Posts

ইন্টারভিউ

জাক লাকাঁর সাক্ষাৎকার : প্রথম পর্ব

June 20, 2025

saleh muhammed

Original Author L- Express

Translated by Saleh Muhammed

156
View

(জাক লাকাঁর এই সাক্ষাৎকারটি ১৯৫৭ সালের মে মাসে, এল’ এক্সপ্রেসে প্রকাশিত হয়) 

ইন্টারভিউয়ার: সাইকোএনালিস্ট তো মারাত্নক জিনিস। ভয়ই লাগে। কিরকম একটা মনে হয় যে, এই লোক চাইলেই নিজের ইচ্ছে খুশি মত আপনার মন নিয়ে খেলতে পারে। যে, নিজে আমি কি করি কি বলি সেটি নিয়ে আমি যা না জানি, উনি জানেন তার চেয়ে ঢের বেশী। ভয়েরই বিষয়।

  

ডক্টর লাকাঁ: বাড়িয়ে বলছেন। এটা করবেন না। এমনটা কি শুধু সাইকোএনালিস্টদের নিয়েই হয়? আপনার তাই ধারণা? অনেকের জন্য একজন অর্থনীতিবিদ কিন্তু একই প্রকারে রহস্যময়। আমাদের সময়ে এই একটা বিষয়। বিশেষজ্ঞকে লোকে ভয় পান। মনস্তত্ত্বের কথা ভাবুন। ওটাকেও বিজ্ঞান হিসেবে দেখা হয়। তারপরও মানুষ ভাবত যে এখানে তাদের একটা সুবিধা আছে। মনস্তত্ত্বকে নিজের আয়ত্তের বাইরে ভাবেননি তারা। এখন, সাইকোএনালিস্টদের বেলায় যেটা হচ্ছে যে, আমাদের মনে হচ্ছে ঐ সুবিধাটা আর নাই। যে, এনালিস্টের এরকম একটা ক্ষমতা আছে যে, আপাতদৃষ্টে বোধগম্য স্পষ্ট বিষয়ের ভেতরেও তিনি কোন একটি কুটিল রহস্যকে উদঘাটন করতে পারেন। ব্যাপারটা এমন হয় যে, একটি তথ্যে পুষ্ট চোখের সামনে আপনি শুয়ে আছেন নগ্ন, অনাবৃত শরীরে। চোখটি আপনার কি দেখে নিচ্ছে, দেখে কি জেনে ফেলছে সেটির কিছুই বুঝতে পারছেন না।

ইন্টারভিউয়ার: এটিতো অনেকটা সন্ত্রাসী গুন্ডাদের মত কাজ হল। মানুষটার মনে হবে, তার নিজের সত্তাটি থেকেই তাকে টেনে ছিড়ে আলাদা করল কেউ একজন।

