মারজিয়া টেবিল থেকে জিনিসপত্র নিয়ে নিয়ে তার ব্যাগ গুছাচ্ছে। একজন পুরুষ মানুষ দরজায় এসে দাঁড়ায়। বলে, ম্যাডাম, আসব?
মারজিয়া ঘুরে তার দিকে তাকায়। ফিরে আবার নিজ কাজে মনোযোগ দিতে দিতে বলে, আপনি যদি চাকরির ব্যাপারে কথা বলতে এসে থাকেন তাহলে না আসাই ভাল। আপনি মামা-খালা-চাচা যার জোরেই এই হাসপাতালে এসে থাকুন, তাতে আমার কিচ্ছু যায়-আসে না। আমার ডিপার্টমেন্টে আমি কোনো অদক্ষ মানুষ দেখতে চাই না! একটু থেমে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বলে, আর কিছু বলার না থাকলে আপনি আসতে পারেন।
মারজিয়ার দিকে নির্বিকারভাবে তাকায় ছেলেটি। ধীরে পায়ে রুমে ঢোকে। ছেলেটা হেঁটে এগিয়ে আসতেই মারজিয়া এক পা পিছিয়ে যেয়ে বিস্মিত চোখে ছেলেটার দিকে তাকায়।
হকচকিয়ে বলে, আপনাকে রুমে ঢোকার অনুমতি তো আমি দেই নি!
ছেলেটির চোখেমুখও বিব্রত হয়ে পড়ে। অনুরোধের সুরে বলে, ম্যাডাম, আপনি প্লিজ একবার আমার কথাটা শুনুন, এরপর আপনি যা বলবেন আমি তাই করব।
মারজিয়া আদেশের সুরে বলে, আপনি আমার রুম থেকে বের হন! অনুমতি ছাড়া কিভাবে আপনি একজন নারী ডাক্তারের রুমে ঢুকে গেলেন!
না, মানে—ম্যাডাম, আপনি যা ভাবছেন এমন কিছু না। আমি তো শুধু—কথাটা শেষ করতে দেয় না তাকে।
রাগান্বিত সুরে মারজিয়া বলে, আপনি কি আমার রুগী? আমার ভাই? আমার বন্ধু? তাহলে কিভাবে আপনি হুট করে আমার রুমে ঢুকে গেলেন! মারজিয়ার চোখ ভর্তি বিরক্তি আর খানিকটা ঘৃণাও হয়ত।
ছেলেটা মারজিয়া চোখের দিকে তাকিয়ে সাথে সাথে রুম থেকে বের হয়ে যায়। দরজার বাহিরে যেয়ে দাঁড়ায়। ম্যাডাম, আমি আপনার সাথে একটু কথা বলতে চাই—ছেলেটার চোখ ছলছল করে ওঠে।
এ ব্যাপারে আমার সাথে কথা বলার কোনো প্রয়োজন নেই। আমার যা বলার আমি ডীনকে বলে দিব। এরপর ডীন যা সিদ্ধান্ত নিবেন, সেটাই চূড়ান্ত। এমনিতেও আপনি লবিং করেই এসেছেন, হাসপাতালে থাকার জন্য আপনার আমার অনুমতির প্রয়োজন হবে না।
মারজিয়া তার ব্যাগটা নিয়ে হেঁটে রুম থেকে বের হয়ে যায়। ছেলেটা করিডোরে দাঁড়িয়ে মারজিয়াকে চলে যেতে দেখে।
পাশেই করিডোরে দাঁড়িয়ে থাকা এক মহিলা ডাক্তার এসে ছেলেটার পাশে দাঁড়ায়। বলে, ও এমনই। ওকে এতো সিরিয়াসলি নেওয়ার কিচ্ছু নেই! হাসি দিয়ে ছেলেটার বাহুতে হাত দেয় মহিলাটি।
ছেলেটা খানিকটা চমকে গিয়ে বলে, শিরিন ম্যাডাম!
