Posts

নন ফিকশন

ইউক্লিডের নাতি ও গডোর ফিরে আসা

July 6, 2025

সাজিদ রহমান

205
View

ঢাকার জীবনকে এক কথায় প্রকাশ করলে কি বলা যাবে? 'দিল্লীর লাড্ডু'। যারা ঢাকার বাইরে থাকেন, তাঁরা দিল্লীর লাড্ডুর অভাব খুব অনুভব করেন। আর যারা প্রতিনিয়ত লাড্ডুর ভিতর গড়াগড়ি খান, তাদের আফসোস আরও বেশি। ঢাকার জীবন একই সাথে চিত্তাকর্ষী ও বিরক্তিকর।  

ঢাকায় নতুন এসেছি। উত্তরায় আবাস, মতিঝিলে কলেজ। প্রতিদিন সায়েদাবাদ-গাজীপুর রুটের বাসে উঠি। সাড়ে ৪ টাকা ভাড়া, আমাদের জন্য আড়াই টাকাই মাফ। বাসে আসতে যেতে পরিচয় হতে থাকে নতুন নতুন বন্ধুদের সাথে। একেক জন দেশের একেক প্রান্ত থেকে আসা। রফিকের সাথে পরিচয় হল, আমি থাকি ওর বেশ কাছেই। আরেকদিন পরিচয় হল আশরাফের সাথে। খুবই দুরন্ত, দ্বিতীয় প্রজন্ম সুত্রে ঢাকার পোলা। বাসে আলাপ হল সোহেলের সাথে। ওরা খিলখেতের স্থানীয়। এই রুটে আমরা অনেকে ছিলাম। আসা যাওয়ার পথে কত স্মৃতি তৈরি হতে থাকলো।এখন আর সবার কথা মনে নেই। অনেক স্মৃতি হারিয়ে গেছে।

ছোট একটা ঘটনা ভুলিনি। দেরিতে ঘুম ভাঙ্গায় লুঙ্গির উপর প্যান্ট পরেই বাসে উঠেছে এক বন্ধু। বাস থেকে কলেজ গেটে নেমে প্যান্ট নিচে নামিয়ে লুঙ্গি কাচা দেয়া শুরু করে। আমরা টের পাই। এরপর যে যার মত হাসতে থাকি। ফাদার পিশেতোর কথা ভোলার উপায় নেই। ফার্স্ট ইয়ারের শুরুতেই দ্বিতীয় বর্ষের অপটিকস পড়াতে এসে সোজা বাংলায় কথা শুরু করলেন। আমেরিকান সাদা চামড়ার একজনের মুখে বাংলা শুনে বিস্মিত না হওয়ার কোন সুযোগ নেই।

খুব ভালো লাগতো টেরেন্স পিনেরু স্যারের ইংরেজি পড়ানো। টেরেন্স স্যারের সাথে অনেক বছর পর দেখা হয়েছিলো 'সয়াবিন চা গরম' ক্যান্টিনে। তখন তিনি সাভারে অবস্থিত গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান। সেই ভার্সিটির ক্যান্টিনের নাম সয়াবিন চা গরম, সেখানে একদিন এগিয়ে গিয়ে পরিচয় দিয়েছিলাম স্যারকে। বাংলার মোখতার স্যার বিখ্যাত ছিলেন দুই কারণে। প্রথমত সুবর্না মোস্তফার প্রেমে ছ্যাকা খেয়ে চিরকুমার থেকে, দ্বিতীয়ত সিরাজউদ্দৌলা নাটকে ঘষেটি বেগমের চরিত্র উন্মোচন ও তাঁর জন্য বিশেষ কিছু শব্দ বরাদ্দ রেখে। গাজী আজমল স্যারও অসাধারণ। প্রাণীবিদ্যা পড়াতে পড়াতে ছাত্রের বিয়ে শাদী বাচ্চার জন্ম পর্যন্ত পৌঁছে যেতেন। কলেজের বাইরে সিডির দোকানে হঠাৎ করে শুনি, 'টু ফোর ফোর ওয়ান ওয়ান থ্রি নাইন......' সেই বয়সে মোখতার স্যারের কথায় কথায় টইটুম্বর রস, গাজী স্যারের আলাপ ভালো না লেগে উপায় আছে!!  