 ডক্টর লাকাঁ: সাইকোএ্যানালাইসিসের সাথে কপার্নিকাসের ঘটনার মিল আছে। এটিও একই প্রকারে পরিধ্বংসী এবং কেলেঙ্কারির গুণ সম্পন্ন। মানুষ নিজেকে ভাবত ব্রক্ষান্ডের কেন্দ্রে। কপার্নিকাস সেটিকে উল্টে দিলেন। এখন মানুষ, তার নিজের মানুষ হওয়ার বিষয়টাকে যেভাবে বুঝত সেটিকেও একই প্রকারে ওলটপালট করে দিচ্ছে সাইকোএনালাইসিস। কপার্নিকাস জানালেন, পৃথিবী, যে গ্রহে মানুষ বাস করে, সেটি আর ব্রক্ষান্ডের মধ্যমণি নয়! এখানেও তো তাই! সাইকোএনালিস্টরাও ঘোষণা দিচ্ছেন, আপনি নিজে এখন আর আপনার মানবসত্তাটির মধ্যমণি নন। কারণ নিজের ভেতরেও আছে আরেক সাবজেক্ট। আরেক সত্তা। দি আনকনশাস। অবচেতন মন। প্রথমদিকে এই সংবাদ ভালোভাবে গ্রহণ করেননি কেউ। ফ্রুয়েডের ব্যাপারে যে একটা ফালতু ‘অযৌক্তিকতা’র দোহাই দেয় লোকে, হাহ! যেখানে আসল ঘটনা পুরোই বিপরীত: যা কিছু যুক্তির বিরুদ্ধাচারণ করত, তাদের সবটাকেই তিনি যুক্তির আয়ত্তে নিয়ে আসেন। তিনি আসার আগ পর্যন্ত এই কাজটি আর কেউ করতে পারেননি। শুধু তো তাই না। তিনি এটাও দেখালেন যে, মানুষের যে কোন ক্রিয়ার সময় একটি যুক্তির প্রক্রিয়া চলমান থাকে। মানে, এমন কিছু যেটা যুক্তিকে আশ্রয় করে কাজ করছে, নিজেও যুক্তি দিচ্ছে, কিন্তু সাবজেক্ট (ব্যাক্তি) জানছে না। এই সবটাকে, ক্লাসিকাল চোখ দিয়ে দেখলে হয়, ফিল্ড অফ দি ইরর্যাশানাল। আমরা ধরেন বললাম, ফিল্ড অফ প্যাশান। অনুরাগের ক্ষেত্র। আর ঠিক এটার জন্যই লোকে ফ্রয়েডকে ক্ষমা করতে পারল না। যে, তিনি সেক্স নিয়ে আসলেন। মানুষকে প্রথমবারের মত জানালেন, যৌনশক্তিগুলো সহসাই, কোন যুক্তি ব্যাতীতই সাবজেক্টকে পরাভূত করতে পারে। তারপরও যৌনতার এই সত্যকে তো স্বীকার করতে হয়েছে। তবে হ্যাঁ, এই যে যৌনতার একটি বক্তব্য আছে, তারপর নিউরোসিস (মানসিক ব্যাধি) একটি রোগ যেটা কথা বলে, এসব তো একটু অদ্ভুতই। এমনকি ফ্রয়েডের শিষ্যরাও মনে করেন, এখানে আমরা অন্য কিছু নিয়েই বলছি। একজন মনোবিশ্লেষককে আপনি “আত্নার ইঞ্জিনিয়ার” হিসেবে দেখলে হবে না। সে কিন্তু ঐ অর্থে ডাক্তার না। কয-ইফেক্টের সম্পর্ক গড়ে গড়ে তিনি অগ্রসর হন, এমন নয়। মনোবিশ্লেষকের বিজ্ঞান হচ্ছে পাঠ করা। এটা হচ্ছে বোধের পাঠ। যেকারণে, নিঃসন্দেহেই, তাঁকে, যিনি ঠিকমত জানেনই না অফিসঘরের দরজার পেছনে কি লুকনো রয়েছে তাঁর জন্য, সাধারণ ভাবে লোকের কাছে তো ওনাকে মনে হয়ই যেন একজন জাদুকর, এরকম অন্য যারা আছেন, তাদের সবার থেকেও প্রবল কিছু।

ইন্টারভিউয়ার : আর এই লুকনো ভয়ঙ্কর জিনিসকে যিনি আবিষ্কার করলেন, তাঁর কি হল?  

ডক্টর লাকাঁ: আসলে আবিষ্কার না। এই সুপ্ত বিষয়গুলোর ধরণটি কেমন সেটি নির্দিষ্ট করতে পারলেই কাজ হয়। এগুলো তো আর প্রকৃতিতে লুকিয়ে থাকা সত্য না। মানে যেমনটা, জীববিজ্ঞান এবং পদার্থবিজ্ঞানে আবিষ্কার করে থাকে। সাইকোএনালাইসিস যদি যৌনতা নিয়ে কিছু সত্য সামনে আনেই, সেটি কিন্তু আমাদের যাপিত বাস্তবতার প্রেক্ষিতে নয়। জৈবিক অভিজ্ঞতাটিকে এখানে বোঝানো হয় না।

ইন্টারভিউয়ার: কিন্তু, ধরেন ফ্রয়েড, তিনি তো আবিষ্কার করেছেন, তাই না। যেভাবে লোকে অজানা মহাদেশ আবিষ্কার করে, সেভাবেই তিনি মানসিক জীবনের একটি নতুন মাত্রা আবিষ্কার করলেন। সেটাকে ‘অবচেতন’ না অন্য কি জানি একটা বলে না ? ফ্রয়েড তো দেখা যায় আপনার ক্রিস্টোফার কলম্বাস!

