Posts

ফিকশন

প্লাটফর্মে এক আসমান ঘুম

June 30, 2025

সাজিদ রহমান

165
View

জীবনের অন্যতম সেরা ঘুম হয়েছিলো তেজগাঁও রেলস্টেশনের প্লাটফর্মে।

সেই ঘুমের ৩০ বছর পুর্তি হতে চললো। এই শহরে কেটেছে জীবনের এক যুগের বেশি সময়। এরপরে প্রায় দেড় যুগ ধরে অসংখ্য বার আসা যাওয়া ছিল। স্মৃতির জলে জাগ দেয়া থাকলেও সে ঘুম-স্মৃতির আঁতুড় ঘরে আর ফেরা হয় নি। ইদানিং দিনের একটা বড় সময় তেজগাঁও এ কেটে যায়। তেজগাঁও রেলস্টেশনও খুব একটা দুরেও নয়।

একদিন। অফিস শেষ। নিয়াত করি, সেই প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে গভীর ঘুমের সেই বালককে দেখে আসি। কিছু সময়ের জন্য সেই সময়ে পরিভ্রমণ করি।

নুরনবীকে তেজগাঁও রেলস্টেশনের দিকে যেতে বলি। সাতরাস্তা থেকে মেয়র আনিসুল হক সড়ক ধরে কিছুটা এগিয়ে যায়। এরপর ডান দিকের গলিতে ঢুকে পড়ে সে। পথ শেষ। নেমে পড়ি।

রেলওয়ে থেকে বেড়া দিয়েছিলো। এখন সেসবের কিছু চিহ্ন আছে মাত্র। প্রায় রেললাইন পর্যন্ত ট্রাক মেরামতের কারখানা। অন্যান্য দোকান পাট। একটার পর একটা। সারাদিন সরকারকে গালি দেয়া লোকগুলো সরকারি জায়গা পেলে দখলে নেয়। দোকানের সামনের ফুটপাথ, রাস্তার অংশ বিশেষ নিজের ব্যবসার কাজে খাটায়। আর যারা সরকারকে খুব পেয়ার করে, তাঁরা আর একটু বেশি দাবি করে। প্লাটফর্ম পর্যন্ত যেতে এর কোন ব্যতিক্রম চোখে পড়েনি। এর ভিতর গলে রেললাইনে পা দিতে বেশ গলদঘর্ম হতে হলো।

এখন অপেক্ষায় আছি, ঢাকার রেললাইনের উপর গড়ে উঠা এই বাজার কবে ব্যাংককের 'মেকলং রেলওয়ে মার্কেট' বা 'ছাতা পুল ডাউন মার্কেট' এর মত খ্যাতি লাভ করবে। কিছু বিদেশি পর্যটক এলেও না হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভে ২/৪ ডলার জমা হত।

২।

একটা সময় ছিল। রেল কলোনির মাঠে ফুটবল খেলা শেষ করে রেললাইনের পাতের উপর দিয়ে হেটে (বন্ধুদের মধ্যে বাজি হত, না পড়ে কে কতদূর যেতে পারে) স্টেশনে পৌঁছে যেতাম। গরু বা খাসির পায়া দিয়ে গোটা কয়েক পাতলা রুটি মেরে দিয়ে বাড়ির রাস্তা ধরতাম। আজ আবার রেললাইনে পা দিতেই মনটা চনমনে হয়ে উঠল। রেললাইনের সাথে আমার শৈশবের ভার্চুয়াল কানেকশন আছে। পা দিলেই সেখানে ফিরতে পারি।

একটা, দুইটা, তিনটা রেললাইন পার হয়ে প্লাটফর্মে উঠে যাই। মানুষে গিজ গিজ করছে। সবাই কথা বলছে, কে যে কার কথা শুনছে। আমি গিয়ে এক পাশে দাড়াই।

আমি ও আমার ইমিডিয়েট বড় অহিদ ভাই, দুজনে মিলে লোকাল বিশ্ব টুরে বের হয়েছিলাম (সময়টা সম্ভবত ১৯৯৫ এর জানুয়ারি)। পার্বতীপুর থেকে ঢাকা মেইল ধরে গাইবান্ধা ফুলছড়ি ঘাট, লঞ্চ করে ব্রহ্মপুত্র পার হয়ে ওপারে জামালপুরের বাহাদুরাবাদ ঘাট। বিশেষ বাহাদুর যারা তাঁরা লঞ্চ ঘাটের জেটিতে টাচ করার আগেই দে লাফ, সেখান থেকে দে দৌড় দিয়ে ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেনে আসন নিশ্চিত করে। আমাদের মত ছোট, দুর্বল ও নালায়েকের জন্য দাঁড়িয়ে যাওয়া আগে থেকেই নির্ধারিত থাকে।

সেই ট্রেন যখন My men sing পৌঁছে, তখন আরেক বিরহের গান শুরু হয়। পিছনের দুইটা বগিকে ডিভোর্স দিয়ে (সেখানে রেখে) ট্রেন চলে যায় ঢাকা শহর। যে অংশ ঢাকা যায়, সে হয়ত ঢাকা শহর দেইখ্যা মনের আশা পুরায়। আর ডিভোর্সি দুখিনীর জন্য বরাদ্দ থাকে '...এক নজর না দেখিলে বন্ধু/ দুনিয়া আন্ধার হয়/ পাশে তোমায় না পাইলে বন্ধু/দম যেন মোর যায়/ও বন্ধু তুমি কই কই রে/এ প্রাণও বুঝি যায় রে......'

কেসসা সেখানেই খতম হয় না। দুখিনী নারীর (ফেলে রাখা দুই বগি) সাথে অন্য একজনের নিকাহ করে দেয়া হয় (অন্য ট্রেনের সাথে জুড়ে দেয়া হয়)। এরপর সেই ট্রেন রওয়ানা দেয় চিটাগং। 'দুঃখিনী, দুঃখ করোনা' বলে আমরা ওর সঙ্গী হতে চাই। কারণ আমাদের ডেসটিনেশন বন্দর নগরী। কিন্তু সেই একই কাহিনী, দুঃখিনী নারীর পেটে জায়গা হয় না। বহুত কসরত করে ওর পিঠে উঠে পড়ি (ছাদে উঠি)। এরপর সে ভৈরব, লাকসাম হয়ে আমাদের চাটগাঁ পৌঁছে দেয়। সময় লাগে মাত্র ৩২ ঘণ্টা।

জুলভার্নের বিখ্যাত উপন্যাস 'Around the world in eighty days' এ প্রধান চরিত্র ফিলিয়াস ফগ লন্ডনের একটা ক্লাবে বন্ধুদের সাথে বাজি ধরে ৮০ দিনে সারা বিশ্ব ঘুরে বেড়ান। পরবর্তীতে ১৯৫৬ সালে একই নামে হলিউড থেকে সিনেমা নির্মিত হয়, যাতে লাউয়াছড়াও আছে, আছে রেললাইনের পাশ দিয়ে হাতি চলে যাওয়ার দৃশ্য। বিশ্ব যখন ৮০ দিনে ঘুরে দেখা যেত, তারও বহু বছর পরেও দিনাজপুর থেকে চিটাগং যেতে ৩২ ঘণ্টার বেশি সময় লাগতো। আমরা কতটা এগিয়ে ছিলাম, এসব ছিল তার নির্নায়ক মাত্র!

সে যাক গে। চিটাগং পার্ট শেষ করে আমরা ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা করি। উত্তরায় চাচা থাকেন। ঢাকায় কয়দিন ঘুরে ঘারে ঘরের ছইল ঘরে ফিরে যাবো। তখনও সব ট্রেন বিমানবন্দর স্টেশন ধরে না। আমরা যখন তেজগাঁও স্টেশনে পৌঁছলাম, মধ্যরাতের ঘড়ির কাটা অনেক আগেই ডান দিকে হেলে গেছে।

জীবনে সেই প্রথম এক নতুন দৃশ্য দেখি। প্লাটফর্মে পা ফেলার জায়গা নেই। সারি সারি মানুষ ঘুমিয়ে আছে। ঠাণ্ডার মধ্যেও অনেকের গাঁয়ে বলতে গেলে কিছুই নেই। আমরাও গরীব এলাকার মানুষ, নিজেরাও হাতি ঘোড়া মেরে বেড়াই, সেরকম গোছের মানুষ নই। তারপরেও প্লাটফর্মে শুয়ে থাকা অসংখ্য মানুষ আমার মাঝে বিস্ময় জাগায়।

