ফিলিস্তিনের ধূলিমাটি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে রক্ত আর কান্নায় ধুয়ে যাচ্ছে। ১৯৪৮ সালের মে মাসে ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার সাথে সাথেই ফিলিস্তিনি মুসলমানদের জীবনে যে “নাকবা” বা “মহাবিপর্যয়” নেমে এসেছিল, তা আজও থামেনি। এই ঐতিহাসিক ক্ষত শুধু ফিলিস্তিনিদের জন্য নয়, বরং সমগ্র আরব ও মুসলিম বিশ্বের জন্য এক নৈতিক পরীক্ষা। বর্তমান গাজা স্ট্রিপে চলমান সংঘাত ও ফিলিস্তিনি দুর্ভোগ নাকবার সেই কালো অধ্যায়কে নতুন করে সামনে নিয়ে এসেছে।
১৯৪৮ সালের ১৪ মে ইসরায়েল রাষ্ট্র ঘোষিত হওয়ার পর থেকে ফিলিস্তিনের ইতিহাসে এক অমোচনীয় ক্ষত সৃষ্টি হয়। সেই ক্ষতের দায় জাতিসংঘের ১৯৪৭ সালের রেজোলিউশন ১৮১। কারন এই রেজোলিউশনই ফিলিস্তিনকে ইহুদি ও আরব রাষ্ট্রে বিভক্ত করার প্রথম পরিকল্পনা দেয়। কিন্তু ফিলিস্তিনি আরবরা এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। কারণ তাদের ৬৭% জনগোষ্ঠীর জন্য বরাদ্দ হয়েছিল মাত্র ৪৩% ভূমি, যেখানে ৩২% ইহুদি জনগোষ্ঠী পেয়েছিল ৫৬ শতাংশ। এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে আরব লীগ যুদ্ধ ঘোষণা করে। কিন্তু আরবদের বিভক্তি, সমন্বয়হীনতা ও দুর্বল প্রস্তুতি ইসরায়েলের সুসংগঠিত সামরিক শক্তির কাছে সহজেই পরাজিত হয়। এই যুদ্ধে প্রায় সাড়ে সাত লাখ ফিলিস্তিনি তাদের ঘরবাড়ি ছাড়তে বাধ্য হন। গ্রামের পর গ্রাম ধ্বংস হয়ে যায়, পরিবারগুলো ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে। এই ঘটনাকেই ফিলিস্তিনিরা “নাকবা” নামে অভিহিত করেন। তাদের পৈতৃক মাটিতে ফেরার স্বপ্ন নিয়ে জর্ডান, লেবানন, সিরিয়া ও গাজার উদ্বাস্তু শিবিরে আশ্রয় নেন। কিন্তু ইসরায়েল জাতিসংঘের প্রস্তাবিত ভূমির বাইরেও ফিলিস্তিনের ৭৮শতাংস ভূমি দখল করে, যা ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের সম্ভাবনাকে ক্রমশ দূরীভূত করে। নাকবা শুধু জমি হারানোর গল্প নয়, এটি সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও মানুষের পরিচয় হারানোর কাহিনি। পৈতৃক বাড়ির চাবি হাতে নিয়ে আজও তারা বাস করে উদ্বাস্তু শিবিরগুলোতে, এই চাবিই যেন তাদের একমাত্র আশার প্রতীক।
বর্তমান গাজা স্ট্রিপ ফিলিস্তিনি দুর্ভোগের এক জ্বলন্ত প্রতীক। নাকবার পর থেকে গাজা উদ্বাস্তুদের আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠে, কিন্তু এখন এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় “উন্মুক্ত কারাগার”। মাত্র ৩৬৫ বর্গকিলোমিটারে ২৩ লাখ মানুষের বাস! যেখানে ইসরায়েলের অবরোধ জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। বিদ্যুৎ নেই, নেই পানি আর না আছে চিকিৎসা—শুধু বোমার শব্দ আর ধ্বংসের ধূলিকণায় ভেসে বেড়ানো রক্তের গন্ধ। জাতিসংঘের তথ্যমতে ২০২৩-২৪ সালে ইসরায়েলের সামরিক অভিযানে গাজার ৮০% মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। জাতিসংঘ এবং অন্যান্য মানবাধিকার সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, এই সময়ে গাজায় কমপক্ষে ৪১,০০০ মানুষ নিহত এবং ৯৫,০০০-এর বেশি মানুষ আহত হয়েছে। যদিও জাতিসংঘ পক্ষপাতদুষ্ট রিপোর্ট করছে, তারপরও চিন্তা করুন……। গাজার এই সংকট নাকবার এক আধুনিক প্রতিচ্ছবি। ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনিরা যেমন তাদের গ্রাম থেকে উৎখাত হয়েছিলেন, তেমনি আজ গাজার বাসিন্দারা বোমার আঘাতে বাড়ি হারাচ্ছেন। হামাসের মতো প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলো লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু তাদের সীমিত অস্ত্র ইসরায়েলের উন্নত সামরিক শক্তির কাছে অপ্রতুল। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিষ্ক্রিয়তা গাজার ক্ষতকে আরও গভীর করে রেখেছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা শক্তিগুলো ইসরায়েলকে সামরিক ও কূটনৈতিক সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। গাজার এই ট্র্যাজেডি প্রমাণ করে যে নাকবা কোনো অতীত ঘটনা নয়; এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া, যা ফিলিস্তিনিদের অধিকারকে প্রতিনিয়ত পদদলিত করছে।
