Posts

উপন্যাস

ত্রি-রমনী (পরিচ্ছেদ ০২)

June 16, 2025

M. Khanam

82
View

বসার ঘরের টিভিতে সংবাদ চলছে। দেয়ালে ঝুলতে দেখা যায় বেশ কয়েকটি ছবি। তিন বোনের ছোটবেলার ছবিই বেশি। তাদের স্পোর্টস ডে, রেজাল্ট ডে, জন্মদিন ইত্যাদি। মারজিয়ার সাদা এপ্রোণ পরা একটি ছবি, আলিশার বাস্কেটবলের জার্সি পরা ট্রফি হাতে, মেডেল গলায় একটি ছবি, আনিসার সিন্ড্রেলার ড্রেস পরা জন্মদিনের কেকের সাথে একখানা ছবি। পাশেই শোকেজে সারি করে সাজানো ক্রেস্ট, মেডেল ও ট্রফি। পরিপাটি করে গুছানো আছে বসার ঘরটা। সোফায় শুয়ে-বসে আছে তিন মেয়ে ও তাদের বাবা। মারজিয়ার কোলে আনিসা মাথা রেখে শুয়ে টিভি দেখছে আর মারজিয়া হাতে একটা মেডিকেলের বই নিয়ে পড়ছে। পাশের সোফাতে এক পা উপরে তুলে শুয়ে আছে আলিশা। সিঙ্গেল সোফাটাতে বসে মনোযোগ সহকারে সংবাদ দেখছে সাদিক। 

পাশের রান্নাঘর থেকে মিলি একটা পাকোড়ার প্লেট হাতে আসে। আলিশার পায়ে একটা বারি দিয়ে প্লেটটা টেবিলে রাখে৷ রাগান্বিত সুরে বলে, এইসব অভ্যাস কি তোর ঠিক হবে না! তোরে কেউ মেয়ে বলবে!

আলিশা বসতে বসতে বলে, মানুষ বললেই কি আর না বললেই বা কি! হাত বাড়িয়ে পাকোড়ার প্লেট থেকে একটা পাকোড়া তুলে কামড় দেয়। আনিসাও উঠে প্লেটটা বাবার দিকে এগিয়ে দেয়, সাদিক টিভির দিকে তাকিয়ে প্লেট থেকে একখানা পাকোড়া তুলে নেয়। আনিসা প্লেটটা টেবিলে রেখে দুটো পাকোড়া নেয়। একটা নিজে খায়, অন্যটা মারজিয়াকে খাইয়ে দেয়। মারজিয়া মনোযোগ দিয়ে বই পড়ছে আর চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছে। আলোচনার দিকে তার মনোযোগ নেই। 

মিলি মারজিয়ার পাশে বসে বইয়ে উঁকিঝুঁকি দিয়ে কি পড়ছে বুঝার চেষ্টা করে। কিছু না বুঝে বিভ্রান্তিমাখা চোখে বলে, তোদের এখন বয়স হয়েছে। ভবিষ্যতের ব্যাপারেও ভাবতে হয়। 

মায়ের কথা শুনে আলিশা মুখ ভেঙ্গিয়ে আরও দুটো পাকোড়া হাতে নিয়ে আবার পা উপরে তুলে শুয়ে পরে।

টিভির স্ক্রিনে এক মহিলাকে দেখে মারজিয়ার বইয়ে হালকা বারি দেয় আনিসা। বলে, আপু, দেখ তোদের ডীনের বউ! 

সবাই টিভির স্ক্রিনে তাকায়। সংবাদে এক প্রেস কনফারেন্সে কথা বলছে দেশের বর্তমান পরিকল্পনা মন্ত্রী আয়েশা চৌধুরী। কালো পারের সবুজ একখানা শাড়ি পরনে তার। পরিপাটি করে চুল পেছনে বাঁধা। চোখে চিকন ফ্রেমের চশমা। আয়েশা চৌধুরী সাবেক প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী রফিক চৌধুরীর নাতনি। মারজিয়া কিছুক্ষণ টিভির দিকে তাকিয়ে থাকে।

আনিসা বলে, মহিলাটা কিন্তু বড্ড সুন্দর! কি সুন্দর করে কথা বলে!

