শুরুর দিনগুলো
ঢাকার ব্যস্ত রাস্তায় প্রথম দেখা হয়েছিল ওদের। তিথি তখন সদ্য ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে, আর আরিফ ফাইনাল ইয়ারে। প্রথম দেখাতেই তিথির মনে হয়েছিল, এই ছেলেটা অন্যরকম। অন্যসব ছেলেরা যেমন হইচই করে, আরিফ বরং চুপচাপ, নিজের জগতে ব্যস্ত থাকে। লাইব্রেরিতে বসে বই পড়ে, ক্যানটিনে বসেও গানে ডুবে থাকে। সেই গভীরতা, সেই নিরবতা তিথির মনে নাড়া দিয়েছিল।
তিথি ধীরে ধীরে খেয়াল করতে লাগলো, আরিফ প্রায়ই তাকে লক্ষ্য করে, কিন্তু কিছু বলে না। একদিন লাইব্রেরির করিডোরে বই নিতে গিয়ে তিথির হাত থেকে বই পড়ে গেল, আরিফ তা তুলে দিয়ে বললো,
“তুমি বুঝি রবীন্দ্রনাথ পছন্দ করো?”
তিথি একটু লাজুক ভঙ্গিতে মাথা নাড়ালো।
“তবে একটা কবিতা শোনাও না কখনো?”
তিথির ঠোঁটে একটুকরো হাসি খেলে গেল। সে জানতো, এই প্রথম কথা কিন্তু শেষ কথা নয়।
২. বন্ধুত্বের গল্প
ধীরে ধীরে ওদের বন্ধুত্ব জমে উঠলো। ক্লাস শেষে দু’জনে বসে গল্প করতো, বই আদান-প্রদান হতো, তিথির প্রিয় চা দোকানটায় বসে বৃষ্টির দিনে চা খেতো।
তিথি ছিলো উচ্ছ্বসিত, প্রাণবন্ত। আরিফ ছিলো শান্ত, গভীর। কিন্তু ঠিক এই বিপরীত গুণগুলোই যেন একে অপরের প্রতি আকর্ষণ তৈরি করলো।
তিথি মাঝে মাঝেই ভাবতো—আসলে ও কি ওকে ভালোবাসে? আরিফ কিছু বলেনি কখনো, কিন্তু তার চোখ, তার আচরণ—সবই যেন একটা না বলা ভালোবাসার ইঙ্গিত দিত।
একদিন তিথি সাহস করে জিজ্ঞেস করেই ফেলল,
“তুমি কখনো কাউকে ভালোবেসেছো?”
আরিফ একটু চুপ করে থেকে বললো,
“ভালোবাসা কখনো শব্দে বলা যায় না, তিথি। এটা বোঝা যায়।”
তিথির বুকটা ধক করে উঠল। সে বুঝে গেল, এই ছেলেটা অনেক কিছু বলতে চায়, কিন্তু পারে না।
৩. সময়ের বাঁক
ভার্সিটি শেষ হলো। আরিফ চাকরির জন্য বাইরে চলে গেলো। তিথি মাস্টার্সে ভর্তি হলো। মাঝে মাঝে মেসেঞ্জারে কথা হতো, কিন্তু ধীরে ধীরে কমে আসলো। একদিন তিথি মেসেজ পাঠালো:
“তুমি কি ফিরে আসবে?”
আরিফ উত্তর দিলো না।
তারপর অনেকদিন কেটে গেল।
তিথি ভাবতো, হয়তো ওর জীবনে কেউ এসেছে। হয়তো ভালোবাসা ছিলো একপাক্ষিক। কিন্তু মন মানতো না। কারণ সে জানতো, আরিফের চোখে সে ভালোবাসা সে দেখেছে।
৪. হঠাৎ একদিন
তিথি তখন একটি স্কুলে শিক্ষকতা করছে। হঠাৎ একদিন স্কুলের গেটের সামনে একটা পরিচিত ছায়া দাঁড়িয়ে ছিল। সে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো।
আরিফ!
চোখে সেই আগের গভীরতা, তবে এবার ক্লান্তিও ছিল।
“তুমি এসেছো?” তিথির গলা কেঁপে উঠলো।
“হ্যাঁ। এসেছি... অনেক কিছু বলা বাকি ছিল, তাই।”
ওরা দু’জনে পাশের ক্যাফেতে বসল। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে আরিফ বলল,
“আমি অনেক সময় নিয়েছি। কিন্তু প্রতিদিন তোমার কথা মনে পড়েছে। আমি বুঝতে পেরেছি, আমার পৃথিবী শুধু তোমাকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে।”
তিথি কিছু বললো না। শুধু চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রুটা মুছে নিল।
৫. শেষটা একটু বেশিই মিষ্টি
কয়েক মাস পর ওদের বিয়ে হলো। বড় আয়োজন নয়, ছোট্ট করে, প্রিয় মানুষদের নিয়ে।
আরিফ এখন লেখালেখি করে, তিথি স্কুলে পড়ে। বৃষ্টির দিনে চায়ের কাপে ভাসে তাদের পুরোনো দিনের গল্প।
তিথি আজও মাঝে মাঝে প্রশ্ন করে,
“তুমি তখন চুপচাপ থাকলে কেন?”
আরিফ হেসে বলে,
“ভালোবাসা কখনো চিৎকার করে বলা যায় না, তিথি। অপেক্ষা করলে সে ঠিক নিজেই কথা বলে।”
