Posts

উপন্যাস

ত্রি-রমনী (পরিচ্ছেদ ০৮)

July 8, 2025

M. Khanam

8
View

সাধারন জামা-কাপড়ে চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে খানিকটা শোয়ার মত করেই চোখ বন্ধ করে বসে আছে মারজিয়া। সামনে স্ক্রিনে এক রুগীর রিপোর্ট দেখা যাচ্ছে। টেবিলের উপর খোলা একখানা মোটা বই, বাতাসে যার পাতা একা একা উল্টে যাচ্ছে। এক পুরুষ ডাক্তার এসে নিঃশব্দে মারজিয়ার পাশে দাঁড়ায়। বলে, একটু ঘুমিয়ে নিলেই পারতেন। শরীরেরও তো আরামের প্রয়োজন আছে নাকি? 

মারজিয়া খানিকটা চোখ খুলে সাদা এপ্রোণ পরা পুরুষ ডাক্তারটিকে দেখে। ক্লান্ত চোখে জিজ্ঞেস করে, তকী, কি চাই? 

জারিন ডাকছে। আপনাদের ডীনের সাথে মিটিং আছে নাকি। টেবিলে থাকা পানির বোতলটা মারজিয়ার দিকে এগিয়ে দেয় তকী। মারজিয়া সোজা হয়ে বসে পানির বোতলটা নেয়। বোতল থেকে খানিকটা পানি পান করে উঠে দাঁড়ায়। 

দরজায় নক করে ভেতরে ঢোকে জারিন ও মারজিয়া। জারিনের হাতে কয়েকটি ফাইল। 

ভেতরে ওয়াসিম চেয়ারে বসে মোবাইলে কথা বলছে, তুমি এত চিন্তা করো না। এই বয়সে ছেলেরা এমন একটুআধটু করে৷ ইশারায় জারিন ও মারজিয়াকে বসতে বলে। তারা চেয়ার টেনে বসে। ওয়াসিম ফোনে কথা বলতে থাকে—তোমার মনে আছে যখন আমাদের প্রথম দেখা হয়েছিলো, আমি কেমন ছিলাম? একবার বিয়ে হয়ে গেলে দেখবে একদম সোজা হয়ে গেছে। জারিন চেয়ারে বসার সাথে সাথেই চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে যায়। মারজিয়া তাকিয়ে একবার তাকে দেখে। এরপর নীচের দিকে তাকিয়ে বসে থাকে। কি যেন গভীর চিন্তায় মগ্ন সে। ওয়াসিম আড় চোখে মারজিয়াকে দেখে। এরপর মৃদু কন্ঠে ফোনে বলে, শুনো না, আমি একটু পর তোমাকে ফোন করছি। তুমি একদম চিন্তা করো না৷ বাসায় এসে আমি ওর সাথে কথা বলব—আচ্ছা, খাওয়াদাওয়া করো, যতই ব্যস্ত থাকো, খেতে যেন না ভুলো—হ্যাঁ, লাভ ইউ। 

ওয়াসিম ফোন রেখে জারিনের দিকে তাকায়৷ সে দিব্যি ঘুমাচ্ছে। কথার আওয়াজ বন্ধ হওয়ায় মারজিয়া মুখ তুলে তাকায়। ওয়াসিম মারজিয়াকে ইশারা করে জারিনকে ওঠানোর জন্য। জারিনের কপাল বরাবর জোরে টোকা দেয় মারজিয়া। চোখ খুলে বিরক্তি চোখে তাকায় জারিন।

ওয়াসিম বলে, সার্জন খান, সার্জন হোসাইন, দুঃখিত আপনাদের কিছুটা অপেক্ষা করালাম। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, সমস্যাটা আমার শালা। পুরুষ মানুষ সুন্দর হলে যে কি বিপদ! আপনাদের দুইজনেরই ভাই নেই৷ ছেলেদের সমস্যা সম্পর্কে তাই আপনাদের সম্ভবত কোনো ধারণাই নেই। একটু থেমে বলে, যাইহোক, এখন বলুন, আপনাদের দুই সুন্দরী রমনীকে আমি কিভাবে সাহায্য করতে পারি? 

হাতের ফাইলগুলো সামনে এগিয়ে দেয় জারিন। এই সার্জারিটার ব্যাপারে আপনার সাথে আলোচনা করতে চাচ্ছিলাম। আমাদের দুইজনেরই মনে হচ্ছে এই মুহুর্তে এই সার্জারিটা করা ঠিক হবে না। 

ওয়াসিম পৃষ্ঠা উল্টে-পাল্টে রিপোর্টগুলো দেখতে থাকে। বলে, আমার বাবা, সার্জন বাসিত জামানকে তো চিনেন আপনারা? 

মারজিয়া বলে, হ্যাঁ, দ্যা হ্যান্ড অব গড। 

ওয়াসিম হাসে। বলে, জী, ম্যারাডোনার পর দ্বিতীয় ঈশ্বরের হাত আমার বাবাই ছিলেন। ইন্টার্নি করার সময় দেখেছি কি লৌহমানব তিনি, এতটুকু বিচলিত হন না। এতটুক হাত কাঁপে না, চোখ কাঁপে না। হাসতে হাসতে বলে, ওনার স্পর্শ পাওয়া রুগীরা নাকি নতুন জীবন পেত। কিছুটা থেমে আবার পৃষ্ঠা উল্টায়। কিন্তু হাস্যকর ব্যাপার কি, জানো? আমার মাকে তিনি বাঁচাতে পারেন নি। এতেই বুঝা যায় পৃথিবীর ঈশ্বরদের সীমাবদ্ধতা থাকে। ফাইলটা বন্ধ করে জারিন ও মারজিয়ার দিকে তাকায় ওয়াসিম। তোমরা দুইজন আমার হাসপাতালের সবচেয়ে ট্যালেন্টেড সার্জন। এখানে এমনও ডাক্তার আছে যারা বিশ-ত্রিশ বছর যাবত অপারেশন থিয়েটারের আগে-পিছে আছে, কিন্তু তাদের ভেতরে সেই নিপুণতা নেই যা তোমাদের আছে। তোমরা যেহুতু মনে করছো বিষয়টা বিপদজ্জনক, আমরা সেভাবেই আগাব। ঈশ্বর বা ডাক্তার, আমাদের মূল লক্ষ্য রুগীর সুস্থতা। ওয়াসিম খানিকটা দুঃখী চোখে হাসে।
 

লাঞ্চ ব্রেকের সময় অফিসের ছাদে কফি হাতে বসে আছে আলিশা। এই জায়গাটা তার ভাল লাগে। শহরের এদিকটাতে এরচেয়ে উঁচু বিল্ডিং আর একখানাও নেই। তাই এর ছাদ থেকে শহরটা দেখতে একদম ভিন্ন লাগে। 

আলিশা উদাসীন চোখে কফিতে চুমুক দেয়। সামনে আরও একখানা খালি কফির মফ, কয়েকখানা চকলেট ও আইসক্রিমের র‍্যাপার। আলিশার মাথা ভর্তি গতদিনের চিন্তা। কিছুক্ষণ বাদেই অফিসের সময় শেষ হবে। অফিস শেষে জাকির সাথে দেখা করার কথা। দেখা হলেই বিয়ে নিয়ে কথা উঠবে। জাকিকে কিছু একটা জবাব দিতে হবে। আলিশা ভাবতে ভাবতে কফিতে চুমুক দেয়। হঠাৎ কারো পায়ের আওয়াজ পেয়ে পেছনে তাকায়। 

আগাগোড়া ব্রান্ডে মোড়া একখানা অতি সুন্দরী মেয়ে হেঁটে এসে আলিশার পাশে রেলিংয়ের দিকে ঝুঁকে দাড়ায়। তার দামী সুটের ভেতরের পকেট থেকে একখানা দামী সিগারেটের প্যাকেট বের করে। প্যাকেট থেকে একখানা সিগারেট বের করে মুখে দেয়। এরপর আলিশার দিকে প্যাকেটটা এগিয়ে দেয়। 

আলিশা বলে, আমি সিগারেট খাই না। 

মেয়েটি কিছু না বলে প্যাকেটটা বন্ধ করে আবার পকেটে ঢুকিয়ে রাখে। সোনালী রঙয়ের চমৎকার একখানা লাইটার বের করে সিগারেটটা জ্বালায়। লাইটারটা সূর্যের আলোতে চকমকিয়ে ওঠে। আলিশার সন্দেহ হয় লাইটারখানা সোনার। এবং তার সন্দেহ সত্যিও।   