মারজিয়া টিভি থেকে চোখ সড়াতে সড়াতে বলে, হুম—প্রথম শুনে ভেবেছিলাম ব্যাটা মজা করছে। পরে দেখি আসলেই তার বউ। একটু থেমে বইয়ের পাতা উল্টায়। বিরক্তের সুরে বলে, আমার খুব ইচ্ছা তাকে জিজ্ঞেস করব, কি দেখে এই ব্যাটাকে বিয়ে করছে!

তোর দেখা হয়েছে কখনও তার সাথে?

না।

আনিসা আর কিছু বলে না। আলিশা একবার মারজিয়ার দিকে তাকিয়ে আবার টিভির স্ক্রিনে মনোযোগ দেয়। 

মিলি বিরক্তির সাথে আলিশার দিকে তাকায়। আদেশের সুরে বলে, আলু, পা নামিয়ে সুন্দর করে বস! আলিশা তার কথায় কান না দিয়ে ওভাবেই শুয়ে থাকে। 

আনিসা রিমোট দিয়ে টিভির চ্যানেল পরিবর্তন করতে থাকে। সাদিক ধমকের সুরে বলে, সংবাদটা বদলালি কেন! খেলাধুলার সংবাদটা বাকি আছে এখনও! আনিসা আবার সংবাদের চ্যানেলে যায়।

মিলি একবার সাদিকের দিকে তাকিয়ে আবার আলিশাকে ধমক দেয়, এই তোকে পা নামাতে বললাম না! তুই কি কসম কেটেছিস যে আমার কোনো কথা কানে নিবি না!

আলিশা বিরক্তির সাথে পা নামিয়ে উঠে বসে। তোমার আজ হঠাৎ কি হল বল তো? শুধু শুধু আমার সাথে এমন করছো কেন?

টিভির দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক-সাধারন কোনো কথা বলার মত করে আনিসা বলে, তোর জন্য একটা বিয়ের সমন্ধ এসেছে এই জন্য। মারজিয়া বাদে সকলে হকচকিয়ে আনিসার দিকে তাকায়।

অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকায় আলিশা। বলে, বিয়ের সমন্ধ! 

মিলি থতমত খেয়ে আনিসার দিকে তাকায়। এখনও এ ব্যাপারে সাদিককে জানায় নি সে। তাই বাবার সাথে কথা না বলে মেয়েকে আগে বলতে চাচ্ছিলেন না। কিন্তু বিষয়টা হাঁটে হাড়ি ভাঙ্গার মত সামনে চলে এলো। নিজেকে সামলে নিল মিলি। বিষয়টা উড়িয়ে দেওয়ার মত করে বলে, ওমন কিছু না। 

আলিশা রাগী চোখে আনিসার দিকে তাকায়। আনিসা মায়ের দিকে তাকিয়ে উঠে বসতে বসতে বলে, কেন কেন? আমির আঙ্কেলের বড় ছেলেটার কথা না বলল দীপ্ত ভাইয়ের বিয়ের দিন। 

সাদিক বউয়ের দিকে তাকায়। মিলি বিব্রতবোধের সাথে সাদিকের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। আলিশা অবাক চোখে মায়ের দিকে তাকায় বিষয় সম্পর্কে জানতে। 

মিলি নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, ঘরে মেয়ে থাকলে তো এমন টুকটাক হয়। তবে বিয়ে-শাদি তো আজ না হয় কাল হবেই। তাই একটু মেয়েদের মতো আচরন কর, আলু! 

সাদিক কিছু না বলে উঠে ভেতরের ঘরে চলে যায়। 

আনিসা বাবার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলে, খেলার সংবাদটা এখনও বাকি আছে তো—আলিশা চোখ রাঙ্গিনে তার দিকে তাকাতেই চুপ হয়ে যায় আনিসা। 

আড় চোখে মায়ের দুশ্চিন্তামাখা চেহারাটা দেখে মারজিয়া। মিলি বুঝতে পারে বিষয়টা ঠিক হল না। হাজার হোক আমির সাহেব সাদিকের বেশ পুরানো বন্ধু। মিলি কি করবে বুঝতে না পেরে আলিশার দিকে তাকায়। বলে, আমরা এখনও কিছু বলি নি এ ব্যাপারে। বিয়ে-শাদির ব্যাপার, ভেবেচিন্তে আগাতে হয়।

আলিশা চেঁচিয়ে বলে, আমি বিয়ে করব না!