ছেলেটির বয়স ত্রিশের আসেপাশে হবে। মাথা ভর্তি চুল। লম্বা-চওড়া শরীর আর চোখ ভর্তি মায়া, চেহারাটা অসম্ভব নিষ্পাপ—যেন ভাজা মাছটাও উলটে খেতে জানে না। পরনে মলিন পোষাক তবুও তার দৈহিক সৌন্দর্য দৃশ্যমান।
নিউরোসার্জারি ডিপার্টমেন্ট তোমাকে না রাখলে, আমরা তোমাকে নিয়ে আসব। এমনিতেও এই ডিপার্টমেন্টে কাজ বেশি। তোমার দুশ্চিন্তার কোনো কারন নেই, উসমান—কথা বলতে বলতে ডাক্তার শিরিন উসমানের বাহুতে ধীরে ধীরে চাপ দিতে থাকে। হাসতে হাসতে বলে, আরে বাহ! তোমার বাইসাপসও আছে নাকি!
উসমানের অস্বস্তি বোধ হতে থাকে। সে ডাক্তার শিরিনের হাত সড়িয়ে দ্রুত সেখান থেকে চলে যায়।
সাদা এপ্রোণটা খুলে গাড়ির পেছনের সীটে ছুড়ে মারে মারজিয়া। হাতে থাকা প্যাকেটটা প্যাসেঞ্জার সীটে রাখে। গাড়ির ড্রাইভার সীটে বসে চুলগুলো উপরে তুলে কাঁকড়া দিয়ে শক্ত করে আটকে নেয়। ফোন হাতে নিয়ে আনিসাকে ফোন করে।
হ্যালো, আনু—কোথায় তুই? ফোনটা কাধের সাথে চেপে ধরে পা থেকে জুতার স্ট্রিপটা খুলতে থাকে।
ফোনের ওপাশ থেকে আনিশা বলে, অফিস থেকে বের হলাম, বাসের জন্য দাঁড়িয়ে আছি। তুই বের হয়েছিস?
হ্যাঁ, আজ আগে আগেই বের হলাম। বাসস্ট্যাডেই থাক। একসাথে বাসায় যাই সবাই।
ঠিক আছে। আলুকে বলেছিস?
ফোন করছি এখন।
আচ্ছা, সাবধানে আয় তাহলে।
মারজিয়া পায়ের জুতার স্ট্রিপগুলো খুলে পা ঝাড়া দিয়ে জুতাগুলো গাড়িতে ফেলে দেয়। ডায়াল থেকে আলিশার নাম্বারটা বের করে।
আলিশার বলা গতকালের কথাগুলো ওর মাথায় ঘুরপাক খায়। নিজেকে অপরাধী মনে হয় তার। মনে হয় তার জন্যই আলিশা একটা স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারে নি, পারছে না। হয়ত মারজিয়ার জায়গায় অন্য কেউ থাকলে ছোট বোনকে আঁকড়ে রাখত, ভালবাসায় রাখত। আলিশা স্বাভাবিক মেয়েদের মত বড় হয়ে উঠত। তার একটা স্বাভাবিক মেয়েলী জীবন হত, সংসার হত—পাশের সীটে রাখা বেকারির প্যাকেটটার দিকে তাকায়। আলিশার পছন্দের বেকারির রেড ভেলভেট কেক।
ছোটবেলায় বাসায় পেস্ট্রি আনা হলে নিজেরটা তাড়াতাড়ি করে খেয়ে সবসময় মারজিয়ারটার দিকে নজর দিত আলিশা। এমনভাবে তাকিয়ে থাকত যে একটা সময় বিরক্ত হয়ে মারজিয়া নিজেই ওর পিচটাও ওকে দিয়ে দিত। একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে এতে। মারজিয়ার মিষ্টি জিনিসের প্রতি ভালবাসা কমে গেছে। মা জোর করে না খাওয়ালে মিষ্টি জিনিস সে খুব একটা খায় না।
আলিশাকে দুই বার ফোন করার পরও যখন সে ফোন ধরে না, তখন মারজিয়া বুঝতে পারে সে ইচ্ছা করেই কল উপেক্ষা করছে। সে আর ফোন করে না। ভাবে ও পৌঁছানোর আগেই তো মারজিয়া বাসস্ট্যান্ড পৌঁছে যাবে। ওকে ধরে গাড়িতে উঠিয়ে নেবে। ফোনটা রেখে গাড়ি চালানো শুরু করে মারজিয়া।
বাসস্ট্যান্ডে আনিসাকে দাঁড়ানো দেখতে পায় মারজিয়া। সে ফোনে কথা বলছে। মারজিয়াকে দেখতে পেয়ে হাসিমুখে হাত নাড়ায়।
আনিসা ফোনে কথা বলতে থাকে। জী স্যার, নতুন ফরমেটে যে পরিবর্তনগুলোর কথা গত মিটিংয়ে রাকিন স্যার বলেছিলেন আমি সবগুলোই ইনপুট করেছি। আজ দুপুরেই কেয়া ম্যাডামের কাছে জমা দিয়ে এসেছি সেটা।
ফোনের ওপাশ থেকে পুরুষ কণ্ঠের আওয়াজ আসে, আপনার কাছে সেটার কোনো কপি হবে যেটা আমি এই মুহুর্তে দেখতে পারব?
