ছোট স্টিলের একখানা যন্ত্র দেয় পাশে দাঁড়ানো স্ক্রাব নার্স। স্থির চোখে ক্লিপস লাগানো চিড়ে রাখা মাথাটার দিকে তাকায় মারজিয়া। পাশে দাঁড়ানো আরেকজন পুরুষ নার্স একটু পর পর অল্প অল্প করে বেড়িয়ে আসা রক্তটা মুছে দিতে ব্যস্ত। আড় চোখে তারা মারজিয়াকে দেখে। হাতে এতটুকু অপ্রয়োজনীয় গতি নেই। তার এই স্থিরতা যেন এক মায়াজাদু। নিজ চোখে না দেখলে কেউ বিশ্বাসই করতে পারবে না যে এমন স্থির মানুষও পৃথিবীতে আছে। অপারেশন থিয়েটারটা গ্লাসস্ক্রিনে ঢাকা। একটু উচ্চতায় গ্যালারির মত একখানা জায়গা আছে। যেখানে বসে অন্যান্য ডাক্তাররা লাইভ সার্জারি দেখতে পারেন। দুইখানা স্ক্রিনে সার্জারির ক্লোজআপ দেখা যাচ্ছে। নিপুণতারসহিত সার্জারি করে যাচ্ছে মারজিয়া।
গ্যালারিতে বসে আছে সার্জন জারিন খান ও হাসপাতালের ডীন সার্জন ওয়াসিম জামান। জারিন গম্ভীর মুখে মারজিয়াকে দেখে যাচ্ছে।
আড়চোখে একবার জারিনের দিকে তাকায় ওয়াসিম। সামনে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলে, ইউ আর বেটার দ্যান হার।
আই নো।
বিষয়টা এমন যে সার্জন হোসাইন যতই পারদর্শী হোক, দিনশেষে সে মানুষ, আর তুমি—শয়তান। জোরে জোরে হাসতে থাকে ওয়াসিম।
জারিন তার কথাটায় খুব বেশি কান দেয় না। মনোযোগ দিয়ে সার্জারিটা দেখতে থাকে।
ওয়াসিম বলে, বাংলাদেশে মাত্র তিনজন নারী নিউরোসার্জান আছে, মিস খান। তার ভেতর একজন ঢাকা মেডিকেলের রেজিনা হামিদ আর বাকি দুইজন আমাদের হাসপাতালে, তুমি এবং মারজিয়া হোসাইন।
জারিন অনাগ্রহের সহিত ওয়াসিমের দিকে তাকায়। তো?
ঘর থেকে বের হলে মেয়েদের জন্য সহজ একটা রাস্তাও খুব কঠিন হয়ে যায়। তোমাদের দুইজনের আর্থসামাজিক অবস্থা আলাদা হলেও, দুইজনের কারো জন্যই এই রাস্তাটা সহজ ছিল না। তাই আমি চাই তোমরা হিংসা না করে একজন আরেকজনকে সাহায্য কর, দুইজনই সামনে এগিয়ে যাও। ঠোঁটে মিষ্টি একখানা হাসি টেনে বলে, তোমাদের দেখে আরও নারীরা ভরসা পাক, স্বপ্ন দেখতে শুরু করুক।
গম্ভীর কণ্ঠে সামান্য তাচ্ছিল্যের সুর টেনে জারিন বলে, স্ত্রীর সাথে সাথে আপনিও রাজনীতিতে নাম লেখাচ্ছেন নাকি? নারী ও শিশু মন্ত্রনালয়? সামান্য হেসে বলে, আপনার থেকে এ ধরনের সুন্দর সুন্দর কথা শুনতে আমি অভ্যস্ত নই। আপনি সেক্সিস্ট কথাবার্তা বলবেন, কথায় কথায় বিব্রতকর জোক্স বলবেন, সেই সার্জন জামানের সাথে আমি বেশি পরিচিত।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ওয়াসিম বলে, পৃথিবী ভর্তি মানুষ আমায় শুধু ভুলই বুঝে গেল।
আর কথা না বাড়িয়ে সামনে তাকায় জারিন। ওয়াসিম একবার জারিনের দিকে তাকিয়ে আবার মারজিয়ার দিকে তাকায়।
অল ফ্যামিলি হাসপাতাল, শহরের সবচেয়ে দামী প্রাইভেট হাসপাতাল। দেশ-বিদেশের নামকরা ডাক্তাররা এখানে বসেন, সার্জনরা অপারেশন করেন। সাধারন মানুষের পক্ষে এ হাসপাতালের করিডোরে দাঁড়ানোরও সামর্থ্য হয় না। পৈতৃকসূত্রে এ হাসপাতালটি জামান পরিবারের। যদিও এককালে এটিও আর আট-দশটা প্রাইভেট হাসপাতালের মতই ছিল, মধ্যবিত্তের সাধ্যের কিছুটা উর্ধ্বে। কিন্তু জামান পরিবারের ভাগ্য খোলে যখন তাদের বড় মেয়ে, ওয়াসিমের বড় ফুপুর বিয়ে হয় দেশের সবচেয়ে এবং দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম ধনী ব্যবসায়ী দাউদ কুরেইশীর সাথে। বিষয়টাকে বিয়ে না বলে দুটি পরিবারের মাঝে ব্যবসায়িক লেনদেন বললেই হয়ত বেশি ভাল হয়। বিয়ের মাধ্যমে কুরেইশী পরিবার পায় একখানা ভাল পরিবারের শিক্ষিত ডাক্তারি ডিগ্রিওয়ালা বউ যে তাদের কথায় উঠবে-বসবে এবং জামান পরিবার পায় ব্যবসায়িক-আর্থিক সহায়তা। পলকে ভাগ্য বদলে যায় জামান পরিবারের সকলের। সাথে তাদের বড় মেয়ে রাজিয়া জামানেরও। সারাজীবনের জন্য সোনার খাঁচায় বন্দী তোঁতা পাখি হয়ে যায় সে।
দীর্ঘ পাঁচ ঘন্টা পর অপারেশন থিয়েটার থেকে বের হয়ে একে একে সকলে মাথার ক্যাপ, মুখের মাস্ক ও হাতের গ্লাভস খুলে ফেলেন। মারজিয়া এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এক মধ্যবয়স্ক পুরুষ ডাক্তার মৃদু হেসে বলে, গুড জব, সার্জন হোসাইন! মারজিয়াও হেসে তার দিকে তাকায়।
যতদূর চোখ যায় ট্রাফিক জ্যাম। গাড়ির জানালা দিয়ে বাহিরে তাকায় মারজিয়া। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটা পাবলিক বাস দেখে তার বোনদের কথা ভাবে। তারা ঠিকমতো বাসায় পৌছালো কিনা সে চিন্তা আসে। সামনে থাকা মোবাইল থেকে আনিসাকে ফোন করে।
ফোনের ওপাশ থেকে আনিসা জিজ্ঞেস করে, হ্যালো, আপু? কতদূর এলি?
রাস্তায় আছি। আরেকটু সময় লাগবে। তুই বাসায় পৌঁছেছিস? মারজিয়ার কণ্ঠ ক্লান্তি ভরা।
হ্যাঁ, একটু আগেই এলাম। বাবা আর আলুও এসে পরেছে।
মাকে জিজ্ঞেস কর কিছু লাগবে কিনা।
আচ্ছা দাঁড়াও। ফোন হোল্ডে রেখে মায়ের কাছে যায় আনিসা।
মিলি ফোনটা হাতে নিয়ে কানের কাছে ধরে। মারজু, শোন, লবন আর ডিম নিয়ে আসিস। আর একটা কি যেন লাগত—মিলি মনে করে করে বলে, ওহ হ্যাঁ, ধনেপাতা গুড়া নিয়ে আসিস এক প্যাকেট।
ঠিক আছে, মা। মারজিয়া ফোন রেখে সামনে তাকায়। দুই চোখ ভরে তার ঘুম নেমে আসতে চায়। জোর করে নিজেকে জাগিয়ে রাখে। কিছুক্ষণের ভেতরই জ্যাম ছেড়ে দেয়। দ্রুত গাড়ি চালিয়ে রওনা দেয় মারজিয়া।