
পর্ব- ৩: আমার অনেক ঋণ আছে
আমাদের রাজতন্ত্র আবার বিচিত্র উপায়ে গনতান্ত্রিক। আমরা যদিও সরাসরি ভোট দিয়ে রানি নির্বাচন করি না, তবে আমাদের আবেগি সম্মতি ছাড়া সুরের সজীব সিংহাসনে কেউ কখনও বসতে পারেন না। যতদিন সমুদ্রবর্তী একক রাজধানী ছিল, রাজত্ব করেছেন “মালিকা-এ-তারান্নুম”। তিনি মূলত নায়িকা ছিলেন। তবে রূপের আলোর চেয়ে তাঁর নামে বেশি ঝলমল করত কণ্ঠের কারূকাজ। যেন এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে ভেসে চলেছে পোড়ামাটির বাঁশি, গলায় খালি কলসির মতো হাহাকার, প্রতিধ্বনি। গীতল শব্দগুলো তিনি উচ্চারণ করতেন একেবারে গভীর থেকে, গলায় মিশে থাকত আনন্দ বেদনার অবিনশ্বর ঝাঁজ। গানের রাজ্য দুইভাগ হয়ে গেলে তিনি চলে যান সঙ্গীতের নতুন রাজধানীতে। ইরাবতী নদীর তীরের ঐতিহ্য-পুরাতন শহরে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন সার্বভৌম আরেক রাজত্ব। ধীরে ধীরে পর্দায় অভিনয় ভুলে গিয়ে মনোনিবেশ করেন সুর সাধনায়।
সাদা যো দিলমে নিকাল রাহি হ্যায়
য়ো শের য়ো নাগমো মে ঢাল রাহি হ্যায়
কে দিলকে আঙান মে জ্যায়সে কোয়ি
গাযালকি ঝাঁঝার ছানাক রাহি হ্যায়
মালিকা-এ-তারান্নুমের ফেলে আসা সিংহাসনে ততদিনে নতুন উত্তরাধিকার। নতুন রানি কিন্তু আগের জনের পরিবার, গোত্র বা জাতির কেউ না। বরং তাঁর জন্ম বেড়ে ওঠা অন্য ভাষায়। সম্পূর্ণ ভিন্ন রোদ, জল, মাটিতে তাঁর কণ্ঠের বিকাশ। কারণ রাজা-রানি, রাজপুত্র-রাজকণ্যা নয়, আমাদের সহজাত রাজতন্ত্রের মূল চালক জনগণ। গনতন্ত্রের অনুচ্চারিত মন্ত্র এখানে কাজ করে ভোট সংসদ সংবিধান ছাড়া, পুরোপুরি জৈবিক প্রেরণায়। সুররাজ্যে আমরা তাই শুধু কন্ঠ আর শ্রবণ। কেবল খোলা কান আর মন ডুবিয়ে গান গেয়ে যাওয়া। এই দুইয়ের মাঝে যোগাযোগ হয় সংকোচহীন, সরাসরি। অধিকাংশ মত-অমতের আদান প্রদানও হয় নির্জনে, কোলাহল ছাড়া।
নতুন রানির উপাধি কালের আবর্তনে হয়ে ওঠে “সুরের সরস্বতী”। ভাষা, সীমানা, ধর্ম, বর্ণ ছাপিয়ে তাঁর কণ্ঠস্বর পৌঁছে যায় পৃথিবীর আনাচে কানাচে। কাঁচা মাটির মতো শান্ত আবেগ মিশিয়ে তিনি দশকের পর দশক মানুষকে মোহিত করে রাখেন। না প্রেম, না বিয়ে, না সন্তান- সব ভুলে গানের সাথে তাঁর সোনালি সংসার চলে বহু যুগ ধরে। নতুন রানি ক্রমেই আরও রঙিন হয়ে ফুটতে থাকেন অজস্র জনমনে।
