Posts

উপন্যাস

প্রথম প্রেমের স্পর্শ : পর্ব ২-শরতের সন্ধ্যায় নীলার ছায়া

June 27, 2025

এম এম মাহবুব হাসান

150
View

প্রথম প্রেমের স্পর্শ

পর্ব ২: শরতের সন্ধ্যায় নীলার ছায়া

লেখক: এম এম মাহবুব হাসান

বইমেলার সেই মুহূর্তের পর কেটে গেছে ছয় মাস। তবু নীলার বলা সেই কথাটি—“তুমি এখনো আগের মতোই আছ”—আজও আমার হৃদয়ে প্রতিধ্বনিত হয়। প্রতিদিনের অফিস, শহরের কোলাহল, মানুষের ভিড়—সব কিছুর মাঝেও মনের অজান্তেই হঠাৎ ওর মুখটা ভেসে ওঠে।

একদিন খুব একাকিত্ব মনে বারান্দায় বসে আছি। লম্বা নারকেল গাছের নুয়ে পড়া পাতার উপর একটি ঘুঘু পাখি কুক্-কুক্ কুক্-কুক্ করে গলা ফুলিয়ে ডাকছে। অনেকক্ষণ ডাকাডাকির পরেও তার সঙ্গীর কোনো সাড়া নেই। হতে

পারে ঘুঘু পাখিটি এখনো একাই। এর মধ্যে হঠাৎ করেই ইনবক্সে একটি অচেনা নম্বর থেকে মেসেজ এল—

“তুমি কি পরশু বিকেলে ধানমণ্ডি ৮ নম্বরে ছিলে?”

—নীলা

এই ছোট্ট বার্তাটি পেয়ে মনে হয় হৃদয়ে এক প্রকার শীতল হাওয়া বয়ে গেল। কী উত্তর দিই বুঝতে পারছিলাম না, আবেগে আমার হাত কাঁপছিল, তবু লিখলাম:

“হয়তো ছিলাম, হয়তো সবসময়ই থাকি তোমার আশপাশে… কিন্তু তুমি কি চাও আমি আবার থাকি?”

কয়েক মিনিট পর মেসেজের উত্তর এল:

“তুমি আসবে? আগামি শুক্রবার বিকেল সাতটায় ‘নীল কফিশপে’? আমি সেখানে অপেক্ষা করব।”

সেই শুক্রবার যেন আমার জীবনের দীর্ঘতম দিন। প্রতিটি মুহূর্ত যেন থমকে ছিল। বারবার আয়নায় নিজেকে দেখেছি—চুল, জামা, মুখভঙ্গি… সব কিছু যেন আরেকবার ওর সামনে দাঁড়ানোর উপযুক্ত হয় কি না, তা যাচাই করে নিচ্ছিলাম। তবুও সময় যাচ্ছিল না। এর মধ্যে অনেক কিছু ভেবে নিয়েছি নীলাকে নিয়ে। নীলা এমনই মেয়ে, যাকে নিয়ে ভাবতে গেলে মিনিট-ঘণ্টা-দিন কখন যে পার হয়ে যায় কিচ্ছু ঠিক থাকে না।

সাতটা পাঁচে ঢুকলাম কফিশপে। কোণার দিকে বসে ছিল নীলা। নীল শাড়ি, খোলা চুল, হালকা কাজল, ঠোঁটে কোনো রং নেই—তবুও যেন এক অপূর্ব সাজে নীলা।

আমি সামনে বসতেই দুজনেই কিছু সময় চুপচাপ। শব্দহীন চোখাচোখি—কিন্তু তাতে ছিল এক গভীর সংলাপ, না বলা আকুতি।

— “কেমন আছ তমাল?” এটা বলতে গিয়ে ওর গলা কাঁপছিল।

— “ভালো… কিন্তু এই ভালোতে তুমি নেই।”

ও চোখ নামিয়ে নিল। একটু দম নিয়ে বলতে লাগল:

— “আমার বিয়ে ঠিক হয়েছিল। শেষ মুহূর্তে ভেঙে গেল। আমি কাউকে ভালোবাসতে পারিনি। কারণ সম্ভবত একটিই, আমি তোমাকে ভুলতে পারিনি।”

চারপাশের সব শব্দ থেমে গেল যেন। হঠাৎ একটি টিকটিকি যেন ঠিকঠিক শব্দে ডেকে উঠল। আমি খুব ধীরে ওর আঙুলে হাত রাখলাম—প্রথমবার, সাহস করে।