আনিসা বিরক্তি চোখে রাস্তায় চলমান গাড়ির দিকে তাকায়, পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া মানুষের দিকে তাকায়, হতাশার চোখে আকাশের দিকে তাকায়। মনে মনে ভাবে—নামেমাত্র ৯-৫ চাকরি। অফিস থেকে বের হতে পারলাম না এখনই ফোন করে জান জ্বালাচ্ছে। মৃদুকণ্ঠে বলে, স্যার, আমি আসলে এখনও বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছি। বাসায় গিয়ে পাঠালে হবে?
ফোনের ওপাশ থেকে খানিকটা নিরবতা আসে। খানিক পরে মৃদু কণ্ঠে বলে, আপনার বাসায় যেতে কতক্ষণ লাগবে?
আনিসা পাশ দিয়ে হেঁটে আসা মারজিয়ার দিকে তাকায়। কষ্ট করে ঠোঁটে হাসি টানে। বলে, কিছুটা সময় তো লাগবে।
মিস আনিসা, আমারও কি আপনাদের মত বাসায় যেতে ইচ্ছা করে নাহ?
অবশ্যই করে, স্যার।
এত মাস হল এই অফিসে কাজ করছেন, একটু তো কমন সেন্স খাটাতে হয় নাকি! একটু থেমে হতাশার সুরে বলে, আগামী মাসে আপনার প্রোবেইশন পিরিয়ড শেষ হতে চলল, এখনও বেসিক বিষয়গুলো যদি আপনাকে বানান করে বলে দিতে হয় তবে কিভাবে হবে! আপনি যখন মিস কেয়ার টেবিলে একখানা ফাইল রেখে যেতে পেরেছেন, আমার টেবিলে আরেকখানা রেখে যেতে আপনার কি সমস্যা হচ্ছিলো?
জী, স্যার। আমি ভবিষ্যতে খেয়াল রাখব, স্যার।
আপনার সাথে ল্যাপটপ থাকার কথা?
জী, স্যার—
ফাইলটা আমাকে দ্রুত মেইল করে দিবেন।
জী, স্যার। ভাল থাকবেন।
ভাল রাখবেন—বলেই ওপর পাশ থেকে ফোন কেটে দেয়।
আনিসা ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকে। সেখানে ইংরেজি অক্ষরে লেখা ‘জেলের বোতল(পিএ)’। নামের সাথে একখানা পায়খানার ইমোজি। নামের নীচেই ইংরেজি ডিজিটে তিন মিনিট বত্রিশ সেকেন্ড লেখাটা টিপুস টিপুস করছে।
গাড়ি এক পাশে পার্ক করে এসে আনিসার সাথে দাঁড়ায় মারজিয়া। আনিসার চেহারায় বিরক্তির ছাপ। মারজিয়া বলে, কিছু হয়েছে?
আনিসা কেষ্ট হাসি হেসে মাথা নাড়ায়, নাহ—অফিস থেকে ফোন ছিল। একটা ফাইল দ্রুত মেইল করতে বলল। কাধের ব্যাগ থেকে ল্যাপটপটা অনিচ্ছার সাথে টেনে বের করল। এরপর এক হাতে সেটাকে রেখে অন্য হাত দিয়ে কাজ করতে লাগল।
মারজিয়া তাকিয়ে ছোট বোনের অবস্থা দেখে। এরপর রাস্তার দিকে তাকিয়ে বলে, আলু ফোন ধরল না। চলে গেল কিনা।
আনিসা ল্যাপটপে কাজ করতে করতে বলে, আমার বিকালে কথা হয়েছিল। বলল পরেই বের হবে। এখনও আসে নি। আসলে তো দেখতাম।
হুম। মারজিয়া এক দৃষ্টিতে আলিশা যে পথ দিয়ে আসবে সেদিকে তাকিয়ে থাকে।
আনিসা কাজ শেষ করে ল্যাপটপটা আবার ব্যাগে ঢোকায়। পাশে ফিরে মারজিয়াকে উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে। গতকালের ঘটনার পর বড় বোনের উদ্বেগ বুঝতে পারে সে। দুষ্টুমিমাখা হাসি দিয়ে বলে, আপু, মনে আছে তুই যেদিন গাড়ি কিনেছিলি আমরা পুরো রাত ঢাকার রাস্তায় গাড়ি নিয়ে ঘুরে বেড়িয়ে ছিলাম? আলু আসলে চল বাসায় যাওয়ার আগে আসপাশ দিয়ে তেমন একটা রাউন্ড দিয়ে আসি!
কোথায় যাবি?
ক্যান্টমেন্টের ভেতর ঢুকতে দিবে? ওদিকটা রাতের বেলা খুব ভাল লাগে।
দিতে পারে।
তাহলে চল না!
ঠিক আছে, আলু আসুক আগে—আমি বরং ওকে আরেকবার ফোন দেই। মারজিয়া ফোনের দিকে তাকায়। আনিশা কাছে এসে মারজিয়ার হাতটা জড়িয়ে ধরে তার কাঁধে মাথা রাখে।
অন্যদিকে, বাতাসের ভেতর থেকে দ্রুত গতিতে শো শো করে এগিয়ে যাচ্ছে একটি বাইক। বাইক চালাচ্ছে যে ছেলেটি তার মাথায় হেলমেট। চোখ দুটো ছাড়া চেহারা তেমন দেখা যাচ্ছে না। রাগী রাগী চোখ দুটো রাস্তা দেখছে। বাইকের গতি খানিকটা কমিয়ে সে বলে, তোর ফোন আসছে।
তার পেছনে হেলমেট মাথায় বসে আছে আলিশা। মুখটা গোমরা করে বলে, জানি।
ছেলেটা সামান্য পেছনে মুখ করে বলে, এতবার ফোন দিচ্ছে—ধর! দুশ্চিন্তা করবে না হলে।
বাড়ি পৌঁছেছি কিনা জানার জন্যই ফোন করছে। কথা বলতে ইচ্ছা করছে না ওর সাথে। একটু থেমে বিরক্তির সাথে বলে, তুই চুপচাপ বাইক চালা নাহলে তোকেও ঠেলে ফেলে দিব।
ফেলে দে! এরপর মন খারাপ থাকলে কাকে ডাকবি সেটা ঠিক করে তারপর ফেলিস। মাথাটা পেছনের দিকে ঠেলে আলিশার হেলমেটে আস্তে বারি দেয় ছেলেটা। আলিশা দুইহাত দিয়ে শক্ত করে পেছন থেকে ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরে তার পিঠে মাথা ঠেকিয়ে গোমড়া মুখে বসে। ছেলেটা এক হাত দিয়ে আলিশার হাতদুটো ধরে।
বাসস্ট্যান্ডের সামনে এসে বাইক থামে। আলিশা ধীরে বাইক থেকে নামে। নিজের হেলমেট খুলে ছেলেটার হাতে দেয়। ছেলেটা হেলমেটটা বাইকের সামনে ঝুলিয়ে দিয়ে আলিশার দিকে তাকায়। বলে, মন খারাপ করে থাকিস না। বাসায় যেয়ে ফ্রেশ হয়ে ফোন দিস।
যদিও হেলমেটের জন্য তার চোখ দুটো ছাড়া আর কিছু দেখা যাচ্ছে না তবুও চোখের রাগীভাবটা কমে গিয়ে যে তাতে হাসি ফুটেছে তা বুঝা যায়। আলিশা কিছু না বলে শুধু তাকিয়ে থাকে। ছেলেটা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হেলমেটটা খুলে বাইক থেকে নামে। আলিশাকে জড়িয়ে ধরে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। আলিশা তার বুকে মাথা দিয়ে চোখ বন্ধ করে রাখে। বসে থাকা অবস্থায় বুঝা না গেলেও এখন বুঝা যায় যে ছেলেটি বেশ লম্বা এবং সুঠামদেহী।
মৃদুকণ্ঠে বলে, বাসায় যেতে ইচ্ছা না করলে আমাদের বাসায় চল।
আলিশা ছেলেটাকে খানিকটা ঠেলে দিয়ে হাসে। বলে, হেহ! খুব সমাধান দিলি!