আঁখো সে ফির ইয়ে পেয়ার কি বারসাত হো না হো
শায়াদ ফির ইস জানাম মে মুলাকাত হো না হো
দুই সম্রাজ্ঞীর দেখাও হলো একদিন দেশ দুইটার যুদ্ধসংকুল সীমান্তে। ইতিহাসের সবচেয়ে সুরেলা দুই স্বরের মধ্যে কেমন অনুভবের আদান প্রদান হলো জানা গেল না। বরং ধীরে ধীরে দূর আকাশের নক্ষত্রের মতো তাঁরা রহস্যময় আর সময়হীন হয়ে উঠলেন। কেবল তাঁদের দুই ধরণের গানের মধ্যে তুলনা করেই লোকজন অতিবাহিত করে ফেলল দেশভাগের পর আরও চার বছর। পঞ্চম বছরে আবির্ভাব ঘটল তৃতীয় অভিজাত আওয়াজের। এবারও নারীকণ্ঠ। তাঁর সুরও মেঘের পালক হয়ে ছায়া ছড়াবে দেশ-কালের সীমানাহীন।
আমাদের বর্তমান সুর-সাম্রাজ্যের রাজকন্যার জন্ম হয়েছিল পাহাড়-টিলাময় প্রাণবান এক শহরে। মাঝখান দিয়ে বয়ে চলেছে সুরমা নদী। আশেপাশের চা-বাগান থেকে সুগন্ধ ছড়িয়ে সকাল-বিকাল গাড়ি এসে থামে সেই নদীর পাড়ে। সদ্য জন্ম নেয়া অতল কণ্ঠস্বর এখানকার জল-বাতাস থেকেই মাটির গন্ধ তুলে নিলেন, অজান্তে অনায়াসে। বাকি জীবন ধরে তাঁর গলায় যে ভেজা মায়ার দেখা মেলে, তার উৎস বোধহয় এই অতিবৃষ্টির শহর। এখানকার দীর্ঘ বর্ষাকাল যে শ্যাওলা সবুজ অমোচনীয় ছবি এঁকে দিয়েছিল, তাঁর কণ্ঠের বিরল জাদু সেই ছবির জয়গান করে যাচ্ছে চিরটাকাল।
বকের ডানায় ছাওয়া চরের কাছে
চাঁদ জাগা বাঁশ বাগানের কাছে
আমার অনেক ঋণ আছে

পঞ্চাশের দশকের মধ্যভাগ। আমাদের এই স্বাধীন রাজ্য তখন শোষিত বঞ্চিত প্রদেশ মাত্র। দেশের আরেক প্রদেশের অবস্থান খুবই বিচিত্র কারণে অনেক দূরের পশ্চিমে। মাঝখানে বয়ে গেছে অন্য ভূখণ্ড। দুই বিচ্ছিন্ন প্রদেশে যোগাযোগের উপায় তাই কেবল আকাশ আর সমুদ্রপথ। পূর্ব প্রদেশের রাজধানী থেকে পশ্চিমে যেতে উড়তে হয় প্রায় দেড় হাজার মাইল। সেই ভিনভাষী রাজধানীতে আমাদের গানের রানি যখন পৌঁছান, তখন তাঁর বয়স তিন। নতুন শহরের মাটিতে প্রথম হাঁটলেন তিনি মায়ের সুদৃঢ় হাতের আঙুল ধরে। বাগানের ঘাসের উপর অচেনা গাছের ছায়া। নরম জমিনে খোলা পা ফেলে সেই মেঘলা বিকেলে প্রায় বিশ মিনিট হাঁটলেন গানের রাজকন্যা। বাগানের ফুলগুলো বসন্ত বাতাসে দুলছে। সেই তালে গলা মেলানোর ইচ্ছা তার তখনও হয়তো জাগেনি। তবে ছোট্ট দুই পায়ে মৃদু সুরে ঘুঙুর বাজছিল বিরামহীন।