মারজিয়া বইটা নীচে নামিয়ে রাখতে রাখতে বলে, কেন বিয়ে করবি না? 

বাহ রে! তুই নিজেও তো বিয়ে করিস নি। বুড়ি হয়ে যাচ্ছিস, নিজের বিয়ের খবর নাই আমাকে নিয়ে নাচানাচি! আমি কোনো বিয়েশাদি করব না! আলিশা রেগে সোফা থেকে উঠে নিজের রুমের দিয়ে পা বাড়ায়। 

মারজিয়া আদেশের সুরে বলে, আলু, বস!

আলিশা ঘুরে বড় বোনের দিকে তাকায়। মারজিয়া যথেষ্ট ঠান্ডা মাথার মানুষ। তার গলার স্বর কখনও নির্দিষ্ট ডেসিম্যালের উপরে যায় না। অন্যদিকে আলিশা তার পুরোই উল্টো৷ পান থেকে চুন খসলেই চিৎকার চেঁচামেচি করে বাড়ি মাথায় তোলে৷ 

মারজিয়া গম্ভীর দৃষ্টিতে আলিশার দিকে তাকিয়ে থাকে। রাগে ফোসফাস করতে করতে আবার সোফায় এসে বসে আলিশা। মারজিয়া জেরা করার মত করে প্রশ্ন করে, কেন বিয়ে করবি না? 

আমার দ্বারা বিয়েশাদি হবে না! কবে বেঁচেছি আমি মেয়েদের মত যে হুট করে আজকে তোমরা আমাকে কারো বাড়ির বউ হতে বলছো? স্বামী-সন্তান, ঘর-সংসার কি চারটিখানি কথা নাকি! 

মিলি চুপচাপ মারজিয়ার পাশে বসে তাদের কথা শোনে। ছোট দুই মেয়ের যে তাদের বড় বোনের সামনে এক চলে না তা সে ভাল করেই জানে। তাকিয়ে মারজিয়াকে দেখে। 

মিলির মনে হতে থাকে এই তো সেই দিন সে বুঝতে পারল পৃথিবীতে তার জন্য কেউ আসছে। মিলি খুব করে চেয়েছিল যেন যে আসবে সে যেন মেয়ে হয়। কিন্তু তার মত নয়। তার চেয়ে একদম ভিন্ন। সেসময় ম্যাগাজিন পড়ার শখ ছিল মিলির। দেশ তখন তোলপাড় এক নারীর নামে। দেশের সবচেয়ে বড় শিল্পপতির ছেলে দাউদ কুরেইশির সাথে দীর্ঘদিনের সম্পর্ক ভেঙ্গে দিয়েছিল যে নারী। তার নাম ছিল, "মারজিয়া খান"। মারজিয়া খান ধনদৌলত বা ভালবাসা বেছে নেয় নি, সে বেছে নিয়েছিল নিজেকে, নিজের আত্মসম্মানবোধকে। বসে বসে পুরোটা দিন মারজিয়া খানের ইন্টারভিউগুলো পড়ত তখন মিলি। মনে মনেই ভেবে নিয়েছিল, তার যদি একখানা মেয়ে হয় তবে সেই মেয়ের নাম রাখবেন, মারজিয়া। মারজিয়া তার মা মিলির মত হবে না, হবে মারজিয়া খানের মত সাহসী, আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন। মেয়ের দিকে তাকিয়ে সে বুঝতে পারে আল্লাহ তার মনের আশা পূরণ করেছে। মারজিয়া মায়ের মত হয় নি। হয়েছে একদম ভিন্ন। 

মারজিয়া কিছুক্ষণ বোনের দিকে তাকিয়ে থেকে শান্ত গলায় বলে, তোকে দিয়ে কি করাবে শ্বশুরবাড়িতে যে তুই পারবি না? রান্নাবান্না, ঘরের কাজ পারিস না? অকর্মক তো বানায় নি তোকে! 

আলিশার চোখ দুটো রাগে-জেদে লাল হয়ে যায়। গলার কণ্ঠস্বর আরও কয়েক ডেসিমেল উপরে চলে যায়। চেঁচিয়ে বলে, অকর্মক বানাস নি, কিন্তু মেয়েও হতে দিস নাই। রাগে চোখে পানি চলে আসে আলিশার। কণ্ঠের জড়তা কথায় ফুটে ওঠে। তুই—তুই আমার লম্বা চুল কেটে দিয়েছিলি, কারন তোর ভাই লাগত! তাই আমি তোর ভাই হয়েই বেঁচেছি সারাজীবন! 

মারজিয়ার দৃষ্টি স্থির, কণ্ঠ শান্ত। মৃদুকণ্ঠে বলে, শুধু চুল কেটেই যদি ছেলে হওয়া যেত তাহলে পৃথিবীতে কোনো মেয়ে থাকত না! একটু থেমে রাগী চোখে বোনের দিকে তাকায়। এইসব ছোটবেলার কথা তুলে কি বুঝাতে চাস, অত্যাচার করেছি আমি তোর উপর? 

তাই করেছিস! তোর জন্য আমি কখনও মেয়ের মত জীবনযাপন করতে পারি নাই! গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে আলিশার। নাক টেনে বলে, এত কথা আমি বলতে চাই না। আমি বিয়ে করব না এটা আমার চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত! উঠে নিজের রুমের দিকে চলে যায় আলিশা। দূর থেকে জোরে দরজা লাগানোর আওয়াজ শোনা যায়। 

মারজিয়া চুপচাপ বসে মেঝের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। নিজেকে দোষী মনে হয় তার। সত্যিই ছোট থেকে আলিশার সাথে অনেক অদ্ভুত আচরণ করেছে সে। মারজিয়ার শখ ছিল তার ভাই হবে। দুই দুইটা বোন যেন সে মানতেই পারত না। তাই ছোটবেলায় একদিন রাগে-ক্ষোভে নিজের এবং আলিশার চুল কেটে দিয়েছিলো মারজিয়া। মারজিয়ার অনুশোচনা হয় সে দিনটা নিয়ে। কিন্তু যা হয়ে গেছে তা কি আর বদলানো যায়! 

আনিসা তাকিয়ে বড় বোনকে দেখে। কি করবে বুঝতে না পেরে হাতের পাকোড়াটা বোনের মুখের সামনে এগিয়ে ধরে বলে, আলু তো এমনই, শুধু ত্যাড়া ত্যাড়া কথা। তুই পড় আর পাকোড়া খা, আপু!

মারজিয়া ওর হাত থেকে পাকোড়াটা নেয়। বলে, প্লেটটা নিয়ে ওর রুমে যা। না খেয়ে চলে গেল। ওর পছন্দ এসব। 

মারজিয়ার কণ্ঠস্বরটা এতটা শান্ত যে আনিসার গা শিরশিরিয়ে ওঠে। তাদের বয়সের পার্থক্য দশ বছর। খানিকটা কোলে-পিঠেই তাকে বড় করেছে মারজিয়া। তবে ছোট থেকে বোন বড়কে খানিকটা ভয় পায় আনিশা। কারনটা মারজিয়ার স্বভাব। অসম্ভব রকম ঠান্ডা মাথার মানুষ, যেন সাইকোপ্যাথ। নিজের বোন বলে শব্দটা মুখে আনে না আনিসা। তবে মাথায় প্রতিনিয়তই আসে। চাকুরীর সুবাদে মানুষের মগজ নিয়েও খেলার সুযোগ তো পেয়েই যায়। কোনো দিন যদি এটা সামনে আসে যে হাসপাতালের আড়ালে মারজিয়া আসলে এক সিরিয়াল কিলার, তাহলেও খুব বেশি অবাক হবে না আনিসা। 

প্লেটটা নিয়ে আলিশার রুমের দিকে তাকায় আনিসা। ফিরে আবার মারজিয়ার দিকে তাকায়। তার চোখেমুখে দুশ্চিন্তার ছাপ। 


 

মিলি একবার মেয়েদের দিকে তাকিয়ে ধীরে উঠে সোবার ঘরে যায়। ঘরে বিচলিত হয়ে পায়চারী করছে সাদিক। মিলিকে দেখে রাগী চোখে তাকায় সে। 