মজা করছি না, সত্যি। আম্মু-আব্বু কিছু মনে করবে না।
থাক, আপনার আর দরদ দেখাতে হবে না। একটু থেমে হাসি দিয়ে বলে, আমার যাওয়া উচিৎ, আপু বারবার ফোন দিচ্ছে। আলিশা ছেলেটার মুখটা টেনে এনে তার ঠোঁটে চুমু খায়। এরপর হাসি দিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। কিন্তু সেই পা আর আগাতে পারে না।
আইসক্রিম হাতে কিছুটা দূরেই বিস্মিত চোখে দাঁড়িয়ে আছে আনিসা। আর তার ঠিক পেছনেই দাঁড়ানো মারজিয়া। তারা দুইজনই তাকিয়ে আছে আলিশার দিকে। আলিশার মনে হল তার পায়ের নীচ থেকে যেন মাটি সরে গেছে। নিজেকে পড়তে পড়তে সামলানোর চেষ্টা করে সে।
কি রে, খালি জায়গায় পড়ে যাচ্ছিস কেন? আলিশাকে সামলায় ছেলেটা।
আলিশা মৃদুকণ্ঠে ভয়ার্তক দৃষ্টিতে বলে, আপু—ছেলেটা আলিশার চোখের দিকে তাকিয়ে সামনে তাকায়।
আনিসার হাতে থাকা আইসক্রিমটা গলে তার হাত থেকে রাস্তায় পরে যায়। তাতেও তার বিস্ময়ে তফাৎ হয় না। বিস্মিত কণ্ঠে বলে, জাকি ভাই—কেমনে! মারজিয়ার কানে কথাটা আসলেও সে তাতে মনোযোগ দেয় না।
জাকি আলিশাকে টেনে তোলে। আলিশা শক্ত করে জাকির হাতটা ধরে থাকে। তার চেহারা দেখে মনে হয় খোকা অবশেষে জানতে পেরেছে তার কাজলা দিদি আসলে কোথায়।
জাকি ধীরে হাত ধরে আলিশাকে টানে। আলু, আয়।
আলিশা ভয়ার্তক দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে। বলে, পাগল! ও মেরে ফেলবে আমাদের!
কিচ্ছু হবে না আয়! জাকি খানিকটা টেনেই আলিশাকে নিয়ে যায়। ওরা এসে আনিসা আর মারজিয়ার সামনে দাঁড়ায়।
আলিশা কান্নাকান্না কণ্ঠে বলে, আপু—
মারজিয়া এক দৃষ্টিতে জাকির দিকে তাকিয়ে থাকে। জাকি একবার মারজিয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে থমকে যায়। তার মনে হতে থাকে তার শরীরটা যেন ঠান্ডা হয়ে আসছে।
মারজিয়া শান্ত গলায় বলে, আনু, আলুকে নিয়ে গাড়িতে বস।
আলিশা জাকির সামনে এসে দাঁড়ায়। ভয়ার্তক কণ্ঠে বলে, আপু, আমার কথা শোন—আলিশাকে কথাটা আর শেষ করতে দেয় না মারজিয়া।
রাগান্বিত চোখে আলিশার দিকে তাকায় মারজিয়া। আদেশের সুরে বলে, গাড়িতে যেয়ে বস! তার চোখ ও কণ্ঠে বলে দিচ্ছে এই পালায় আর রক্ষা নেই তাদের।
জাকি আলিশাকে খানিকটা ঠেলে পাঠানোর চেষ্টা করে। আলু, যাহ—কিন্তু আলিশা নড়ে না। প্লিজ যা। কিচ্ছু হবে না। জাকি আবার ঠেলে।
আলিশা জাকির দিকে তাকায়। তার চোখে অশ্রু। এ যেন রোমিও-জুলিয়েটের বিচ্ছেদের কাহিনী। জাকি বিপদের আভাস পায়। মন ভয় পেতে চায় কিন্তু মাথার পেছনে গান বাজতে থাকে, পেয়ার কিয়া তো ডারনা কেয়া!
আনিসা তার বড় বোনের লাল চোখের দিকে তাকিয়ে পরিস্থিতির গম্ভীরতা বুঝতে পারে। ছোট থেকে কল্পিত সাইকোকিলারের আবতারটা আজ সত্যিই চোখের সামনে চলে আসে কিনা—ভাবতে থাকে আনিসা। দ্রুত এসে আলিশার হাত ধরে টানতে টানতে অনুরোধ করে, আলু, চল! আপুকে আর রাগাস না! জাকিও তাকে ঠেলে।
আলিশা চলে যাওয়ার আগে দ্রুত জাকির কানে কানে বলে, ও পকেটে হাত দিলে দৌঁড়ে পালিয়ে যাস!
জাকি মারজিয়ার হাতের দিকে তাকায়। মনে খানিকটা ভয়ের অনুভূতি হয় তার। তাকিয়ে টেনে টেনে প্রেমিকাকে নিয়ে যেতে দেখে সে। প্রেমিকার থেকে চোখ সরিয়ে সামনের বিপদের দিকে মনোযোগ দেয় জাকি। ভয়ার্তক দৃষ্টিতে মারজিয়ার দিকে তাকায়।
কণ্ঠের জড়তা দূর করে বলে, আপু, আমার নাম জাকি। আমি আর আলু—মানে আলিশা এক কোম্পানিতে চাকরি করি। আমরা একই সাথে ভার্সিটিতেও পড়েছি, সেইম ডিপার্টমেন্ট। আমি জানি বিষয়টা খুব বাজে ভাবে সামনে এসেছে। কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমি আলিশাকে অনেক বেশি ভালবাসি। জাকির কণ্ঠ ভরা অনুনয়।
মারজিয়া তার চোখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাকে। মারজিয়ার মনে হতে থাকে তার ঘাড়ে ব্যাথা করছে। সে বুঝতে পারে জাকি যথেস্ট লম্বা। সে হেঁটে বাসস্ট্যান্ডের ভেতরে যায়। জাকিও তার পেছন পেছন যায়।
আদেশের সুরে বলে, বস!
জাকি সাথে সাথে বসে যায়। মারজিয়া তার চোখের দিকে তাকায়। তার চোখে একখানা চমক এসেছে। মানে, এইবার সে লেভেলে এসেছে।
মারজিয়া সামান্য হেঁটে জাকির বাম পাশে এসে দাঁড়ায়। জাকি এখন আর মারজিয়াকে দেখতে পায় না। জাকির মনে হতে থাকে সে গহীন জঙ্গলে আটকা পড়েছে। আসেপাশ থেকেই বিপদের আওয়াজ পাচ্ছে কিন্তু দেখতে পাচ্ছে না। ভয়ের মাত্রাটা হঠাতই বেড়ে যায় যখন মাথায় প্রশ্ন আসে, মারজিয়া পকেটে হাত দিল কিনা এখন বুঝবে কিভাবে! জাকি সামনে তাকিয়ে থাকে।
বাসস্ট্যান্ডে কিছু মানুষজন আছে, আসেপাশ দিয়ে আরও মানুষ হেঁটে যাচ্ছে। এতক্ষণ এই মানুষগুলো নজরে পড়ে নি তার৷ প্রেমে পড়লে সম্ভবত মানুষ অন্ধ হয়ে যায়। লজ্জায় মাথা নীচু করে রাখে।
মারজিয়া গম্ভীর কণ্ঠে বলে, আমার বাবা সারাটা জীবন শুধু খেঁটে গেছেন। খুব বেশি টাকা-পয়সা কামাতে পারেন নি কিন্তু অনেক সম্মান কামিয়েছেন।
আপু, আমি—কি বলবে বুঝতে পারে না জাকি। তাই চুপ করে থাকে।
তোমাকে কিছু বলে আমার লাভ নেই। আমি বরং আমার বোনকে সামলাই। কথাটা শেষ করে হাঁটা শুরু করে মারজিয়া।
মারজিয়ার পেছনে হেঁটে যায় জাকি। বলে, আপু, আলিশার কোনো দোষ নেই। ও তো এইসব থেকে সবসময়ই দূরে দূরে থাকত৷ আমিই ওর পেছনে পেছনে সেই ভার্সিটির শুরু থেকে ঘুরতাম, ওকে জ্বালাতাম। আলিশা তো কখনও এসব ব্যাপারে আগ্রহই দেখাত না!
ঘুরে জাকির দিকে তাকায় মারজিয়া। তার চোখ দুটো লাল হয়ে আছে। শান্ত গলায় বলে, পথেঘাটে আর তামাশা করো না!
মারজিয়ার লাল চোখের চাহনি আর শরীর ঠান্ডা করে দেওয়া শান্ত কণ্ঠস্বর জাকিকে থামিয়ে দেয়। এ যেন এক মায়াজাল। সে আর কিছু বলতে পারে না। মারজিয়া হেঁটে চলে যায় সেখান থেকে।
গাড়িতে বিচলিতভাবে বসে আছে আলিশা। পাশে বসা আনিসা এখনও বিস্ময়ের ভেতর আছে। বিস্মিত কন্ঠে আলিশার দিকে তাকিয়ে বলে, জাকি ভাই! জাকি ভাই! সিরিয়াসলি, আলু, কেমনে!
আলিশা কোনো কথা না বলে বিচলিতভাবে এদিকে-ওদিক তাকায়। আনিসা বোনের অবস্থা বুঝতে পেরে নিজের বিস্ময়ের ইতি টানে। ভাবে, এসব তো পরে জানাই যাবে। কিন্তু এই মুহুর্তে আলিশাকে সাহায্য করতে সে কি করবে বুঝতে পারে না।
খানিকটা খোঁটা দেওয়ার সুরে বলে, আজ ফোনটা ধরলে এই দিন দেখতে হত না!
আলিশা রেগে তার দিকে তাকায়। মাথায় একটা বারি দিয়ে বলে, তুই তো আমাকে একটা ফোন করতে পারতি! বজ্জাত! আনিসা ব্যাথা পেয়ে আলিশার দিকে রেগে তাকায়। আলিশা বিরবির করে বলে, এর চেয়ে আব্বু দেখলেও ভাল হত!
আনিসা হাসে। দুষ্টামি মাখা কণ্ঠে বলে, আমি যে সবসময় আপুকে সাইকোপ্যাথ ভেবে ওর রুমে লাশ খুঁজে বেড়াতাম, কখনও ভাবি নাই সেই লাশ তোর বের হবে, আলু! একটু থেমে বোনকে সামান্য জড়িয়ে ধরে বলে, তোর কথা আমার খুব মনে পড়বে রে। খুব ভাল না হলেও বোন হিসেবে খারাপ ছিলি না তুই!
আলিশা বিরক্তি নিয়ে তাকায় ওর দিকে। হঠাৎ তার চোখ পড়ে সামনের সীটে রাখা কেকের প্যাকেটটার দিকে।
আনিসাও প্যাকেকটা দেখে। বলে, কি ঢংটা করেই না বললি যে বিয়ে করবি না! তোর পছন্দের কেক নিয়ে এসেছিল যাতে গতকালের মত আর সেন্টি না খাস। তবে এখন মনে হচ্ছে কেক এবং বিয়ে কোনোটাই আর তোর কপালে আর জুটবে না! খানিকটা চিন্তিত চোখে জানালা দিয়ে মাথা বের করে দেখে মারজিয়াকে দেখা যায় কিনা।
আলিশা এক নজরে কেকটার দিকে তাকিয়ে থাকে।
দ্রুত ভদ্রভাবে সীটে বসে পড়ে আনিসা। বিচলিত কণ্ঠে বলে, আপু আসছে।
আলিশা দুশ্চিন্তামাখা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, জাকিকে দেখতে পেলি?
উঁহু! তার খেলা শেষ করে দিয়ে এসেছে। ডান হাতটা দিয়ে গলা কাটার ভান করে বলে, গেইম ওভার! আলিশা তার পা বরাবর একটা লাথি দেয়। আনিসা ব্যাথায় পা ঘষতে ঘষতে বলে, বুঝে নে, আলু। এই ঘরে এখন তোর দলে একমাত্র আমিই আছি। আমার সাথে এমন ব্যবহার করা ঠিক হচ্ছে কিনা!
মারজিয়া এসে গাড়ির দরজা খুলে ড্রাইভিং সীটে বসে। গাড়ি চালু করে নিঃশব্দে চালাতে থাকে। কেউ কোনো কথা বলে না। হঠাৎ আলিশার ফোন ভাইব্রেট করে ওঠে।
জাকির ম্যাসেজ—সুযোগ পেলে আমায় ফোন করিস, দুশ্চিন্তায় আছি তোকে নিয়ে।
আলিশা ম্যাসেজটা পড়ে। গাড়ি যত বাড়ির কাছে এগিয়ে আসে তার তত দুশ্চিন্তা বাড়ে। না জানি কি হবে আজ তার সাথে।