ফিলিস্তিন ইস্যুতে আরব বিশ্ব বিশেষ করে সৌদি আরবের ভূমিকা একটি নৈতিক দায়িত্ব হিসেবে বিবেচিত হয়। মক্কা-মদিনার অভিভাবক হিসেবে সৌদি আরবের কাছ থেকে ফিলিস্তিনিদের প্রতি বিশেষ সমর্থন আশা করা যায়। কিন্তু ১৯৪৮ সাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত তাদের অবস্থান প্রতিশ্রুতি ও বাস্তবতার মধ্যে দোলাচলে রয়েছে। ১৯৪৮ সালে সৌদি আরব বাদশাহ আবদুল আজিজের নেতৃত্বে, ফিলিস্তিনের পক্ষে সোচ্চার ছিল। আরব লীগের মাধ্যমে তারা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সমর্থন দেয়। কিন্তু তাদের অংশগ্রহণ ছিল প্রায় নগণ্য। তাদের এই সীমিত ভূমিকা অবশ্যই সমালোচনার বিষয়। আরব জনগণের সমর্থন পেতে তারা ফিলিস্তিন ইস্যুকে প্রচারণার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে এবং উপস্থিত অপরিপক্ক, অপরিকল্পিত একটি যুদ্ধ-নাটক তৈরি করে বর্তমান যুগের গাজা পর্যন্ত দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের জন্ম দিয়েছে। বাস্তবে পশ্চিমা শক্তি বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে তারা বেশি মনোযোগী ছিলো। তাদের এই দ্বৈত নীতি ফিলিস্তিনের বৃহত্তর সমস্যার প্রতিফলন। মিসর, জর্ডান, সিরিয়ার মতো দেশগুলো যুদ্ধে অংশ নিলেও, তাদের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস ও সমন্বয়ের অভাব ছিল। তাদের এই বিভক্তি ফিলিস্তিনিদের পরাজয়ের পথ প্রশস্ত করে। ২০২৫ সালে সৌদি আরব ও আরব বিশ্বের অবস্থান আরও হতাশাজনক। ২০২০ সালের আব্রাহাম অ্যাকর্ডে আমিরাত, বাহরাইনের মতো আরব দেশগুলো ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে, আর সৌদি আরব তাতে নীরব সম্মতি দেয়। ২০২৩ সালে গাজায় ইসরায়েলি হামলার সময় সৌদি আরব নিন্দা জানায়, ১৫ মিলিয়ন ডলারের ত্রাণ ঘোষণা করে, কিন্তু তেল নিষেধাজ্ঞা বা কূটনৈতিক বয়কটের মতো বিজ্ঞানসম্মত বাস্তব ও কঠোর পদক্ষেপে তারা যায়নি। এই নিষ্ক্রিয়তা সৌদি আরব ও আরব বিশ্বের নৈতিক ব্যর্থতার প্রতীক। অন্যদিকে আরব জনগণের মধ্যে ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থন অটুট। এক জরিপে দেখা গেছে, ৯৬% সৌদি নাগরিক ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের সমর্থক, কিন্তু সৌদি সরকার জনমতকে দমন করে এই ইস্যুকে কূটনৈতিক টেবিলেই সীমাবদ্ধ রেখে দিয়েছি। আরব বিশ্বের অন্যান্য দেশও একই পথে। মিসর ও জর্ডান, যারা ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তি চুক্তি করেছে, গাজার সংকটে কার্যকর কিছু করেনি। আমিরাতের মতো দেশগুলো ফিলিস্তিনকে পাশ কাটিয়ে ইসরায়েলের সাথে বাণিজ্য বাড়িয়েছে। সৌদি আরব ও আরব বিশ্ব তেল সম্পদ ও আঞ্চলিক প্রভাব দিয়ে ইসরায়েলের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারত, কিন্তু তারা তা করেনি।
নাকবা ছিল ফিলিস্তিনি জনগণের ইতিহাসে এক মর্মান্তিক অধ্যায়, যা তাদের ভূমি, পরিচয় ও স্বপ্ন কেড়ে নিয়েছিল। বর্তমান গাজার সংকট সেই ট্র্যাজেডির এক জীবন্ত প্রতিধ্বনি, যেখানে ফিলিস্তিনিরা ধ্বংস, অবরোধ ও বাস্তুচ্যুতির মধ্যে বেঁচে আছেন। ফিলিস্তিনের মাটি এখনও ন্যায়বিচারের জন্য কাঁদছে। এই কান্নার জবাব শুধু ইসরায়েলকেই দিতে হবনা, বরং আরব বিশ্বের সেইসব রাষ্ট্রনায়কদেরও দিতে হবে যারা ফিলিস্তিনের নামে শপথ করে ক্ষমতায় এসেছে। কিন্তু পশ্চিমাদের খুশি রাখতে গাজা আর জেরুজালেমকে বিস্মৃত করেছে। এই অমানবিক নীরবতা, এই নিষ্ক্রিয়তা একদিন ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড়াবে। কেননা ফিলিস্তিনের প্রশ্ন শুধু একটি জাতির অধিকারের নয়, এটি মানবতার, ন্যায়বিচারের এবং সত্যের প্রশ্ন। নাকবা আজও থামেনি—কারণ বিশ্ব আজও চোখ বুজে আছে, আর আরব বিশ্ব বেছে নিয়েছে নীরব আপস।
লেখক:
মাহফুজ বিন মোবারকপুরী
প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট।