আমার আর সোহাগের পাঁচ বছরের সম্পর্ক। সোহাগ জোর জবরদস্তি করেই এতটা বছর ধরে রেখেছে আমাকে। কিন্তু আমি ওর উপর অনেক নিষ্ঠুর হয়ে যাচ্ছি। হবো নাই বা কেন? আমার শারীরিক নির্যাতন আর ভালো লাগছে না, হয়তো এত বছরে এই ব্যথা সহ্য হয়ে যাওয়া উচিত ছিল। শুনেছি মার খেতে খেতে এক সময় নাকি চামড়া শক্ত হয়ে যায়, কিন্তু আজকাল উল্টো ওর হাতে চড় খেতে আমার আরো বেশি ব্যথা লাগছে আগের থেকে।
একদিনের এক ঘটনা বলি। সম্পর্কের দুই বছরের মাথায় একদিন ও হঠাৎই বলল ওর জন্য খিচুড়ি রান্না করে নিয়ে যেতে। খিচুড়ি রান্নার পাশাপাশি আমাকে আবার ওর সামনে সুন্দর করে সেজেও যেতে হবে, আর সবকিছু আধা ঘণ্টার মধ্যে করতে হবে। ও আবার খুব পাংচুয়াল আমার বিষয়ে। আমাকে ঠিক সময়মত এসে ওর জন্য অপেক্ষা করতে হবে, কিন্তু বিষয়টা তার জন্য আবার একই নয়। তো যাই হোক, প্রেসার কুকারে খিচুড়িটা দিয়ে ঝটপট গোসলটা সেরে নিলাম। সব কিছু ঠিকঠাক করে সেজেগুজে ওর জন্য বের হলাম, চুল ভেজা, কিন্তু সময় ছিল না পুরো শুকানোর, যদিও আমার ভীষণ সাইনোসাইটিস এর প্রবলেম। তবে মস্ত বড় একটা ভুল করে বসেছিলাম—খিচুড়ি তো নিয়ে গেছি, কিন্তু চামচ নিয়ে যাইনি। পরে ভাবলাম হাত দিয়ে খেতে অবশ্য তেমন সমস্যা হওয়ার কথা না।
টিফিনবক্স হাতে ওর জন্য অপেক্ষা করছিলাম শহীদ মিনারের সামনে। ও প্রায় দশ মিনিট পরে এলো। এসেই একটা হাসি দিলো—তাতে বুঝলাম, আমাকে আজ ওর কাছে সুন্দর লাগছে। সুন্দর না লাগলে আবার বাসায় পাঠিয়ে দিয়ে সুন্দর করে সেজে বের হতে বলতো। একবার আমি আমার মার হাতের সেলাই করা সালোয়ার কামিজ পরে বের হয়েছিলাম, মানে জামাটা বানানো শেষ হতেই আমি পরে নিলাম। ভাবলাম, নতুন জামা পরে ওর সামনে যাবো, ওর সঙ্গে দেখা করতে বের হয়েছিলাম দুপুরে। আমাকে দেখা মাত্রই বললো,
“তুমি এটা কী পরে আসছো? দেখতে তো পুরোটাই ক্ষ্যাত লাগতেছে তোমারে।”
আমি বললাম,
“থাক সোহাগ, এভাবে বলো না। এটা মাত্রই আমার মা বানিয়ে দিয়েছেন, তার নিজের হাতের সেলাই করা জামা নিয়ে কিছু বলো না প্লিজ।”
কিন্তু ও বললো,
“তোর মা জামা বানাতে পারে না তো বানায় কেন্? বাসায় যা, পাঁচ মিনিটের মধ্যে চেঞ্জ করে আসবি, না হলে জামার হাতা ছিঁড়ে ফেলবো।”
