এরকম নাকি হয়! আসলেই হয়?
কবির কলম আন্ধা হয়ে যায়। কালি থাকলেও কলম লেখকের কথা শুনে না। লেখার জন্য হাত নিশপিশ করে। দিল ছিঁড়ে খান খান যায়। দুনিয়াটা ছন্নছড়া লাগে। মাথার চুল ছেড়ার ইচ্ছে বহুত কষ্টে সামলে নিতে হয়। জগত সংসারের কিছুই ভালো লাগে না লেখকের। নিজেকে বোকা বোকা লাগে। অন্যেরা সেটা ধরেও ফেলছে। কিছুদিন হল আমিও প্রায় অনুরূপ উপসর্গে ভুগছি। অনেক লিখতে ইচ্ছে করে। কিন্তু লিখতে বসলে ব-ক-ল-ম হয়ে যাই।
ঈদের দুইদিন আগে ঢাকা থেকে শিকড়ে ফিরেছি। প্রায় ১৭ ঘণ্টার ম্যারাথন ও ক্লান্তিকর জার্নি। অথচ সড়কের অবস্থা ভালো। রাস্তায় আইনশৃংখলা বাহিনী খুব তৎপর। তবুও মানুষের কপালে ভোগান্তি লেখা। সেটা অনুবাদ করতে গিয়েও কলম জড়িয়ে যায়।
আপনি যত অভুক্ত থাকেন, নির্দিস্ট পরিমাণ খাওয়ার পর আর খেতে পারবেন না। এর বেশি খেলে বমি হতে পারে, গতরে নানা ব্যাধিও বাসা বাধতে পারে। রাস্তারও নির্দিস্ট ধারণ ক্ষমতা আছে। এর বেশি গাড়ি তার পেটে ঢুকলে রাস্তার শিরা ধমনীতে রক্ত চলাচল আটকে যাবে। বেশি ব্লক হয়ে গেলে ওপেন হার্ট কিংবা বাইপাস করাতে হয়। ঢাকা (বা এর আশপাশ) কেন্দ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের কারণে সারা দেশের মানুষ এসে জড়ো হয়। এরপর নাড়ির টানে বাড়ির পানে ছুটতে গিয়ে রাস্তা ল্যাং মেরে ফেলে দেয়। সারা বছর এলোমেলো চলা বাস হঠাৎ করে চাইলেও সোজা চলতে পারে না। বাবা তোমার বাঁকা লেজ সোজা করো, মামা বাড়ির আবদারের মত শোনায়। ভাবি, গুছিয়ে কারণ ও এর প্রতিকার লিখবো। লেখা হয় না। কে যেন অদৃশ্য হাতকড়া পরিয়ে দেয়।
রংপুর থেকে বন্ধু হিমু আসে। শেখেরটেক ১২ নম্বরে ছোলা মুড়ি অর্ডার দিয়ে ছোট টুলে পশ্চাতদেশ এলিয়ে দেই।
‘তিন দিন আগে সন্ধ্যায় ঠিক তোর ঐ টুলে বসেছিল এক হুরপরি।‘
এ কথা বলে মার্কারি শাহিন ব্যাংকার হিমুর উদ্দেশ্যে গল্পের ঝোল ছিটিয়ে দেয়। সামান্য কথায় ব্যাংকারের হিসেব এলোমেলো হওয়ার জোগাড়। আরও কিছু শোনার জন্য ওর চুল খাড়া হয়ে যায়। যদিও হিমুর চুল আগে থেকে খাড়া, সজারুর কাটার মত।
মার্কারি গলা খাকরি দিয়ে বাকি গল্পের জন্য রেডি হয়।
জান্নাতের হুরপরিরা কেমন হবে তার সামান্য নমুনা দেখিয়েছেন। ধবল সাদা স্বচ্ছ ত্বক, যেন বার্জারের সাদা লাক্সারি সিল্কের প্রলেপ দেয়া। তবুও সেই ত্বকের সামান্য নিচ দিয়ে বয়ে যাওয়া নীল নীল শিরাগুলোকে গাঙয়েও বদ্বীপে ছড়িয়ে পড়া নদীর মত লাগে। বান্দার পক্ষে বিধাতার সৃষ্টির গুণকীর্তন করে শেষ করা সম্ভব হয় না। ছোলামুড়ি চলে আসে, গল্প শেষ হয় না। মনে মনে প্লট সাজাই, এদিক ওদিক করে একটা দুর্দান্ত গল্প লিখে ফেলবো। কিন্তু আলস্যের হাতে বন্দি এই মন আলস্যকে ছাড়া কাউকে সহ্য করতে পারে না।
কিংবা গল্প হতে পারে বিক্রয়কর্মী মেয়েটাকে নিয়েও। সেলস কমিশন পাওয়ার আশায় পিছন পিছন ঘুরতে থাকে।
‘এই থ্রি-পিস ম্যাডামকে খুব মানাবে।‘
বলে নিজের শরীরে ঝুলায়ে দেখে। লাইভ হ্যাঙ্গারের মত দেখতে লাগে। সুর্য ডুবে যেতে পারে। কিন্তু তাঁর মুখের হাসিতে লেগে থাকে দক্ষিণ চীন সাগরের তলদেশে পাওয়া মুক্তার ঝলকানি। সেই হাসিতে হোঁচট খেয়ে কত জনের যে দফা রফা হয়েছে, খোদা মালুম। পথে বেপথে এরকম অনেক গল্প জমে। গিন্নির অবশ্য থ্রি-পিস পছন্দ হয় না। দরজা ঠেলে বের হয়ে অন্য শোরুমের দিকে পা বাড়াই।
কিংবা জয়নুল ভাইকে নিয়েও দু চার কলম লেখা যেতে পারে। দুর্দান্ত ফুটবল খেলত বলে পুলিশের চাকরি হয়ে যায়। কিন্তু একটা সময় কি হয় কে জানে? খেলতে ভালো লাগে না। ভালো লাগা দখল করে নেয় নেশার উপকরণ। এক সময় ভাবে বিয়ে করলে নেশা পরিবর্তন হয়ে যাবে। অল্প কয়দিন ঠিক থাকলেও পুরোনো নেশা মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। নেশার জন্য অপরাধে জড়িয়ে যান। এরপর সবকিছু শেষ হয়ে যায়। চাকরি, সহধর্মিনী সবাই ছেড়ে যায়। সেই জয়নুল ভাইকে দেখি বহু বছর পরে। কাছে যাওয়ার সাহস হয় না।
গল্প লেখা যায় এই শহরকে নিয়েও। এই শহরের সবচেয়ে আজব চরিত্র এই শহর নিজেই। ঘর নেই, দোর নেই। ঘরে খাবার নেই, পানি নেই। তবুও জন্ম নিয়ন্ত্রণে তাঁর কোন আগ্রহ নেই। বছর বছর হাজারও সন্তান বাড়িয়েই যাচ্ছে। বৃষ্টির জলে শহর ডুবে গেলে লিখে দেয়, পানির নিচে রাস্তা ভালো। এই শহরে থাকে কত রমজান আলী। যাদের যাপিত জীবনে কার বা কি এসে যায়। সে নিজে মনে করলেও কত জনই তাঁকে খুঁজতে থাকে।
এরকম কত গল্প চোখের সামনে দেখি, শুনি। লিখতে চাই, পারি না। শেষ মেষ পেটে জমা রাখি। সুযোগ হলে উগরে দিবো বলে।