নাচ বোধহয় একধরণের গান। শুধু গলা না খেলে যেখানে বরং সারা শরীর দুলে ওঠে। শব্দ বাক্য গৌণ করে চোখ, বাহু, পায়ের পাতা রচনা করে কামনা বিলাপ আনন্দ বিদ্রোহের সাবলীল সব গল্প। শৈশবের হালকা সবুজ বছরগুলোতে আমাদের গানের ভবিষ্যত সম্রাজ্ঞীও নিজের সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে এঁকে নিয়েছিলেন ছন্দ লয়ের অপরিসীম বিন্যাস।
নাচের স্কুলের আয়োজনে অংশ নেয়া প্রথম অনুষ্ঠানে তিনি তাল মিলিয়েছিলেন একটা কয়েকশ বছরের পুরোনো সিন্ধি গানের সাথে। কোনো শব্দের মানে বোঝার মতো আবেগ তখনো তাঁর অবুঝ মনে জন্ম নেয় নাই। তিনি বরং দ্রুতগামী ঢোলকের দোলা বহু ভগ্নাংশে ভাগ করে নিলেন। দুই হাত মেলে মঞ্চের আলোয় নাচছেন আর মগ্নতার অন্ধকারে ভাঙছেন তবলার বোলগুলো। ওই বয়সে পায়ে তাঁর শক্তিই বা কতখানি? নুপূরে হয়তো তিনি সকল ঝংকার তুলতে পারলেন না, তবে জীবনের অভ্যন্তরে কোথাওনা কোথাও যত্নে তুলে রাখলেন তাল তারানার পরমাণু সমান সূক্ষ্মতা।
আবার গানও বোধহয় এক ধরণের নাচ। সারা শরীর হয়তো গাওয়ার সময় ছন্দবিধুর দুলে ওঠে না, কিন্তু কণ্ঠকে ঠিকই তবলা, পাখোয়াজ বা ড্রামসের সাথে মিশে যেতে হয়। সুর সম্রাজ্ঞী নৃত্য গীতের এই পরম যোগাযোগ জেনে গেলেন মাত্র ছয় বছর বয়সে। সেদিন আরো একবার মঞ্চে তিনি। তবে এইবার পায়ে ঘুঙুর নাই। নিজের চেয়েও বড় একটা তানপুরা কোনরকম স্পর্শ করে জীবনের প্রথম সঙ্গীত পরিবেশনা শুরু করলেন। হলভর্তি দর্শক এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। কেউ কেউ ভাবছে উঠে যাবে। তিনি দুই একটা সন্দেহ আক্রান্ত মুখের দিকে চাইলেন। এরপর সব ভুলে মন ডুবালেন সুর দরিয়ায়। শ্রোতাদেরকে অবাক করে দিয়ে রাগ-প্রধান একটা খেয়াল গাইলেন ভুলত্রুটিহীন দক্ষতায়। সেদিন সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার সময় গাড়ির সামনের আসনে বসে জানলা খুলে তিনি কিছু খোলা হাওয়া গায়ে জড়িয়ে নিলেন। বুঝে গেলেন সুর আর ছন্দের যোগাযোগ আসলে আদিমতম। নাচ থেকে গান, গান থেকে নাচে তাই চাইলেই যেকোনো মুহূর্তে যাতায়াত করা যায়। বিশেষ করে গানের সময় নাচের ছবি কণ্ঠের আড়ালে অনায়াসে দুলতে পারে দুরন্ত কলমি ফুলের মতো।
কথাগুলো তার অবচেতন মন ভাবলো কেবল। মুখে তো দূরের কথা, মনে মনে উচ্চারণের জন্যে দরকারি শব্দগুলোও কোন ভাষাতেই তিনি এখনও শেখার সময় পান নাই। তাঁর অবিশ্বাস্য গীতল জীবনের সিংহভাগ তখনও আগামী নামক দুর্গম কুয়াশার অন্তরালে।
চলবে…