ওকে অনেক বুঝিয়ে বলার পরও কোন লাভ হলো না। আমার চোখ দিয়ে পানি পড়তে থাকলো অবিরাম। খুব অভিমান করে বাসায় ফিরে গেলাম। আর মোবাইলটা বন্ধ করে রাখলাম, যাতে ও আমাকে কোনো ফোন দিতে না পারে। কিন্তু সমস্যা হলো—ও আমাদের বাসার ল্যান্ডফোন নম্বর আর ঠিকানা সবই জানে। সম্পর্কের শুরুর দিকে যখন ওর আসল রূপ সম্পর্কে আমার কোনো ধারণাই ছিল না, তখনই ওকে আমি আমার ল্যান্ডফোন এর নম্বর, আমার মায়ের মোবাইল নম্বর দিয়ে দিয়েছিলাম। আর বাসার ঠিকানাও ওর জানা ছিল যেহেতু দেখা করা শেষে প্রতি বার ও আমাকে বাসা পর্যন্ত পৌঁছে দিতো—“সো কল্ড কেয়ারিং” মুখোশ পরে।
ও যথারীতি ল্যান্ডফোনে মিসকল দিয়েই যাচ্ছে। আর আমার মা বারবার ফোনটা রিসিভ করতে গিয়ে থেমে যাচ্ছেন। ভেবেছিলাম, ওয়াশরুমে গোসল করতে গিয়ে খানিকটা সময় কেঁদে নিব। কিন্তু সেটারও সময় পেলাম না, ওদিকে আবার আমার রুমের জানালা দিয়ে দেখি—ও বাসার সামনে ফুটপাথে বসে আছে। আমি মোবাইলটা অন করে ওকে বললাম কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে, আর ল্যান্ডফোনে বারবার কল না দেওয়ার জন্য অনেক আকুতি মিনতি করলাম। সে আমার উপর দয়া করলো।
আমি বাসা থেকে বের হয় আবার ওর সঙ্গে দেখা করলাম। সেদিন আর না পেরে বলেই ফেললাম যে, “আমি আর পারছি না। আমাকে মাফ করে দাও। আমি এই সম্পর্কে থাকলে একদিন মরে যাবো।”
চিৎকার করে কাঁদলাম সোহাগের সামনে, রাস্তার মানুষগুলো দেখছে, কিন্তু তাতে ওর কিছু যায় আসছে না।
এক পর্যায়ে আমি ভীষণ চেঁচামেচি আর ছাঁটাছাঁটি করতে শুরু করলাম। আর তখন ও ভাবলো এইবার তাকে কঠিন হতেই হবে—আমাকে সে মাথায় তুলে বেশ লাই দিয়ে ফেলেছে। কিছুক্ষণ পরে এজন্য সে তার পায়ের চটি খুলে আমার ডান গালে বসিয়ে দিলো এক ঘা। অন্য সময় হাত দিয়ে মারে, বা আমার চুল পেছন থেকে টেনে ধরে, নয়ত হাতটা ধরে মোচড়ে দেয় সামান্য। কিন্তু তার মনে হয়েছে—এটা যথেষ্ট নয়। তাই নেক্সট স্টেপে এগিয়ে গেল। রাস্তার মানুষ গতিশীল, তাই হয়তো তারা কেউ আমাকে বাঁচাতে আসলো না। সেদিন অবশেষে রাক্ষসটার কাছে আমি হার মেনেই নিলাম। চটির আঘাতে আমি আমার ভুল বুঝতে পারা অর্থাৎ অনুতপ্ত হওয়ার একটা মিথ্যে নাটকের আশ্রয় নিলাম এবং তার কাছে ক্ষমা চাইলাম। কারণ এই ক্ষমা না চাইলে আমি আমার বাসায় ফিরতে পারব না। আর সন্ধ্যার আগে পৌঁছাতে না পারলে মা-বাবাও আমাকে বাসায় ঢুকতে দিবে না। আর আমার এই তীব্র কড়া পরিবারের কথা সম্পর্কের প্রথম এক মাসেই বুঝে গিয়েছিল সোহাগ আর সেটার সম্পূর্ণ সুযোগ নিতে সে কখনো একটুও দ্বিধা করেনি।