মিলি মৃদুস্বরে বলে, আমি তোমাকে বলতাম, আসলে সময়-সুযোগ হয়ে ওঠে নি— 

সাদিক খানিকটা বিস্ময়ের সুরে বলে, তোমার কি আমিরের ছেলেকে পছন্দ না? ওদের পরিবার পছন্দ না? তার কথাতেই বুঝা যায় যে ছেলে এবং পরিবার, দুটোই তার বেশ পছন্দ। তাই মিলির এই দ্বিধা তার পছন্দ হচ্ছে না। 

পছন্দ কেন হবে না! আমির ভাই, পারুল ভাবী দুইজনই বেশ ভাল মানুষ, আমাদের পূর্ব-পরিচিত। কিন্তু সাদিক— 

মিলিকে কথাটা শেষ করতে দেয় না সাদিক। নিরাশার চোখে তাকিয়ে বলে, মেয়েদের ব্যাপারে তুমি যখন যা সিদ্ধান্ত নিয়েছো আমি তোমার সাথে একমত জানিয়েছি। কারন আমি সবসময় বিশ্বাস করি একজন মা-ই তার মেয়েদের জন্য সঠিক সিদ্ধান্তটা নিতে পারে। কিন্তু এখন আমার মনে হচ্ছে মেয়েদের সব সিদ্ধান্ত তোমার উপর ছেড়ে দেওয়া আমার উচিৎ হয় নি। 

মিলি মাথা নীচু করে অপরাধীর মত কথাগুলো শুনতে থাকে। 

সাদিক বেদনার সুরে বলে, মারজিয়ার বয়স কত হয়েছে কোনো ধারণা আছে তোমার! এতগুলো ছেলে তাকে দেখানো হল, তার কাউকে পছন্দ হয় না, কারো এটা তো কারো ওটা—এক এক করে সব ছেলেদের বাদ দিয়েছে সে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সাদিক। জীবনটা অনেক বড়, মিলি। মানুষ যতই উন্নতির শিখড়ে চলে যাক, দিন শেষে পরিবারের সাথে ভাল সময় কাটাতে পারাটাই আসল সাফল্য—আর আমি দেখতে পাচ্ছি আমার মেয়েদের কপালে সে সুখ-সাফল্য জুটছে না! 

সাদিক আর কোনো উত্তরের আশা করে না। সে বিশ্বাস করে মিলির এতটা বুঝ-বুদ্ধি আছে যে এর পরে এ বিষয়ে সে আর দ্বিমত জানাবে না। তার অনুমানই সঠিক হয়। মিলি কিছু বলে না। তবে ভিন্ন কারনে।  

মিলির মনে হয় বললেও সাদিক তার চিন্তা-অনুভূতি বুঝবে না। কারন সে নিজে একখানা সিদ্ধান্ততে চলে এসেছে। মিলি মাথা নীচু করে রান্নাঘরের দিকে আগায়। ঘর থেকে বের হয়েই দরজার পাশে মারজিয়াকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। মেয়ের মায়া ভরা চেহারাটা তার মুখে এক কষ্টের হাসি ফোঁটায়। মায়ের হাতখানা নিজের হাতে নেয় মারজিয়া। তার চোখে-মুখে এক অজানা বেদনার ছাপ। 

মারজিয়ার ঘরে চুপচাপ বসে আছে দুইজন। মারজিয়া এক গ্লাস পানি মায়ের দিকে এগিয়ে দেয়। শান্ত গলায় বলে, পারুল আন্টি বলছিলো জায়েদ কানাডাতে একখানা বড় কোম্পানিতে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে আছে। তাদের পরিবারও সব দিক দিয়ে বেশ ভাল। বাবার দিক দিয়ে চিন্তা করলে এরকম একটা সমন্ধ খুঁজে পাওয়া আসলেই কঠিন। 

আমি জানি তাদের পরিবার ভাল, ছেলে ভাল—তবে কি জানিস? মিলি একটু থামে। তার চোখে-মুখে দুশ্চিন্তা। একটা মানুষ ভাল হলেই যে সে আমাদের জন্য সঠিক তা কিন্তু নয়। মিলি মারজিয়ার দিকে তাকিয়ে গ্লাসটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরে বলে। তারা যদি তোর ব্যাপারে বলত, আমার হয়ত কোনো দ্বিধাদ্বন্দ, দ্বিমত থাকত না। কিন্তু আলু—আলুর জন্য তারা সঠিক না। আলু উড়নচন্ডী, মুখে মুখে তর্ক করে, ঝামেলা করার একটা সুযোগ ছাড়ে না! ওর জন্য এমন কাউকে দরকার যে ওর এই স্বভাবটা বুঝবে। ওকে জানার চেষ্টা করবে। ও যখন কোনো ভুল করবে ধৈয্যের সাথে ওকে সামলাবে, বুঝাবে। ওকে আদরে-শাসনে রাখবে। 

মিলি একটু থেমে মেয়ের দিকে তাকায়। বিষাদ মিশ্রিত কণ্ঠে বলে, আলু যেটা বলল, শুধু রান্নাবান্না আর ঘর সাঁজানো জানলেই সংসার করা যায় না। সংসার করতে হলে মেয়েদের চুপ থাকতে জানতে হয়। হাজারটা অপমানের জবাবে চুপ থাকতে হয়, হাজারটা উপহাসের জবাব হেসে দিতে হয়, দোষ যারই থাকুক নিঃস্বার্থ হয়ে ক্ষমা তাকেই চাইতে হয়—তাতে সে মেয়ে দেশের প্রধানমন্ত্রী হোক বা ভিখারি! ঘরের বউ বোকা হতে হয়, স্বামী-শ্বশুর বাড়ির দোষ দেখেও অন্ধ হতে হয়, হাজারটা কটুবাক্য শুনেও কানে কালা হয়ে থাকতে হয়। মিলির চোখ দুটো ছলছল করে ওঠে। মৃদু কন্ঠে বলে, যেদিন মেয়েরা দেখতে-শুনতে পায়, সেদিন থেকেই সংসারে ফাটল ধরে।

মারজিয়া এক পলকে তাকিয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে সাহসী নারীকে দেখে, যে শক্ত হাতে তার তিন মেয়েকে অকূল দরিয়া থেকে পাড়ে টেনে তুলেছে। কিন্তু সেই দরিয়ায় আজোও ভাসছে নিজে। কারন মায়েদের কোনো সাফল্য থাকে না, রান্নাঘরের বাহিরে তাদের কতৃত্ব থাকে না। সকলের সাফল্যে তাদের অবদান থাকলেও তাদের নামের আগে কোনো পদবী যুক্ত হয় না। তারা শুধুই মা হিসেবে পরিচিতি পায়, ভাষণে দুই লাইন আবেগ পায়, যে আবেগ ঘর অব্দি আসতে আসতে অবহেলায় পরিনত হয়। 

মিলি দুশ্চিন্তামাখা চোখে মারজিয়ার দিকে তাকায়। মলিন হাসি দিয়ে বলে, আমি তোকে কখনও কোনো বিষয়ে জোর করি নি, মারজু। আমি জানতাম তুই পানির মত, যে পাত্রেই রাখবে, তুই সেই পাত্রের আকারই ধারণ করবি। তাই আমি সবসময় চেয়েছি তুই নিজের মন মত আকার ধারণ কর।

মারজিয়া হাসে। বলে, আমি পানি, আর আলু?

মিলি হাসতে হাসতে বলে, ও সুনামি, কখন, কোথা থেকে এসে কাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে কেউ বলতে পারে না! দুইজনই হাসে। মিলি মেয়ের হাত দুটো শক্ত করে ধরে। তাকিয়ে মারজিয়ার মুখটাকে ভাল করে দেখে। এক হাত দিয়ে ওর গালে হাত বুলায়। কখনও আমার মত হোস না— 

মারজিয়া মায়ের হাতটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরে। তাকিয়ে দেখে মায়ের হাতখানাকে। হাতটা টেনে এনে চুমু খায় সে হাতে। পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী হাত। সমাজের সব তাচ্ছিল্য, কুৎসা, পরিহাস এই হাত দিয়ে ঘরের দরজার বাহিরে ঠেলে পাঠিয়ে দেয় মা। যেন কোনো কষ্ট তার মেয়েদের নজরেও না পরে।

Comments

    Please login to post comment. Login

  • Kazi Eshita 3 months ago

    মা মেয়ের সম্পর্কের বাঁধন তো বেশ