এই মেয়েটি আর কেউ না, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম ধনী ব্যবসায়ী দাউদ কুরেইশীর একমাত্র কন্যা ও কুরেইশী এমপায়ারের ভবিষ্যৎ মালিক দামী কুরেইশী। আলিশা যে কোম্পানিতে কাজ করে সেই কিউ গ্রুপের বর্তমান সিইও তিনিই। নানা ঘটনা পরিক্রমায় পূর্বেও তাদের দেখাসাক্ষাৎ হয়েছে। এবং দামী কুরেইশীর ব্যাপারে একখানা বিষয় জেনে রাখা ভাল, তিনি কখনও কিছু ভুলেন না।   

দামী নির্দ্বিয়ায় আলিশার পাশে দাঁড়িয়ে  সিগারেট টানতে থাকে। আড় চোখে রেলিংয়ের উপর রাখা খালি প্যাকেট, ওয়ান টাইম মগটা দেখে। 

আলিশা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?

দামী ঘুরে রেলিংয়ে হেলান দিয়ে আলিশার দিকে তাকায়। সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে মাথা নাড়ায়। 

বিয়ে বিষয়টাকে আপনি কিভাবে দেখেন? আপনি কখনও বিয়ে করবেন?

দামী খানিকটা অবাক হয় তবে চেহারায় সেটা প্রকাশ পায় না। সামান্য হেসে আবার ঘুরে দাঁড়িয়ে  আকাশ দেখতে দেখতে জিজ্ঞেস করে, বিয়ে করছো নাকি? 

ভাবছি এ ব্যাপারে। 

দামী সিগারেটটা ঠোঁটে ঠেকায় এরপর ধোঁয়া ছেড়ে বলে, ভার্সিটিতে একজনের সাথে প্রেম করতাম। আমাদের গ্রাজুয়েশন পার্টির দিন আমরা বেশ আনন্দ-ফূর্তি করছি, নাচ-গান হচ্ছে। হঠাৎ গান থেমে গিয়ে বেশ রোমান্টিক একখান মিউজিক বাজতে শুরু করে। আমি তাকিয়ে দেখি আমার এক্স একখানা আংটি হাতে হাঁটু গেরে সামনে বসে আছে। 

আলিশা কৌতুহলী চোখে দামীর দিকে তাকায়। তারপর? 

দামী মৃদু হাসে। ওই মুহুর্তে আমি জীবনের সবচেয়ে বড় বোকামীটা করি। দামী ঘুরে আলিশার দিকে তাকায়। সামান্য হেসে বলে, আমি তাকে বলি যে আমি তাকে বিয়ে করতে পারব না। কারন সে ছাড়াও আমার আরও একাধিক পার্টনার আছে। দামী শব্দ করে হাসে। 

আলিশার চোখে-মুখে বিভ্রান্তি। এমনটা কেন করলেন?

আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। যতবার আংটিটা দেখছিলাম চোখের সামনে নিজের বাবা-মায়ের বিবাহিত জীবনটা আসছিলো, নিজের জায়গায় আমার সন্তানদের কল্পনা করছিলাম। সবমিলিয়ে একখানা বিয়ের মাধ্যমে আমার জীবনে যতটা দুঃখ আসতে পারে তার সবটা একসাথে কল্পনা করছিলাম। 

আমারও এমনই বোধ হয়, জানেন। ছোট থেকে মাকে আমার বাবার সংসারে এতটা সংগ্রাম করতে দেখেছি যে সবসময় সেই জীবনটা থেকে পালিয়ে বেড়িয়েছি। এত ঝামেলা আমার দ্বারা হবে না।

দামী হাসে। হাতের সিগারেটটা রেলিংয়ের উপর চেপে চেপে সেটার আগুন নিভিয়ে ফেলে দেয়। বলে, তোমাকে দেখলে আমার পারসার কথা মনে পড়ে। 

পারসা হাসান? ওই ক্রাইম রিপোর্টার?

হুম। সেও এমন বলত কখনও বিয়ে করবে না, বিয়ে-শাদি তার জন্য না। আজ সে বেশ সুখে স্বামী-সন্তান নিয়ে সংসার করছে। দামী শব্দ করে হাসে। 

উনি তো লেখক রঙ্গন রিফতির বউ।

হ্যাঁ। পারসাকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেন সে বিয়ে করল? ও বলেছিল, সে কখনও বিয়েতে বিশ্বাস করবে না, কিন্তু সে মানুষটার উপর বিশ্বাস করেছে। বিয়ে করলে হয়ত ভবিষ্যতে সব ঠিক থাকবে না, কিন্তু এই মানুষটাকে বিয়ে না করলে তার বর্তমানটাও ঠিক থাকবে না। কারন রিফতিকে ছাড়া বাকিটা জীবন সে আর কল্পনা করতে পারে নি। 

দামী থেমে হাসি মুখে আলিশার দিকে তাকায়। মোবাইলটা হাতে নিয়ে ইশারায় আলিশাকে কাছে ডাকে। আলিশা এগিয়ে যায়। মোবাইলে সোস্যাল মিডিয়া খুলে আলিশাকে দেখাতে দেখাতে বলে, এটা আমার ফেইক একাউন্ট। এই একাউন্টে আমি শুধু কবিরকে ফলো করি, আমার সেই এক্স। ছবি স্ক্রল করে করে আলিশাকে দেখায় দামী। প্রতিটা পোস্টে এক মহিলাকে দেখতে পাওয়া যায় কবিরের সঙ্গে। দামী শান্ত কণ্ঠে বলে, এটা ওর স্ত্রী। বেশ কয়েক বছর হল বিয়ে করেছে। দুটো বাচ্চাও আছে। সুন্দর একখানা সংসার হয়েছে তার। 

আলিশা কি বলবে বুঝতে না পেরে দামীর দিকে তাকিয়ে থাকে। তাকে নিয়ে অনেক ধরনের কথা শোনা যায়। দামী কুরেইশী যে সোনার চামচ মুখে নিয়ে দামী জন্মেছে, তাতে যে ডায়মন্ডের কারুকাজও ছিল তাতে কোনো সন্দেহ নাই। চরিত্র যেন তার বিশেষভাবে কলুষিত। কিন্তু সেই নারী যে আজ এক দশক পরও এক পুরুষের স্মৃতি মনে চেপে ধরে বেঁচে আছে—তা বোধহয় আলিশা কখনও ভাবে নি। 

দামী মোবাইলটা রেখে বলে, কবিরের পরে আমার জীবনে আসা প্রতিটা পুরুষে আমি তাকেই খুঁজেছি। আর প্রতিটা দিন অনুশোচনায় ভুগেছি। হয়ত কবিরের সাথে সম্পর্কটা সারাজীবন একরকম সুন্দর থাকত না, কিন্তু তা তো এখনও নেই। অন্তত এই অনুতাপ আমার থাকত না। দামী সামান্য হেসে আলিশার দিকে তাকায়। বলে, ওকে ছাড়া যদি আগামীর জীবনটা কল্পনা করতে পার, ভবিষ্যতে তাকে আরেকজনের স্বামী, সন্তানের বাবা হতে দেখেও সুখী হতে পারো, তবে বিয়ে করো না। 

আলিশার চোখ দুটো ছলছল করে ওঠে। দামীর কথাটা যেন তার ভেতরে একটা ঝড় সৃষ্টি করেছে। আলিশার চোখ বেয়ে টপটপ করে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। সে হু হু করে কেঁদে ওঠে।

আলিশা? দামী তড়িগড়ি করে তার দিকে এগিয়ে আসে। ওমা, কাঁদছ কেন! বোকা মেয়ে! তোমার হাতে তো এখনও সময় আছে! আলিশাকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দেয় দামী। বলে, যদি বিয়ের পর আর ওকে ভাল না লাগে, তাহলে বাড়ি চলে এসো। নিজের বাড়ি যেতে মন না চাইলে আমার বাড়ি চলে এসো। আমাদের বিশাল একখানা বাড়ি আছে কিন্তু তাতে থাকার কোনো মানুষ নেই। দামী আলিশার পিঠে ধীরে ধীরে টোকা দেয়। আলিশা তবুও কাঁদতে থাকে। দামী ওকে একটু ঝাঁকি দিয়ে বলে, আরে! আমার চরিত্র আগে থেকেই মানুষের কাছে ভাল না। তোমাকে এইভাবে কাঁদতে দেখলে লোকে ভাববে আমি ছেলেদের সাথে সাথে এখন মেয়ে ঘুরানোও শুরু করেছি! থামো, বাবা! 

দামীর কথা শুনে আলিশা হেসে দেয়। চোখের পানি মুছতে থাকে। 

দামী রেলিংয়ের দিকে তাকিয়ে বলে, এসব খেয়েও যে কিভাবে এরকম একটা ফিগার বানিয়েছো, আল্লাহই ভাল জানেন! দুইজন একসঙ্গে দাঁড়িয়ে হাসতে থাকে।

Comments

    Please login to post comment. Login