         
 এত কিছুর মাঝেও নিমাই স্যারের কথা মনে আসছে। এর কারণ অবশ্য নিমাই স্যার নয়, ইউক্লিডের নাতি। ইউক্লিড ছিলেন একজন প্রাচীন গ্রিক গণিতবিদ, যিনি "Father of Geometry'  হিসেবে সুপরিচিত। তিনি প্রায় ৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আলেকজান্দ্রিয়া শহরে বসবাস করতেন। মিশর এক সময় গ্রিকের রাজধানী ছিল।  আলেকজান্দ্রিয়াও ছিল গ্রিক রাজ্যের অংশ। নিমাই স্যার চমৎকার ম্যাথ পড়াতেন।  এক একটা নতুন ধরণের অংক শিখিয়ে সমস্যা সমাধান করে দিতেন। ক্লাসের সবাই তৃপ্ত, বুঝতে পেরে। কিন্তু একজন ঠিক হাত তুলতো। হাত উঁচু রেখেই সে স্যারকে চ্যালেঞ্জ করে বসতো।

স্যার, আমি যদি আপনার ব্যাখ্যা না মানি, আপনার যুক্তি অস্বীকার করি?

শুরুতে ওর হাত তোলা, প্রশ্ন করাটা বেশ চমৎকারিত্ব পায়। সবাই প্রশ্ন করতে পারেনা। কিন্তু দিনের পর দিন, একই কথা। 
আমি যদি আপনার যুক্তি না মানি, তাহলে উত্তর কি? 

নিমাই স্যার থমকে যেতেন। এরপর মাথা ঠাণ্ডা রেখে উত্তর দিতেন।

সেই থেকে নিমাই স্যারের ক্লাস শেষ হলে আমরা অপেক্ষায় থাকি।

হাত কখন উঠবে? মুখ নিসৃত অমিয় প্রশ্ন কখন আসবে?

এরপর ক্লাসের বাকি পোলাপাইন ওর একটা নাম দেয়। ইউক্লিডের নাতি। কলেজ পাশের পর আর কোনদিন তাঁর সাথে দেখা হয়নি। কথাও না। 
কার কাছে শুনলাম, সে ইউএসএ চলে গেছে। সে আর ফিরবে না।

২।
আইরিশ লেখক উইলিয়াম বেকেট ১৯৬৯ সালে নোবেল পান। তারই বিশ্ববিখ্যাত সৃষ্টি ওয়েটিং ফর গডো (waiting for godot)। সেখানকার প্রধান দুই চরিত্র – ভ্লাদিমির ও এস্ট্রাগন – এক গাছের নিচে অপেক্ষা করে এক রহস্যময় ব্যক্তির জন্য, যার নাম গডো (Godot)। তারা জানে না গডো কে, কখন আসবেন, আদৌ আসবেন কি না — তবু তারা অপেক্ষা করে। এধরনের সৃষ্টিকে অ্যাবসার্ডিজম বলে- যেখানে জীবনটাই অর্থহীন।

এই যুগেও এসে কেউ যদি ভাবে গডো আসবে, তাকে অসীম ধৈর্য ধরতে হবে। গত উত্তাল সময়ে যদি ভেবে থাকে, এই বার গডো হাতের নাগালে থাকবে, আগামীতে অধিক অনুগত হবে, সে অলীক কল্পনারই অংশ হবে।

আমাদের গডোর জন্য আমাদের অপেক্ষা থাকবেই। হয়ত সে আসবে, হয়ত কখনই দেখা দিবে না। হয়ত জীবনকে অর্থহীন মনে হবে।

তবুও গডোর জন্য অপেক্ষা করার নামই জীবন।

Comments

    Please login to post comment. Login