শেষ কয়েক দিনের টানা জার্নিতে আমি ক্লান্ত। চোখে আমার এক আসমান ঘুম। অত রাতে স্টেশন ত্যাগ করা মোটেও ঠিক হবে না। ঢাকা শহর। শুনেছি সেখানে হোটেলে মাংস খেতে গিয়ে অনেকেই মেয়েলি আঙ্গুল, আংটি সমেত পেয়েছে। চুরি ছিনতাই খুব মামুলি বিষয়, ওয়ান টু কা ফোর। দুই ভাই মিলে যৌথ সিদ্ধান্ত নিই। রাতটা প্লাটফর্মে কাটিয়ে দেবো। ভোর হলে উত্তরায় চলে যাবো। এরপর ঢাকা ঘুরবো।

দুই ভাই মিলে ফাঁকা জায়গা খুজতেছি। আমার পক্ষে জেগে থাকা সম্ভব নয়। শুয়ে থাকা অনেক মানুষের ভিড়ে একটা জায়গা পেয়ে যাই। ব্যাগ খুলে কিছু একটা বিছানো হবে।

এই সময় এক বেরসিক লোক এসে জিজ্ঞেস করে, টিকেট দেখাও।

আমরা একটা পাশ নিয়ে এসেছিলাম। রেলের স্টাফরা পরিবার সমেত ঘোরার জন্য পেয়ে থাকে।

অহিদ ভাই সেই পাশ দেখায়।

আমাদেরকে তাঁর সাথে অফিসে যেতে বলে। এরপর দুই ভাইকে দুই জায়গায় নিয়ে জেরা করে।

তখন এটার চল ছিল। একজনের পাশ নিয়ে অন্যজন ঘুরে বেড়ানোর। আমরাও সেই সুযোগ নিয়েছিলাম।

অহিদ ভাই যে তথ্য দিয়েছে, আমি দিয়েছি ভিন্ন তথ্য। এই অপরাধে আমাদেরকে নিয়ে একটা ঘরে আটকিয়ে রাখে। সকাল হলে পুলিশে দিবে। ভয় দেখায়। আমি খুব ভয় পেয়ে যাই। কিন্তু অহিদ ভাই ঘাবড়ায় না। মুলামুলি করে ১০০ টাকা দিয়ে আটকাবস্থা থেকে মুক্তি মিলে।

আমার চোখে প্রচণ্ড ঘুম। আর মনে ভীষণ ভয়। আবার বুঝি কেউ এসে ধরে নিয়ে যাবে। আমরা প্লান করি, খুব ভোরে প্লাটফর্ম থেকে বের হয়ে যাবো।

ঘুমানোর জায়গায় ফিরে আসি। কিছু একটা বিছায়ে দেয় অহিদ ভাই। আমি ঢলে পড়ি। এবং মুহুর্তের মধ্যে ঘুমিয়ে যাই। অহিদ ভাই সম্ভবত জেগেই ছিল। দুইজনে ঘুমিয়ে গেলে ব্যাগ চুরি হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। সকালে ভাই যখন ডাকে, বুঝতে পারি কী দারুণ এক ঘুম থেকে উঠলাম। ওরকম প্রচণ্ড ঘুম নিয়ে আর কোনদিন ঘুমাতে গেছি, মনে পড়ে না। ঘুম থেকে উঠে অত গভীর ভালো লাগা, আর কোনদিন আসে নি।

৩।

জীবন সেরা ঘুমের সেই তেজগাঁ রেলস্টেশন, সেই প্লাটফর্ম দেখতেই ফিরে এসেছি। তখনই একটা ট্রেন আসে। ট্রেন ছাড়া একটা স্টেশন প্রাণহীন মানবদেহের মত মনে হয়। ট্রেনটা এসে আমার স্টেশনে আসাকে সার্থক করে তুলে। কিছুটা শান্ত প্লাটফর্ম গমগম করে উঠে। ট্রেনটা কিছুক্ষণ থেমে হুইসেল বাজিয়ে অন্য ষ্টেশনের উদ্দেশ্যে চলে যায়।

দিনের হাতে তখনও সময় আছে। সন্ধ্যা নামার আগে। যাত্রীদের খেয়াল করতে থাকি। অনেক মানুষের ভিড়ে ঠিকঠাক ভাবে কাউকে দেখা হয় না। যদি সুযোগ পাই, অন্য কোন দিন অনেক রাতে এসে বসে থাকবো। একটা আসা অবধি। আর দেখবো, সেই ৯৫' এর মত কেউ প্লাটফর্মে পা দিলো কি না। ঘুম ঘুম চোখে এদিক ওদিক জায়গা খুঁজে কি না। গভীর একটা ঘুম দেয়ার জন্য।

এখানে আরও একদিন ফিরে আসবো।

Comments

    Please login to post comment. Login