ও কেঁপে উঠল, কিন্তু হাত সরায়নি। আমার বুকের ভেতর বয়ে গেল এক মরু-ঝড়।

— “তুমি চাইলে আজ কিছু না বলেই পাশে বসে থাকতে পারি… প্রতিটি নিঃশ্বাসে তোমার কাছে থাকব।”

আমার প্রস্তাবে সায় দিয়ে ও মাথা নাড়ল। তারপর বেশ আত্মবিশ্বাসের সাথে বলতে লাগল:

— “আজ খুব একা লাগছিল। শরতের বাতাস যেমন নিঃশব্দে মন ছুঁয়ে যায়, তেমন করে তুমি পাশে থেকো… শব্দ ছাড়া, ব্যথা ছাড়া।”

কফির কাপ শেষ করে আমরা বাইরে এলাম। হালকা ঠান্ডা হাওয়া বইছে। ওর চুলের ফাঁকে একটি চেনা সুগন্ধ এসে লাগল নাকে—এক সময় কলেজ করিডোরে যেটা আমাকে বারবার কাঁপিয়ে দিত।

নীলাকে নিয়ে ওর বাসার সামনে এসে দাঁড়ালাম।

— “চলে যাবে? নাকি আমার হাতের এক কাপ চা খাবে?”

আমি কোনো কথা না বলে মাথা নাড়লাম। বাসার ভিতরে ঢুকলাম।

ও চা বানাচ্ছিল, আমি বসে ছিলাম। এতদিন কিছু একটা নীরব টান যেন মাঝখানে লুকিয়ে ছিল—আজ না আছে কোনো জবাবদিহি, না আছে কোনো প্রশ্ন।

চা নিয়ে এসে ও পাশে বসল। আমি ওর হাতে হাত রাখলাম। তারপর হঠাৎ ওকে বুকের ভেতর টেনে নিলাম। ওর কানের পাশে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললাম:

— “নীলা, এত দিন কেন দূরে ছিলে?”

ও কেঁপে উঠল, তবু সরে গেল না। ওর গায়ের সেই চেনা সুগন্ধ আমাকে বিমুগ্ধ করে তুলল।

রাত গভীর হচ্ছিল। ওর ঘরটা নিঃশব্দে ভরে উঠছিল সেই অতীত, যেটা আমরা দুজনেই মাটি চাপা দিয়ে রেখেছিলাম। আমি ধীরে ধীরে ওকে রুমের ভিতরে টেনে নিয়ে গেলাম। আমরা একে অপরের গরম নিঃশ্বাস অনুভব করতে থাকি। ও আমাকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল…

সেই রাতে…

আমরা একে অপরকে ছুঁয়ে দেখলাম নতুন করে—কিন্তু সেই ছোঁয়ায় লুকানো ছিল বহু দিনের না বলা কথা, ফেলে আসা চিঠির অপ্রাপ্ত উত্তর, কিছু কবিতা, কিছু চোখের ভাষা।

নিঃশব্দে আমরা নিজেদের খুঁজে নিলাম, হারিয়ে যাওয়া সময়ের মধ্যে। ওর শরীরের উষ্ণতা, চোখের জল, আমার কাঁপা ঠোঁট—সব কিছু মিলে এক অপরিণত প্রেম পূর্ণতা পেল।

সেই রাতে কোনো প্রতিশ্রুতি ছিল না। কোনো দায় ছিল না। ছিল কেবল এক অভিমান-ভাঙা নিঃশ্বাস, আর একবার ফিরে পাওয়ার সাহস।

সকালে আমি যখন দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিলাম।

নীলা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বলল—

— “তোমার কি মনে হয়, আমরা আবার শুরু করতে পারি?”

আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলাম। তারপর বললাম—

— “প্রথম প্রেমকে শেষ করতে নেই। শুধু তাকে সাহস দিয়ে জাগিয়ে তুলতে হয়। আমি শুরু করেছিলাম, কিন্তু তুমি পূর্ণ করেছ।”

ও কিছু বলল না। শুধু হালকা করে হাসল—যে হাসিতে ছিল কিছুটা অনুশোচনা, আর গভীর স্বস্তি।

আমি চলে এলাম। কিন্তু জানতাম—সেই রাতে যা হয়েছিল, তা ভুলে থাকা সম্ভব নয়।

আমরা কেউ জানি না ভবিষ্যতে কী আছে। কিন্তু শরতের সেই সন্ধ্যায়, নীলার ছায়া আমার জীবনে ফের একবার আলো হয়ে ফিরে এসেছিল।


 

(চলবে)

Comments

    Please login to post comment. Login