ডক্টর লাকাঁ: চেতনার নাগালের বাইরেও যে অনেক মানসিক কার্যকলাপ ঘটে থাকে- সেটি জানার জন্যে তো আমাদের ফ্রয়েড পর্যন্ত অপেক্ষা করার দরকার পড়ে নি! যদি তুলনাই চান, তবে ফ্রয়েডকে  চ্যাম্পোলিয়ান (মিসরীয় হায়ারোগ্লিফের পাঠোদ্ধারকারী) ভাবতে পারেন! মানুষের যেই স্তরটিতে সহজাত প্রবৃত্তি আর প্রাণশক্তিগুলোর অবস্থান, ফ্রয়েডিয়ান অভিজ্ঞতাটি কিন্তু সেখানে হয় না। আমি মনে করছি, ফ্রয়েডিয়ান অভিজ্ঞতায় এই বিষয়গুলো আবিষ্কার হয় একমাত্র তখনই, যখন অপ্রধান অন্য একটি শক্তির ওপরে ফ্রয়েডকে প্রয়োগ করা হয়। সহজাত প্রবৃত্তির প্রভাবান্বিত ‘প্রাথমিক শক্তি’ নিয়ে কাজ করে না ফ্রয়েড। বিষয়গুলো বিশ্লেষণযোগ্য কারণ তারা ইতিমধ্যেই সাবজেক্টের ইতিহাসের সামগ্রিক স্বতন্ত্রতার ভেতরে সুস্পষ্ট রূপে ফুটে আছে। সাবজেক্ট ওটার ভেতরে নিজেকে চিনতে পারবে যদি সাইকোএনালাইসিসে এই সুস্পষ্ট বিষয়টিকে দ্বীতিয় অপ্রধান একটি কারও ওপরে প্রয়োগ করতে দেয়া হয়।

অন্য কথায়, সাবজেক্ট যখন “দমন” করেন, তার মানে এই নয় যে সাবজেক্ট তার কোন একটি প্রবৃত্তি বিষয়ে সচেতন হতে চাচ্ছেন না। যেমন, কারও একটি যৌন প্রবৃত্তি। এই প্রবৃত্তির বিষয়টি অবদমিত। যদি বেরিয়ে আসে, তাহলে সমকামিতার রূপে প্রবৃত্তিটি নিজেকে প্রকাশ করবে। এখানে কি হচ্ছে? সাবজেক্ট কি নিজের সমকামিতাকে অবদমন  করতে চাচ্ছেন? মোটেও না। সাবজেক্ট তার সমকামিতাকে কখনই প্রত্যাখ্যান করেন না। তিনি দমন করেন তার ভাষণকে। তার যেই ভাষ্যে, সমকামিতা ‘সিগনিফায়ার’ (মূর্ত) সেটিকে তিনি চেপে যান। মানে বুঝলেন তো, এটা কিন্তু কোন অস্পষ্ট, অনিশ্চিত বিষয় নয় যেটিকে তিনি দমন করে রেখেছেন। এটি তার কোন প্রয়োজন বা প্রবৃত্তি। সমকামিতাকে দমন করার একটি প্রবৃত্তি তার সহজাতভাবেই আছে, এরকম নয় বিষয়টা (কারণ, তাহলে অবদমিত হওয়ার কারণে আর কখনও অস্তিত্বমানই হত না সমকামিতা)। বরঞ্চ এটা তার এক ধরণের বক্তব্য। যেটি ইতিমধ্যেই নিজস্ব ব্যাকরণে সুগঠিত। ইতিমধ্যেই যেটি একটি আস্ত ভাষার রূপ পেয়ে গেছে। আবিষ্কার করার কিছু নেই, কারণ সবটাই আবিষ্কৃত অবস্থায় ইতিমধ্যেই আপনার সামনে সাজানো।

ইন্টারভিউয়ার : আপনি বলছেন যে সাবজেক্টের একটি ভাষা আছে। সেই ভাষায় সে একটি স্পষ্ট বক্তব্য রচনা করেছে। তারপর ভাষা শুদ্ধু বক্তব্যকে অবদমন করে রাখছে। অথচ, তারপরও যখন মানসিক সমস্যায় থাকা কারও সাথে, ধরুন মুখচোরা ধরণের কেউ বা বাতিকগ্রস্থ  কারও সাথে যখন আমাদের দেখা হয়, তখন কিন্তু ওদের মাঝে নিজেদেরকে আমরা খুঁজে পাই না। তাদের কাজকর্ম দেখলে আমরা ভাবি, কেমন অদ্ভুত কারবার। কি পাগলামি করছে এরা এসব। আর আমরা যদি অনুমান করি যে এর কোন একটি অর্থ হবে, তাহলে এটা স্পষ্ট নিশ্চিত কিছু হয় না। একটা দ্বিধাপূর্ণ ভগ্নস্বরের মত হয়। ভাষার যে পর্যায়ের জিনিস, তার অধঃস্তন একটি পর্যায় থেকে একে অনুভব করতে হবে। আর একজন মানুষের যখন মনে হয় যে দুর্বোধ্য সব শক্তিতে সে পীড়িত, যাকে আমরা সাধারণ ভাবে বলি নিউরোটিক, এসব তো শক্তি একদম দেখাই যায় যে অযৌক্তিক সব কার্যকলাপের মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করছে, সাথে থাকে বিভ্রান্তি আর উদ্বেগ!

ডক্টর লাঁকা: আপনি যেটা দ্যাখেন, সেটা হচ্ছে উপসর্গ। আপনার কাছে এগুলোকে পাগলামি বা অযৌক্তিক আচরণ মনে হয় কারণে আপনি এই ঘটনাকে একটা বিচ্ছিন্ন জিনিস হিসেবে বিবেচনা করছেন। এবং উপসর্গেটিকে সরাসরি বিশ্লেষণ করছেন। বা আক্ষরিক অর্থে সেটিকে গ্রহণ করছেন। একটা উদাহরণ দেই। ইজিপশিয়ান হায়েরোগ্লিক্স। ইজিপশিয়ান এই লিপির দিকে তাকালে দেখা যায়, শকুন, মুরগী, দাড়িয়ে থাকা, বসে থাকা, হাঁটতে থাকা মানুষ ইত্যাদি। এখন যতক্ষণ এসব প্রতীকগুলোকে আপনি আক্ষরিক অর্থে দেখবেন ততক্ষণ লিপির মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারবেন না। কারণ “শকুন” প্রতীকটির শুধুমাত্র শকুন হিসেবে কোন অর্থই হয় না। এই প্রতীকটি যে ভাষা ব্যবস্থার সেটি প্রেক্ষিতে যখন এটিকে বিবেচনা করবেন একমাত্র তখনই শকুনের ছবিটা একটা অর্থ দিতে পারবে আপনাকে। তো, সাইকোএনালাইসিসের নিয়মটাও এরকমই। তারা (উপসর্গগুলো) একটি ভাষা ব্যবস্থার (ল্যাংগেজিয়া- ফরাসিতে) অংশ। একজন সাইকোএনালিস্ট একটি অজানা উপমহাদেশের সন্ধানরত অভিযাত্রী নন। অতল অন্ধকার গহীন থেকে কিছু তুলে আনতে হচ্ছে না তাকে। সাইকোএনালিস্ট হচ্ছেন আপনার একজন ভাষাবিদ। তিনি ভাষা বিজ্ঞানের চর্চা করেন। তার চোখের সামনে যা লেখা আছে, সেটিকে তিনি পড়তে শেখেন। এই লেখাটি শুধু সাইকোএনালিস্ট না, সব মানুষের চোখের সামনেই আছে। কিন্তু যারা আমরা পড়তে জানি না, তাদের কাছে মনে হয় হাবিজাবি দুর্বোধ্য় একটা কিছু। সুতরাং পড়তে জানাটাই প্রধান। 

সূত্র: http://braungardt.trialectics.com/projects/psychoanalysis/lacans-life/interviewjacques-lacan/

Comments

    Please login to post comment. Login